রেইনকোট আরোহী পর্ব-০৭

0
139

“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ৭
(নূর নাফিসা)
.
.
“সরকারি চাকরির বয়স চলে যাচ্ছে, সেটা সবাই দেখে। বিয়ের বয়সটা যে পেরিয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কেউ দেখে না!”
মৃদু হাসলো সে নিজেই। আবরার গম্ভীরমুখে বললো,
“বিয়ে করতে গেলেও চাকরি লাগবে। কোনো বাবা তার মেয়েকে বেকারের হাতে তুলে দিবে না। এই-যে বলছি, কানে নিচ্ছিস না এখন। সার্টিফিকেট ভালো, রেজাল্ট ভালো কেন অযথা বসে থাকবি! এগুলো সাজিয়ে রেখে ক্ষতি ছাড়া লাভটা কি হচ্ছে? পরে বুঝবি, যখন সময় থাকবে না হাতে।”
ইলহাম কথায় কানই দিলো না। ধ্যানমগ্ন সে ফোন ও ইয়ারফোনে। আবরার বিরক্ত হলো তার উপেক্ষণীয় আচরণে। একটু পরই হঠাৎ মুখে হাসি ও বুলি ফুটালো ইলহাম। মারওয়াকে কল করেছে। আবরার যেন কথপোকথন শুনতে পায় সেজন্য ইয়ারফোন ছাড়িয়ে নিলো।
“হ্যালো, বাবাই। কি করছো তুমি?”
“তুমি কি করছো, সেটা বলো আগে।”
“আমি? আমি তো বসে আছি।”
“আর কি করছো?”
“আর? আর তোমার সাথে কথা বলছি।”
“তুমি এলে না কেন নানু বাসায়?”
“আসবো তো।”
এমনি মিমির গলা স্পষ্ট হলো,
“ইলহাম, ফোন দিয়েছিলাম তোমাকে দুপুরে। রিসিভ করলে না কেন?”
“খেয়াল করিনি, ভাবি।”
“বাড়ি ফিরেছো?”
“না।”
“এখনো বন্ধুর বাসায়ই? কদিন থাকবে আর? একদিনের কথা বলে তো দেখছি সপ্তাহ পাড় করে দিবে! কাজের সময় তোমাকে পাওয়াই যায় না!”
“আরে, না। চলে আসবো আগামীকাল। গতকাল শুধু ফ্রেন্ডের বাসায় ছিলাম। এলাম, একটু ঘুরাফেরা না করলে কেমন হয় বলো? তাই আজ সারাদিন ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার দিকে শপিং করে ফিরলাম আরেক জায়গায়।”
“আরেক জায়গায়, আবার কোথায়! কি কি শপিং করলে শুনি?”
“এইতো, শার্ট প্যান্ট আর শো।”
ফোনের স্ক্রীনে ইলহামকে লক্ষ্য করে পরিচিত বারান্দা দেখে মিমি বললো,
“ইলহাম, কোথায় আছো তুমি?”
মারওয়ার হাতের ফোনের ক্যামেরার এক কোণে মিমির ভ্রু কুচকানো মুখটা দেখে ইলহাম কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে মিমি হয়তো বুঝতে পেরেছে। তাই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“তোমার সতীনের বাড়ি এলাম একটু আগে। খুঁজে বের করতে যা কষ্ট হয়েছে না! যাইহোক, ভালো আপ্যায়ন হলো। পেট ভরে মজা করে খাওয়া হলো।”
তার কথা শুনে এদিকে আবরার যে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে, সেদিকে খেয়ালই নেই! সে যে আবরারের কাছে এসেছে তা বুঝতে পেরে মিমি এবার চুপ হয়ে গেলো। মারওয়া ইলহামের কাছে প্রশ্ন ছুড়লো,
“বাবাই, সতীন কি?”
ইলহাম শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
“কিছুনা, বাবাই।”
“তুমি কি খেয়েছো বললে?”
“আমি? ভাত, মাছ, চিকেন ভেজিটেবলস খেয়েছি।”
“তবে তুমি কোথায় আছো?”
“ঢাকায় আছি, বাবাই।”
“ঢাকায়! আমার আব্বুর কাছে নাকি! এটা তো আমার আব্বুর বারান্দা দেখা যাচ্ছে! ওই চেয়ারটাতেও আব্বু বসে!”
“তুমি কিভাবে জানো?”
“আব্বু তো এখানে বসে বসে কথা বলে আমার সাথে।”
“ইশ! সব মুখুস্ত করে রেখেছে একেবারে!”
“তুমি আব্বুর কাছে কেন গেছো? আমাকে নিয়ে গেলে না কেন?”
“আমি তো তোমার আব্বুর কাছে আসিনি, বাবাই। আমি শপিং করতে এসেছিলাম ঢাকায়। তাই একটু দেখা করতে এলাম তোমার আব্বুর সাথে।”
“আমিও যেতাম দেখা করতে। তুমি একদমই পঁচা!”
“তুমি বাবাইকে পঁচা বলতে পারলে! রাগ করেছি।”
“বেশ করেছি, বলেছি!”
মারওয়ার জবাবে শরীর কাপিয়ে আবারও হাসলো ইলহাম। তারপর বললো,
“ওকে, এখন ভালো হতে কি করা যায়! ঢাকা থেকে কি নিয়ে আসবো তোমার জন্য? বলো।”
“আব্বুকেই প্যাকেট করে নিয়ে চলে আসো।”
কথা বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো মারওয়া! অথচ কথাটা বুকে বিঁধলো প্রত্যেকের! আবরার যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে কথাটা শুনে। ইলহাম হাসলেও সেই রসিকতা বজায় নেই তার হাসিতে। একটু অন্যরকম আনন্দ জুড়েছে। মিমির মুখটা দেখা গেলো না স্ক্রিনে। তাই রিয়েকশানও বুঝে উঠা গেলো না। বাচ্চাটা তো দুষ্টুমির রাশিতেই বুলি ছুঁড়েছে। কিন্তু এই কথাটুকুর মর্মার্থ যে প্রাপ্ত বয়স্ক হৃদয়গুলোতে কতটা কোমলতার সৃষ্টি করেছে, জানে না সেই বাচ্চাটা! আবরারের ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে ছুটে যেতে, একটু প্রাণভরে আদর করে দিয়ে আসতে কলিজাটাকে! কতটা মিস করছে সে তার আব্বুকে!
ইলহাম কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার দুষ্টুমি জুড়লো,
“আব্বুকে দিয়ে কি করবে? আব্বু তোমাকে নিয়ে বেড়াতে যায় নাকি? বাবাই নিয়ে যায় তোমাকে ঘুরতে, আইস্ক্রিম খাওয়াতে।”
“কোথায়? তুমি তো আসবে বলেও এলে না। আমি কবে থেকে ঘুরতে যাইনা তোমার জন্য ওয়েট করতে করতে!”
“এইতো, বাবাই। ঢাকা থেকে ফিরেই তোমার কাছে আসবো।”
“প্রমিজ তো?”
“প্রমিজ।”
“আমার জন্য মজার চকলেট নিয়ে আসবে ঢাকা থেকে।”
“ওকে।”
আবারও মিমির কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ইলহাম, কালকে কখন ফিরবে?”
“সকালেই রওনা দিবো।”
“তবে বিকেলে আমার সাথে দেখা করো। রোহান শপিংয়ে যাবে তোমাকে নিয়ে। যা যা প্রয়োজন, আগেই গুছিয়ে রেখো দুজন। পরশু আমরা সবাই যাবো আবার।”
“কাল কে কে যাবে তবে?”
“তুমি আর রোহান যাবে শুধু। আর কেউ না। প্রোগ্রামের জন্য কি কি দরকার, তোমরা ভালো বুঝো।”
“ওকে, দেখা যাক।”
“দেখা যাক না। হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।”
“ওকে, ওকে। পরশু তোমরা কোথায় যাবে? ঢাকা আসবে নাকি শপিংয়ে?”
“না, ঢাকায় আমাদের কোনো কাজ নেই। আমরা তত ডিমান্ডের লোক নই। আচ্ছা, এসো। রাখি তবে।”
মিমির কথায় আড়চোখে আবরারকে দেখলো ইলহাম। ওদিকে মারওয়া কল রাখতে দেয়নি। সে তার আব্বুর সাথে কথা বলবে। কিন্তু মিমি চলে গেছে এখান থেকে। মারওয়া কথা বলবে জেনে আবরার এগিয়ে এসেছে বারান্দায়। ইলহামও ফোন দিয়ে দিয়েছে তার হাতে। চলে গেছে বিছানায় ঘুমাতে। সকালে তাযিন ইচ্ছাকৃতই দুইজনের নাস্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। নাস্তা করেই ইলহাম বেরিয়ে গেছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। আবরারও চলে যেতো তার সাথেই। কিন্তু তার দাওয়াত আছে সন্ধ্যায়।

এদিকে, এডভোকেট আব্দুল মান্নানের বাড়িতে সুন্নাতে খাৎনার দাওয়াত পড়েছে সৈয়দ আবরারের৷ সচরাচর তার কর্মসূত্রে পরিচিত লোকেদের দাওয়াত গ্রহণ করে না কিন্তু এডভোকেটের দাওয়াত গ্রহণ করেছে আবরার। ছোট ভাইয়ের ছেলের সুন্নাতে খাৎনার বিরাট আয়োজন করা হচ্ছে। এডভোকেট মান্নান নিজে এসে অতি আন্তরিকতার সাথে আবরারকে চেপে ধরেছে, দাওয়াতে তাকে যেতেই হবে। আবরার বলেছে সে যাবে। অথচ নিজ পরিবারের কত আয়োজনে সে উপস্থিত হতে পারছে না। কিন্তু এডভোকেট আব্দুল মান্নান তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় না হওয়া সত্ত্বেও সে যাবে সেই দাওয়াতে৷ বিকেলে মারফত সাহেব তাকে ফোন করেছে,
“আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। জ্বি, বলুন?”
“স্যার, আপনি অফিসে আসবেন কখন?”
“কেন?”
“স্যার, একটু প্রয়োজন ছিলো।”
“আমি আজ অফিসে আসছি না। সুন্নাতে খাৎনার দাওয়াত আছে আমার। আমি দাওয়াতে যাচ্ছি এডভোকেট আব্দুল মান্নান সাহেবের বাড়ি।”
“ওহ্, স্যার। কিন্তু একটু বিশেষ প্রয়োজন যে ছিলো।”
“কি তেমন বিশেষ প্রয়োজন?”
“আসলে স্যার, ওই বাচ্চাটার কিডন্যাপ হওয়ার গুরুতর ইনফরমেশনগুলো আমরা অনেকটাই সংগ্রহ করেছি। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছি।”
“ওকে। বাট আজ আর আসছি না। আপাতত দাওয়াতটাই আমার কাছে বিশেষ। আগামীকাল এসে দেখবো সব। আপনি ইনফরমেশন রেকর্ড করে রাখুন।”
“জ্বি, স্যার।”
কাজের চেয়ে দাওয়াত বড় হয়ে গেছে, তা-ও আবার সুন্নাতে খাৎনার! ব্যাপারটা যেন আপত্তিকর হয়ে ঠেকলো মারফত সাহেবের কাছে। এর আগে তো এভাবে দাওয়াতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে দেখা যায়নি আর। শুনেছে নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও যায়নি স্যার। অথচ এডভোকেটের বাড়ির দাওয়াত মিস করছেন না তিনি! আত্মীয়তা এতোদূরই গড়িয়েছে নাকি? সে যাক, এতো ভেবে কাজ নেই। বরং নিজের কাজ করা যাক। এ বিষয়ে আর অতিরিক্ত মাথা ঘামালেন না মারফত সাহেব। কোনোরকম সন্দেহও আনতে পারলেন না মান্নান সাহেবের প্রতি। কেননা, জানাশোনায় খুবই নরম মনের একজন মানুষ এই এডভোকেট। মানবতার সাথে ভালো মিশতে দেখা গেছে বরাবরই।

চলবে।