শঙ্খতেও ফাটল ধরে পর্ব-০২

0
150

#শঙ্খতেও_ফাটল_ধরে
পর্ব-২
লেখনীতে-সঞ্চিতা

-“তোমার জ্ঞান ফিরলো তাহলে, কিন্তু তোমাকে তো আবার ঘুমাতে হবে। তুমি না ঘুমালে তোমার সার্জারি হবে কিভাবে? (হালকা হেসে)

লিখি ভয়ে কেঁপে উঠলো। লিখির কাছে সবটা পরিষ্কার হলো। লিখির বৃক্কে কোনো পাথর হয়নি বরংচ শুভম তাকে মিথ্যা নাটক দেখিয়ে তার এবোর্শন করাতে চাচ্ছে। লিখি দ্রুততার সাথে বেড থেকে নেমে গেলো। শুভমের থেকে থেকে নিজেকে বাঁচাতে ওখানে থাকা কিছু জিনিস পত্র ছুড়েতে থাকে। শুভম বিরক্ত বোধ করলো প্রচুর, সে এগিয়ে গেলো লিখির দিকে। লিখি গায়ের সমস্ত জোড় দিয়ে শুভমকে ধাক্কা মারলো, শুভম কিছুটা পিছিয়ে গেলো। অমনি লিখি বাহিরের দিকে যেতে নিলে পিছন থেকে শুভম লিখির চুল চেপে ধরলো। রেগে শুভম লিখিকে ওভাবেই স্বজোরে ধাক্কা দিলো সামনের দিকে। লিখি ব্যালান্স হারিয়ে কক্ষের দরজার সাথে লেগে মাথায় বা”রি খেলো। ব্যথায় কুকিয়ে উঠলো লিখি তবুও নিজেকে সামলে নিলো। উঠেই দ্রুত বাহিরে গিয়ে, বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো।
শুভম এটা দেখে দৌড়ে দরজার কাছে গেলো আর জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।

-“লিখি তুমি যা করছো ভালো করছোনা, দরজা খুলো বলছি। নাহলে তোমাকে কাছে পেলে এমন অবস্থা করবো, যা তুমি গত আট বছর আমার সাথে থেকেও টের করতে পারোনি যে তোমার সাথে আমি ঠিক কি কি করতে পারি। (রেগে চিৎকার করে)

লিখির মাথা ঘুরছে। মাথাটা শক্ত পোক্ত করে চেপে ধরে কতক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। এরপর আশেপাশে তাকিয়ে হসপিটালের বাহিরে যেতে লাগলো। মাত্র হসপিটালে প্রবেশ করছেন ডক্টর অভি। লিখিকে এভাবে হন্ত দন্ত হয়ে বাহিরে যেতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
লিখি কোথাও না তাকিয়ে সোজা দ্রুততার সাথে হসপিটালের বাহিরে চলে যাচ্ছে।
~~

এইদিকে মুখে গম্ভীর্য এনে ডক্টর অভি শুভম যেই কক্ষে আটকে আছে সেখানে গেলেন। শুভম ভেতর থেকে চেঁচামেচি করছে। ডক্টর অভি দ্রুত দরজা খুলে দিলেন। শুভম রাগে ফোঁসফোঁস করছে।

-“লিখিকে দেখেছেন ডক্টর অভি।ও পালিয়ে গেছে, একটুর জন্য ওর এবোর্শনটা আজ করানো গেলো না। তবে পালিয়ে যাবে কোথায়! ওকে তো এই আমার খাঁচাতেই ফিরতে হবে। (রাগান্নিত কণ্ঠস্বরে)

ডক্টর অভি শুধু চেয়ে দেখলেন শুভমের মুখশ্রীটা। বাহির থেকে দেখলে সবাই বলবে শুভমের মতো ভালো মানুষ আর একটাও নেই অথচ ভেতরটায় এতটা কালিমাখা একটা পশুত্ব আছে টা কেউ জানেই নাহ।
~~

লিখি আর হাঁটতে পারছেনা, পা টা কেমন জানি অসাড় হয়ে আসছে তার। আজকে বিজয়া দশমী, প্রতিমা বিসর্জনের জন্য সবাই প্রতিমা নিয়ে নিকটতম দীঘির কাছে যাচ্ছে।
লিখি ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো শুধু। মনে মনে দূর্গা মাকে স্মরণ করলো।
ভীষণ জলের তেষ্টা পেয়েছে লিখির। সেই কাল থেকে এই অব্দি কিছুই খাওয়া হয়নি তার। খাবার কিনে খাবে যে লিখির কাছে টাকাও নেই। লিখি চাইলেও নিজের বাবার বাড়িতে যেতে পারবেনা, শশুরবাড়ি তো নাই। সেখানের একেকটা মানুষ চেহারায় মুখোশ এঁটে রেখেছে।
লিখি কোনোদিন কল্পনাও করেনি শুভম এইরকম কিছু করতে চাইবে তার সাথে। গত আট আটটা বছর তার সাথে কাটিয়ে আসছে তবে কোনোদিন শুভমের কোনো বাজে উদ্দেশ্য তার লক্ষে পড়েনি। মানুষটা কি সুন্দর তার সাথে এতো গুলো দিন অভিনয় করে আসছে।
ভাবতেই গা শিউরে উঠছে লিখির। অনেকক্ষন ধরে কিছু না খাওয়ার ফলে লিখির প্রচন্ড দুর্বল লাগছে নিজেকে। কোনোমতে হেটে একটা গাছের ছায়ায় বসলো সে।
লিখির ক্লান্ত চোখ বুজে এলো। কিছুতেই সে আর চোখ মেলে রাখতে পারছেনা।
ঘুমেরা চোখরাজ্যতে নিজেরদের রাজত্বে মেতে উঠলো।
~~

-“আপনি কি আমাকে শুনতে পারছেন! আপনার এখন কেমন ফিল হচ্ছে? (অস্বস্তি মিশ্রিত কণ্ঠে)

কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে আদো আদো ভাবে চোখ মেলে তাকালো লিখি। কিঞ্চিৎ আলো চোখে পড়তেই চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। পরক্ষনে মনে পড়লো কেউ তাকে গাড়ি করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিলো। লোকটা লিখির মাথা তার কাঁধের উপরে রেখেছিলো।
চট করে চোখ মেলে ফেললো লিখি। চোখ মেলতেই দেখো বিশাল এক কক্ষের বিছানায় শুয়ে আছে সে। তার শোয়ার ডান পাশে বসে আছে ষাট বছরের এক বৃদ্ধা। বৃদ্ধার কিছুদূরে দাঁড়িয়ে আছে সাদা শার্ট পরা এক যুবক। লিখির আসে পাশে আরও কয়েকজন রয়েছে।

-“আপনি ঠিক আছেন তো? কেমন ফিল হচ্ছে এখন? (হালকা কেশে)

লিখি পিটপিট করে চাইলো ব্যাক্তিটার দিকে। সাদা শার্ট পরিহিত ব্যক্তিটাকে লিখির কেন জানি চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কিন্তু আপাতত তার ব্রেইনে জোড় দেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছেনা লিখির।

-“ভালো। আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে? (নিচুস্বরে)

-“আমি নিয়ে এসেছি। প্রতিমা বিসর্জন দেখে বাড়িতে যাওয়ার পথে আপনাকে এলোমেলো ভাবে পরে থাকতে দেখলাম, সবাই আপনাকে ঘিরে রেখে ছিলো। আপনাকে অনেক ডাকার পরও আপনি কোনো রেসপন্স করেননি। আপনাকে কেউ চেনেও না, আপনার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো আপনি অসুস্থ তাই আপনাকে আমার সাথে বাড়ি নিয়ে আসলাম আর ডক্টরকে ফোন দিলাম। উনি আপাতত আপনাকে স্যালাইন দিয়েছেন। আপনি বোধহয় অনেক ক্ষণ যাবৎ কিছু খাননি আর সাথে অতিরিক্ত স্ট্রেস নেয়ার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন! (গম্ভীর কণ্ঠে)

লিখি মুখ চুপসে ফেললো। কি বলবে সে বুঝতে পারছেনা। কিছু না বলে কৃতজ্ঞতার সহিত লোকটার দিক তাকালো।

-“আপনার জন্য খাবার টেবিলে রাখা আছে, খেয়ে নিয়েন। ঠাম্মি আপাতত সবাই বাহিরে চলো। ওনাকে কিছু সময় একা থাকতে দেওয়া উচিৎ, পরে নাহয় ওনার পরিবারে খবর দেওয়া যাবে।( গম্ভীর কণ্ঠস্বরে)

পরিবারে খবর দেওয়ার কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলো লিখি। কাঁপা কাঁপা স্বরে কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলোনা। লোকটা কিছু বলার সুযোগ দিলোনা, হনহন করতে করতে বেরিয়ে গেলো। লিখি ভয় আরষ্টে চোখ বুজে ফেললো, মনে মনে চাইলো কোনোদিন যাতে সে আর শুভমের মুখোমুখি না হয়।
~~

-“মা লিখি পালিয়ে গেছে! একটুর জন্য আজ ওর এবোর্শনটা হলোনা। যদি লিখির এবোর্শন না করাতে পারি তাহলে মণি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। লিখি এখন যা বুঝার বুঝে ফেলেছে, যদি ও সমরেস বাবুকে সব বলে দেয় তাহলে তো আর সমরেস বাবুর থেকে প্রতিমাসে আর ওতো গুলো টাকা নিতে পারবোনা!( উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে)

শুভম বাড়িতে ঢোকা মাত্রই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। মাথার চুল খামচে একবার এদিক যাচ্ছে আবার ওদিক যাচ্ছে। শুভমের এহেন আচরণে শুভমের মা প্রমিলা চিন্তিত কণ্ঠস্বরে ছেলেকে কিছু বলতে যাবেনোই এরই মাঝে শুভম কথা গুলো বলে উঠলো,,
শুভমের কথা শুনে চোখ কপালে উঠার ন্যায় প্রমিলা দেবীর।
হা হয়ে গট গট করে বলে উঠলেন,,

-“পালিয়ে গেছে মানে কি? লিখি জানলো কিভাবে জে ওর সার্জারির বদলে এবোর্শন হবে? মানে কি বলছিস তু্ই!

-” আমি যা বলছি তাই,, লিখি সব জেনে গেছে। ওই নার্স সব বলে দিয়েছে লিখিকে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি কালকের ডক্টরের সাথে বলা কথাগুলো ও জানলো কিভাবে? আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে মা। যদি লিখির এবোর্শন না করাই তাহলে মণি আমাকে ডিভোর্স দিবে বলেছে!অন্যদিকে লিখি যদি সমরেস বাবুকে বলে দেয় সবটা তাহলে ওতো গুলো টাকা আমার হাত ছাড়া হয়ে যাবে! (উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে)

প্রমিলা দেবী কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শুভম পাগল প্রায় আচরণ করছে।
গত আট বছরে একটু একটু করে নাটক করা সংসার সাজিয়েছেন লিখির সাথে। কেবল মাত্র লিখির নামে থাকা পৈতৃক সকল সম্পত্তি নিজেদের নাম নিতে পারবেন বলে। কিন্তু আজ সবটাই হারিয়ে যেতে বসেছে,,

চলবে,,