রেইনকোট আরোহী পর্ব-০৬

0
120

“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ৬
(নূর নাফিসা)
.
.
সাথে টেক্সট, “বুঝলাম না, দেশে আইন কেন রাখা হয়েছে! এই সন্ধ্যার রাস্তাঘাটের পরিবেশই এমন, মধ্যরাত না জানি কেমন! করেন টা কি আপনারা বসে বসে?”
পার্সোনাল নম্বরে পার্সোনাল ভাবে এতোটা সাহস নিয়ে এই ধরনের বিদ্রুপসম্পন্ন টেক্সট যে কে করতে পারে, তা অনেকটাই সন্দেহে নিয়ে এসেছে এবার আবরার। কথার ধরণ তার বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। ফোন নম্বরের ইনফরমেশন সংগ্রহ করা তো খুব একটা ব্যাপার হবে না, কিন্তু সেই ব্যবস্থা আবরার করলো না। কেউ তাকে হুমকি তো দিচ্ছে না, বরং বিদ্রুপের সাথে উপকারটাই করছে কিছু অপরাধমূলক তথ্য দিয়ে। সে এবার ডায়াল করেনি এই অপরিচিত নম্বরে। অপরিচিতকে নিয়ে তো পরেও ভাবা যাবে, কিন্তু এখন সময়কে একটু কাজে লাগানো যাক। ছবিতে ফুটে উঠা এই রাস্তাটা আবরারের খুবই নিকটে আছে। দেয়ালের লেখা দেখেই রাস্তা চিনে গেছে। যে ব্যক্তি ছবিটা পাঠিয়েছে, সে নিশ্চয়ই কোনো গাড়িতে বসে ছবিটা তুলেছে বুঝা যাচ্ছে। আবরার কাপের চা অর্ধেকটা বাকি রেখেই উঠে গেলো। রাস্তায় নেমে রিকশা নিলো সেই পথে। সরু পথ হওয়ায়, বড় বড় গাড়িগুলো খুব একটা চলে না এখানে। মানুষের যাতায়াতের উপযোগী ছোট ছোট গাড়ি গুলোই চলে অনবরত। তখন মেইনরোডে এলেও আবরার এই ভেতরের রাস্তা দিয়েই এখন ফেরার চিন্তাভাবনা করেছে। খুব একটা দেরি করেনি সে। রিকশায় চড়তে চড়তে সিগারেট হাতে চারজন ছেলেকে বসে থাকতে দেখেছে সেই দেয়ালে। এদের ছবিই তাকে পাঠানো হয়েছে। ছবিতে স্পষ্ট না হলেও সরাসরি স্পষ্টই দেখে নিয়েছে প্রত্যেককে। এদের মধ্যে একটা ছেলেকে এবং দুইটা বাইক থেকে একটা বাইক ঠিক চিনে উঠতে পেরেছে আবরার। সে চলতি রিকশায় থেকে শুধু চোখের দেখা দেখে গেলো বখাটেদের। শহুরে পথঘাটে এমন বখাটেদের অভাব নেই। আইন সর্বত্র কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলেই এরা ভাইরাসের মতো ছড়াচ্ছে শুধু। হ্রাস পাচ্ছে না এক ভাগও! বিষয়টা নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে।
ভাবতে ভাবতেই কোয়ার্টারে ফিরলো আবরার। বাসভবনে এসে রেইনকোট ছাড়িয়ে নিজেকে একটু আয়নায় দেখে নিলো। ঘাড়ের এদিকটায় কাটা চুল পড়েছে। চুলকাতে শুরু করলে রাতের ঘুমের বারোটা বাজবে। তাই এসময় গোসলে চলে গেলো। ফিরে আসতেই কলিং বেল বাজলো। তা-ও একবার না, দুইবার না! ঘনঘন কয়েকবার! এমন করে কলিং বেল তো এখানকার কেউ বাজায় না! কে এমন পাগল হয়ে গেলো হঠাৎ! এসময় তো তাযিনের খাবার নিয়ে আসার কথা। তাযিন তো এমনটা করবে না। অন্য কাউকে পাঠায়নি তো? অন্য কেউই বা এমন কেন করবে! বিরক্ত বোধ করলো আবরার। একটা ধমক দিয়ে ভদ্রতা শিখিয়ে দিবে, সেই প্রস্তুতি নিয়ে সে দরজা খুললো। কিন্তু দরজার ওপাশে যেই ব্যক্তিটা দাঁড়িয়ে আছে, জীবনেও তাকে ভদ্রতা শেখানো যাবে না। কেননা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনোরকম শিক্ষা নিতে প্রস্তুত নয় এই অভদ্রটা।
হঠাৎ তাকে দেখে আবরারের বিরক্তিগুলো নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এলো। কিছুটা বিস্মিত তো অবশ্যই হয়েছে ছোট ভাই ইলহামকে দেখে! ইলহাম ইচ্ছাকৃত ক্লান্তি নাশের নিশ্বাস ফেলে তিনটা শপিং ব্যাগ হাতে হনহন করে ভেতরে ঢুকে পড়লো। আবরার ধীর গতিতে দরজা চাপিয়ে দিতে দিতে তার দিকেই তাকিয়ে রইলো। তার ভাবভঙ্গি দেখে নিলো। ফোন নম্বর নিয়ে এই ব্যক্তিটাকেই তার সন্দেহ হয়েছিলো দ্বিতীয়বার। ব্যক্তিভেদে তার কথাবার্তাই এই টাইপের হয় সবসময়।
“হঠাৎ তুই এখানে!”
ইলহাম জুতো খুলতে খুলতে জবাব দিলো,
“দেখতে এলাম তোমার সংসার কেমন যাচ্ছে। তুমি নাকি বিয়ে করে নিয়েছো, সেজন্য বাড়ি যেতে চাইছো না, ভাবি বললো। তাই না জানিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চলে এলাম। কোথায়, নতুন ভাবি কোথায়?”
আবরার প্রতিক্রিয়াহীন দাঁড়িয়ে রইলো। কথার ভিত্তিতে ভেতরে তার অপ্রকাশিত বিরক্তি জমা। ইলহাম জুতো জোড়া একপাশে রেখে শপিং ব্যাগগুলো রাখলো বিছানার এক কোণে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পরনের টিশার্টটা নেড়েচেড়ে আবার বললো,
“তোমার আমার চেহারায় কি একদমই মিল নেই? মানুষের মনে এতো অবিশ্বাস কেন? নিচে আমাকে এমনভাবে ধরেছিলো, যেন আমি ডাকাতি কিংবা খুন করতে এসেছি এখানে! প্রমাণস্বরূপ কত ফ্যামিলি ছবিটবি দেখিয়ে তারপর আসতে হলো এ পর্যন্ত।”
“তারা তাদের নিয়মানুযায়ী কাজ ঠিকভাবে করেছে, এখানে অবিশ্বাসের কি হলো?”
“একটা আইডি কার্ড দিয়ো, যে আমি তোমার ভাই। তবে আর এতোটা যুদ্ধ করতে হবে না কোথাও যেতে হলে।”
“আইডি কার্ড আমার কেন দিতে হবে? নিজের ক্যারিয়ার, নিজের কার্ড নিজে কেন কনফার্ম করতে পারছিস না?”
“ওফ্ফ! বৃষ্টির দিনেও কি গরম!”
আবরারকে ইগনোর করে টিশার্টের কলার ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে ওয়াশরুমে চলে গেলো ইলহাম। গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বললেই সে আর এই জায়গায় থাকবে না। চিরতরের অভ্যাস! আবরার বসে শপিং ব্যাগ দেখতে লাগলো, কি আছে এতে। এক জোড়া জুতো, দুইটা শার্ট, আর একটা প্যান্ট। নিজের জন্য শপিং করতে এসেছে সে তবে!
ইলহাম বেরিয়ে এলে বললো,
“শার্ট দুটো সুন্দর। কোথা থেকে নিয়েছিস?”
“কেন, পছন্দ হয়ে গেছে বুঝি? নজর কম দাও। কোনো ডিসকাউন্ট পাইনি তোমার পরিচয়ে।”
যথাযথ জবাব না পাওয়ায় তার বিপরীতে কোনো প্রতিক্রিয়া রাখলো না আবরার। দেখা শেষে সবগুলোই প্যাকেটে রেখে দিচ্ছে সে। ইলহাম রুমের ভেতর খুটিনাটি করছে। চায়ের ফ্ল্যাক্স ধরে বললো,
“কি এটার ভেতর?”
প্রশ্নটা উত্তর পাওয়ার আশায় করেনি। ফ্ল্যাক্স খুলে চায়ের গন্ধ পেয়ে বললো,
“খালি ফ্ল্যাক্স সাজিয়ে রাখা! এটা নাকি র‍্যাব ডিরেক্টরের কোয়ার্টার! ক্ষুধা লেগেছে, কি খাই? কোনো খাবারের ব্যবস্থা নেই এখানে? খাও কোথায় তবে?”
এমনি কলিং বেল বেজে উঠলো। আবরার দরজা খুলে দেখলো তাযিন এসেছে তার খাবার নিয়ে। তাযিন খাবারের ট্রে নিয়ে ভেতরে আসতেই ইলহাম এগিয়ে বললো,
“ও… মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! মনে মনে চিন্তা করলেই বুঝি সব হাজির হয়ে যায় এখানে?”
প্রশ্নটা আবরারের জন্য করে খাবার হাতে নিতে নিতে তাযিনকে “থ্যাংকস” জানালো। তাযিন হাসলো,
“আপনি স্যারের ভাই?”
“তোমার কি মনে হয়?”
“চেহারায় মিল আছে কিছুটা।”
“শুভদৃষ্টি! স্যরি, সুন্দর নজর। সো স্মার্ট এন্ড ইন্টেলিজেন্ট বয়। এই জিনিসটাই কারো নজরে পড়লো না তোমার মতো। এখানের তুমি বাদে সবার চোখে সমস্যা আছে।”
তার এই অহেতুক প্যাচাল বন্ধ করতে আবরার তাযিনকে পাঠিয়ে দিলো,
“তাযিন, আরেকজনের খাবার পাঠিয়ে দাও।”
“ওকে, স্যার।”
ইলহাম টেবিলটা টেনে খাটের পাশে নিয়ে খাটে বসে খেতে লাগলো চুপচাপ। আবরার শপিং ব্যাগ চাপিয়ে রাখতে রাখতে খাটের অন্যপাশে বসে বললো,
“তুই কখন এসেছিস ঢাকায়? সকালে?”
“গতসন্ধ্যায়।”
“গতসন্ধ্যায়! গতকাল রাতে কোথায় ছিলি তবে?”
“টাকা হলে থাকার জায়গায় অভাব?”
খেতে খেতে জবাব দিচ্ছে ইলহাম। আবরার আবার বললো,
“তবে আজ কেন এখানে? টাকার অভাব পড়ে গেছে?”
ইলহাম জবাব দিলো না। খাওয়ার মাঝেই মুখ চেপে হাসলো শুধু।
“শপিংয়ে যাবি, আমাকে নিয়ে গেলেই পারতি। আজ ফ্রি ই ছিলাম।”
“ফ্রি থাকো বলেই তো দেশের এই অবস্থা। পরিবারের দৃশ্যও সুন্দর! বউ বাবার বাড়ি চলে যায়!”
“বাড়ি যাবো এ সপ্তাহেই। তুই স্কুলে গিয়েছিলি কেন সকালে?”
“কেন জানি মনে হলো আমার লাইফ পার্টনার এখন স্কুলে পড়ে। তাই বিভিন্ন স্কুলে যেতে হয় পরিদর্শনে। যদি একবার দেখা পেয়ে যাই আরকি!”
সিরিয়াস জিজ্ঞাসায় তার মস্করা একদমই ভালো লাগছে না আবরারের। সে বিরক্ত হয়ে চুপ করে রইলো। জবাব দিয়ে ইলহাম আড়চোখে একবার দেখে নিয়েছে তাকে। এরই মধ্যে আবার খাবার নিয়ে হাজির হলো তাযিন। আবরার খাবার নিয়ে নিজেও খেতে বসলো। ইলহামের খাওয়া শেষ হলো আগেই। সে টেবিলটা আবার যথাস্থানে রেখে রিলেক্স মুডে ঢেকুর তুলে গিয়ে বসলো বারান্দার ইজি চেয়ারে। হাতে ফোন, টিশার্টে আটকানো ইয়ারফোন। পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে ফোনের দিকে নজর রেখে নিজ থেকেই বললো,
“শহরটা ঘুরে দেখলাম আজ সারাদিন। সবটা মনের মতো না। এরচেয়ে ভালো আমাদের কিশোরগঞ্জ! মানুষ বুড়ো হলেও কিশোর-ই থাকে!”
আবরার খেতে খেতেই বললো,
“সবসময় শুধু ঘোরাফেরাই করবি? কবে থেকে বলছি কোনো একটা কাজের চেষ্টা কর, ভাইবা দে। নিজের মধ্যে কোনো চেষ্টাই নেই। সরকারি চাকরির বয়সটা চলে গেলে কি আর ফেরাতে পারবি?”
ইলহাম কানে ইয়ারফোন গুজে দিতে দিতে বিড়বিড় করলো,
“সরকারি চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে, সেটা সবাই দেখে। বিয়ের বয়সটা যে পেরিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কেউ দেখে না!”

চলবে।