শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-০১

0
856

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_০১
#সামিয়া_মেহেরিন

নিজের প্রেমিকের সাথে সৎ বোনের বিয়ে হতে দেখছে অষ্টাদশী মেয়েটি। তার দুই নেত্রপল্লব থেকে অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল।
বিয়েতে আমন্ত্রিত মেহমান বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে। কেউ হয়তো ভাবছে বিয়ের মতো আনন্দময় একটি অনুষ্ঠানে মেয়েটি কাঁদছে কেন। আবার কেউ হয়তো মেয়েটির চেহারার ক্ষত আর কালশিটে দাগের জন্য আড়চোখে তাকিয়ে আছে।

ক্ষত আর কালশিটে দাগগুলো থাকারই কথা। সৎ ভাইয়ের হাতে কম মার তো আর কপালে জোটেনি। কিন্তু বাইরের ক্ষতগুলো অপেক্ষা বন্যার হৃদয়ের ভিতরের ক্ষতটা যে আরো গভীর।

লহমায় তার প্রেমিক অন্যকারো হয়ে গেলো। শাবাব এখন তার সৎবোন জুঁইয়ের বর ভাবতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বন্যার।
———

অমানিশা রাত। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। নিস্তব্ধ গভীর রাতে দোতলা বাড়ির ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে বন্যা। তার দৃষ্টি সুদূর অন্তরীক্ষে স্থির। চোখের কার্নিশ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা উষ্ম তরল গড়িয়ে পড়ে।

-তুমি এই সময় ছাদে কি করছ?

কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছানো মাত্র চমকে ওঠে বন্যা। পেছন ফিরে শাবাবকে দেখতে পায়। তার পরনে এখনো বিয়ের শেরওয়ানি। মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে। বন্যা তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে তার তো চোখ-মুখের অবস্থা এমন হওয়ার কথা না। উল্টে খুশি হওয়ার কথা যতই হোক আজ তার বিয়ে হয়েছে। সে যা চেয়েছে তাইতো হয়েছে।

আজ শাবাব আর জুঁইয়ের কাবিন পড়ানো হয়েছে। জুঁইকে নিয়ে যাওয়া হয়নি আর শাবাবকেও যেতে দেয়া হয়নি। বন্যাদের বাড়িতেই তাদের বাসরঘর সাজানো হয়েছে।

শাবাব পুনরায় তার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় বন্যার দিকে।
-বন্যা, এতো রাতে ছাদে কি করছো?

বন্যার সম্ভিত ফেরে। ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে বলে
-এই প্রশ্ন তো আমার করার কথা। আজ তোমার বাসর রাত অথচ তুমি তোমার বউ ঘরে রেখে ছাদে চলে এসেছো।

বন্যা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে শাবাবের দিকে তাকায়। শাবাব কি বলবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করা শুরু করে। সে কীভাবে বন্যাকে বুঝাবে যে এই বিয়ে সে মানতে পারছে না। অবশ্য না মেনেও কোনো লাভ নেই। এটাই তাদের নিয়তি।
বন্যা শাবাবকে আমতা আমতা করতে দেখে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে। একটা তপ্তশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে।

-জুঁই এখন তোমার স্ত্রী, শাবাব। জুঁইকে বিয়ে যখন করেই নিয়েছো, স্ত্রীর মর্যাদা দিতে কি সমস্যা? ভালো থেকো নিজের স্ত্রীকে নিয়ে। ভুলে যেও বন্যা নামের কেউ তোমার জীবনে ছিল।

শেষ কথাটুকু বলতে বন্যার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে। শাবাবের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে বন্যা সেই স্থান ত্যাগে উদ্যত হয়।
দুই কদম গিয়ে আবার পিছন ফিরে তাকায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে
-ভালোবাসার সাহস যেভাবে দেখিয়েছিলে, ভালোবাসাকে নিজের করার জন্যও যদি একটু সাহস দেখাতে তবে আজ হয়তো আমাদের গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো।

বন্যা নিজের ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। শাবাব তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে তপ্তশ্বাস ছাড়ে। বন্যার বলা কথাটা ভুল নয়। শাবাব চাইলে আজকের গল্পটা অন্যরকম করতে পারত। কিন্তু সে অপারগ।

সারারাত এপাশ-ওপাশ করে ভোরবেলায় বন্যার চোখে ঘুম ধরা দেয়। কিন্তু সেই ঘুম বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। সৎ মায়ের কর্কশ কণ্ঠস্বর কানে যেতেই দ্রুত বিছানা ছাড়ে সে। ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই তার কপালে ভাঁজ পড়ে। বিয়েতো কাল হয়েই গেলো তাহলে আজ আবার এতো আয়োজন কীসের?

সেই মুহূর্তে তার সামনে এসে দাঁড়ায় তার বাবা বারেক সাহেব। বন্যাকে দেখে তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দেন বারেক সাহেব।
-যা এটা পড়ে তৈরি হয়ে নে।

বন্যা কাঁপা কাঁপা হাতে শপিং ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখে ভেতরে একটা লাল জামদানি শাড়ি। কিন্তু এই শাড়ি তাকে কেন পরতে বলা হচ্ছে তা বন্যার মাথায় ঢুকলো না। বারেক সাহেব বন্যাকে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেঁতে উঠেন। বন্যা কি করবে ভেবে পায় না। বাবাকে রাগতে দেখে সে আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

ঘরে যাওয়ার জন্য পিছনে ফিরতেই সৎভাই জায়ানকে দেখতে পায়। বন্যা মাথা নিচু করে জায়ানকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

এদিকে বারেক সাহেব আজ মহাখুশি। মেয়ে নামের এই বোঝা এবার তার ঘাড় থেকে নামবে বলে কথা। জায়ান বাবার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে
-বাবা, ওর বিয়ে দিবে ভালো কথা, কিন্তু তাই বলে…

জায়ান তার কথা শেষ করতে পারে না। তার আগেই বারেক সাহেব বলতে শুরু করেন।
-যা হচ্ছে হতে দেতো। যত তাড়াতাড়ি আপদ বিদেয় হবে ততই ভালো।

বন্যা নিজের ঘরে প্রবেশ করে দেখে সেখানে আগে থেকেই জুঁই এসে দাঁড়িয়ে আছে। বন্যাকে ঘরে আসতে দেখে জুঁই মুখে বাঁকা হাসির রেখা টানে। বন্যার দিকে এগিয়ে যায়।

-কিরে, খুব শখ ছিল না শাবাবের বউ হওয়ার? বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে গিয়েছিলি। চাঁদ তো পেলিই না উল্টে বুড়ো বর কপালে জুটলো।
কথাটুকু বলে জুঁই ঘর কাঁপিয়ে হাসি দেয়।
——-

লাল জামদানি শাড়িতে সাজানো হয়েছে বন্যাকে। একহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসানো হয়েছে তাকে। আর তার পাশে তাদের এলাকারই এক চল্লিশঊর্ধ্ব মাতব্বর। বন্যা নিরবে নিজের চোখের জল বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে। কাজী সাহেব তাকে কবুল বলতে বললে সে মূর্তির মতো স্থির বসে থাকে।
ওদিকে শাবাব অসহায় দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে চেয়েও পারছে বন্যার জীবন ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করতে।

-বিয়ে বন্ধ করো। আমি থাকতে এই বিয়ে কিছুতেই হতে দেবো না।

এক মেয়েলি কণ্ঠস্বরে বিয়ের আসরে উপস্থিত সকলে মধ্যবয়স্ক মহিলাটির দিকে তাকায়। মহিলাটির পেছনে একজন মধ্যবয়সী পুরুষও রয়েছে। বন্যার কাছে মহিলাটির কণ্ঠস্বর খুব চেনা লাগল বিধায় নিজের হাত দিয়ে ঘোমটা ছড়িয়ে ফেলল। মানুষটাকে দেখে তার মনে একটু আশার ফুটলো। এক ছুটে মহিলাটির কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল।

-খালামণি, তুমি এসেছো! প্লিজ খালামণি, আমাকে বাঁচাও। এই বিয়ে তুমি ভেঙে দাও।
বন্যা আটকা আটকা গলায় কথাটুকু বলে আবার কেঁদে দেয়।

রাত প্রায় ১২টার কাছাকাছি। ঘুমের ভিতর বন্যা কি যেনো বিরবির করছে। সারা শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। হঠাৎ ভয়ার্ত কণ্ঠে “নাহ” শব্দ করে বন্যা লাফিয়ে ওঠে। জোরোসোরো হয়ে হাঁটুতে মাথা গুঁজে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। আজ আবারও সেই একই স্বপ্ন দেখেছে সে। স্বপ্নও বুঝি এতোটা বিভীষিকাময় হয়!

খট আওয়াজ করে তার ঘরের জানালা খুলে যায়। বাইরে ঝড় উঠছে। কালবৈশাখী ঝড়।
বন্যা ধীর পায়ে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে আসা ঝড়ো হাওয়ায় তার কোমর সমান চুলগুলো উড়তে থাকে। পরনে তার ছাইরঙা তাঁতের শাড়ি। শাড়িটা তার খালামণির।

আজ সে তার খালামণি-খালুর সাথে সে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে এসেছে ঢাকায়। তার খালা-খালুর নিজের সন্তান নেই বিধায় বন্যার প্রতি তাদের আলাদা স্নেহ কাজ করে। বন্যার বিপদ জেনে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হয়ে যায়।

বন্যা একদৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ঝড়ের বেগ কমে গেছে। বৃষ্টি কমেনি। এখনো মুষলধারেবৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি বন্যার খুব পছন্দের ছিল। কিন্তু এখন তা অপ্রিয়। ভীষণ অপ্রিয়। এমনি এক বর্ষনের রাতে প্রিয় মানুষটি তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে প্রেম নিবেদন করেছিল।
এখন সবই স্মৃতি। হঠাৎ আজ অনেকদিন পর বন্যার বৃষ্টিবিলাসের ইচ্ছা জাগলো। কিছু না ভেবে সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে চলে গেল।

চারতলা বিল্ডিং। বন্যারা থাকে তিনতলায়। ছাদে এসে বন্যা বেশ বুঝতে পারে বাড়িটা অনেক পুরনো। ছাদের অনেক জায়গায় শেওলা পড়ে পিচ্ছিল হয়ে আছে। ছাদে রেলিং দেয়া নেই। ততক্ষণে বন্যা বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার। হুট করে তার মনে এক ভয়ংকর পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছা ডানা বাঁধতে শুরু করে।

ধীর পায়ে হেঁটে ছাদের শেষ কিনারে চলে আসে। আর এক পা আগালেই হয়তো বন্যার এই ছোট্ট জীবনের আয়ু আরেকটু কমে যাবে। কিন্তু বন্যার সেই মনষ্কামনা যেন পূর্ণ হওয়ার নয়। হঠাৎ এক পুরুষালি কণ্ঠস্বরে বন্যার পুরো শরীর কেঁপে ওঠে।

চলবে!

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।