রেইনকোট আরোহী পর্ব-০৮

0
126

“রেইনকোট আরোহী”
পর্ব- ৮
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যার পরপরই আবরার তৈরি হয়ে নিজস্ব গাড়িতে চড়ে উপস্থিত হয়েছেন এডভোকেট আব্দুল মান্নানের বাড়িতে। সাথে আছে দুজন গার্ড। বিশাল বাড়িতে ধনবান ও ক্ষমতাসম্পন্ন লোকদের নিয়ে আয়োজিত বিশাল আয়োজন। আবরারকে উপস্থিত হতে দেখে খুবই খুশি হয়েছেন এডভোকেট। বিশেষ আন্তরিকতার সাথে স্বাগতম জানিয়েছেন, আতিথেয়তার কোনোরকম অযত্ন হয়নি। পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচয় করিয়েছেন, বাড়িটা ঘুরেফিরে দেখিয়েছেন, বসে গল্পসল্পও করেছেন। আবরারের দুতিনজন সহকর্মীও ছিলো এখানে। প্রত্যেকেই আড্ডায় যথেষ্ট সময় পাড় করেছেন। তারা যতক্ষণ ছিলো, এডভোকেট এতো ব্যস্ততার মাঝেও তাদের সময় দিয়েছেন। এডভোকেটের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তার ছেলে ও ছোট ভাইকে আগে থেকেই চেনে আবরার। আগেও দেখেছিলো, এখন নতুন করে আবারও পরিচিত হলো। সন্ধ্যার সময়টা এডভোকেটের বাড়িতে কাটিয়েই আবরার আবার নিজের বাসস্থানে ফিরেছে। কিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফ্রেশ হয়েছে৷ ভাবনাতে যেন চট করেই ব্রেক নেওয়া হলো। বাইরে হঠাৎ ঠান্ডা বাতাস বইছে। অনেকটা ঝড়ো হাওয়ার মতো। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সময়টাতে এক কাপ চা সঙ্গী হলে মন্দ হয় না। ফ্ল্যাক্স ধরে দেখলো খালি! টেলিফোন লাইনে কল করতেই তাযিন এসে হাজির হলো। চায়ের ফ্ল্যাক্স ধরিয়ে দিয়ে রাতের খাবার দিতে নিষেধ করলো। সে দাওয়াত খেয়ে এসেছে। চা এলে নিজ হাতেই কাপে ঢেলে নিলো আবরার। চা এবং ঝড়ো হাওয়া একসাথে উপভোগ করতে ছোট বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। পাশেই চেয়ার রাখা থাকলেও বসার ইচ্ছে বোধ করলো না। একদমই ঠান্ডা মাথায় ভাবনাদের নিয়ে খেলতে লাগলো।
রাত বেড়েছে, সময় অনুমান করলো এগারোটার খুব একটা কম হবে না। এডভোকেটের বাড়ি থেকেই তো এসেছে নয়টার পরে। এরপর ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে বারান্দায় সময় কাটালো প্রায় এক ঘন্টা! চোখ যেন জানান দিচ্ছে ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু বাতাসটা মারাত্মক ভালো লাগার! এতোটা সময় কাটানোর পরও শরীর তৃপ্ত হচ্ছে না। আরও দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে, তবুও তৃপ্তি আসবে কি না অজানা। কিন্তু ঘুম প্রয়োজন। ঠিকমতো খাওয়া এবং ঘুম না হলে তার কাজে ব্যাঘাত ঘটে। মনমেজাজ ঠান্ডা থাকে না খুব একটা। তাই সবসময়ই ঘুম এবং খাওয়ার ব্যাপারটা বলতে গেলে রুটিনমাফিক চলে তার। মাঝে মাঝেই একটু হেরফের হয়ে যায়। গ্লাস লাগিয়ে পর্দা টেনে দিয়ে বিছানায় অবস্থান করলো আবরার। চোখ বুজে নেওয়ার আগে মনে পড়লো মেয়েটাকে। ফোন নিয়ে চেক করে দেখলো কোনো কল এসেছে কি না। মেয়ে তো কল দেয় প্রায় প্রতিদিনই। কিন্তু না, কোনো কল আসেনি। বাবার মতো মেয়েও কি ভুলে যায় নাকি মাঝে মাঝে? যাওয়ারই কথা। আবরার ডায়াল করলো মিমির নম্বরে। রিসিভ হলো না। পরপর তিনবার ট্রাই করার পরও রিসিভ না হওয়ায় বুঝতে পারলো মারওয়া ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো। তাই ফোন রিসিভ হচ্ছে না। এতোটা সময়ে জেগে থাকারও তো কথা না। আচ্ছা, মিমিও কি ফোনটা রিসিভ করতে পারে না একবার! কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো আবরার। তার যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায়, সেই খবরটাও তো পাবে না তখন। হায়াত যদি হঠাৎ ফুরিয়ে আসে, মৃত্যুর খবরটাও তো জানা হবে না তার। কি হয় ফোনটা রিসিভ করে একটু কথা বললে? ক্ষণিকের জন্য নাহয় অভিমানটা ভুলে যাক। একটু কথা বলার পর নাহয় আবার অভিমান জাগিয়ে বসে থাক। অভিমানগুলো কেন হয় না তেমন?
ধীর নিশ্বাস ফেললো আবরার। বিরক্তি ভাবটা কেটে একটু সুখ অনুভব হলো মুহুর্তেই। মিমি অভিমান করলে বরাবরই ভালোবাসাটা একটু নাড়া দেয়। মায়া বেড়ে যায় সহধর্মিণীর প্রতি। কিন্তু এবারের অভিমানটা একটু বেশি জটিলতার দিকে যাচ্ছে। অবহেলাটা একটু বেশি হয়ে গেছে যে! কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেনি সে! তাইতো সরাসরি জানিয়ে দিলো তার সংসারে ফিরবে না সে! কল দিলে মেয়েটাকে একটু কথা বলতে দেয় মাত্র।
পরদিন নাস্তা করেই কার্য ভবনে উপস্থিত হয়েছে আবরার। মারফত সাহেবের গতকালের ফোনকল ভুলেনি সে। অফিসরুমে এসে বসতেই মারফত সাহেব হাজির হলেন তার রেকর্ড নিয়ে।
“স্যার, কিডন্যাপিং মামলায় মোট ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। এরমধ্যে পাঁচজন পেশাগত কিডন্যাপার৷ অর্থাৎ অর্ডার অনুযায়ী তারা কাজ করে দেয়। আর একজন হচ্ছে এই মামলার নায়ক। বাপ্পি আহমেদের বিজনেস পার্টনার হচ্ছে ইকবাল৷ এই ইকবালই বাপ্পি আহমেদের ছেলেকে কিডন্যাপ করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য পেশাগত কিডন্যাপারদের হায়ার করে নিয়েছে।”
“ইকবালের পারিবারিক তথ্য কিছু সংগ্রহ করেছেন?”
“জ্বি, স্যার। অবিবাহিত লোক। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাবা-মা, বোন আছে।”
“একদম নির্ভেজাল লোক দেখছি! স্ত্রী সন্তানের টেনশন নেই। তাইতো এমন কাজে হাত দিতেও ভয় নেই।”
মারফত সাহেব মৃদু হেসে বললো,
“শুনেছি বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছে পরিবার।”
“আপনাদের আরেকটু দেরি করে যাওয়া প্রয়োজন ছিলো তবে।”
আবরার না হাসলেও তার কথায় মারফত সাহেব ঠিক শরীর কাপিয়ে হেসে নিয়েছে।
“স্যার, আগেই যখন চলে গেছি। সেই ব্যবস্থাটুকু নাহয় আমরা করে দিলাম। একটু বিশেষ আদরযত্ন হবে আমাদের এখানে। আরেকটা বিষয় স্যার, বিত্তবানের দিক থেকেও তার পারিবারিক অবস্থা খারাপ না৷ তবুও টাকার লালসা।”
“এটাও কেন এখনো অজানা আপনার? এই পৃথিবীতে টাকা যার বেশি আছে, লালসাটাও তারই বেশি। কারণ সে টাকার মায়া চিনেছে। যে চিনেনি, সে লালসাকেও কব্জা করতে পারেনি।”
“জ্বি, স্যার। ঠিক।”
“মামলাটা একটু জটিল করুন। একজন কিডন্যাপারও যেন মুক্তির জন্য সহজে লড়তে না পারে। উপর থেকে দায় নিক্ষেপ হলে আমি দেখবো।”
“ওকে, স্যার।”
বুধবার সন্ধ্যার পরপরই কিশোরগঞ্জের রাস্তায় প্রবেশ করেছে সৈয়দ আবরার। দোটানায় আছে, এখন নিজ বাড়িতে যাবে, নাকি শ্বশুর বাড়িতে! গাড়ি ছুটে চলেছে সোজা রাস্তায়। আবরার শুরুতেই মায়ের কাছে ফোন করলো। আগে জানায়নি কাউকেই সে যে আসছে। ভেবেছে হুট করে একদম সামনাসামনি এসেই পরিস্থিতি সামলাবে৷ কিন্তু এখন ঠিক ভেবে পাচ্ছে না আগে বাবামায়ের কাছে যাবে নাকি বউ বাচ্চার কাছে? অপেক্ষা তো সবারই আছে। তারও সবাইকেই খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। এখন উপায়? নাকি আগে বাবামায়ের সাথে দেখা করে বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করেই আবার শ্বশুর বাড়ি যাবে? কিন্তু মা তো গেলেই হুটহাট ছাড়বে না। একটু কথাবার্তা বলতে গেলেও দেখা যাবে রাত বেড়ে গেছে। আচ্ছা, মায়ের সাথে কথা বলেই একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাক। মা যদি বলে আগে বাড়ি গিয়ে তারপর আগামীকাল শ্বশুর বাড়ি যেতে, তাতেও হয়। আবরার মাকে কল করে জানালো সে বাড়ি আসছে, রাস্তায় আছে। তার মা অবিশ্বাস্য গলায় জবাব দিলো, “আগে বাড়ি আয়। তারপর এসে বলিস, মা আমি এসেছি। তোর তো আবার রাস্তা থেকে ফিরে যাওয়ার অভ্যাস আছে!”
আবরার যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতাশাগ্রস্ত নির্বাক হয়ে রইলো। মা খুশি হওয়ার জায়গায় তার কথায় সন্দেহ টানলো! একদমই আনন্দ প্রকাশ পেলো না যেন! সবারই আনন্দ মজে গেছে নাকি তার বাড়ি ফেরার প্রতি! আবরার আবারও মাকে বললো,
“আমি সত্যিই আসছি, মা। কিশোরগঞ্জের রাস্তায় আছি। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবো ইনশাআল্লাহ।”
“ঠিক আছে, সাবধানে আয়। মিমিকে বলেছিস, তুই আসছিস?”
“না, কাউকেই বলিনি। ভাবছিলাম বাসায় আসবো এখন, নাকি সেই বাসায় যাবো।”
“সেখানেই যা। মেয়েটা বাপের জন্য পাগল হয়ে গেছে!”
“মারওয়া না এসেছিলো শুনেছি। চলে গেছে?”
“হ্যাঁ, কাল বিকেলে নিয়ে এসেছিলো ইলহাম। সন্ধ্যায়ই পাঠিয়ে দিয়েছি। রাতে না আবার কান্না করে দেয়! এমনিতেই বারবার বলছিলো আম্মুর কাছে কখন যাবে! মাকে ছাড়া থাকেনি তো আর।”
“বাবা বাড়িতে আছে?”
“হ্যাঁ।”
“তবে আগে বাসায় আসি। দেখা করে তারপর নাহয় আবার চলে গেলাম।”
“না, সেখানেই যা। এখানে এলে আবার সেখানে যাবি কোন বেলা! এইটুকু দেখার জন্য রাতবেরাত এতো ঘুরাফেরার দরকার নেই। কাল আমরা ওবাড়ি যাচ্ছিই। দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।”
“ঠিক আছে। বাবাকে বলো, রাগ টাগ যেন আর না করে। আমি তো ইচ্ছে করে করে আর এতোটা অবহেলা করিনি।”
“ওসব বাদ দে। সাবধানে যা। পৌঁছে ফোন দিস।”
“ঠিক আছে।”
রাত ন’টার দিকে গাড়ি এসে থামলো মিমিদের বাড়ির সামনে। বাড়ির গেইটের সামনে বিয়ের গেইট কমপ্লিট। শুধু লাইটিংটা বাকি। বাড়ির ছোট গেইট খোলাই আছে। বড় গেইট খোলার প্রয়োজন না হলে খোলা হয়না। আবরার গাড়ি থেকে নেমে এসে ছোট গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরেও ডেকোরেট করার জন্য আসবাবপত্র সবই এনে রাখা হয়েছে। কিছু কিছু ব্যবস্থা ইতোমধ্যে হয়েও গেছে। দোতলা ঘরের সামনে উঠুনটা বড় হওয়ায় অনুষ্ঠান এখানেই খুব ভালোভাবে সম্পন্ন হয়ে যাবে। ঘরের সামনে আসতেই ঘরের সদস্যদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। মারওয়ার চেচামেচিও শোনা যাচ্ছে। হাসাহাসি, কথার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। আবরার মেইন দরজার সামনে জুতা খুলতে খুলতে মারওয়াকে ডাকলো। মুহুর্তেই যেন আলাপ আলোচনার শব্দের নব্বই ভাগই কমে এলো! হয়তো সবাই তার ডাকের দিকে মনযোগ দিয়েছে আরেকবার শুনে নিশ্চিত হতে। এদিকে একমাত্র শ্যালক, রোহান এগিয়ে এসেছে দরজার সামনে। তাকে দেখেই আবার ভেতরের সবার উদ্দেশ্যে বললো,
“ভাইয়া এসেছে দেখি!”
মুখে মৃদু হাসি নিয়ে এগিয়ে সালাম দিলো রোহান। আবরার সালামের জবাব দিয়ে বললো,
“ভালো আছো, রোহান?”
“আলহামদুলিল্লাহ। এখন তো ভালো থাকতেই হয়। এতোক্ষণে সময় হলো আপনার?”
জুতা জোড়া একপাশে চাপিয়ে রেখে আবরার জবাব দিলো,
“হয়েছে, আরকি।”
এমনি মারওয়া দরজার সামনে এসে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো,
“আব্বু!”
এক দৌড়ে বাবার কোলে! আবরার মুখে হাসি নিয়ে একদম বুকে চেপে নিয়েছে। ঘরে প্রবেশ করতে করতে রোহানের উদ্দেশ্যে বললো,
“ড্রাইভার বাইরে অপেক্ষা করছে, রোহান। গেইটটা খুলে দিয়ে এসো, গাড়ি রাখবে।”
“যাচ্ছি।”

চলবে।