রাজকন্যা হূরিয়া পর্ব-৯+১০+১১

0
206

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[৯]

কালা-পাহাড়িয়ার কারাগারের ভেতরে কবিরাজ মশাইয়ের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পাওয়া গেলো। রাজকন্যা খবর পাওয়া মাত্রই ছুটে এলো। ভয়াবহ অবস্থা কবিরাজ মশাইয়ের। রাজকন্যার সমস্ত শরীর বরফ শীতল হয়ে উঠলো। মানুষ কাউকে মেরে ফেলার জন্য এতোটা তাড়না দেয়? কি দশা করেছে মুখটার। পুরো একদম থেঁতলে আছে। সেনাপতি আতাউল রাজকন্যাকে ডেকে বাহিরে নিয়ে গেলো। রাজকন্যার এখানে থাকা একদমই ঠিক হবেনা। আর কবিরাজ মশাইয়ের শরীরের যা অবস্থা তাতে তো তারই ভয় করছে। রাজকন্যা কি করে সহ্য করছে জানেনা সে।

“রাতের মধ্যপ্রহরে বেশির ভাগ প্রহরীরাই ঘুমিয়ে পড়েছিলো রাজকন্যা। সেই সুযোগেই কেউ কবিরাজ মশাইয়ের এই দশা করে রেখে গেছে।”

রাজকন্যার কানের পাশে একপাল মৌমাছি ভোঁ ভোঁ করে উড়তে থাকে। সে বাহ্যিক কোনো শব্দ শুনতে পায়না। কবিরাজ মশাইয়ের মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। যে তাকে খুন করেছে সে কতটা পাষাণ্ড ভাবতেই বুক চিঁড়ে তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অনেকটা দমবন্ধ হয়ে আসে তার এখানে।

রাজকন্যার অন্যমনস্ক ভাব সেনাপতি আতাউল এক-বারেই ধরতে পারে। সেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বোঝার চেষ্টা করে এই মুহুর্তে রাজকন্যার মনের উপর থেকে কি প্রবল ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

“কবিরাজ মশাইয়ের কন্যার ব্যাপারে খোঁজ নিন সেনাপতি মশাই। কবিরাজ মশাইয়ের মেয়েকে অক্ষত অবস্থা ফিরে পাওয়া আমাদের কাছে যুদ্ধের চেয়ে কিছু কম নয়।”

আদেশের সুরে বলে ওঠে রাজকন্যা। সেনাপতি আতাউল নতশির করে আজ্ঞা পালন করে। বিচলিত মনে কিছু আওড়াতে নিলে হঠাৎ থমকে যায়। তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের পেছনে কারোর পা ফেলার শব্দ পায়। রাজকন্যাও সতর্ক হয়ে ওঠে। আত্মরক্ষার জন্য সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে রাখা ছোট্ট অস্ত্রটি হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে। সেনাপতি আতাউলও সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয় গুপ্তচর আক্রমণ করার। সে তার অস্ত্রটি সন্তর্পণে হাতে উঠাতেই রাজকন্যা তার হাতের ছোট অস্ত্র খানা বিনাবাক্যে ছুঁড়ে মারে পাহাড়ের দিকে। ওপাশ থেকে কাতর কন্ঠে চেঁচায় কেউ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় সেনাপতি আতাউল। কিন্তু ততক্ষণে গুপ্তচর অদৃশ্য হয়ে যায় ঘটনাস্থল থেকে। কেবল বনের উপর পড়ে থাকে রাজকন্যা রক্ত মাখানো ছোট্ট ছুরিটা। রাজকন্যাও দ্রুত পায়ে ছুটে যায় সেখানে। সেনাপতি আতাউল চাপা আক্রোশে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ভেতরের রাগ সংবরণ করতে না পেরে বলে ওঠে,

“গুপ্তচর! একবার হাতের নাগালে পেলে ওর বংশ উৎখাত করে ফেলতাম।”

“ক্রোধ সংবরণ করুন সেনাপতি মশাই। বুদ্ধি খাটান।”

“যেমন?”

“অস্ত্র তার কাজ করে দিয়েছে। এখন আমাদের কেবল চোখ কান খোলা রাখতে হবে এই আহত ব্যক্তি কোন কবিরাজের কাছে যায় তার চিকিৎসা করাতে।”

সেনাপতি আতাউল ঝুঁকে রাজকন্যার অস্ত্র খানা হাতে তুলে আনে। কয়েক মুহুর্ত নিয়ে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে তার গায়ের তাজা রক্ত মুছতে মুছতে বলে,

“আপনার হাত থেকে কারোর পালানোর সাধ্য নেই রাজকন্যা।”

“বটেই। এবার আমাকে ফিরতে হবে সেনাপতি মশাই। কবিরাজ মশাইয়ের জানাযা পড়িয়ে উনাকে কবরস্থ করার ব্যবস্থা করুন।”

“যথা আজ্ঞা।”

রাজকন্যা এগিয়ে গেলো সুফির দিকে। একহাতে ভর দিয়ে উঠে বসলো সুফির পিঠে। অতঃপর সুফির পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে রওন হলো রাজপ্রসাদের উদ্দেশ্যে।

______

রাজকন্যা কক্ষে প্রবেশ করা মাত্রই রাজকুমারের চিন্তাক্লিষ্ট, বিমূঢ় মুখটা দৃশ্যমান হয়। রাজকুমার রাজকন্যাকে দেখতেই ছুটে গেলো তার নিটকে। যেন হারানো কোনো প্রিয় জিনিস খুঁজে পেলো অবশেষে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে করুন গলায় বলে,

“কোথায় ছিলেন আপনি? সেই কখন থেকে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।”

রাজকন্যা জবাব দিলো না। রাজকুমারকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই পেছন থেকে হাতে টান অনুভব করে রাজকন্যা। তাই অগত্যাই দাঁড়িয়ে পড়তে হয় তাকে। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজকুমারের বিচলিত কন্ঠটা পূনরায় এসে কানে বারি খায়,

“একি! আপনার তো ভীষণ জ্বর! এই শরীরে কোথায় গিয়েছিলেন রাজকন্যা?”

রাজকন্যা চমকায়। তার জ্বর? কই সে তো টের পেলোনা। রাজকুমার হাসফাস করতে করতে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। তাড়াহুড়ো করে রাজকন্যার গালে,কপালে হাত বুলায়। ভীষণ বিষ্ময় নিয়ে আওড়ায়,

“কথা বলছেন না কেন? কখন এলো এতো জ্বর?”

রাজকন্যা এবারও জবাব দেয়না। শান্ত শীতল তার চাহনি। রাজকুমার ভড়কায়। বড্ড অদ্ভুত লাগে তার রাজকন্যাকে। এতো নিশ্চুপ কেন সে?

“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রাজকুমার!”

বড্ড করুন গলায় কোনো মতে বলে রাজকন্যা। রাজকুমার দমবন্ধ করে তাকায় রাজকন্যার তপ্ত মুখশ্রীতে। পুড়ে যাচ্ছে যেন। ধূসররঙে ভরে গেছে ফর্সা মুখখানা। ফ্যাকাসে মুখবিবর। সে হাত উঁচিয়ে রাখলো রাজকন্যার তপ্ত মুখবিবরে। হাত রাখা যাচ্ছে না। রাজকন্যার সঙ্গে সঙ্গে সেও পুড়ছে। আর দেরী করলো না। রাজকন্যাকে পাঁজা কোলে তুলে নিয়ে শয্যাও শোয়ালো। অতঃপর গলা উঁচিয়ে দাসী-দের ডাকলো। কবিরাজকে খবর দেওয়া হলো। অতঃপর এগিয়ে রাজকন্যার পাশে গিয়ে বসলো। তার শরীর ঢেকে দিলো ওম চাদরে। রাজকন্যা থেকে থেকে কাঁপছে। রাজকুমার কিছুতেই বুঝতে পারছেনা রাজকন্যার এই করুন দশা। কোথায় গিয়েছিলো,কোথা থেকে ফিরলো আর এই জ্বর.. সব কিছুর সাথে কি কোনো সংযোগ আছে? ভাবতে পারেনা আর! অজানা এক আশংকায় গলা কাঁপে তার। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে! অদ্ভুত আওয়াজ। তাকে সতর্ক বার্তা জানায়।

সময় গড়াতে কবিরাজ মশাই এসে হাজির হয়। রাজকন্যাকে দেখে সুক্ষ্ম মস্তিষ্কে। পর্যবেক্ষণ করে,ভাবে। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে,

“কোনো বস্তু দেখে ভয় পেয়েছে। যার ফলশ্রুতি জ্বর। চিন্তার কোনো কারন নেই। অতিদ্রুত সেরে যাবে।”

চিন্তার কোনো কারন নেই। তবুও শান্ত হতে পারলো না রাজকুমার। সবাই চলে গেলো কক্ষ ছেড়ে। আর সে কেবল পায়চারি করতে লাগলো। অজানা আতংক তাকে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ তার পা থমকে পড়ে। সে অনুভব করে কক্ষে কারোর উপস্থিতি। থমকে দাঁড়ায় সে। গতকালও ঠিক একই রকম অনুভূতি অনুভব করেছিলো সে। তবে রাজকন্যা সম্মুখে থাকায় সে কিছু বলতে পারেনি। কক্ষের চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলায়। কে এসেছে কক্ষে? জ্বীন! তার চোয়াল শক্ত হয়। চোখ বুঁজে কিছু একটা পড়ে। অতঃপর মুখ গোলাকার করে ফু দেয়। অমনি কক্ষ আগের মতো হয়ে যায়। সে আর রাজকন্যা বাদে আর কারোর অস্তিত্ব টের পায়না। সে এবার নিশ্চিত হয়। কক্ষে কোনো জ্বীনের আগমন ঘটেছিলো। রাজকন্যা কি জানে এই খবর? সেদিন আরহামও বলছিলো।

রাজকুমার কক্ষ থেকে প্রস্থান করে। এই বিষয়ে আরহামের সঙ্গে কথা বলা উচিৎ। রাজপ্রাসাদে জিন্নাত জাতি ঘোরাফেরা করে। অথচ কারোর কোনো মাথাব্যাথা নেই। বড় অদ্ভুত লাগে তার।

জিন্নাত আবারও প্রবেশ করে কক্ষে। তার মুখশ্রী বেজায় ভড়কানো। রাজকুমারের কান্ডে ভড়কে গেছে সে। রাজকন্যার অসুস্থতার কথা শুনে ছুটে এসেছিলো। উত্তেজনার বশে খেয়াল করেনি ঘরে রাজকুমার আছে। তাই ভুল করেই ঢুকে পড়ে। কিন্তু রাজকুমার তার অস্তিত্ব শক্ত হাতে ধরে ফেলবে বুঝে উঠতে পারেনি। কি কঠিন দোয়া পড়লো সে। এক ফুয়ে ছিটকে পড়লো ঠিক একশ মাইল দূরে।

রাজকন্যা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। গায়ে চাদর টানা। জিন্নাত এগিয়ে গেলো তার কাছে। পাশে বসলো নিবিড়ভাবে। অতঃপর মাথায় হাত রেখে মোলায়েম স্বরে ডাকলো,

“রাজকন্যে? ও রাজকন্যে?”

রাজকন্যার হুঁশ ফেরেনা। সে এখনও অচেতন। জিন্নাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দোয়া পড়ে ফু দেয়। প্রায় অনেক্ষন ওর গা ঘেঁষে লেপ্টে থাকে। শরীরে ঔষধের প্রলেপ পড়ায় জ্বরটা আস্তে আস্তে নেমে যায়। রাজকন্যার ঘোরও অনেকটা কেটে যায়। সে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। তখনও জিন্নাত তার গা ঘেঁষে বসে আছে। তুলতুলে নরম শরীর জিন্নাতের। রাজকন্যা প্রথমে বিড়াল ভাবে। অতঃপর মনকে বুঝায় তার কক্ষে ছোট বিড়ালের চেয়েও বড় বিড়াল বাস করে। ভেবে মনেমনে হাসে। জিন্নাত চোখ বড় বড় করে দেখে রাজকন্যাকে। গালে, কপালে হাত ঠেকিয়ে আগ্রহী কন্ঠে জানতে চায়,

“ছেড়েছে জ্বর?”

“ছেড়েছে। কখন এলে তুমি?”

রাজকন্যা প্রশ্ন করে। জিন্নাত তার কপাল থেকে হাত সরিয়ে মাথায় রাখে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,

“অনেক্ষন। জ্বর বাঁধালে কি করে?”

“জানিনা। হঠাৎ জ্বর এলো।”

“কালা-পাহাড়িয়ার কারাগারে গিয়েছিলে.. কি হলো সেখানে?”

জিন্নাতের প্রশ্নে রাজকন্যা হঠাৎ চমকে উঠলো। বিমূঢ় কন্ঠে আওড়ালো,

“খুব নৃশংস ভাবে হত্যা হয়েছে কবিরাজ মশাইয়ের।”

জিন্নাত কেঁপে উঠলো রাজকন্যার এহেম বানীতে। কন্ঠে অবিশ্বাসের ছাপ ফেলে বলল,

“এতো প্রহরীর মাঝে কেমন করে কি করলো?”

“প্রহরীরা তখন জেগে ছিলো না। খুনী মধ্যরাতে গিয়েছিলো।”

“হে রব!”

“হু। আর জানো? আমার হাতে এক গুপ্তচর আহত হয়েছে!”

জিন্নাত প্রশ্নবিদ্ধ মুখ করে তাকালো রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যা ধীরেধীরে সবটা খুলে বলল জিন্নাতকে। জিন্নাত সবটা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,

“আমি আছি তো। কবিরাজ মশাইয়ের একমাত্র কন্যাকে পাতলপুরী থেকে খুঁজে আনার দায়িত্ব আমার।”

রাজকন্যা মলিন হাসে। জিন্নাতের হাতটা ধরে আলতো করে। বলে,

“এই মুহুর্তে তুমিই আমার একমাত্র ভরসা জিন্নাত।”

জিন্নাত ওর অন্য নরম হাতটা রাজকন্যার হাতের পিঠে রাখে। ভরসা দিয়ে বলে,

“খালি হাতে ফিরবো না কথা দিলাম। ভরসা রাখো।”

এই বলে অদৃশ্য হলো জিন্নাত। রাজকন্যা শূন্যে দৃষ্টি ভাসালো। কবিরাজ মশাইয়ের বিকৃত মুখটার কথা মনে পড়লে এখনও বুক কাঁপে তার। নিজের কন্যার প্রানের বদলে প্রান দিলো কবিরাজ মশাই। তার কন্যাকে খুঁজে বের করতেই হবে। যে করেই হোক।

কক্ষের কাছাকাছি কারোর পদধ্বনি ভেসে আসে। রাজকন্যা চোখ বুঁজে। সে চায়না এই মুহুর্তে কারোর সঙ্গে কোনোরকম কথা বলতে। এমনকি রাজকুমারও নয়। সে এখন একা থাকতে চায়। একদম একা।

#চলবে

#রাজকন্যা_হূরিয়া🌸🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১০]

রাজকন্যার ঘুম ভাঙে রাতের মধ্যপ্রহরে। একটু নড়েচড়ে উঠে এপাশ ফিরতেই মনে হয় সে কারোর হাতের বাঁধনে আঁটকে আছে। তার মাথাটা স্থান পেয়েছে মানুষটার প্রসস্থ বুকে। রাজকন্যা মুখ উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করে মানুষটাকে। একটু কষ্ট করলে দেখতেও পায় রাজকুমারকে। রাজকুমার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রাজকন্যা চোখ সরাতে পারেনা রাজকুমারের স্নিগ্ধ মুখবিবর থেকে। মায়া যেন উপচে পড়ছে তার মুখ থেকে। রাজকন্যা নিষ্পলক চেয়ে থাকে তার শ্যামের দিকে। যতই সে তাকে দেখে ততই যেন ভালোবাসা বাড়তে তাকে। কিছু সময় এভাবেই পেরিয়ে যায়। নড়ে না কেউই। ক্ষনকাল পেরোতে রাজকুমার খানিক নড়ে উঠতেই ভড়কে যায় রাজকন্যা। তার চেতন ফেরে। সম্ভ্রম ফিরে পেয়ে সে হঠাৎ লজ্জা পেয়ে যায়। একি করছে সে? এমন পাগলিনীর মতো কেন দেখছে রাজকুমারকে? সত্যি পাগল হয়েছে সে। গভীর প্রেমে পড়েছে। মানতেই হবে।

রাজকুমারের হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে বেশ বেগ পেতে হলো রাজকন্যার। কোনো মতে শয্যা ত্যাগ করলো সে। পরনের পোশাক বেশ এলোমেলো। টেনেটুনে কোনো ভাবে ঠিক করে নিলো সব। তারপর হঠাৎ তাকালো রাজকুমারের ঘুমন্ত মুখপানে। মস্তিষ্ক কেমন আজগুবি কথা বলে উঠলো, ‘ভাগ্যিস এই মুহুর্তে রাজকুমার জেগে নেই।’

জেগে থাকলে হয়তো সে আরও বেশি লজ্জায় পড়তো। চোখ তুলে তাকাতে অব্দি পারতো না মানুষটার দিকে। খানিক্ষন পর চোখে মুখে পানি দিলো রাজকন্যা। পোশাক ছেড়ে পড়ে নিলো খুব সাধারন একটা পোশাক। যেমন রোজ রাতে আব্বাজানের সন্ধানে বের হতে পড়ে থাকে। মাথার চুলগুলো পাগড়ির সাহায্যে আঁটকে নিলো। সঙ্গে রাখলো ছোট বড় দু’খানা তলোয়ার। আজ আর বাবার সন্ধানে নয় আজ সে কবিরাজ মশাইয়ের কন্যার সন্ধান করতে বেরোবে। তার নিজের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আছে। সে পারবে তার খোঁজ বের করতে, অবশ্যই পারবে। কক্ষ ছাড়তে ছাড়তে আরেকবার তাকালো রাজকুমারের ঘুমন্ত মুখপানে। কি পবিত্র। মনেমনে রবের প্রশংসা করতে ভুললো না রাজকন্যা। অতঃপর হাতের তলোয়ারটা শক্ত করে ধরে নিজের ভেতরের কঠিন রূপটাকে সামনে টেনে আনলো। আর এই ঠান্ডা শীতল বিনম্র রূপটাকে ঠেলে দিলো অন্তরের গভীরতায়। আর এক মুহুর্তও দেরী করলো না। ঘোড়াশালে গিয়ে সুফিকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করলো।

ক্ষতস্থানে জল পড়তেই আর্তনাদী কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠছে গুপ্তচর। ও গুপ্তচর নয়। ডাকাত সরদারের ডান হাত বলা যায়। ডাকাত সরদার ওকে প্রানের প্রিয় বন্ধু ডাকতেও ভুলে না মাঝেমধ্যে। ডাকবে নাই বা কেন? কারন ওর কাজই এমন যে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ছাড়া কারোর দ্বারা এসব করা সম্ভব নয়। খুব চালাকি করে রয়েসয়ে দান মারে ও। মাঝেমধ্যে ডাকাত সরদারের পিতাও ভড়কে যান ওর কান্ডে। সর্বদা বাহবা লেগেই থাকে ওর নামের সাথে। কিন্তু আজ.. আজ সামান্য এক কন্যার হাতে আহত হয়ে ডেরায় ফিরে আসাতে এক নিমিষে প্রশংসার খাতা থেকে উৎখাত করে ফেলা হয় ওর নাম। এক আঘাতে কাপুরুষের নাম পেয়ে বসেছে ও। রাগে-ক্ষোভে মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে আছে সেই অনেক্ক্ষণ। ইচ্ছে করছে এক্ষনি ছুটে গিয়ে ঐ পুঁচকে কন্যাকে বলি দিয়ে আসতে। পারেনা এক কোপে ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে দেয়। কিন্তু বাঁধা কেবল ডাকাত সরদার স্বয়ং। তার পিতাও চান ঐ কন্যার মৃত্যু হোক। তবেই যে রাজপ্রাসাদ তাদের দখলে আসবে। বর্ষবাদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে।

রাজকন্যার ছুরির আঘাতে ডান পা-টা মাঝখান থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার জো হচ্ছিলো। তৎক্ষণাৎ ছিটকে সরে না পড়লে পঙ্গু হতে সময় লাগতো না।

“আহহ্! জা’নোয়া’রের বাচ্চা সামলে দিতে পারিস না?”

যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলো পূনরায়। তাকে ঔষধী লাগাতে আসা ভীতু কবিরাজ চমকে উঠল মুহুর্তেই। ওমনি তার মুখশ্রীতে এসে ভর করলো মৃত্যুভয়। কবিরাজ মশাইয়ের মুখের অবস্থা দেখে উল্লাসে মেতে উঠলো তার মন। এটাই তো তাদের ধর্ম। মানুষের মুখে মৃত্যুর ছাপ একে দেওয়া! একদিন নির্ঘাত ঐ পুঁচকে মেয়ের মুখেও এই ছাপটাই দেখতে পাবে তারা।

“ক্ষমা করবেন রেজওয়ান মশাই! আ্ আমি সাবধানে করছি!”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো রেজওয়ান। যন্ত্রণায় হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে ও। নরকীয় যন্ত্রণা অনুভব করছে। এই মুহুর্তে সরদার যদি ওর পাশে থাকতো একটু ভরসা দিতো তবে একটু হলেও মনে বল পেতো। কিন্তু সে তো তার কর্ম নিয়েই ব্যস্ত।

ঘন জঙ্গলের সামনে এসে থামলো সুফি। হঠাৎ পা খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ায় নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলো রাজকন্যা। ফের সুফিকে ধরে নিজেকে সামলালো। সে ভেবে ছিলো সুফি এখানে থামবেনা। জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে সামনে এগোবে। কিন্তু এগোলো না। রাজকন্যা চিন্তিত মনে সুফির পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো। পাশেই বিরাট মাঠ। আকাশে মস্ত বড় পূর্নিমার চাঁদ আর জমিনে সবুজ ঘাস। আলোয় ঝলমলে করছে মাঠটা। যা চোখে পড়তেই কিছু মুহুর্ত লাগলো রাজকন্যার চিন্তা ভুলতে। সে সুফির দিকে তাকিয়ে পিঠ চাপড়ে বলল,

“ভালো চালবাজ হয়েছো দেখছি। ক্ষিদে পেলো আর ওমনি রাজকন্যাকে মাঝপথে নামিয়ে দিলে। পাজি একটা। যাও পেট ভরে খেয়ে এসো। আমি এখানেই আছি।”

সুফি নিশ্চুপ শুনলো। রাজকন্যা ওর গলার বেল্টা দু’বার টান দিয়ে কিছু পথ এগিয়ে দিলো। সুফি এক প্রান্ত থেকে ঘাস খেতে আরম্ভ করলো। মাঝ বরাবর আর গেলো না। রাজকন্যা কয়েক মুহুর্ত নিষ্পলক চেয়ে দেখলো প্রকৃতির এই অসাধারণ সৌন্দর্য্য। তার যে ইচ্ছে করছে ছুট্টে গিয়ে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও গেলো না। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঘন জঙ্গলটা কে খতিয়ে খতিয়ে দেখতে লাগলো। বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ ভয়ানক। তবুও সে বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে পা বাড়ালো সেদিকে। চাঁদনীর আলোতে ততটাও অন্ধকার বোধ হলো না রাজকন্যার। সে সবটা স্পষ্ট দেখতে দেখতেই পা ফেলতে লাগলো। কিছু পথ অতিক্রম করতেই তার ভড়কে যাওয়ার পালা। এ কি! সামনে তো একটা গ্রাম মনে হচ্ছে। ভেতরটা এতো সুন্দর অথচ বাইরেটা এতো ভয়াবহ কেন? এটা কোনো চাল নয়তো? নিমিষেই বুক কাঁপলো রাজকন্যার। কিন্তু সে এবারও পাত্তা দিলো না নিজের অহেতুক ভয়কে। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে পায়ে পায়ে গিয়ে পৌঁছোলো একটা ঘরের সামনে। অসাধারণ হস্তশিল্পে করা মাটির ঘর। তার গায়ে গায়ে আঁকা রঙবেরঙের হাতের কাজ। কি ভীষণ সুন্দর। রাজকন্যা আনমনেই ছুঁয়ে দিলো ঘরটা। কিন্তু চোখের পলক পড়তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো ঘরটা। একই সাথে অন্ধকারে ছেয়ে গেলো পুরো ধরনী। রাজকন্যা ভীতিগ্রস্ত হয়ে পড়লো। হাতের তলোয়ারটা শক্ত করে চেপে ধরে অস্ফুট শব্দে চিৎকার করলো সে। এক নিমিষেই বুঝে ফেললো এখানে জিন্নাত জাতিদের কালো জাদু করে রাখা হয়েছে। যা প্রতি ক্ষনে ক্ষনে চোখের ধোঁকায় পরিনত হবে। সে আরও কিছুক্ষন এখানে থাকতে চাইলেও পারলো না। তার উপস্থিতি টের পেয়ে অনেক জ্বীনই হাজির হয়েছে। রাজকন্যা দেখতে পাচ্ছে তাদের। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেনা যে রাজকন্যা তাদের দেখছে। রাজকন্যা আর দাঁড়ালো না৷ দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলো উল্টো পথে। কিন্তু যেতে পারলো না। আকস্মিক তার পা থমকে গেলো কারোর চিৎকারে। সে দাঁড়িয়ে পড়লো। পেছন মুড়ে তাকাতেই কেবল একটা ঘর দেখতে পেলো। বাকি সব ঘর গুলো এখনও অদৃশ্য। কেবল ঐ একটা ঘরই অদৃশ্য হয়নি। রাজকন্যা পূনরায় মনের বল বাড়ালো। এখানে এমন কিছু আছে যা তাকে উদ্ধার করতেই হবে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আশেপাশে একবার তাকিয়ে দেখলো জ্বীন গুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। সে সবার মুখের দিকে একবার একবার তাকিয়ে কন্ঠে একপ্রকার ভরসা টেনে রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল,

“চিন্তা করিওনা। আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না। আমি সিরাজদি নগরের রাজকন্যা হূরিয়া। তোমাদের সাথে আমার জন্মগত সূত্র আছে। সম্পর্ক আছে। আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারিনা। আমি শুধু ঐ ঘরটার কাছে যেতে চাই। আমাকে যেতে দাও।”

রাজকন্যার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলেও কেউ ওর পথ ছাড়লো না। রাজকন্যার দুঃশ্চিন্তা বাড়লো। এরা যদি ওর পথ রোধ করে তবে যে ও কিছুতেই ঐ ঘরের কাছে পৌঁছাতে পারবেনা। এখন উপায় কি? জিন্নাতই একমাত্র উপায় হতে পারে। রাজকন্যা আর সাতপাঁচ না ভেবে মনে মনে স্বরন করলো জিন্নাতকে। জিন্নাত এক ডাকে হাজির হয়ে গেলো। রাজকন্যার ঠিক ডান পাশটাতে অতি নিভৃতে এসে দাঁড়ালো। কিছু বলবে ঠিক সেই মুহুর্তে সম্মুখ পানে এতগুলো জ্বীনকে দেখে চিন্তার ভাজ পড়লো কপালে। তাদের উদ্দেশ্যই বলল,

“পথ রোধ করলে কেন?”

তাদের মধ্যে একজন জবাব দেয়,

“এখানে কারোর আসার অনুমতি নেই। চলে যাও তোমরা।”

রাজকন্যা শুনতে পায় ওদের কথা। তাই জিন্নাতের আগে সেই কথা বলে,

“কার অনুমতির কথা বলছো তোমরা?”

আরেকজন বলে,

“সরদারের।”

“কোন সরদার। কে উনি?”

“আমাদের সরদার। জ্বীনের সরদার। আমরা উনার পালিত জ্বীন। উনি আমাদের নিজের কাছে রেখেছেন একমাত্র তার উপকারের জন্য। আমরা উনার কথা অমান্য করতে পারিনা।”

রাজকন্যা অধৈর্য্য হয়ে ওঠে। এতো কথা বলার সময় তার হাতে নেই। ভেতরে কেউ বন্দী আছে। তাকে উদ্ধার করতে হবে। আর এদের বন্দী না করলে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। নয়তো এরা কিছুতেই তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেবেনা।

রাজকন্যা আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর উপায় নেই। এদের বন্দী করতেই হবে। পাশ ফিরে জিন্নাতকে একবার দেখে। তারা চোখে চোখে কথা বলে। জিন্নাত এক নিমিষেই বুঝে যায় রাজকন্যার ইশারা। তারা দু’জনে একত্রে দোয়া পড়তে আরম্ভ করে। কয়েক মুহুর্তের মাঝে শেষ করে মুখ গোলাকার করে সামনের দিকে ফু দিতেই সব বন্দী হয়ে যায় মাটির নীচে। রাজকন্যা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। অতঃপর এগিয়ে যায় ঘরটার দিকে। হাতের তলোয়ারটা শক্ত করে ধরে রাখে। সুযোগ বুঝেই আক্রমণ চালাবে।

#চলবে______

#রাজকন্যা_হূরিয়া❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
[১১]

ঘরের চারপাশটা যেমন সুনশান-নিস্তব্ধ ঘরের ভেতরটা তার চেয়েও অত্যাধিক সুনশান। মাটির ঘরের পাটের দরজাটা ভেজিয়ে রাখা ছিলো। তার মানে ভেতরে যে কেউ আছে তা একশভাগ নিশ্চিত রাজকন্যা। জিন্নাত তাকে আঁটকায়। ভেতরে বিপদ থাকতে পারে ভেবে নিজেই আগে প্রবেশ করে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করতে পারলেও বের হওয়ার নাম নেই। রাজকন্যা চিন্তায় পড়ে গেলো। জিন্নাত এখনও বের হচ্ছে না কেন? এবার নিজেই ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরে মাটির গৃহতলে (মেঝে) নিভু নিভু করে জ্বলছে একটা ভাঙা হারিকেন। দক্ষিনা হাওয়াতে বারবার নিভে যাচ্ছে প্রায়। আবার জ্বলে উঠছে দপদপ করে। রাজকন্যা চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বোলালো। শঙ্কিত মনে ভাবলো, ‘জিন্নাত কি বন্দি হলো?’

কিন্তু কাউকেই দেখছে না রাজকন্যা। এ ঘর থেকেই কারোর চিৎকার ভেসে এসেছিলো। এখন যে নিস্তব্ধতায় খা খা করছে চারিদিকে। রাজকন্যার পা থমকে গেলো হঠাৎ। তার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় তাকে জানান দিলো কেউ তার পেছনে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক্ষনি আক্রমণ চালাবে নির্ঘাত।

সত্যি তাই হলো। পেছন থেকে কেউ তলোয়ার চালাতেই কায়দা করে নীচের দিকে ঝুঁকে গেলো রাজকন্যা। ফের নীচের দিকে আক্রমণ আসতে কৌশলে ওখান থেকে সরে পড়লো। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাক্তিটির পেছনে গিয়ে শক্ত হাতে কোপ বসালো তার পিঠে। লোকটা ব্যাথায় আর্তনাদ করে হাঁক ছাড়লো। নিজেকে বাঁচাতে ছিটকে পড়লো বিপরীত পাশে। পেছন মুড়ে রাজকন্যার অগ্নি দৃষ্টি দেখতেই কাঁপন ধরে গেলো শরীরে। একি দেখছে সে! রাজকন্যা হূরিয়া এতোদূর অব্দি চলে এসেছে? কিন্তু না। সে ভয় পেলো না। বরং পুরুষের দাম্ভিকতা টেনে চোয়াল শক্ত করলো। একটা পুঁচকে মেয়ের হাতে সে কিছুতেই জখম হতে পারেনা। তাই শক্ত হাতে তলোয়ার চেপে ধরে আবারও হামলা চালালো রাজকন্যার উপর। তবে এবারও ব্যর্থ হলো। রাজকন্যার অগ্নিমূর্তি আরও দিগুণ বেড়ে গেলো। সে এলোপাতাড়ি তলোয়ারের কোপ শুরু করলো। যা দেখতেই বাধ্য হয়ে সরে পড়তে হলো তাকে। একপ্রকার ছুট্টে পালালো ঘটনাস্থল থেকে। তাকে পালাতে দেখে রাজকন্যা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আশেপাশে কড়া দৃষ্টিতে দেখে। বন্দীকে কোথায় রাখা হয়েছে? সব দিকেই যে ফাঁকা! আর জিন্নাতই বা কোথায়? ঘাড় ঘুরিয়ে পূনরায় এদিক সেদিক দেখে রাজকন্যা। হাতের তলোয়ারটা রেখে দেয় যথাস্থানে। হঠাৎ কারোর পদধ্বনি ভেসে আসে এদিকটায়। কেউ আসছে.. আবার কোনো শত্রু নয়তো? রাজকন্যা লুকিয়ে পড়ে আড়ালে। গলার আওয়াজ পাচ্ছে সে। ভেজানো দরজা ঠেলে এক এক করে চারজন ভেতরে প্রবেশ করে। সঙ্গে এক কন্যাও আছে। কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তার হাত-পা বাঁধা পরনের পোশাক এলোমেলো। কেবল এলোমেলোই নয়! তার অবস্থা শোচনীয়। রাজকন্যার আর বুঝতে বাকি রইলো না এই কন্যার চিৎকারের আওয়াজই শুনেছে সে। আর এই লোকগুলো তার সঙ্গে কি করেছে.. বুঝে নিলো রাজকন্যা। ভাবতেই রাগ আর ঘৃনায় গা গুলিয়ে উঠলো তার। মনের মাঝে ভর করলো তীব্র ক্ষোভ। ভয়ংকর রাগ। যে রাগ তাকে ক্ষনকালের ব্যবধানে রনচন্ডির রূপ দিতে দেরী করলো না। আর আড়ালে থাকা সম্ভব হলো না। লোকগুলো আবারও খারাপ কাজে লিপ্ত হতে যাচ্ছে। বেচারিকে চামড়ার বেল্ট দিয়ে এলোপাতাড়ি মারা হচ্ছে। আর সে কেবল আর্তনাদ করে চলেছে।

“অধম পুরুষ জাতি! এবার থামো তোমরা। নয়তো মৃত্যু অনিবার্য তোমাদের।”

তেজি কন্ঠে গর্জে উঠলো রাজকন্যা। তার এহেম গলার স্বর কাঁপিয়ে তুললো চার পুরুষের অন্তর। থমকাতে হলো তাদের। চোখেমুখে পাষবিক হিংস্রতা নিয়েই ফিরে তাকালো পেছনে। তাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুঁচকে কন্যা। বয়স বেশি হলে বিশের কোঠায়। তার চাহনির তীব্র তেজে কেমন হৃদয় কাঁপানো ব্যাপার আছে। তারা মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে দু’পা এগোলো রাজকন্যার দিকে। তাদের পদচারনে রাজকন্যা তৎক্ষনাৎ একটানে বের করে আনলো তার ধারালো অস্ত্র। ক্রুদ্ধ চাহনিতে উঁচিয়ে ধরলো তলোয়ার। রুষ্ট কন্ঠে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,

“পতিত হও নিজের পাপ থেকে। নয়তো এক কোপে তোমাদের ধর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলবো।”

চার পুরুষ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো একে অপরের। এই টুকুনি কন্যার এতো তেজ? হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো চারজনে। ততক্ষণে চারজনের থেকে ছাড়া পেয়ে মেয়েটা নিজেকে আড়ষ্ট করে রেখেছে। এই নয়দিনে সে যতবার নির্যাতিত হয়েছে ঠিক ততবার মনেমনে মরেছে। কেবল উপরওয়ালার কাছে ভিক্ষা চেয়েছে নিজের জীবনটা। উপরওয়ালাও যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ওর থেকে। কেমন পাষাণ হলো এই ধরণীও। মুখ বুঁজে সবটা সহ্য করেছে এই প্রকৃতিও। তাই সে বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছে। এখন কেবল প্রতি ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যুকামনা করে নিজের।

“মেঘ না চাইতেই বর্ষণ শুরু। ওস্তাদজী যে আরও একটা নেশাদ্রব্য আমাদের জন্য পাঠালেন খবর দিলেন না কেন?”

বলে উঠলো একজনে। যা শুনতেই ফোঁস করে উঠলো রাজকন্যা। নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে।

“কি গতর দেখো দেখি? লোভ যে সামলাতে পারছিনা।”

তার পাশের জন বলে ওঠে এবার। রাজকন্যা কপাল কুঁচকে তাকায়। ভালো করে খেয়াল করলে বুঝতে পারে তারা টাল হয়ে ঢুলছে কিঞ্চিৎ। এর মানে এরা নেশাদ্রব্য খেয়ে আছে পূর্বেই। তাই আরও পাষবিক হয়ে আছে।

এর মধ্যে একজন দাঁত কপাটি কেলিয়ে এগিয়ে এলো রাজকন্যার পানে। কেমন বিকৃত হাসতে হাসতে রাজকন্যাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। রাজকন্যা দু’কদম পিছিয়ে পড়েই করে ফেললো এক অবিশ্বাস্য কাজ। তলোয়ার বাড়িয়ে এক কো’পে দি’খন্ড করলো তার হাতের পাঁচ আঙ্গুল। জীবন্ত আঙ্গুল গুলো মাটিতে পড়ে প্রায় অনেক্ষন ছটফট করলো। আর এদিকে লোকটা ভয় আর যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে জ্ঞান হারালো। রাজকন্যা বাঁকা হাসলো। যার দরুন শরীরে আগুন ধরে গেলো তাদের। রাজকন্যা তাদের দিকে তাকালো। ঠোঁটের কোনে দাম্ভিক হাসি নিয়ে বলল,

“রাজকন্যা হূরিয়া এতোটাও দুর্বল নয় যে তাকে এতো সহজেই পরাজয় করে ফেলবে। এই গোটা সাম্রাজ্যের একমাত্র শাসক.. রাজকন্যা হূরিয়া।”

খানিকটা দমে গেলো তিন পুরুষ। ধাতস্থ করলো নিজেদের। দু’জন তো প্রস্তুত নিয়ে ফেললো পালানোর। তবে একজনের ব্যাক্তিত্বে করাঘাত লাগলো। সামান্য এক কন্যার হাতে পরাজিত হয়ে কাপুরুষের ন্যায় ফিরতে পারবেনা সে। কিছুতেই না। তাই পুরুষের দাম্ভিকতা বজায় রেখেই তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে গেলো। রাগে ক্ষোভে আক্রোশে ফেটে পড়ে বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠে তলোয়ার চালালো রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যা এবার পিছু হটলো না। সম্মুখে দাঁড়িয়ে পাল্টা আঘাতে লোকটার হাতের তলোয়ার ফেলে দিলো বহুদূরে। সে বুঝে ওঠার আগে পূনরায় আঘাত করলো। এবার তলোয়ার গিয়ে বিঁধল তার বাহুতে। ব্যাথায় আর্তনাদ করারও সময় পেলো না সে। এর মাঝেই বুকে সজোড়ে ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়লো জমিনে। ক্ষনকালে অনুভব করলো সে কারোর পদতলে আঁটকে পড়েছে। তার নিঃশ্বাস নেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে উঠলো। রাজকন্যা তার তলোয়ার দিয়ে চেপে ধরলো লোকটার বক্ষস্থলে। ফ্যাচ করে খানিকটা গেঁথে গেলো ধারালো তলোয়ার। তলোয়ারের মুখ র’ক্তসিক্ত হয়ে গেলো। রাজকন্যা মুখ উঁচিয়ে গুটিশুটি মেরে কাঁপতে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে কাছে ডাকলো। সে প্রথমে নড়লো না। কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো। রাজকন্যা তাকে ভরসা দিলো। নরম গলায় ডাকল,

“ভয় পেয়ো না। আমি তোমাকে এই নরকীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে এসেছি। ভয় পেয়োনা। আমার কাছে এসো।”

মেয়েটা নড়লো। কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। তবুও একবুক সাহস নিয়ে এগিয়ে এলো রাজকন্যার দিকে। রাজকন্যা সহাস্যে আগলে ধরলো মেয়েটাকে। তার বয়স বেশি না। পনেরো কি ষোল। যে বয়সটা জীবনের সবচেয়ে স্বরণীয় আর আবেগঘন হয়। যে বয়সটায় উপলব্ধি হয় জীবনটা ঠিক কতটা উপভোগ্য। কিন্তু সে বয়সটাই যে ওর সবচেয়ে বড় কাল হয়ে দাঁড়ালো। কি করে ভুলবে ও এই কালরাত্রি গুলো! কি করে ভোলানো যাবে ওর সাথে ঘটতে থাকা সমস্ত পাপ কাজ। হ্যাঁ, উপায় আছে। রাজকন্যা ওকে ছেড়ে পাশে সরে এলো। হাতের তলোয়ারটা ওর হাতে শক্ত করে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

“দি’খন্ড করো এই নরপশুর মাথা।”

রাজকন্যার রুষে ওঠা কন্ঠে শরীরে শক্তি অনুভব করলো মেয়েটা। ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো লোকটার পানে। লোকটা কেঁপে উঠলো। নিজের মৃ’ত্যুকে সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রান ভিক্ষা চাইতে লাগলো। কিন্তু কাজ হলো না। মেয়েটা আর শক্তি হারালো না। এই কয়দিনের তীব্র যন্ত্রণা হঠাৎই মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো তার। বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠলো। তার সুন্দর জীবনটাকে এমন ভাবে কুৎসিত করে দেওয়ার বিষাদ জাগলো মনে। গলা ফাটিয়ে বিকট এক চিৎকার করেই এক কো’পে মাথা আলাদা করে দিলো লোকটার। সঙ্গে সঙ্গে এক খাবলা তাজা র’ক্ত ছিটকে এলো চোখে মুখে। একপ্রকার নেয়ে উঠলো তাজা র’ক্তে। হঠাৎই হুহু করে কেঁদে উঠে বসে পড়লো গৃহতলে। আজ তার মুক্তি হয়েছে। চিরমুক্তি। রাজকন্যা হাঁটু ভাজ করে বসলো ওর পাশে। কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় জিঙ্গেস করলো,

“কোন রাজ্যে বাস তোমার? এর আগে কখনও দেখিনি তোমাকে।”

“আমি এই রাজ্যেই থাকি। রাজপ্রাসাদের কবিরাজ মশাইয়ের কন্যা আমি!”

ফোপাঁতে ফোপাঁতে জবাব দিলো মেয়েটা। রাজকন্যা কেঁপে উঠলো। আচমকা তার বুকের ভেতর উথাল-পাতাল ঢেউ শুরু হলো। কবিরাজ মশাইয়ের কন্যা! যাকে সে উদ্ধার করলো সেই কবিরাজ মশাইয়ের কন্যা! চটজলদি নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো মেয়েটাকে। অবাক কন্ঠে বলল,

“তোমার নাম কি?”

“আরোভি।”

র’ক্তে ভেজা মলিন মুখ তার। না জানি কতটা পীড়া সহ্য করেছে এ’কদিনে। ওকে এই মুহুর্তে আর কোনো প্রশ্ন করা ঠিক হবেনা। এক্ষনি ওকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে হবে।

“রাজকন্যে?”

পেছনে জিন্নাতের অস্তিত্ব টের পেলো। চটজলদি পেছন মুড়ে তাকিয়ে দেখল সত্যি জিন্নাত এসেছে। তার চোখেমুখে অজানা ভয়। রাজকন্যা উদ্বিগ্ন মনে প্রশ্ন করলো,

“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?”

“আমি কাকে যেন দেখেছি গো। মুখটা ভীষণ পরিচিত।”

“কে?”

“ঠিক মনে করতে পারছিনা। আমি উনার পিছু নিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদূর যেতেই উনি আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে যান। অমনি দোয়া পড়ে আমাকে মাঝপথেই আঁটকে দেন। আমি আর যেতে পারিনি। আপ্রান চেষ্টা করেছি।”

“এই বিষয়ে আমরা পরে কথা বলবো জিন্নাত। আগে আরোভিকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।”

“ঐ কি তবে কবিরাজ মশাইয়ের কন্যা?”

“তুমি ঠিক ধরেছো।”

“হে রব। একি অবস্থা হয়েছে।”

“আমাদের হাতে সময় নেই জিন্নাত৷ ওকে প্রাসাদে নিয়ে ফিরতে হবে।”

“যথাআজ্ঞা।”

#চলবে_____