রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
397

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩০
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“বারান্দায় কি করছিস এই সময়?”

আরশি হকচকিয়ে উঠে। ফোন নিচে নামিয়ে ভয়ে ঝট করেই পেছন ফিরে তাকায়। শাকিল আরশির বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কপাল কুচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আরশি মুখে হাসি আনার চেষ্টা করেও পারছে না। ভীষণ ইতস্ততবোধ করে বলল-

“কিছু না কিছু না এমনি।”

“এক কথা দু’বার করে বলছিস কেন? কিছু হয়েছে! তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

শাকিল কন্ঠে কৌতূহল। কপালে চিন্তার ভাজ। আরশির ফ্যাকাসে মুখ দেখে উত্তেজনা নিয়ে-ই আরশির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আরশি ভয়ে অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। হাত কচলাচ্ছে আর ভয়াতুর চোখে আশেপাশে তাকাচ্ছে। পুরোপুরি পেছনে তাকানোর সাহসটুকুও পাচ্ছে না।

“শাকিল একটু আমার সাথে আয় তো।”

ধ্রুবর কথায় শাকিল মাঝপথেই থেমে গেল। ধ্রুবর দিকে চেয়ে ছোট করে জিজ্ঞেস করল-

“কোথায়!”

ধ্রুব আরশির দিকে একঝলক তাকালো। শাকিলের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল-

“আরে শা’লা চল একটু কাজ আছে।”

ধ্রুব আর শাকিল বেরিয়ে গেল। আরশি বুকে হাত রেখে বড় করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। হন্তদন্ত হয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে আবারও বারান্দায় আসে। রেলিং-এর পাশে এসে নিচে রাস্তায় নজর দিলো। রৌদ্র আর নির্বাকের তাকিয়ে আরশি হতভম্ব। রাগে, দুঃখ আর হতাশায় নিজের গালেই কষে কয়েক গাঁ চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে এই মুহুর্তে। ভয়ে অস্থির হয়ে থাকা চোখ দুটো রাগে জ্বলজ্বল করে উঠলো। তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফোন কানের কাছে ধরলো। রৌদ্র হাতের মাঝে নির্বানের গলা পেচিয়ে ধরছে। আর নির্বান রৌদ্রর থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। গড়গড় করে একনাগাড়ে বলছে-

“দেখ রৌদ্র তুই কিন্তু এবার স্বার্থপরের মতো করছিস। তোর রুদ্রাণীকে খুঁজতে আমি কত কত শাড়ি পড়া মেয়েদের পেছনে তাকিয়ে ছিলাম তোর হিসাব আছে!! আর তুই কি-না এখন আমার সাথে এমন ব্যবহার করছিস?”

“একদম চুপ থাক হারামি৷ চেচামেচি করবি না। তুই আমার প্রেম করিয়ে দিতে আসছিস নাকি ধরা খাওয়াতে কোনটা!”

আরশির ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। একটুর জন্য সে তার ভাইয়ের কাছে ধরা খায়নি। ভয়ে তার জান যায় যায় অবস্থা আর এই দুজন কি-না নিজেদের মতো ঝগড়া করেই যাচ্ছে!! কোনো হুশ জ্ঞান নেই তাদের মধ্যে!! তাদের ঝগড়া দেখে আরশি মেজাজ গরম হয়ে গেলো। ফোনে ‘হ্যালো হ্যালো’ করেও কোনো লাভ হলো না। শেষমেশ অতিষ্ঠ হয়ে ফুল গাছের টব থেকে মুঠ ভরে মাটি নিয়ে তাদের দিকে ছুড়ে মা’র’লো। নির্বান আর রৌদ্রর গায়ে মাটি পরতেই তারা মাথা উঁচু করে উপরে তাকালো। আরশির দিকে কিছুক্ষন অপলক তাকিয়ে থেকে ছিটকে দুজন দু’দিকে চলে যায়। বোকা বোকা চাহনিতে নির্বার রৌদ্র একে অপরের চাওয়াচাওয়ি করে একসাথেই অপ্রস্তুত হাসি দিলো। আরশি এখানে ছিলো সেটা তাদের একদমই খেয়াল ছিলো না৷ রৌদ্র ফোন কানের কাছে ধরে বলল-

“আসলে আরু….”

“একদম চুপ থাকুন আপনি। আপনাদের জন্য আমি ভাইয়ার কাছে ধরা খেয়ে যেতাম। ভাগ্যিস ধ্রুব ঠিক টাইমে চলে এসেছে।”

আরশি দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল। রৌদ্র একটা মেকি হাসি দিয়ে বলল-

“যাক বেঁচে গেছো তাহলে।”

রৌদ্রর কথায় আরশির রাগ তরতর করে মাথায় উঠে গেল। রাগান্বিত কন্ঠে চাপা হুংকার দিয়ে বলল-

“এক্ষুনি এখান থেকে যাবেন আপনারা। নাহলে দুজনের মাথায় দুটো টব ভাঙবো। আর কখনো যদি দেখেছি বাসার সামনে এসে এসব উদ্ভট কর্মকান্ড করতে তাহলে আমার খারাপ কেউ হবে না বলে দিচ্ছি।”

আরশি একনাগাড়ে হুমকি গুলো দিয়েই ফোন কেটে দিলো। হাতের মুঠোয় আরও কিছু মাটি নিয়ে তাদের দিকে ছুড়ে মা’রে। হনহনিয়ে রুমে এসে শব্দ করে বারান্দার দরজা লাগিয়ে লাইট অফ করে দিলো। রৌদ্র আর নির্বান আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশির বারান্দার দিকে।

“এসব কিছু কার জন্য হয়েছে দোস্ত!”

রৌদ্র মিষ্টি সুরে কথাটা বলেই নির্বানের দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে। নির্বান হাসলো। কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিয়ে বলল-

“কারও জন্য হয়নি বন্ধু। এটা ভাগ্যের লিখন আর কিছু না।”

“ভাগ্যের লিখন তাই না!”

রৌদ্র তেড়ে গেল নির্বানের দিকে। নির্বানের পেছনে লা’থি মে’রে কিড়মিড়িয়ে বলল-

“হারামি তোর জন্য হইসে এসব। কত সুন্দর মুড নিয়ে আসছিলাম। সব কিছুর উপর তুই পানি ঢেলে দিলি। শা’লা তুই শুধু আমারে বাঁশই দিতে পারছ এ ছাড়া আর কিছু ঠিকঠাক করতে পারছ না।”

নির্বান হাসতে হাসতে বলল-

“ভাই আমি পানি ঢালি নাই। তোমার বাঘিনী ড্রাগনের মতো আগুন ছুড়ে দিছে আমাদের উপর।”

“আর একটা কথা বললে দেখিস আমি নীলার জন্য অন্য ছেলে খুঁজবো। ওর ভবিষ্যতের দুলাভাই বলে কথা।”

রৌদ্র শেষের বাক্যটা বেশ ভাব নিয়ে বলল। নির্বান বাঁকা হেসে হেলমেট মাথায় দিয়ে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বললো-

“তুই নীলাদ্রির দুলাভাই হওয়ার আগেই আমি ওর জামাই আর বাচ্চার বাপ হয়ে বসে থাকবো।”

———————————

“আরু আসবো!”

ধ্রুবর কথায় আরশি রুমের ভেতর থেকে ক্ষিপ্ত গলায় বলল-

“তোকে না আমি বলেছি আমার রুমে আসার সময় জিজ্ঞেস করবি না।”

ধ্রুব তপ্ত শ্বাস ফেলে। গম্ভীর পায়ে রুমের ভেতরে আসে। আরশি বিছানার ঠিক মাঝখানে হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। এলোমেলো চুল। মুখে আকাশ সমান বিরক্তির রেশ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব ক্ষেপে আছে। ধ্রুব নিঃশব্দে বিছানার এক কোণে পা তুলে বসলো। আরশি ধ্রুবর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-

“এক কথা কয়বার বলা বলতে হয় তোকে? এসব ফর্মালিটি আমাকে না দেখিয়ে তোর বউয়ের জন্য জমিয়ে রাখ।”

“তুই এখন আর বাচ্চা না আরু। তোর একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু কাজ থাকতে পারে। একটু আগে হুট করে শাকিলের চলে আসায় কি হলো দেখিস নি!”

আরশি নেড়েচেড়ে বসলো। চুল গুলো গুছিয়ে নিয়ে মিনমিনিয়ে বলল-

“আসলে আমি জানতাম না ওনারা দুজন হুট করেই চলে আসবে। তখন ভাইয়াকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তুই না আসলে আজকেই আমার শেষ দিন হতো৷ যাইহোক বাদ দে, এখন বল তুই কি করে জানলি ওনারা এসেছে!”

“যেভাবে ভাবি ভাবি করে ডাকছিলো সবই শোনা গেছে ড্রয়িং রুম থেকে। বাকি সবাই খেয়াল না করলেও আমি করেছি।”

“আর বলিস না। দুইটাই খুব বড় ধরনের অসভ্য। এই সময় এখানে এসে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি সব শুরু করেছে বাচ্চাদের মতো। কুত্তা বিলাইয়ের মতো ঝগড়া লেগেছিলো যত্তসব। আমিও কম না রেগেমেগে মাটি ছুড়ে দিয়েছি দুজনের উপরে।”

আরশি রাগে গজগজ করে কথা গুলো বলছে আর ধ্রুব নির্বিকার ভঙ্গিতে আরশির কথা শুনছে। খানিকটা সময় পর ধ্রুব গম্ভীর গলায় বললো-

“আরু তোকে কিছু কথা বলি মনোযোগ দিয়ে শোন। তুই আর রৌদ্র তোরা দুজনেই স্টুডেন্ট। তুই এখনো অনেকটাই ছোট। আর রৌদ্র! উনি এখন আপাতদৃষ্টিতে একজন বেকার ছেলে। আর এই অবস্থায় যদি বাসায় সব কিছু জেনে যায় তাহলে কেউ-ই ওনাকে মেনে নিবে না আর আমিও কিছু বুঝাতে পারবো না। তাই বলছি যা করবি সাবধানে। ওনাদেরকে না করে দিবি নেক্সট টাইম যেন বাসার সামনে না আসে আর কখনো। আমি চাই না তোকে নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক।”

আরশি মাথা নাড়িয়ে বলল-

“আমি না করে দিয়েছি।”

“আচ্ছা তুই তো গিফট গুলো আমাকে দেখালি না।”

ধ্রুব প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য গিফটের কথা বলল। গিফটের কথা মনে পরতেই আরশি উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-

“একদমই মনে ছিলো না ওগুলোর কথা। আমি নিজেও একটা গিফট খুলে দেখিনি।”

আরশি কথা গুলো বলেই হন্তদন্ত হয়ে গিফট গুলো নিয়ে আসলো।

চলবে….

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩১
#Saiyara_Hossain_Kayanat

‘উপহার’ কি সব সময় টাকা দিয়ে কেনা দামী জিনিসই হয়! হয়তো অনেকের কাছে উপহারের ক্ষেত্রে দামী দামী জিনিসের-ই গুরুত্ব বেশি। আবার অন্য কারও কাছে হয়তো ভালোবাসায় মোড়ানো ছোট ছোট জিনিসের উপহারই হয় শ্রেষ্ঠ উপহার। যার সাথে জড়ানো থাকবে কিছু সুপ্ত অনুভূতি আর এক আকাশ সমান ভালোবাসা।
আরশি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দেওয়া গিফটের দিকে। ভালোবাসায় মোড়ানো একটি গিফট। মুগ্ধতায় তার চোখ দুটো ঝলঝল করছে৷ খুব বড়সড় একটা পেন্টিং। হয়তো রৌদ্র নিজেই এই পেন্টিংটা করেছে। রাতের সমুদ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোরীর ছবি। তার খোলা চুল। বাতাসে উড়তে থাকা তার আঁচল আর পূর্নিমার চাঁদ। প্রতিটা জিনিসই রংতুলিতে খুব নিখুঁত ফুটিয়ে তুলেছে এই পেন্টিং-এর মাঝে। নিজ হাতে এতটা নিখুঁতভাবে এক একটা জিনিস এঁকেছে যা যে কেউ দেখলেই প্রশংসা বিমোহিত হবে।

“বাহ! খুব সুন্দর তো। রৌদ্র এত সুন্দর পেন্টিং করতে পারেন জানা ছিলো না।”

ধ্রুব পেন্টিংটা হাতে নিয়ে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বলল। আরশি এখনো ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চেয়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে। এটা হয়তো তার জন্য বেস্ট একটা গিফট। তাই হয়তো গিফটটা দেখে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া করতে পারছে না। ধ্রুব নির্বানের ছবিটা নিয়ে বলল-

“দুই বন্ধুর-ই তো অনেক গুন আছে দেখা যাচ্ছে।”

আরশি এবারও চুপ। ধ্রুব কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। ধ্রুব আরশির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আরশির দিকে দৃষ্টিতে দিলো। আরশিকে থম মে’রে বসে থাকতে দেখে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল-

“কিরে তুই কি খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলি না-কি! কথা বলছিস না কেন?”

আরশি অপ্রস্তুত হয়ে নেড়েচেড়ে বসলো। হাসার চেষ্টা করে আমতা-আমতা করে বলল-

“না না তা কেন হবে। পেন্টিংটা সত্যিই খুব সুন্দর হয়েছে। তাই একটা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।”

ধ্রুব চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। পরক্ষণেই চোখ সরিয়ে নেয়। হঠাৎই পেন্টিংটার পেছনে একটা নীল রঙের কাগজ দেখতে পায়। ধ্রুব কাগজটা হাতে নিয়ে বলল-

“এটা হয়তো তোর জন্য চিঠি।”

আরশি চিঠিটা হাতে নিলো। চিঠির ভাজ খুলতে নিলেই ধ্রুব ধমকিয়ে ওঠে।

“আমার সামনে খুলছিস কেন! তোর লজ্জা করে না বড়দের সামনে প্রেমপত্র পড়তে।”

আচমকা ধ্রুবর ধমকে আরশি খানিকটা কেঁপে উঠল। বুকে ফুঁ দিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে ছুড়ে দিলো ধ্রুব দিকে। ধ্রুব বাহুতে হাল্কা আঘাত করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-

“সয়তান, ভয় দেখিয়ে মে’রে ফেলবি না-কি! হারামি কোথাকার।”

ধ্রুব শব্দ করে হেসে উঠলো। আরশি তীক্ষ্ণ চোখে ধ্রুবর হাসির দেখছে।

“এই আরু! ধ্রুব! খেতে আয়।”

ডাইনিং রুম থেকে আরশির মা’র আকর্ষণ কাড়া কন্ঠ ভেসে আসলো। ধ্রুব হাসি থামিয়ে আরশিকে তাড়া দিয়ে বলল-

“চল ডিনার করবি। অনেক রাত হয়ে গেছে।”

আরশি উঠে দাঁড়ালো। পেন্টিং আর ছবিটা রেখে ধ্রুবর সাথেই বাহিরে চলে যায়। আরশির মা ধ্রুব আর আরশিকে দেখে বললেন-

“দাঁড়িয়ে আছিস কেন তাড়াতাড়ি বস তোরা আমি খাবার দিচ্ছি।”

“আমি বাসায় যেয়ে খাবো ছোট মা।”

ধ্রুব কথায় আদিব হাসান কপাল কুচকে বললেন-

“বাসায় যেয়ে কেন খাবি! আসছিস যখন আমাদের সাথেই খেয়ে যা।”

“আম্মু বাসায় একা ভুলে গেছো তোমরা? খাবারের টেবিলে আমাকে না দেখলে আমার কান ছিড়ে ফেলবে।”

ধ্রুবর কথায় আরশি আর শাকিল ঠোঁট চেপে হাসলো৷ আরশির আম্মু সহজ ভঙ্গিতে বললেন-

“তাহলে তুই যা আপাকে নিয়ে আয়। সবাই মিলে একসাথেই খাবো।”

ধ্রুব তার ছোট মা’র কাধে হাত রেখে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল-

“আজ না ছোট মা অন্যদিন একসাথে খাবো। আম্মু কষ্ট করে রান্না করেছে ওগুলো শুধু শুধু পরে থাকবে। তোমরা ডিনার করো আমি যাচ্ছি।”

ধ্রুব চলে গেল। আরশির মা দরজার দিকে তাকিয়ে ছোট করে শ্বাস ফেলে। বেশ ভাবুকতার সাথে বললেন-

“এ-বয়সেই এই ছেলে যে এতোকিছুর খেয়াল কিভাবে রাখে একমাত্র আল্লাহ তায়ালা জানে।”

“ধ্রুব জন্ম থেকেই দায়িত্ববান ছেলে। তা না হলে তোমার এই দামড়া মেয়েকে কি এভাবেই বড় করছে না-কি!”

আরশির পাশ থেকে শাকিল ফোনের দিকে তাকিয়েই ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বলল। আরশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শাকিলের দিকে। আরশির মা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন-

“ওর থেকে কিছু শিখতে-ও তো পারিস। তোর থেকে ছোট তবুও কতকিছু বুঝে আর তুই! এখনো খাবারের টেবিলে বসে বসে ফোন টিপিস।”

শাকিল হতভম্ব হয়ে মাথা তুলে তাকালো। তার মা’য়ের জ্বলন্ত চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দৃষ্টি সরিয়ে তার বাবার দিকে চেয়ে মলিন কন্ঠে বলল-

“এখানে আমার ফোন টিপার কি দোষ!”

আদিব হাসান কপাল কুচকে ঠোঁট উল্টালো। আরশি পাশ থেকে শাকিলের ফোন কেড়ে নিয়ে বলল-

“তুই এতো বড় দামড়া একটা ছেলে হয়ে সারাক্ষণ ফোন নিয়ে পরে থাকিস তোর লজ্জা করে না!”

শাকিল রাগান্বিত চোখে তাকালো আরশির দিকে। কিছু বলার সুযোগ পাওয়ার আগেই তার মা’য়ের রামধমক খেয়ে দুজনেই চুপসে যায়।

————————

প্রিয় রুদ্রাণী,

অনেক প্রচেষ্টার পর এই পেন্টিংটা সম্পূর্ণ হয়েছে। আমি এসব ড্রয়িং, পেন্টিং আঁকাআঁকি একদমই পারি না। তবুও প্রায় একবছর ধরে চেষ্টা করছিলাম। অবশেষে দ্বীপের সেই রুদ্রাণীকে আমার নিজ হাতে এই পেন্টিং-এ আবদ্ধ করার কাজে সার্থক হলাম। সেই সাথে তোমাকেও নিজের হৃদয়ে আবদ্ধ করে নিলাম।

জানো তো, আমি ভেবেছিলাম হয়তো ছবির মেয়েটাকে কখনোই খুঁজে পাবো না। সেন্টমার্টিনে তো বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ ঘুরতে যায়। কিন্তু ছবির মেয়েটা যে আমার এতটা কাছাকাছিই ছিলো সেটা কখনই ভাবিনি। যখন তোমাকে রুদ্রাণী হিসেবে আবিষ্কার করলাম, তখন নিজের উপরেই রাগ হচ্ছিলো। যাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম আমি কি-না তার সাথেই নিজের অজান্তে ঝগড়া করে যাচ্ছিলাম নিয়মিত। তোমাকে খেপানোর জন্য নিজের গালেই কষে চড় দিতে ইচ্ছে করছিলো। আচ্ছা এসব বিব্রতকর কথা না হয় না-ই বলি।

বিঃদ্রঃ আজ আর কোনো সাংকেতিক ভাষা লিখবো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি রুদ্রানী।

ইতি
রৌদ্র

আরশি চিঠিটা পড়ে মুচকি হাসলো। রৌদ্রর ভালোবাসা দেখে বরাবরই আরশি অবাক হচ্ছে। মানুষটা তাকে না দেখেই আড়াল থেকে এতটা ভালোবেসে আসছে এটা জেনেই রৌদ্রর প্রতি আরশি দূর্বল হয়ে পরছে৷ চিঠি ভাজ করে রেখে দাওয়ার সাথে সাথেই আরশির ফোন বেজে ওঠে। আরশির ফোন হাতে নিয়েই ভ্রু কুচকালো। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শান্ত শীতল কন্ঠস্বর ভেসে আসলো-

“আমার কথা ভাবছিলে তাই না আরু!”

আরশি বিস্মিত হলো। নিজের মনকেই খুব তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করলো “আমি কখন কি করি এই লোকটা সব কিছু আগে থেকে জেনে যায় কিভাবে!” আরশি মন থেকে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আসলো না। আরশি হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ে। ক্ষীণ গলায় বলল-

“এত রাতে ফোন করলেন যে! ঘুমাননি কেন”

“মনে হলো তুমি আমাকে নিয়ে ভাবছো তাই কল দিলাম। ভাবলাম একটু প্রেম করি।”

আরশি নিঃশব্দে হাসলো। মুহুর্তেই কন্ঠে গম্ভীরতা এনে বলল-

“একদিনেই এতটা অসভ্য কি কিরে হলেন আপনি?”

রৌদ্র উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। আনন্দিত গলায় বলল-

“অসভ্য হই আর যা-ই হইনা কেন সবই তোমার জন্য রুদ্রাণী।”

——————————

“কিরে তুই এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে আছিস কেন নিলু?”

ক্লাসে এসেই আরশি নীলাকে গোমড়া মুখ বসে থাকতে দেখে। সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করলো। নীলা বিষন্ন দৃষ্টিতে এক পলক তাকালো আরশির দিকে। আবারও মাথা নিচু করে ফেলে। আরশির প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। আরশির ভ্রু বাঁকিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করল-

“কথা বলছিস না কেন? কি হয়েছে বল আমাদের।”

নীলা এবারও কিছু বললো না। এক হাত গালে রেখে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। নীলার ভাবভঙ্গি দেখে কাসফিয়া প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠলো। ক্ষিপ্ত গলায় বললো-

“অদ্ভুত তো! এভাবে বোবার মতো বসে আছিস কেন? গলায় কি কিছু আটকেছে না-কি!”

“আব্বু নিলুর বিয়ে ঠিক করেছে রে কাসফি।”

নীলের কথা শুনে সবাই চমকে পেছন ফিরে তাকালো। নীল আর আদ্রাফ তাকিয়ে আছে। দু’জনের মুখের অবস্থা বাংলার পাঁচের মতো। আরশি হাসতে হাসতে বলল-

“হারামি মজা করিস না তো। সত্যি করে বল কি হয়েছে। নিলুর মন খারাপ কেন?”

নীল গম্ভীরমুখে বলল-

“তোদের কি আমাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি মজা করছি!!”

কাসফিয়া, আরশি আর সুপ্তি কিছুক্ষন নীলের দিকে আর কিছুক্ষর নীলার দিকে পর্যায়ক্রমে তাকালো। হঠাৎই ভয়ংকর উত্তেজনা নিয়ে তিনজন একসাথে জোর গলায় বলে উঠে,

“কিইইইইই… সত্যি??”

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩২
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“হঠাৎ করেই বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে কি! বিয়েটা কি কোনো খেলা না-কি?”

ক্ষিপ্ত গলায় বলল আরশি। সকলের মুখে চিন্তার ছাপ। নীল একঝলক নীলার দিকে চেয়ে ছোট করে শ্বাস ফেলে। মিহি কন্ঠে বলল-

“বিয়ে এখনো ঠিক হয়নি।”

নীলের কথায় আরশি রেগে যায়। কপাল কুচকে শক্ত গলায় বলল-

“এই বলছি বিয়ে ঠিক করেছে আবার বলছিস বিয়ে ঠিক হয়নি। আমি না তোদের দুই ভাইবোনের ভাবগতিক কোনো কিছুই বুঝতে পারছি না। যা বলার সোজাসুজি বল।”

“বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আম্মু বলেছে তোদের যেন কাল বাসায় যেতে বলি। আমরা কারণ জানতে চাইলে বলে যে আগামীকাল নিলুকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে।”

নীলের কথা শুনে সুপ্তি বোকার মতো হাসতে শুরু করে। নীলার কাধে হাত রেখে খুব সহজ গলায় বলল-

“দেখতে আসবে সেটা আগে বললেই হতো শুধু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। চাপ নিস না দেখতে আসলেই কি বিয়ে হয়ে যায় না-কি!”

“আমার কথা মনে নেই!”

কাসফিয়া নির্লিপ্ত কণ্ঠ শুনে সবার মুখের রঙ উড়ে যায়। সুপ্তির হাসি মুখখানা বিষাদে ঢেকে গেল। সকলের মাঝে দুঃশ্চিন্তার ছড়াছড়ি। আদ্রাফ পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য আশ্বাস দিয়ে বলল-

“এতো চিন্তা করিস না। যা হয় ভালো জন্যই হয়। সব ছেলে তো আর টাকার লোভে বিয়ে করে না তাই না। আর এমনটাও তো না যে নিলু কাউকে পছন্দ করে।”

আদ্রাফের কথায় সবার চিন্তা খানিকটা দূর হয়েছে। কিন্তু নীলা এখনো অন্যমনস্ক হয়ে আছে। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করছে- “আমি কি সত্যিই কাউকে পছন্দ করি না? আমার মনে কি কারও জন্য কোনো অনুভূতি নেই?” প্রশ্নগুলোর কোনো পাওয়া গেল না। তার বিনিময়ে বুক চিড়ে বেরিয়ে আসলো এক দীর্ঘশ্বাস। হয়তো যা হওয়ার ভালোর জন্যই হবে।
দুটো ক্লাস শেষে করেই সবাই ক্যানটিন যাওয়ার জন্য বেরিয়ে যায়। ক্যানটিনের কাছে আসতেই রৌদ্রর ডাক শোনা গেল পেছন থেকে। সবাই একসঙ্গেই পেছন ফিরে তাকালো। রৌদ্র হাসি হাসি মুখ নিয়ে এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। নীলার চোখ দুটো নিজের অজান্তেই নির্বানকে দেখার জন্য ছটফটিয়ে উঠলো। কিন্তু আশেপাশে কোথাও নির্বানকে দেখা গেল না। গত কয়েক মাসে মানুষটার উদ্ভট সব আচরণের প্রতি কিছুটা হলেও ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে তার মনে। তবুও কেন যেন নীলা সেটা মানতে নারাজ। কোথাও যেন কোনো একটা বাধা কাজ করছে। নিজের অনুভূতিকে প্রশ্রয় দিতে সাহস পায়নি কখন।

“কেমন আছো সবাই?”

“জ্বি ভাইয়া ভালো। আপনি ভালো আছেন?”

নীলা আর আরশি ছাড়া সবাই একসাথে মৃদু হেসে মলিন কন্ঠে বলল। রৌদ্রর কপালে ভাঁজ পড়ল। সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করল-

“কি ব্যাপার সবার মুখের এমন হাল হয়ে আছে কেন?”

“তেমন কিছু না, ওদের খিদে লেগেছে তাই এমন দেখাচ্ছে।”

আরশি বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল। রৌদ্র কিছুক্ষণ সবার দিকে চুপ করে তাকিয়ে থেকে বলল-

“আচ্ছা তাহলে তোমারা যাও নাস্তা করো। আমি আরুকে একটু ধার নিয়েছি।”

আরশি ভ্রু কুচকে ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করল-

“ধ্রুব জানে!”

“গত দু মাসে কখনো দেখেছো ধ্রুবর অনুমতি ছাড়া তোমাকে কোথাও নিয়ে গেছি! তবুও কেন প্রতিবার একই প্রশ্ন কর বলো তো? বিশ্বাস করো না আমাকে?”

রৌদ্র ভীষণ গম্ভীর গলায় বলে শেষের কথাটা। আরশি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল-

“নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করি।”

“আচ্ছা তাহলে আপনারা থাকুক, আমরা এখন আসি।”

নীলের কথায় রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। মিনিটের মধ্যেই সবাই চলে যায়। আরশি আর রৌদ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র নিরবতা ভাঙে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল-

“চল আমার সাথে।”

রৌদ্র হেঁটে যাচ্ছে আর আরশিও নিঃশব্দে তার পেছন পেছন যাচ্ছে।

———————————

আষাঢ়ের মাঝামাঝি সময়। ক্ষনে ক্ষনে থেমে আষাঢ়ি বৃষ্টি নামে। মেঘ গুলো বৃষ্টির পানি হয়ে ঝুমঝুম করে পৃথিবীর বুকে অঝোরে পড়ছে। চারপাশে বইছে ঝোড়ো হাওয়া। বাতাসের তীব্রতায় বৃষ্টির ফোটা গুলো এলোমেলো হচ্ছে। আরশি এক মনে তাকিয়ে আছে বাহিরের দিকে। রেস্টুরেন্টের কাঁচের দেয়াল দিয়ে গড়িয়ে পরছে বৃষ্টির পানি। ঝাপসা ঝাপসা দেখাচ্ছে বৃষ্টি কন্যার এলোমেলো নৃত্য। রৌদ্র অপলক দৃষ্টি তার রুদ্রাণীর মাঝেই নিবদ্ধ৷ ধোয়া ওঠানো কফির মগে চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল-

“আজ তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন আরু?”

আরশি ঘাড় বাকিয়ে সামনে বসে থাকা রৌদ্রর দিকে তাকালো। হাল্কা হেসে নিম্নস্বরে বলল-

“কেমন দেখাচ্ছে?”

“বৃষ্টি শুরু হাওয়ার আগের গম্ভীর, নিস্তব্ধ গুমোট পরিবেশের মতো। রৌদ্রজ্বল আকাশ যেন কালো মেঘে ঢেকে আছে। কিছু কি হয়েছে মিস আরু?”

রৌদ্রর কথা শুনে আরশি হেসে ফেলে। কফির মগের দিকে তাকিয়ে উদাসীন গলায় বলল-

“বৃষ্টির সাথে কফিটা ঠিক যাচ্ছে না। চা হলে বৃষ্টির দিনটা উপভোগ করা যেত।”

“এটা আগে বললেই হতো। শুধু শুধুই এভাবে মুখ ভার করে বসে ছিলে।”

কথাটা বলেই রৌদ্র উঠে দাঁড়ায়। আশেপাশে তাকিয়ে রেস্টুরেন্টের অন্য পাশে চলে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার চলে আসলো। আরশি ভ্রু কুচকে বলল-

“কোথায় গিয়েছিলেন?”

“একটু কাজ ছিল।”

আরশি ছোট করে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে। মিনিট পাঁচেক সময় পেরুতেই ওয়েটার দু কাপ চা দিয়ে যায়। আরশি অবাক চোখে চায়ের কাপের দিকে চেয়ে রইলো। বিস্ময়ের গলায় বলল-

“আপনি চায়ের ওর্ডার দিয়েছেন? কিন্তু এই রেস্টুরেন্টে তো চা পাওয়া যায় না।”

রৌদ্র চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে বলল-

“রুদ্রানীর মন কিছু একটা চাচ্ছে আর তার রৌদ্র সেটা পূরণ করবে না তা কি হয়!”

আরশি লাজুক হেসে মাথা নিচু করে ফেলে। রৌদ্র মুচকি হাসলো আরশির লজ্জারুণ চেহারা দেখে। টেবিলের দিকে খানিকটা ঝুঁকে শীতল কন্ঠে বলতে শুরু করে-

“এমন কোনো দিন নেই যেদিন তোমার ছবি আমার মানিব্যাগে ছিল না। এমন কোনো রাত খুঁজে পাওয়া যাবে না যেদিন তোমাকে নিয়ে আমি ভাবিনি। এমন কোনো দিন নেই যেদিন তোমাকে খোঁজার চেষ্টা করিনি। অনেক সাধনার পর আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছি। ভীষণ ভীষণ ভীষণ ভালোবাসার পর তোমার মনে জায়গা নিয়েছি। এমন একটা মুহুর্ত খুঁজে পাওয়া মুশকিল যখন তোমাকে অনুভব করিনি। প্রতিটা পূর্নিমার রাতে তোমার সেই খোলা চুল আর হাসতে হাসতে গান গাওয়ার মুহুর্তটা ফিরে পেতে চেয়েছি। খুব কষ্টে, বিষন্নতায় দিন কাটানোর পর অবশেষে তোমাকে পেয়েছি৷ আর তোমার এই সামান্য ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারবো না তুমি ভাবলে কি করে! তোমার মন খারাপ, তোমার লজ্জা, অস্বস্তি সব কিছুই আমি অনুভব করতে পারি। ভালোবাসি বলেই তোমাকে অনুভব করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে।”

রৌদ্র আগের মতোই সোজা হয়ে বসলো। আরশি ধীরে ধীরে মাথা তুলে। বিস্ময়ে দৃষ্টিতে তাকায় রৌদ্রর দিকে। রৌদ্র ভ্রু নাচিয়ে আরশির অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে ব্যাঘাত ঘটায়। সাথে সাথেই আরশি তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। রৌদ্র মনকাড়া হাসি দিয়ে বলল-

“তুমি কিন্তু এখনো আমাকে ভালোবাসি বলনি আরু। তাবে কি ভেবে নিবো তুমি আমাকে পছন্দ করো না।”

আরশি ঝট করে তাকায় রৌদ্রর দিকে। ভড়কে উঠে বলল-

“আমি কি কখনো বলেছি আমি আপনাকে পছন্দ করিনা!”

“তাহলে কি শুধু পছন্দই করো কিন্তু ভালোবাস না!”

রৌদ্র গোমড়া মুখে কথাটা বলে। প্রতিত্তোরে আশায় কৌতূহলী চোখে আরশির দিকে চেয়ে থাকে। বরাবরের মতো এবারও আরশি চুপ করে রইলো। কোনো উত্তর দেয়নি তার কথার। রৌদ্র তপ্ত শ্বাস ফেলে। বিষন্ন গলায় বলল-

“বৃষ্টি কমেছে। এবার যাওয়া উচিত। না হলে তোমার বাসায় হয়তো সবাই চিন্তা করবে।”

“ধ্রুব মেসেজ দিয়ে আমাকে বাসায় চলে যেতে বলেছে। ওর হয়তো কোনো কাজ আছে। তাই বাসায় যেতে দেরি হবে।”

রৌদ্র চা শেষ করে কাপটা রেখে বলল-

“তাহলে আজ না হয় আমিই তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব।”

আরশি সম্মতি সূচক নাড়ে। দু’জনেই বেরিয়ে যায় রেস্টুরেন্ট থেকে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। খুব শীতল একটা পরিবেশ। গায়ে হাল্কা বাতাসের ঝাপটা লাগতেই আরশি বার বার কেঁপে উঠছে। রৌদ্র রিকশা থামিয়ে আরশিকে রিকশা বসিয়ে নিজেও বসে পরে। পুরো রাস্তা কেউ কোনো কথা বলেনি। বৃষ্টির গতি আরও বেড়েছে। বাসার সামনে এসে রিকশা থামতেই আরশি বলল-

“মামা একটু গেইটটা খুলে দিয়ে আসুন তো।”

আরশির কথায় রিকশাওয়ালা গেইট খুলতে চলে যায়৷ তখনই আরশি রৌদ্রর কানের দিকে এসে মৃদুস্বরে বলল-

“ভালোবাসি বলেই আপনাকে পছন্দ করি রোদ।”

কথাটা বলে আরশি এক মুহুর্তও দেরি করেনি। ঝড়ের বেগে রিকশা থেকে নেমে বাসায় চলে যায়। রৌদ্র হতভম্ব অবস্থায় বসে রইলো। পুরো দুনিয়াটা যেন কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেছে তার জন্য। আশেপাশের কোনো শব্দ তার কানে আসছে না। বৃষ্টির ছন্দ কিংবা বাতাসের শব্দ কোনো কিছুই শুনতে পারছে না৷ তার মস্তিষ্কের পুরোটা জায়গা এখন আরশির বলা কথা গুলোতেই আটকে আছে। রিকশার হাল্কা ঝাঁকুনিতে রৌদ্রর হুশ ফিরলো। আরশির বাসা থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে রিকশা। আনমনেই রৌদ্রর ঠোঁট প্রসারিত হয়ে যায়। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে বিশ্বজয়ী এক হাসি।

———————————

“তোরা নিলুর কাছে থাক। আমি দেখে আসছি মেহমান এসেছে কিনা।”

সুপ্তি আর কাসফিয়া মাথা ঝাঁকালো। বিছানার এক কোণে নীলা মনমরা হয়ে বসে আছে। আদ্রাফ আর নীল বাহিরে গেছে ফুলদানিতে রাখার জন্য তাজা ফুল আনতে। পুরো বাড়িতে যেন বিয়ের আয়োজন চলছে এমন একটা পরিবেশ। আরশি কথা বলার শব্দ শুনে ড্রয়িংরুমে আসলো। মধ্য বয়স্ক একজন মহিলা আর পুরুষ বসে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা স্বামী স্ত্রী। মহিলার একপাশেই বসে আছে রৌদ্র। রৌদ্র দেখে আরশি যেন আকাশ থেকে পরলো। মনের মধ্যে ঝেকে বসেছে নানানরকম প্রশ্ন। এনারা কি রৌদ্রর বাবা-মা! দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু এনারা সবাই এখানে কেন? তাহলে কি তারাই এসেছে নিলুকে দেখতে??
আরশি হড়বড়িয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে রৌদ্রকে মেসেজ দিল-

“আপনি এখন কোথায়?”

আরশি আড়ালে চলে গেছে। আড়ালে থেকেই দেখছে রৌদ্র ফোন টিপছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আরশির ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠল। আরশি কৌতুহলী চোখে তাকালো ফোনের দিকে-

“পাত্রী দেখতে এসেছি।”

চলবে….

[সবার মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা❤️]