শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা পর্ব-০৩+০৪

0
323

#শূন্যস্থানে তুমি পূর্ণতা
#পর্বঃ০৩+০৪
#ফারজানা_আক্তার

সিয়াম দূরে দাঁড়িয়ে রাইসাকে দেখছে আর অদ্ভুত ভাবে হাঁসছে। ক্লাস শেষে রাইসা আর রিয়া ক্যাম্পাসে বসে কিছু পড়া নোট করতেছে। সেদিন রাহেলা খাতুনের রাইসাকে খুব পছন্দ হয়েছিলো। গোলগাল চেহারা উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং চিকন ঠোঁট আর নেশা লাগানোর মতো চোখ সব মিলিয়ে অপূর্ব লেগেছে রাইসাকে রাহেলা খাতুনের। সেদিন ফজলুর রহমান একেবারে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে চলে যায়। রাহেলা খাতুনেরা সেদিন চলে যাওয়ার পর খুব রেগে গিয়েছিলো রাইসা, সে সরাসরি জানিয়ে দেয় এতো দ্রুত পড়ালেখা শেষ করার আগে সে বিয়ে করতে চাইনা, পরে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করে ফারুক আহমেদ রাইসাকে। রাইসা এই বিয়েতে রাজি হলেও এখনো সে জানেনা বর কে। হবু বরকে একটা নজর দেখার আগ্রহ জন্ম নেয় রাইসার মনে। ইসলামেও বিয়ের আগে ছেলেমেয়ে এক নজর একে-অপরকে দেখে পছন্দ করার নিয়ম রয়েছে। রাইসা লজ্জার কারণে নিজের অপ্রকাশিত ইচ্ছে টা কিছুতেই বাবা মায়ের সামনে প্রকাশ করতে পারছেনা। একটা মেয়ের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে তেমন রাইসারও বেশ কিছু স্বপ্ন রয়েছে কিন্তু যখন রাইসা তার হবু বরকে সরাসরি দেখবে তখন হয়তো রাইসার সব স্বপ্ন কাঁচের মতো ভাঙ্গবে কেননা রাইসা মোটেও পছন্দ করেনা সিয়ামকে।

পড়া নোট করা হয়ে গেলে রাইসা যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলো তখনই রিয়া বলে ওদের সাথে গাড়িতে যেতে কিন্তু রাইসা এতে অমত প্রকাশ করে। রাইসা আর রিয়ার সাথে আরেকটা মেয়ে মিশেছে ইদানীং, মেয়েটার নাম হুসনা। হুসনা সম্পূর্ণ পর্দা না করলেও বেপর্দাও চলাফেরা করেনা, সে সবসময়ই হিজাব নিকাব পরে তবে হাত মোজা আর পা মোজা পরেনা এর কারণ রাইসা আর রিয়ার জানা নাই তারা জিজ্ঞেসও করেনি কখনো।

সিয়াম বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে আর ওইদিকে রিয়া গাড়িতে বসে রাগে ফুঁসছে। প্রতিদিন এভাবে গাড়িতে এসে বসে থাকতে বিরক্ত লাগে ওর কিন্তু ভাইয়ের সামনে কিছু বলার সাহস সে পায় না। রিয়া বিরক্ত হয়ে বসে বসে কাগজ ছিঁড়তেছিলো তখনই সেইদিনের সেই ছেলেটি রিয়াকে ডেকে বলে “কি ম্যাডাম আপনার ভাই এখনো আসেনি? আপনি চাইলে কিন্তু আমার এই ভাঙ্গা সাইকেলে উঠতে পারেন।”

“অদ্ভুত, ছেলেটি জানলো কিভাবে যে আমি আমার ভাইয়ার সাথে যাওয়া আসা করি।”
মনে মনে ভাবছে রিয়া।

“কি ম্যাডাম কি ভাবছেন?”
হেঁসে হেঁসে জিজ্ঞেস করে মাহিন।

রিয়া কিছু না বলে গাড়ির জানালার গ্লাস গুলো সব তুলে দেয়। মাহিন বুঝতে পারে রিয়া বিরক্ত ওর প্রতি তাই সে চলে যায় নিজ গন্তব্যে।
মাহিন খুব গরিব ঘরের ছেলে। মাহিনের আপন বলতে ওর মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউই নেই। কলেজ শেষে কয়েকটা টিউশনি করেই নিজের খরচের টাকা সে জোগাড় করে আর বাবার পেনশনের টাকায় চলে যায় ঘর খরচা। আবার মায়ের ওষুধের পেঁছনেও অনেক টাকা খরচ হয়। সব মিলিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে জীবন উপভোগ করছে মাহিন। কলেজে কয়েকটা বন্ধু হয়েছে মাহিনের কিন্তু সবাই বড়লোক তাই তাদের সাথে খুব কম মিশে মাহিন। মাহিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ থেকে সে আর রিয়াকে বিরক্ত করবেনা, বড় লোকের মেয়ে যদি প্রিন্সিপালের কাছে একবার বিচার নিয়ে যায় তবে এই কলেজে পড়ার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে।

রাইসা আর হুসনা এক সাথেই একই রিক্সা করেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। রাইসাদের বাসা আগে হওয়ায় রাইসা নেমে যায়, যদিও হুসনাকে বাসায় ডাকে রাইসা কিন্তু হুসনা নামেনি রিক্সা থেকে। রাইসা ঘরে চলে গেলে হুসনা রিক্সা নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়। রিক্সাওয়ালা বেশ বৃদ্ধ দেখে হুসনা উনাকে ভাড়া একটু বাড়িয়ে দিলে তিনি অনেক দোয়া করে দেয় হুসনাকে। হুসনাদের বাসা দুতলা কিন্তু হুসনা কখনোই দুতলায় পা রাখেনি। হুসনা রা চার বোন কিন্তু সে ওর বড় বোন রিহা ছাড়া আর কোনো বোনের সাথে কথা বলেনা। হুসনা খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে, সবসময়ই চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে সে। হুসনা ওর মায়ের সাথে টুকটাক কথা বললেও ১৫বছর বয়সের পর থেকে কখনো বাবার সাথে কথা বলেনি এমনকি ওর বাবার দিকে থাকাইও না আর তাই ওর বাবা সবসময়ই দুতলায় থাকে, নিচের তলায় কোনো প্রয়োজন ছাড়া আসেনা। হুসনা ঘরে খাবার দাবার খেলেও নিজের পোশাক আশাক আর পড়ালেখার খরচ নিজেই চালায় টিউশনি করে। হুসনার হৃদয়ে অনেক ক্ষত যা এখনো সবার কাছে অস্পষ্ট।

*
আজ রাইসাকে দেখতে রিয়া শাহিল আর সিয়াম আসবে কেননা আর মাত্র ৪দিন পরেই তাদের বিয়ে। ওদের দুজনের পরিবারই চাই বিয়ের আগে ছেলেমেয়ে দুজন দুজনকে একবার হলেও দেখুক নয়তো পরে সমস্যা হতে পারে। রাইসা জানে আজ ওকে দেখতে আসবে ওর হবু বর কিন্তু সে এখনো জানেনা ওর হবু বর টা আসলে কে। রাইসা প্রচুর নার্ভাস, মনে মনে ভয় হচ্ছে কেননা এই প্রথম রাইসা কোনো ছেলের সামনে নিকাব ছাড়া যাবে যদিও সম্পূর্ণ পর্দা থাকবে শুধু নিকাব ছাড়া।
অবশেষে সেই ক্ষণ এসেছে, ফাহিমা আসছে রাইসাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যেতে। রাইসার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে, শ্যামলাবর্ণ লালচে হলে দেখতে নিদারুণ লাগে। রাইসা নিচের দিকে তাকিয়েই হাঁটছে, সবার সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে রিয়ার পাশে বসেছে রাইসা কিন্তু এখনো খেয়াল করেনি রিয়াকে। রাইসাকে দেখে গোল গোল চোখ করে এক নজরে তাকিয়ে আছে সিয়াম। “একটা মেয়ে এতোটা পরিপূর্ণ কিভাবে হতে পারে?” ভাবছে আনমনা হয়ে সিয়াম।
একটু পর রিয়া রাইসাকে বলে “ভাবি একটু চোখ তুলে দেখো, ভাইয়া তোমাতে মগ্ন হয়ে গেছে মুহুর্তেই”।
রিয়ার কণ্ঠস্বর টা বেশ পরিচিত মনে হলো রাইসার কাছে তাই রাইসা পাশফিরে হুট করে দ্রুত চোখ তুলে তাকাতেই দেখে রিয়াকে, রাইসা রীতিমতো অবাক সে রিয়াকে এই জায়গায় দেখবে সেটা কখনোই ভাবেনি আর ওর মুখে এভাবে হঠাৎ ভাবি ডাক শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা রাইসা। রাইসা একনজর সিয়ামের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে যায় আর ওর আব্বু আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলে “এই বিয়েটা আমি করতে পারবোনা, আমাকে তোমরা জোর করিওনা প্লীজ। পড়ালেখা শেষ হোক আগে তারপর বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবো।”
এটা বলেই রাইসা নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। তখনই সিয়াম বলে উঠে “বিয়ের সব আয়োজন করা শেষ মিস কালো পরি, সমাজে একটা ছেলের বিয়ে ভাঙ্গাটা স্বাভাবিক নিলেও একটা মেয়ের বিয়ে এভাবে হুট করে ভেঙ্গে যাওয়া স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া হয়না। যেদিন প্রথম তোমায় দেখেছি সেদিনই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি তাই বাবা মাকে পাঠিয়ে বিয়েটা ফিক্সড করেছি। ভেবে নাও আরো একবার সময় আছে হাতে এখনো চারদিন।”

কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটা ধরে রাইসা, সে নিজের রুমে যেয়েই দরজা বন্ধ করে দেয়। সিয়ামের সাথে কি এমন হয়েছে যে রাইসা এমন রিয়েক্ট করলো বুঝতে পারছেনা রিয়া আর বাকি সবাই তো অবাক হয়ে দেখছে দুজনের কান্ড।
সিয়াম রা বিদায় নিয়ে চলে যায়। এরপর রিয়া অনেকবার কল করলেও রাইসা রিসিভ করেনা। রিয়ার উপর ভীষণ রাগ রাইসার কারণ রিয়া সব জেনেও গোপন রেখেছে ওর থেকে। রিয়ার মন খারাপ হয়।
পরেরদিন কলেজে রিয়ার সাথে একটা কথাও বলেনি রাইসা। হুসনা ওদের রাগ অভিমানের কারণ খুঁজলেও কিছু জানতে পারেনি যদিও রিয়া কিছুটা বলেছে কিন্তু তবুও কিছু বুঝেনি ও।
সন্ধ্যাবেলা রিয়া রাগ নিয়ে সিয়ামের রুমে গিয়ে ওর কাছে জানতে চাই রাইসার সাথে সে কি করেছে কেনো রাইসা এমনটা করতেছে? সিয়াম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে “তুই ছোট মেয়ে, ছোটমেয়েদের এসব জানতে নেই। যা পড়তে বস।”

এভাবে কেটে গেলো আরো দুইদিন। আর মাত্র বাকি আছে একদিন। রাইসা ফারুক আহমেদ এর রুমে যেয়ে দরজায় নক করতেই তিনি বলেন “আয় মা আয়। আর তো মাত্র একদিন তারপর তুই আমাদের ছেড়ে নিজের সংসারে চলে যাবি।”

কথাটা বলতেই গলা ধরে আসছে ফারুক আহমেদ এর। রাইসার চোখও ঝাপসা হয়ে এসেছে। রাইসাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারুক আহমেদ বলে “কিছু কি বলবি মা?”
ছোট থেকেই রাইসা কিছু বলতে আসলে বাবার পাশে এভাবে চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাই ফারুক আহমেদ এর বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে রাইসা কেনো এসেছে উনার রুমে।

প্রায়ই ১০মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে রাইসা বলে “আব্বু ওই লোক টা তো এখনো স্টুডেন্ট আর আমিও স্টুডেন্ট। কেনো তোমরা এই বিয়েতে রাজি হলে?”

ফারুক আহমেদ হালকা কাঁশি দিয়ে বলেন”_________

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#শূন্যস্থানে_তুমি_পূর্ণতা
#পর্বঃ০৪
#ফারজানা_আক্তার

প্রায়ই ১০মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে রাইসা বলে “আব্বু ওই লোক টা তো এখনো স্টুডেন্ট আর আমিও স্টুডেন্ট। কেনো তোমরা এই বিয়েতে রাজি হলে? তুমি তো ওই ছেলে সম্পর্কে কোনো খোঁজ খবরও নাওনি, তুমি জানোই নাহ ছেলেটা কেমন। কিছু না জেনে এভাবে হুট করে বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হয়েছে তোমার? বিয়েটা তো দুই একদিনের জন্য না, বিয়েটা তো সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে আমাকে।”

ফারুক আহমেদ হালকা কাঁশি দিয়ে নড়েচড়ে বসেন। রাইসাকে বলেন এক গ্লাস পানি এনে দিতে। রাইসা পানি নিয়ে আসলে ওর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নিলেন। মেয়ের কথা সঠিক মনে হলেও উনার যে কিছু করার ছিলোনা রাজি হওয়া ছাড়া। ফারুক আহমেদ রাইসা কে বসতে বললেন আর মাথা ঠান্ডা রেখে উনার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে বললেন “মা তুই তো সব জানিস, তুই এই ঘরের বড় মেয়ে। তোর মাকে যখন বিয়ে করেছি তখন আমার একটা ভালো চাকরিও ছিলোনা আর তখন আমরা মধ্যবিত্তও ছিলাম না, গরিব ছিলাম খুব গরিব, একবেলা খেলে অন্য বেলা না খেয়ে থাকতে হতো তবুও আমার সাথে তোর মা এই সংসার করেছে, কোথাও যায়নি তোর মা। তখন তো ঘরে তোর দাদা দাদি ফুফি সবাই ছিলো কিন্তু তোর নানু সব জেনেও আমার ঘরে তোর মাকে দিয়েছে, তখন আমার অবস্থা খারাপ থাকলেও এখন কিন্তু ততটাও খারাপ না আমার অবস্থা। আমি ভালো চাকরি পাওয়ার পর-ই তোর ফুফিকে বিয়ে দিয়েছি। আমি এখন একটা বড় কোম্পানির ম্যানেজার আর এই চাকরিটা আমাকে সেদিন কে দিয়েছিলো জানিস তুই?”

কিছুটা চোখ বড় বড় করে রাইসা বলে “কে?”

একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ফারুক আহমেদ বলেন “তোর হবু শশুড়। তোর হবু শশুড় আর আমি একসাথেই স্কুলে পড়েছিলাম, একদিন হঠাৎ আল্লাহর হুকুমে ওর সাথে আমার রাস্তায় দেখা হলে আমরা একটা ঠং দোকানে বসি চা খাওয়ার জন্য তখন আমার পারিবারিক অভাবের কথা শুনে ও আমাকে একটা ছোট চাকরি দেয় ওদের অফিসে তারপর অনেকগুলো বছর পর প্রমোশন হয়ে ম্যানেজার হয়ে যায়। আল্লাহ যদি সেদিন ওর সাথে এভাবে হঠাৎ দেখা করিয়ে না দিতো তবে আমি হয়তো এখনো সেই অবস্থাতেই থেকে যেতাম। এবার তুই বল আমি যদি এই বিয়েতে রাজি না হতাম তবে আমাকে আবার তোদের কে নিয়ে রাস্তায় নামতে হতো। এই বয়সে নতুন চাকরি পাওয়া খুব জটিল হয়ে পরতো আমার জন্য। আর একটা কথা সেটা হলো সিয়ামের আর মাত্র কয়েকমাস পরেই অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা তারপর ও পড়ালেখার ফাঁকে অফিসেও যোগ দিবে। এসব নিয়ে কোনো টেনশন করিসনা তুই মা। রাজ রানি হয়ে থাকবি ওই ঘরে তুই। খুব সুখে থাকবি তুই ইনশাআল্লাহ”

বাবার কথা শুনে জলে দুই চোখ ভরে গিয়েছে রাইসার। রাইসার আর কিছু বলার নেই বাবাকে। চোখের জল মুছে হাঁসিমুখে বাবাকে বলে যায় সে রাজি এই বিয়েতে।

*
হুসনা দরজা জানালা সব বন্ধ করে নিজের রুমে চুপচাপ হয়ে শুয়ে আছে। আজ কলেজ থেকে ফেরার সময় বাড়ির গেইট দিয়ে প্রবেশ করতেই সে তার বাবার সামনাসামনি পরে গেছে। কেনো জানি এই মানুষটাকে দেখলে ভীষণ ঘৃণা হয় হুসনার। হুসনার মা জাহানারা বেগম অনেক ডাকাডাকি করলেও হুসনা খেতে যায়না, বাবা নামের মানুষটাকে দেখলে খিদেও মিটে যায় তার। মেয়ের এমন আচরণে বেশ কষ্ট পান হুসনার বাবা ইমতিয়াজ হোসেন তবুও কিছু করার নেই, এটাই হয়তো ভাগ্যে ছিলো।
এই এলাকার-ই একটা ছেলে হুসনাকে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু হুসনা এসবে মোটেও বিশ্বাস করেনা। কখনো বিয়ে করবেনা বলে নিজের সাথে নিজেই ওয়াদা করে হুসনা এর কারণ সবার অজানা হলেও হুসনার বড় বোন আর মায়ের অজানা নয়।

*
আজ রাইসা আর সিয়ামের বিয়ে। সিয়াম অনেক আনন্দে থাকলেও রাইসার মনে প্রচুর সন্দেহ। কেনো না দেখেই সিয়াম ওকে বিয়ে করার জন্য পরিবার পাঠিয়েছে তা জানার জন্য অস্থির হয়ে আছে রাইসা।
খুব সাধারণভাবেই ওদের বিয়েটা হয়ে যায়। বিদায়ের সময় রাইসা ছোট বাচ্চাদের কান্না জুড়ে দেয় রোকসানা আমিন কে জড়িয়ে ধরে।

আজকেও ড্রাইভার নেয়নি সাথে সিয়াম, সে নিজেই ড্রাইভ করে বউ নিয়ে বাসায় যাচ্ছে। এতে কিছুটা অবাক হলেও চুপচাপ পাশের সিটে বসে আছে রাইসা। যদিও রাইসার মনে চলছে এখন হাজার প্রশ্ন। সিয়াম ড্রাইভ করছে আর আঁড়চোখে রাইসার দিকে তাকিয়ে দেখছে ওকে। ড্রাইভ করতে করতে হঠাৎ মাঝ রাস্থায় ঠাস করে গাড়ি থেমে যায়, রাইসা একটু সামনের দিকে ঝুঁকে গেলেও সামলিয়ে নেয় নিজেকে কারণ সে ভারি সাজগোজ করেনি, প্রতিদিনের মতোই সে বোরকা পরিধান করেই আছে। হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় রাইসা কিছুটা চোখ বড় বড় করে তাকায় সিয়ামের দিকে, সিয়াম কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে চেক করে এসে বলে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে আর এতো রাতে এই রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি যাতায়াত করে না তাই আজ তাদেরকে এখানেই রাতটা কাটাতে হবেে। এটা শুনে রাইসার খুব রাগ হয়, রাইসা জানে অন্য রাস্তা দিয়ে সিয়ামদের বাসায় যাওয়া যায় কিন্তু সিয়াম অন্য রাস্তা দিয়ে না যেয়ে এই ফাঁকা রাস্তা দিয়ে এনেছে তাই সিয়ামের উপর খুব ক্ষোভ হয় রাইসার কিন্তু প্রকাশ করছেনা কারণ সিয়াম এখন ওর স্বামী আর স্বামীর সাথে বেয়াদবি করার মতো শিক্ষা রাইসা পায়নি। রাইসা চুপচাপ বসে আছে আর রাগে ফুঁসছে। সিয়াম গাড়িতে উঠে বসে বলে “সরি গো, বিয়ের প্রথম রাত তোমাকে এভাবে রাস্তায় কাটাতে হচ্ছে, সত্যি বলছি খুব লজ্জা লাগছে আমার তোমাকে নিয়ে রাস্তায় রাত কাটাতে তাও আবার বিয়ের প্রথম রাত। বাসর রাতটা এভাবে কাটাবো কেমনে, একটু কাছে আসবে প্লিজ!”
সিয়ামের এই কথাগুলোই একটুও সত্যতা খুঁজে পায়নি রাইসা তবুও সে নিজেকে কন্ট্রোল করে চুপ করে আছে এখনো।
সিয়াম বাড়িতে কল করে বলেছে আজ সে রাইসাকে নিয়ে একটা হোটেলে থাকবে সেখানেই অনেক টাকা খরচ করে নাকি সে রুম সাজিয়েছে। ফজলুর রহমানও ছেলের কথা বিশ্বাস করে সবাইকে বলে ঘুমিয়ে যেতে রাত অনেক হয়েছে।

সিয়ামের এমন একটা মিথ্যা কথা শুনে রাইসা আর চুপ থাকতে পারলোনা।
“আপনি বাসায় মিথ্যা বললেন কেনো? মিথ্যা বলা পাপ জানেন না আপনি? আপনি যদি সত্যি টা বলতেন তাহলে হয়তো আঙ্কেল আমাদের জন্য অন্য গাড়ি পাঠাতো।”
কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে রাইসা।

“বাহ্ মহারানী বাহ্৷ বড়লোক ঘরে বিয়ে হতে না হতেই দেখি তোমার শরীরে বড়লোক্স ভাব চলে এসেছে”
তাচ্ছিল্যের হাঁসির সাথে কথাটি বলে সিয়াম। রাইসা খুব অপমানবোধ করে সিয়ামের এমন কথায়।
রাইসা বোরকা পরলেও সে বোরকার মধ্যে বিয়ের শাড়ি পরেছে, বিয়ে বলে কথা স্বামীর জন্য হলেও তো একটু সাজতে হলো যদিও রাইসা সাজতে চাইনি কিন্তু রিয়া জোর করে সাজিয়ে দিয়েছে। রাইসার এখন বেশ অস্বস্তি লাগতেছে, বিয়ের শাড়ি দিয়ে যেনো শরীর চুলকাচ্ছে কিছুটা কারণ রাইসা ঘেমে গেছে খুব যদিও এসি গাড়ি তবুও বোরকার কারণে রাইসার শরীরে তেমন এসির বাতাস যাচ্ছে না। রাইসা একবার ভেবেছিলো সিয়ামকে বলবে আবার বলেনি, কারণ সিয়ামকে তেমন সহ্যই হচ্ছে না রাইসার।

“মানুষটা অদ্ভুত ধাঁচের, মামুষটাকে বুঝতে সময় লাগবে অনেকটা।” ভাবছে রাইসা।

“বাহির থেকে গাড়ির ভেতরের কিছুই দেখা যাবেনা। তুৃমি নিকাবটা খুলতে পারো চাইলে বোরকাও খুলতে পারো।”
সিয়ামের কথায় ছেঁদ পরে রাইসার ভাবনায়। গাড়িতে বসে বোরকা খুলা সম্ভব না তবে নিকাব তো খুলা যায় এটা ভেবে নিকাবটা খুলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় রাইসা কিন্তু এবার সমস্যা হলো আরেকটা সেটা হলো ক্ষুধা, প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে রাইসার কারণ সে আজ সকাল থেকে ভালো করে কিছুই খায়নি শুধু দুপুরবেলা ওর আম্মু ভাত খাইয়ে দিয়েছিলো কয়েক লোকমা তাও জোর করে। লজ্জায় সে সিয়ামকে বলতেও পারছেনা ক্ষুধার কথা আবার সহ্যও করতে পারছেনা ক্ষুধার জ্বা”লা টা। সিয়াম ঘুমিয়ে গেছে। রাইসার ঘুম আসছেনা, পেটে যেনো তেলাপোকা দৌড়াচ্ছে। মনে মনে সিয়ামকে অনেক বকাঝকা করে ঘুমিয়ে যায় রাইসা।

*
রিয়ার ঘুম আসছেনা বারবার শুধু মাহিনের কথা মনে পরছে ওর।
মাহিনেরও একই অবস্থা। মাহিন তো প্রথম দেখায় রিয়াকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে কিন্তু রিয়াকে বলার সাহস পাচ্ছেনা কারণ সে অনেক বড় ঘরের মেয়ে অথচ সে হচ্ছে খুব গরিব ঘরের ছেলে। মাহিন শুয়ে শুয়ে ভাবছে রিয়ার কথা সে আর ভাববে না, রিয়াকে সে কখনোই নিজের করে পাবেনা বরং কষ্ট পাবে পরবর্তী। নিজের মনকে কন্ট্রোল করার চেষ্টায় আছে মাহিন। মাহিনের মা খেয়াল করেছে মাহিন না ঘুমিয়ে কিছু একটা চিন্তা করছে তাই উনি রান্নাঘর থেকে পানি নিয়ে ছেলের রুমে যায়। মাহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মাহিনের মা সেনুয়ারা বেগম বলেন “আমি জানিনা বাবা তুই কি নিয়ে চিন্তায় আছিস তবে এইটুকু বলতে পারি যে কখনোই কোনো কিছু নিয়ে এভাবে চিন্তা করবিনা শুয়ে বসে। কোনো কিছু নিয়ে খুব বেশি চিন্তা হলে অজু করে এসে নামাজে দাঁড়িয়ে যাবি দেখবি সব চিন্তা নিমিশে দূর হয়ে যাবে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউই তোর চিন্তা দূর করতে পারবেনা মনে রাখিস সবসময়ই। নে পানি খেয়ে অজু করে আয়।”

*
রাইসা ঘুম থেকে জেগেই অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিয়ামের দিকে। সিয়ামের মুখে দুষ্টু হাসি। সব যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে রাইসার, কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। মুখ ফুলিয়ে রাইসা বলে উঠে “কিভাবে কি হয়েছে বলবেন কি আমায় একটু?”________

#চলবে_ইনশাআল্লাহ