রৌদ্র দ্বীপের রুদ্রাণী পর্ব-২+৩

0
592

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“ধ্রুব এই ছবিটা কি তুই রেখেছিস এখানে? আর এসব কি রৌদ্র রুদ্রাণী লেখা!”

আরশি সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব ভ্রু কুচকে তাকালো আরশির হাতের ছবিটার দিকে। সরু চোখে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে ক্ষীণ গলায় বললো-

“পাগলের মতো কথা বলছিস কেন! আমি কেন তোর ছবি এখানে রাখবো! আর এটা তো সেন্টমার্টিন দ্বীপে গিয়েছিলাম তখনকার ছবি। কিন্তু আমি তো তোকে এই ছবি তুলে দেইনি।”

“ধ্রুব মজা করিস না প্লিজ। তুই এই ছবি না তুললে আর কে তুলবে! দেখ ছবিতে আমার আদ্রলিকা নাম লিখা আছে। আর আমাকে এই নামে তুই ছাড়া অন্য কেউ ডাকে না।”

আরশি বিরক্তি প্রকাশ করে বলল কথা গুলো। ধ্রুব ছবিটা নিজের হাতে নিয়ে ভালো করে দেখতে লাগলো। ছবিটা টেবিলে রেখে আরশির দিকে ঘাড় বাকিয়ে তাকালো ধ্রুব। যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বললো-

“হ্যাঁ আমি মানছি আমি তোকে আদ্রলিকা নামে ডাকি। তবে সত্যি বলছি আমি এই ছবি তুলিনি। আমাদের বন্ধুত্বের কছম।”

আরশি মনে মনে বিস্মিত হলো। নির্লিপ্ততার সাথে ধ্রুবর গম্ভীরমুখের দিকে তাকালো। ধ্রুব কখনো বন্ধুত্ব নিয়ে মিথ্যে কথা বলবে না। ছবির ব্যাপারটা হয়তো খুব সিরিয়াস ভাবেই নিয়েছে তাই সরাসরি বন্ধুত্বের কছম কেটে ফেলেছে। আরশি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বইয়ের মধ্যে ছবিটা রেখে বইটা হাতে নিয়ে শান্ত গলায় বলল-

“আরে.. এত সিরিয়াস হচ্ছিস কেন! বাদ দে এসব। বাসায় চল এখন। রাত হয়ে যাচ্ছে৷ বইটা বাসায় নিয়ে যাই। পরে পড়বো।”

ধ্রুব গম্ভীর গলায় ছোট্ট করে ‘আচ্ছা’ বলে উঠে দাঁড়ালো।

আরশি পরেরদিন ঠিক একই সময় ধ্রুবর সাথে লাইব্রেরিতে আসলো। ছবিটা নিয়ে মনে মনে কিঞ্চিৎ কৌতুহল থাকলেই সেটাকে তেমন পাত্তা দেয়নি। বইটা আগের জায়গায় রাখতে গিয়ে বিস্মিত হলো। বইয়ের জায়গায় একটা চিরকুট ভাজ করে রাখা। আরশি কৌতুহল মেটাতে চিরকুটটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো-

“হুমায়ূন স্যারের ‘দারুচিনির দ্বীপ’ বইয়ের মধ্যে একটা ছবি ছিলো। ছবিটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। যার কাছে বইটা আছে তাকে দয়া করে ছবিটা বইয়ের মধ্যেই রেখে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।”

আরশি হতভম্ব হয়ে ধ্রুবর কাছে গেল। ধ্রুবর দিকে চিরকুটটা এগিয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বলল-

“ধ্রুব এটা দেখ।”

ধ্রুব আরশির দিকে কয়েক সেকেন্ডে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বিস্ময় নিয়ে চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো। পড়া শেষ হতেই ধ্রুব হতবাক হয়ে আরশির দিকে তাকালো। পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বলল-

“কে এটা! তোর ছবি কেন এই আগন্তুকের কাছে ইম্পর্ট্যান্ট হবে?”

আরশি চেয়ারে বসে ঠোঁট উলটে দু কাধ উঁচু করলো। যার মানে সে জানে না। ধ্রুব ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে চিরকুটটার দিকে দৃষ্টি রেখে বলল-

“এখন কি করবি! ছবিটা ফিরিয়ে দিবি?”

আরশি কিছু বলল না। ধ্রুবর হাতে থাকা চিরকুটের দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টি দিলো। মনে মনে বেশ কিছুক্ষন চিন্তাভাবনা করলো। অবশেষে ছবিটা সঠিক জায়গায় রেখে দিবে বলেই ঠিক করলো। তবে তার সাথে একটা চিরকুট দিবে বলে চিন্তা করলো। আরশি একটা সাদা কাগজে লিখল-

“ছবিটা ফিরিয়ে দিলাম। তবে আপনার কাছে এই ছবিটা এতো গুরুত্বপূর্ণ কেন তা জানার প্রবল আগ্রহ জেগেছে আমার মনে। আশাকরি আমার কৌতুহল মেটানোর জন্য আপনি এই ছবিটা সম্পর্কে আমাকে জানাবেন।”

আরশি চিরকুটটা লিখে ছবির সাথে বইয়ের শেষের দিকে রেখে দিলো। ধ্রুব চোখ ছোট ছোট করে বলল-

“ছবিটা দেওয়া কি ঠিক হচ্ছে! আর এসব তো বাচ্চামো ছাড়া৷ কিছুই না। তোর কি মনে হয় মানুষটা তোর চিঠির উত্তর দিবে?”

আরশি সহজ গলায় উত্তর দিলো- “জানি না।”

আরশি প্রথম চিঠি বিনিময়ে কথা ভাবতে ভাবতেই লাইব্রেরির কাছে এসে দাঁড়ালো। ক্লান্ত চোখে লাইব্রেরির দিকে তাকালো৷ এলাকার এক বৃদ্ধ লোক আর স্ত্রী খুব শখ করেই লাইব্রেরিটা করেছিল। লাইব্রেরিটা অনেক পুরনো। বাহিরের দেয়াল গুলোতে শেওলা পরে আছে। দেয়ালের সাদা রঙটা এখন আর নেই। সিমেন্ট গুলো কিছু কিছু জায়গা থেকে খসে পড়েছে। এখন আর এই লাইব্রেরিতে তেমন কোনো মানুষ আসে না। তবুও বৃদ্ধ লোকটা তার স্ত্রীর শেষ স্মৃতি হিসেবে লাইব্রেরিটা চালু রেখেছেন। আরশি অনেক আগে থেকেই এই লাইব্রেরিতে আসা যাওয়া করে।

“কিরে চল। রোদের মধ্যে কি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে তোর ভালো লাগছে না-কি!”

আরশি ধ্রুবর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে গম্ভীর পায়ে লাইব্রেরিতে ডুকলো। বরাবরের মতোই সর্বপ্রথম হুমায়ুন আহমেদ ‘দারুচিনির দ্বীপ’ বইটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো। সব সময়ের মতো এবারও আশাহত হলো আরশি। আজও কোন চিঠি দেখতে পেলো না৷ আরশি মলিন মুখে বইটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুব আরশির দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। এক বছর আগেই আরশির কাছে এই লাইব্রেরিটা মন ভালো করার জায়গায় হিসেবে ছিলো। অথচ এখন এই লাইব্রেরির আশেপাশে আসলেও যেন আরশির মাঝে লুকিয়ে থাকা এক গম্ভীর রূপ দেখতে পাওয়া যায়। আরশির এই গম্ভীর বিষন্ন রূপের সাথে আর কেউ পরিচিত নয়। আরশির সকল বিষন্নতা শুধু ধ্রুব কাছেই প্রকাশ পায়।

—————————

আরশির দু চোখে বিস্ময় আর রাগ নিয়ে তাকিয়ে আছে সামনের তিনটা ছেলের দিকে। ধ্রুব আরশিকে হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে যেতে দেখে বলল-

“কিরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন!”

আরশি সামনের ছেলে গুলোর দিকে দৃষ্টি রেখেই শক্ত গলায় বলল-

“এই ছেলে গুলোই কালকে সুপ্তিকে আজেবাজে কথা বলেছিল।”

ধ্রুব ভ্রু কুচকে তাদের দিকে তাকালো। সব গুলো ছেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে ভয় নাকি অনুতপ্ত ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আরশি আর ধ্রুব তাদের এড়িয়ে ভার্সিটির গেইট দিয়ে ডুকবে তখনই ছেলে গুলো আরশির কাছে এসে মাথা নিচু করে বলল-

“আপু আমাদের মাফ করে দিন। কালকের জন্য আমরা সবাই খুব লজ্জিত। এবারের মতো আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিন আপু। এর পর থেকে আর কখনো কোনো মেয়ের দিকে খারাপ নজরে তাকাবো না।”

আরশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ছেলে গুলোর দিকে। তাদের কথার প্রতিত্তোরে কিছু বলল না৷ ধ্রুব গম্ভীর গলায় বলল-

“কথা গুলো সব সময় মনে রেখো। আর কখনো কোনো মেয়ের দিকে খারাপ নরজ দেওয়ার আগে নিজের মা অথবা বোনের কথা চিন্তা করো তাহলেই হবে। যাও এখন।”

ছেলে গুলো এক সাথে মাথা নাড়িয়ে স্থান ত্যাগ করলো। আরশি এখনো গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধ্রুব আরশির হাত ধরে ভার্সিটির ভেতরে যেতে যেতে বলল-

“এসব নিয়ে এখন আর চিন্তা ভাবনা করিস না আরু। রাগ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।”

আরশি ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে ‘হুম” বলল। ধ্রুব একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-

“তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে আজ।”

আরশি আড় চোখে তাকালো ধ্রুব দিকে। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“কিসের সারপ্রাইজ?”

“সেটা না হয় পরেই দেখতে পারবি।”

ক্যানটিনের কাছে আসতেই আরশি থমকে দাঁড়ালো। ধ্রুব আরশির হাতে হাল্কা টান দিয়ে বলল-

“দাঁড়িয়ে গেলি কেন?”

আরশি কিছু বলল না। রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে আছে রৌদ্রর দিকে। রৌদ্র আর নির্বান ক্যানটিনের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্র পকেটে দু হাত গুজে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। আরশির চোখে এই মুহূর্তে নিজের জন্য ঘৃণা দেখতে পাচ্ছে রৌদ্র। রৌদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরশির দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই আরশি উল্টো দিকে ফিরে হাঁটতে লাগলো। রৌদ্র শান্ত গলায় খানিকটা উচ্চস্বরে ডাক দিলো-

“এই যে নিউ স্টুডেন্ট। এক্সকিউজ মি শুনতে পাচ্ছেন!”

আরশি শুনেও না শোনার ভান ধরে চলে যাচ্ছিলো তখনই ধ্রুব আরশির হাত ধরে আটকে ফেলে। আরশির চরম বিরক্তি নিয়ে ধ্রুবর দিকে তাকালো। ধ্রুব কিছুটা থমথমে গলায় বললো-

“ক্যানটিনের দিকে তাকা আরু।”

আরশি ভয়ংকর রকমের বিরক্ত নিয়ে সেদিকে তাকালো। রৌদ্রর গম্ভীরমুখ আর নির্বানের উৎসুক চেহারা দেখতে পেল। সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকাতেই চমকে উঠলো আরশি। বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মুহুর্তেই খুশিতে ঝলঝল করে উঠলো আরশির মুখ। আরশির মুখে হাসি দেখে রৌদ্র খানিকটা অবাক হয়। আরশিকে হাসিমুখে দ্রুত পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে রৌদ্র হকচকিয়ে উঠলো। রৌদ্র অপ্রস্তুত হয়ে আরশিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরশি রৌদ্রকে পাশ কাটিয়ে ক্যানটিনে চলে গেল। রৌদ্র আর নির্বান হতবাক হয়ে পেছন ফিরে আরশির দিকে তাকালো। আরশি ক্যানটিনে এসেই ঝাপিয়ে পরলো তার ফ্রেন্ডদের উপর। সবাইকে এখানে দেখে যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে আরশি। ধ্রুব মুখে তৃপ্তিদায়ক হাসি টেনে আরশির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নির্বান হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আহত গলায় বলল-

“ইশশ.. আমি ভাবলাম মেয়েটা তোকে দেখে খুশিতে আপ্লূত হয়ে তোকে জড়িয়ে ধরতে আসছে।”

রৌদ্র কটমট করে নির্বানের দিকে তাকালো। নির্বান রৌদ্র চাহনি উপেক্ষা করে আবারও বিষন্ন গলায় বলল-

“পুরাই বেকুব হইয়া গেলাম ভাই। মেয়েটা আমগোরে ছ্যাকা দিয়ে গেলো অন্যজনরে জড়াইয়া ধরতে। হায় আল্লাহ! মানা যায় এসব! এতো বড় ধোকা কিভাবে খেইলাম ভাই!”

“নির্বান আজাইরা কথা বলিস না। চুপ কর।”

রৌদ্র কঠিন গলায় কথা গুলো বলেই গটগট করে চলে গেল। নির্বান এক নজর ক্যানটিনের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রৌদ্রর পেছন পেছন হাঁটা শুরু করলো।

“হারামি তোরা আমাকে মিথ্যা বলেছিস কেন?”

কাসফিয়া আরশিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল-

“আমরা সবাই তোকে সারপ্রাইজ দিবো বলেই মিথ্যা কথা বলেছি।”

আরশি কাসফিয়ার দিকে চেয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলল-

“জানিস আমার কতটা মন খারাপ হয়েছিল এই কয়দিন! আমি ভেবেছিলাম তোরা সত্যি সত্যিই অন্য ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিস।”

আদ্রাফ আরশির মাথায় আস্তে করে একটা চাপড় মেরে বলল-

“তুই যে একটা গাধী তাই আমাদের কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিস।”

“আমরা তো তখন তোকে রাগানোর জন্য মিথ্যে বলেছিলাম। কিন্তু পরে যখন দেখলাম তুই আমাদের কথা সত্যি মনে করে মুখ গোমড়া করে রেখেছিস। তখনই আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি তোকে সত্যিটা বলবো না। একেবারে ভার্সিটিতে এসেই তোকে সারপ্রাইজ দিবো। যেমনটা ভেবেছিলাম তেমনটাই করলাম। আর তুই এতোটাই বোকা যে এই কয়দিন আমাদের কাছে থেকে একবারও আমাদের ভার্সিটির নাম ঠিকানা কিছুই জানতে চাসনি।”

নীল কথা গুলো বলেই হাসতে লাগলো। নীলের সাথে সাথে কাসফিয়া, নীলা, আদ্রাফ, সুপ্তি আর ধ্রুব একসাথে তাল মিলিয়ে হাসছে। আর আরশি হতভম্ব হয়ে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

——————————

দুটো ক্লাস করার পর। হঠাৎ করেই আরশি জানালা দিয়ে তাকিয়ে খেয়াল করলো রৌদ্র আর নির্বান তাদের ক্লাসের দিকে আসছে। আরশি সাথে সাথেই রৌদ্র দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। ক্লাসে এখন টিচার নেই। সবাই অপেক্ষা করছে। কেউ কেউ বই পড়ছে। কেউ বা আড্ডা দিচ্ছে। আরশির পাশেই নীলা, কাসফিয়া আর সুপ্তি কথা বলছে। আর পেছনের বেঞ্চ থেকে নীল আর আদ্রাফ তাদেরকে নানানভাবে ক্ষেপাচ্ছে। রৌদ্র আর নির্বান ক্লাসে এসে গম্ভীর হয়ে দাঁড়ালো। সবাই চুপ করে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দু’জনের দিকে। রৌদ্র পুরো ক্লাসে নজর বুলিয়ে নিয়ে আরশির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলল-

“মিস এ্যাংরি বার্ড। আপনি একটু আমার সাথে আসুন।”

আরশি কোনো সাড়া দিলো রাত কথায়। সে আগের মতোই চুপ করে বসে আছে। সবাই পেছনে তাকাচ্ছে বোঝার চেষ্টা করছে রৌদ্র কার উদ্দেশ্যে কথাটা বলেছে। নীলা আরশির কানে কানে নিম্ন স্বরে বলল-

“দোস্ত লোকটা তো মনে হচ্ছে তোকে বলছে।”

“মনে হচ্ছে না আশুকেই বলেছে শিউর।”

সুপ্তি বেশ কনফিডেন্স নিয়েই বলল। আরশি গরম চোখে তাকালো তাদের দিকে। রৌদ্র আবারও বলল-

“আমি আপনাকেই বলছি মিস এ্যাংরি বার্ড। লাল জামা আপনি দয়া করে আমার সাথে এসে আমাকে একটু ধন্য করুন।”

চলবে…

#রৌদ্র_দ্বীপের_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“এই যে লাল জামা! আমি আপনাকেই বলছি। দয়া করে আমার সাথে এসে আমাকে একটু ধন্য করুন।”

রৌদ্রর কথায় ক্লাসের সবাই কৌতুহলী চোখে আরশির দিকে তাকালো। সকলের এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আরশি অস্বস্তিতে চোখমুখ কুচকে অন্ধকার করে ফেলে। হঠাৎ করে ক্লাসে এসে সবার মাঝে এভাবে ডাকাডাকি করা আরশির কাছে মোটেও কোনো ভদ্র ছেলের কাজ বলে মনে হচ্ছে। আরশি কোনো নাড়াচাড়া করলো না। রৌদ্র আরশির দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলো। আরশির পেছন থেকে আদ্রাফ আরশিকে খোচা দিয়ে ফিসফিস করে বলল-

“আশু উনি তো তোকেই ডাকছে। যাচ্ছিস না কেন?”

আরশি কিছু বলল না বরং তার চোখ মুখ আগের থেকে শক্ত হয়ে এলো। সুপ্তি আরশির দিকে চেয়ে নিম্ন স্বরে বলল-

“দোস্ত ডাকছে যখন গিয়ে দেখ কি বলে! হয়তো কালকের ঘটনাটা নিয়েই কিছু বলবে।”

আরশি নির্লিপ্ত চোখে সুপ্তির দিকে তাকালো। আরশি কিছু বলার আগেই রৌদ্রর কন্ঠ কানে ভেসে আসলো।

“আপনি কি কানে কম শোনেন নাকি আমি আপনাকে খেয়ে ফেলবো সেই ভয়ে আমার সাথে আসতে চাচ্ছেন না!!”

রৌদ্রর গাঁ জ্বালানো কথায় আরশির রাগ হুরহুর করে বেড়ে গেল। সশব্দে হাতের বইটা বেঞ্চের উপরে রেখে উঠে দাঁড়ালো। গাম্ভীর্যতার সাথে রৌদ্রর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রৌদ্রর দিকে না তাকিয়েই ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছ গুলোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। রৌদ্র আরশির পেছন পেছন চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে। নির্বান এখনো আরশির ক্লাস রুমেই দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীলার দিকে। নীলাকে অস্বস্তিতে কাচুমাচু করতে দেখে নির্বান ভদ্রতার সাথে হাল্কা হেসে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসলো।

“সমস্যা কি আপনার? অসভ্যের মতো কাজকর্ম না করলে কি আপনার পেটের খাবার হজম হয় না না-কি!”

রৌদ্র আরশির কাছে এসে দাঁড়াতেই ঝাঁঝালো কণ্ঠের কথা গুলো আরশি তীরের বেগে ছুরে তার দিকে। আরশির কথায় রৌদ্রর মধ্যে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না৷ সে আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রৌদ্রকে চুপ থাকতে দেখে আরশি দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-

“আমাকে নিয়ে এসে এখন বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন! জলদি বলুন কিসের জন্য ডেকেছেন।”

রৌদ্র আরশির দিকে শীতল চাহনি দিয়ে। পকেটে দু’হাত গুজে শান্ত গলায় বলল-

“আপনি কি সব সময়ই রেগে থাকেন?”

“আমি সব সময় কিভাবে থাকি সেটা নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে। এতো বেশি কথা না বলে আসল কথা বলুন।”

আরশির কঠিন বাক্যে রৌদ্র ছোট করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল-

“সরি। কালকের ঘটনা পুরোটা-ই একটা ভুলবোঝাবুঝি ছিল। আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে। আর তার জন্য আমি দুঃখিত। আই থিংক আপনি বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা।”

আরশি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দুহাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে গম্ভীর গলায় বলল-

“পরবর্তীতে কাউকে কিছু বলার আগে সঠিকভাবে পুরোপুরি ঘটনা জেনে নিবেন।”

রৌদ্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিচের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বিনয়ের ভঙ্গিতে বলল-

“আসলে অনেক দিন পর ভার্সিটিতে এসেছি। আর এসেই দেখলাম আপনি ছেলেগুলোকে ধমকাচ্ছেন তাই একটু রাগ উঠে গিয়েছিল। তবে যাইহোক আপনি ওদের শায়েস্তা করেছেন এটা শুনে খুব ভালো লাগলো।”

“কেউ কোনো বাজে কথা বললে অথবা বিনা অনুমতিতে গায়ে হাত দিলে সেটার প্রতিবাদ করা আমার কাছে তেমন কোনো বড় ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না।”

রৌদ্রর ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। আরশি যে তাকেই কথা গুলো বলেছে সেটা রৌদ্রর বুঝতে মোটেও অসুবিধে হয়নি। রৌদ্র আরশির দিকে সরু চোখে চেয়ে সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করল-

“আচ্ছা মিস এ্যাংরি বার্ড আপনার রাগ সব সময় নাকের ডগায় এসে থাকে কেন?”

আরশি জ্বলন্ত চোখে রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্র আগের মতোই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি রৌদ্রর কাছে এসে আঙুল উঁচু করে ক্ষিপ্ত গলায় বলল-

“দেখুন মিস্টার আপনি কিন্তু বেশি বারাবাড়ি করছেন। সরি বলতে এসেছেন মানলাম। তবে সেই কখন থেকে দেখছি অসভ্যের মতো উল্টাপাল্টা নামে ডাকছেন। ক্লাসেও সবার সামনে আমাকে বিব্রত করলেন। এসবের মানে কি!”

রৌদ্র আরশির আঙুলের দিকে এক ঝলক তাকালো। পকেট থেকে ডান হাত বের করে আরশির উঁচু করে রাখা আঙুলে আলতো করে আঘাত করে বলল-

“ওই নামে ডাকার পেছনে দুটো কারণ আছে। প্রথমত আমি আপনার নাম জানি না। আর দ্বিতীয়ত এই নামটা আপনার সাথে বেশ মানায়।”

আরশি আবারও দু-হাত ভাজ করে গোমড়া মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল-

“আরশি! আরশি আমার নাম।”

“অহহ মিস আরু! এটাও সুন্দর নাম। তবে এ্যাংরি বার্ড নামটাই বেশ ভালো লাগে। যাইহোক আমি রৌদ্র।”

রৌদ্র নামটা বলেই আরশির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল৷ তবে আরশি সেদিকে তাকানোর আগেই মাঠে ধ্রুবকে তার ক্লাসের দিকে যেতে দেখে দ্রুত পায়ে সেদিকে হাঁটা শুরু করলো। আরশির কাজে রৌদ্র খানিকটা অপমানিত বোধ করলো। মনে মনে রাগ হলেও সেটাকে প্রকাশ করলো না। ধ্রুব আর আরশির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই হনহনিয়ে স্থান ত্যাগ করলো।

“আদ্রলিকা শোন। ছোট মা ফোন করেছিলো তুই নাকি ফোন ধরছিস না তাই আমাকে কল করেছে।”

ধ্রুবর কথায় আরশির মনে পরলো সে তার ফোন ক্লাসেই রেখে এসেছে। আরশি ভ্রু কুচকে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল-

“আম্মু এই সময় কেন কল করেছে?”

“শাকিল এসেছে। একেবারের জন্য এসে পড়েছে। আমাদের সারপ্রাইজ দিবে বলে কিছু বলেনি।”

আরশি প্রচন্ডরকম উত্তেজিত হয়ে ধ্রুবর বাহু ধরে বলল-

“সত্যি ভাইয়া এসেছে?”

ধ্রুব হাল্কা হেসে বলল-

“হুম হুম সত্যি। এখন যা ব্যাগ নিয়ে আয়। বাসায় যাবো। ছোট মা বলে দিয়েছে আজ আর আমাদের ক্লাস করতে হবে না।”

খুশিতে চিকচিক করে উঠলো আরশি চোখ। আরশি, ধ্রুব আর শাকিল ছোট থেকেই একে অপরের সাথে প্রতিটা মুহুর্ত কাটিয়েছে। তবে হঠাৎ করে তাদের মাঝ থেকে শাকিল বিদেশ চলে গেল। আজ প্রায় দু’বছর পর দেশে ফিরেছে। পড়াশোনার জন্যই বিদেশ গিয়েছল। এই প্রথম তাদের সবার কাছ থেকে এতদূর একা একা ছিল।
শাকিল দেশে ফিরছে সেই আজ আর লাইব্রেরিতে যায়নি। শাকিল দেশে ফিরেছে শুনেই মাথা থেকে এসব বেরিয়ে গেছে।

—————————

আরশি ছবির সাথে চিঠি রাখার পরেরদিনই সেই চিঠির উত্তর পেয়েছিলো। লাইব্রেরির টেবিলে আরশি আর ধ্রুব খুব আগ্রহ নিয়েই চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।

প্রিয়….

আপনাকে কি বলে সম্মোধন করবো বুঝতে পারছি না তাই প্রিয় জায়গাটা খালি রেখে দিলাম।

অনেক অনেক ধন্যবাদ ছবিটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলাম আমার বেখেয়ালির জন্যই আমি ছবিটা হারিয়ে ফেলেছি। ছবিটা আবারও ফিরে পাবো আশা করিনি। জানি না আপনি কে! তবে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ছবিটা আমার কাছে খুবই মূল্যবান। আর এই ছবিটা ঘিরেই আছে আমার সকল অনুভূতি আর ভালো লাগা।

আশাকরি এই ছবি নিয়ে আপনার মধ্যে আর কোনো জানার আগ্রহ নেই। এখন নিশ্চয়ই আপনার কৌতুহল মেটাতে পেরেছি!

ইতি,
অচেনা একজন।

“কিরে এসব কি লিখেছে! কে এই লোক? তুই এই অচেনা মানুষের কাছে এতো মূল্যবান হলি কবে থেকে? সত্যি করে বল তো তুই এই মানুষটাকে চিনিস কি-না!”

ধ্রুবর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে৷ আরশি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ধ্রুবর দিকে। মুহুর্তের মধ্যেই ধ্রুবর পিঠে সজোরে এক থাপ্পড় পড়লো। রাগান্বিত কন্ঠে বলল-

“হারামি আমি তো সারাদিন তোর সাথেই থাকি। আমি চিনলে তো তোরও চেনার কথা।”

ধ্রুব মৃদুস্বরে ‘আহহ’ শব্দ করেই পিঠে হাত দিল। উদাসীন গলায় বললো-

“আমি তো এমনতেই জিজ্ঞেস করলাম। তাই বলে কি আমাকে মারবি!”

“চুপ থাক। ভাবতে দে আমাকে কি যায় এই চিঠিওয়ালাকে নিয়ে!”

“কি আর করবি! আবারও চিঠি লিখ। তবে এবার রাগ নিয়ে লিখবি। এটা যে তোর ছবি সেই কথাও বলবি।”

ধ্রুব কোনো কিছু না ভেবে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে কথা গুলো বললেও আরশি ধ্রুবর কথা মতোই করলো। চিঠি লিখলো। খুব রাগ নিয়ে। আর কিছুটা হুমকি দিয়ে।

প্রিয় অচেনা একজন,

আপনাকে হয়তো প্রিয় সম্মোধন না করে মিথ্যাবাদি সম্মোধন করা উচিত। আপনি যে অন্য কারও ছবি নিয়ে এতো কাহিনী আমাকে শোনাচ্ছেন! আপনি হয়তো নিজেই জানেন না এই ছবির মেয়েটা কে! আমার ছবি নিয়ে আপনার মিথ্যা কথা আপনি আমাকেই বলছে? আপনার লজ্জা করে না আমার ছবি নিয়ে এতো বানোয়াট কথা বলতে?

বিঃদ্রঃ আপনি কে! আমার ছবি কোথায় পেয়েছে! অবশ্যই সব কিছু জানাবেন।

ইতি,
আপনার ছবির আদ্রলিকা

চলবে…

রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️