রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-০১

0
908

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#সূচনা_পর্ব
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আপনি কে? আমার হাত ধরার সাহস পেয়েছেন কোথায় আপনি! হাত ছাড়ুন বলছি।”

প্রচন্ডরকম রাগ নিয়ে শক্ত গলায় কথা গুলো বলল আরশি। কিন্তু আরশির কথায় সামনের লম্বাচওড়া বিশাল দেহের মানুষটার কোনো কর্নপাত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। মানুষটা চোখমুখ শক্ত করে ভয়ংকর রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশির হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে রাগান্বিত কন্ঠে বলল-

“ভার্সিটিতে কি র‍্যাগিং করার জন্য আসেন নাকি!! আপনার সাহস কি করে হয় স্টুডেন্টদের ধমকানোর?? আমি থাকতে এই ভার্সিটিতে কোনো প্রকার র‍্যাগিং চলবে না।”

লোকটার গাঁ জ্বলানো কথা শুনে ধপধপ করে আরশির মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। মনে হচ্ছে এখনই আরশির রাগের শিখায় এই লোকটাকে ঝলসে দিবে। হঠাৎই পাশের একটা ছেলে এসে চাপা কন্ঠে বললো-

“রৌদ্র দোস্ত! তোর কোথাও ভুল হচ্ছে।”

রৌদ্র ছেলেটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল-

“কি বলতে চাইছিস নির্বান? কিসের ভুল?”

নির্বান রৌদ্রর কাধে হাত রেখে কানের কাছে এসে ক্ষীণ গলায় বলল-

“উনি তো কোনো র‍্যাগিং করেনি। এই হারামি গুলাই মেয়েদের ডিস্টার্ব করছিলো তাই উনি ওদেরকে ধমকাচ্ছিল।”

নির্বান চোখের ইশারায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটা ছেলেকে দেখিয়ে কথা গুলো বলল। আরশি রাগ সামলাতে না পেরে এক ঝাটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। হাতের কব্জি ঘষতে ঘষতে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল-

“কি পেয়েছিন কি আপনারা! আমরা মেয়ে বলে কি আমাদের কোনো আত্মসম্মান নেই? মুখ বুঝে সব সহ্য করবো! যে কেউ এসে খারাপ ব্যবহার করবেন, হাত ধরবেন, বাজে কথা বলবেন আর আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তা দেখবো? যদি এটাই ভেবে থাকেন তাহলে আপনার ভাবনা ভুল। আমি মোটেও এসব সহ্য করবো না।”

রাগে গজগজ করে এক নিঃশ্বাসেই কথা গুলো বলে দিলো আরশি। রাগে যেন পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে পাশে তাকালো। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুপ্তি। ভার্সিটির দ্বিতীয় দিনই এমন কিছু হবে হয়তো ভাবতে পারেনি। আরশি চাপা কন্ঠে সুপ্তিকে বলল-

“সুপ্তি চল এখান থেকে। এসব মানুষদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেই আমার গাঁ জ্বলে যাচ্ছে।”

আরশি কথাটা বলে এক মুহুর্ত দেরি করলো না। সুপ্তির হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো। আশেপাশের মানুষ গুলো অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে তাদের দিকে। তবে মানুষ গুলোর দিকে ফিরে তাকানোর মতো রুচি আরশির নেই। রৌদ্র তীক্ষ্ণতার সাথে চেয়ে আছে আরশির যাওয়ার দিকে। আরশি রৌদ্রর দৃষ্টির আড়াল হতেই রৌদ্র নির্বানের দিকে তাকালো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো-

“কি হচ্ছিলো এখানে! পুরো পুরি ঘটনা আমাকে বল।”

নির্বান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। শার্টের হাতা ঠিক করে উদাস গলায় বললো-

“এই ছেলেগুলো মেয়েটার ফ্রেন্ডকে বাজে ইঙ্গিত করে কথা বলেছে তাই মেয়েটা রেগে গিয়ে ছেলেগুলোকে ধমকাচ্ছিলো। আর তুই ভেবেছিস মেয়েটা ওদেরকে র‍্যাগিং করছে।”

রৌদ্র দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-

“তাহলে তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিলি! ছেলেগুলোকে কিছু বললি না কেন?”

“আমি আবার কি বলবো! মেয়েটা তো নিজেই প্রতিবাদ করছিলো তাই আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। কিন্তু তুই যে হুট করে এসেই মেয়েটার সাথে এমন করবি ভাবতে পারিনি।”

রৌদ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে পাশ ফিরে তাকালো। ছেলে গুলো এখন আর এখানে নেই। রৌদ্র আর নির্বানের কথার মাঝেই সুযোগ বুঝে পালিয়েছে। নির্বান রৌদ্রর কাধে হাত রেখে বলল-

“পালিয়েছে ওরা।”

—————————

ক্যান্টিনে বসে অনবরত হাত কচলাচ্ছে আরশি। মনে হচ্ছে সকল রাগ হাতের উপর মেটাচ্ছে। তার ঠিক সামনেই সুপ্তি মলিন মুখে চুপচাপ বসে আছে। আরশির রাগ সম্পর্কে তার খুব ভালো ধারণা আছে। সুপ্তি খানিকটা সময় চুপ থেকে ইতস্তত করে বলল-

“দোস্ত মাথা ঠান্ডা কর প্লিজ।”

আরশি সরু চোখে সুপ্তির দিকে তাকালো। সুপ্তির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আছে। মেয়েটা বড্ড বেশি ভীতু। অল্পতেই অস্থির হয়ে পড়ে। ‘তুই এতটা ভীতু কেন সুপ্তি! কেউ কিছু বললে প্রতিবাদ কেন করছিস না!’ প্রশ্ন গুলো সুপ্তিকে করার ইচ্ছে থাকলেও আরশি প্রশ্ন গুলো নিজের মনেই রেখে দিলো। এই প্রশ্ন করা হয়তো উচিত মনে করছে না। কারণ মেয়েটা তার নামের মতোই স্বচ্ছ। এই রকমই মেয়েটাকে খুব ভালো মানায়।

“কিরে এভাবে গাল ফুলিয়ে বসে আছিস কেন?”

আরশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। ধ্রুব ভ্রু কুচকে কৌতুহলী চোখে চেয়ে আছে আরশির গম্ভীর মুখের দিকে। আরশি ধ্রুবকে দেখে সাথে সাথেই খানিকটা উচ্চস্বরে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো-

“ধ্রুব জানিস কি হয়েছে একটু আগে…”

আরশির কথার মাঝেই ধ্রুব অপ্রস্তুত হয়ে আরশির মুখ চেপে ধরলো। অস্থির চোখে আশেপাশে একবার নজর বুলিয়ে নিলো। ক্যান্টিনে তেমন কোনো মানুষ নেই। যারা আছে তারা সবাই নিজের মতো আড্ডা দিতে অথবা খাওয়ায় ব্যস্ত। ধ্রুব এক হাতে আরশির মুখ চেপে ধরেই আরশির পাশে বেঞ্চিতে বসে চাপা কন্ঠে প্রায় ফিসফিস করে বললো-

“ওই তোকে না বলেছি আমাকে তুই করে বলবি না।”

আরশি ভড়কে গিয়ে ধ্রুবর হাতে খামচি দিতেই ধ্রুব তাড়াতাড়ি করে নিজের হাত সরিয়ে ফেলে। মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে হাত ঘষতে লাগে। আরশি তেজী গলায় বলল-

“হারামি আমাকে দম আটকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছিস না-কি!”

“রাক্ষসী তুই কি আমাকে খামচি দিয়ে মারতে চাচ্ছিস নাকি!”

ধ্রুবর কথায় আরশি জ্বলন্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ধ্রুব ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললো-

“আরু তোকে তো আমি আগেই বলেছিলাম ভার্সিটিতে আসলে আমাকে তুই করে বলবি না। ভার্সিটিতে আমি তোর সিনিয়র। শুধু মাত্র দুই এক বছরের না, তোর থেকে তিন বছরের বড় আমি।”

আরশি চোখমুখ কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-

“দেখ ধ্রুব বড় বলে বার বার জ্ঞান দিবি না।”

“জ্ঞান দিচ্ছি না আরু। এটা ভার্সিটি এখানে তুই যদি আমাকে তুই করে বলিস তাহলে মানুষ তোকেই বেয়াদব বলবে। আর আমি যেহেতু সিনিয়র তাই আমারও আলাদা একটা সম্মান আছে জুনিয়রদের কাছে। তাই বলছি কষ্ট করে হলেও ভার্সিটিতে তুমি সম্মোধন করে বলিস, এরপর বাহিরে যা ইচ্ছে বলিস আমি কিছু বলবো না।”

ধ্রুবর কথায় আরশি কিছু বলল না। সুপ্তি খানিকটা জ্ঞানী ব্যাক্তির মতো ভাব নিয়ে বলল-

“আশু! ধ্রুব ভাইয়া তো ঠিকই বলেছে। সিনিয়রদের তুই করে বললে মানুষ তোকেই বেয়াদব বলবে। তুই বরং আপাতত ওনাকে তুমি করেই বল।”

আরশি একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল-

“আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি করেই বলল।”

“এখন বল কি বলতে চেয়েছিলি! আর মুখ এমন অন্ধকার করে রেখেছিস কেন?”

ধ্রুবর প্রশ্ন শুনে মুহুর্তেই আরশির চোখেমুখে রাগের আভাস দেখা দিল। আরশি গম্ভীর গলায় বললো-

“কয়েকটা ছেলে সুপ্তিকে আজে বাজে কথা বলেছে তাই আমি ওদের ধমকাচ্ছিলাম। তখনই একটা ছেলে এসে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল আমি না-কি ছেলেদেরকে র‍্যাগিং করছি। কতটা অসভ্য ছেলে দেখেছো! একে তো আমার হাত ধরেছে তারপর কিছু না জেনে শুনেই আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দিলো।”

আরশির কথা শুনে ধ্রুবর কপালে চিন্তার ভাজ পরে গেল। টেবিলের উপর দুহাত এক করে রাখলো। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“ছেলেটা কে ছিলো?”

“আমি কি করে জানবো! আমি তো আজকেই প্রথম আসলাম এখানে।”

বিরক্তির সুর টেনে বলল আরশি। সুপ্তি নিম্ন স্বরে বলল-

“ছেলেটার নাম মনে হয় রৌদ্র। অন্য একটা ছেলে তো এই নামেই ডাকছিল।”

ধ্রুবর ভ্রু জোড়া আগের থেকেও কুচকে এলো। ধ্রুব বেঞ্চি থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে বলল-

“এখন ক্লাসে যা। আর হ্যাঁ ছেলেদের থেকে দূরে থাকবি। প্রথম দিনই ঝামেলা পাকিয়ে ফেললি। নেক্সট টাইম যেন কোনো ঝামেলা না হয় বলে দিলাম। ক্লাস শেষে আমার সাথেই যাবি।”

আরশি আর সুপ্তি দুজনেই বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। ধ্রুব হাল্কা হেসে ক্যান্টিন থেকে চলে গেল।

—————————

গ্রীষ্মের শুরু। মাথার উপর তেজস্বী রোদ। সূর্যের তীর্যক রশ্মিতে চিকচিক করছে পিচঢালা রাস্তা। উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাস্তাঘাট। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছি আরশি আর ধ্রুব। সুপ্তি চলে গেছে নিজের বাসায়। সকালের ঘটনা প্রায় ভুলেই গেছে আরশি আর সুপ্তি।

“দোস্ত ব্যাগটা একটু তোর কাছে রাখ প্লিজ। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে।”

আরশি ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বলল ধ্রুবকে৷ ধ্রুব হাঁটা থামিয়ে চোখ ছোট ছোট করে আরশির দিকে তাকালো। রোদের তাপে আরশির উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা গায়ের ত্বক এখন লালচে বর্ণের আকার ধারণ করেছে। ধ্রুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল-

“ক্লান্ত লাগলে বাসায় চল। বাসায় যেয়ে বিশ্রাম নিস। এখনই তোকে লাইব্রেরিতে যেতে হবে কেন?”

আরশি কোনো কথা বলল না। চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে চিরচেনা রাস্তা দিয়ে। ধ্রুব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। আরশির সাইড ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়ে আরশির পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। আরশি নিচের দিকে তাকিয়েই মুচকি হাসলো। ধ্রুব সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই শান্ত গলায় বলল-

“আর কত অপেক্ষা করবি আরু? অচেনা একটা মানুষের কাছ থেকে চিঠির আশা করি কি তোর ঠিক হচ্ছে?”

আরশি এবারও চুপ রইলো। ভাবতে লাগলো বছর খানেক আগের কথা, যেদিন থেকে শুরু হয়েছিলো এই অপেক্ষার প্রহর গুনা।

কোনো এক কারণে আরশির মন খারাপ থাকায় ধ্রুব জোর করেই আরশিকে নিয়ে এসেছিল পুরনো লাইব্রেরিতে৷ ধ্রুব খুব ভালো করেই জানে এই লাইব্রেরিতে আসলে আরশির মন খারাপ নিমিষেই দূর হয়ে যায়। আরশি মন খারাপ নিয়েই লাইব্রেরির শেষের দিকের একটা তাক থেকে বই নিলো। টেবিলে ধ্রুবর সাথে বসেই বই পড়ছিল।

“রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী।”

হুমায়ূন আহমেদের ‘দারুচিনির দ্বীপ’ বইয়ের একদম শেষ পাতায় ছোট ছোট করে এই লাইনটা লেখা। সাথে একটা মেয়ের ছবি। ছবির এক কোণে সুন্দর করে লিখা ‘আদ্রলিকা’। পূর্নিমার রাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে সবুজ রঙের সুতি শাড়ি গায়ে জড়ানো খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরী মেয়েটি আর কেউ নয় আরশির নিজেরই ছবি। ছবিতে মুখ দেখা যাচ্ছে না। ছবিটা পেছন থেকে তোলা তাই শুধু মাত্র বাতাসে ঢেউ খেলানো চুল গুলো দেখা যাচ্ছে। আরশি প্রচন্ড অবাক হলো। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। আরশির কাছেও ওইদিনের ছবি আছে, ঠিক একই রকম তবে সব গুলো ছবিই সামনের দিক থেকে তোলা। কিন্তু পেছন দিক থেকে তোলা এই রকম ছবি তো তার কাছে নেই। তাহলে এই ছবিটা কে তুলেছে? আর কেই-বা এখানে রেখেছে! আরশির মাথায় নানানরকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

চলবে।