শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-০২

0
591

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_০২
#সামিয়া_মেহেরিন

-হ্যালো মিস, আরেক পা এগোলে ছাদ থেকে নিচে না, সোজা উপরে চলে যাবেন। উপরে বলতে উপরওয়ালার কাছে।

হঠাৎ এক পুরুষালি কণ্ঠে বন্যার পুরো শরীর কেঁপে ওঠে।কিছু না ভেবে কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে পেছন ফিরতে পা পিছলে পড়ে যেতে নেয়। বন্যাকে বেসামাল দেখে লোকটা তড়িঘড়ি করে এসে এক হাত দিয়ে বন্যার বাম হাত চেপে ধরে আর অন্য হাত যায় বন্যার কোমরে।
আকস্মিক ঘটনায় বন্যা হতভম্ব। নিজেকে সামলে নিতে কিছুটা সময় লেগে যায় তার। যখন নিজের অবস্থান বুঝতে পারে এক ঝটকায় লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। আগে-পিছে না ভেবে ভোঁ দৌড় দেয় বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

এদিকে লোকটা হা করে বন্যার কাজকর্ম দেখে গেলো। মেয়েটা কোনো ভাবে তাকে ভূত-টূত ভেবে নেয় নি-তো? নিজেকে আশ্বস্ত করতে লোকটা নিজের দুই হাত দিয়ে নিজের চেহারার গঠন বোঝার চেষ্টা করে। নাহ, তার চেহারা একদম সুন্দর-স্বাভাবিক মানুষের মতো। তাহলে মেয়েটা এভাবে তার থেকে ছিটকে পালিয়ে গেল কেন?

বৃষ্টির বেগ ততক্ষণে কমেছে। লোকটা এতক্ষণ ছাদের এক কোণায় বসে আপন খেয়ালে টুপটাপ বৃষ্টি পড়া দেখছিল। যেখানে বসে ছিল সেখানে মাথার ওপর টিনের ছাউনি থাকায় সে ভিজে যায়নি। কিন্তু আগন্তুক মেয়েটার হাবভাব তার সুবিধার লাগেনি। তাই-তো মেয়েটা যখন ছাদের কিনারে চলে যায় সেও তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। যার জন্য তাকেও বৃষ্টির পানি মাথায় লাগাতে হলো।

লোকটা নিজের ডান হাত দিয়ে চুলে পরপর দুইবার ঝারি দিয়ে বিরবির করে
-একটা ধন্যবাদ অন্তত আমার প্রাপ্য ছিল বৃষ্টিকন্যা।

গ্রীষ্মকাল বন্যার খুব অপ্রিয়। এই সময় একদিকে যেমন গরম পরে, তেমনি অন্যদিকে সময়ে অসময়ে কালবৈশাখী ঝড়ের অত্যাচার। এইতো আজ সে তার খালু মাজহার সাহেবের সাথে বেরিয়েছিলো জামাকাপড় কিনতে। আসার পথে মাজহার সাহেব বললেন তার জরুরী কাজে অফিসে যেতে হবে। বাসার সামনে বন্যাকে নামিয়ে দিয়ে তিনি রিকশা নিয়ে চলে গেলেন অফিসের উদ্দেশ্যে।
এমন সময় শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। রিকশা থেকে নেমে শুধু রাস্তা পার হয়েছে তাই একদম ভিজে চুপচুপ হয়ে গিয়েছে বন্যা।

বন্যার একটা বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে। কিন্তু দোতলা পর্যন্ত উঠে সে পড়লো আরেক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে। উপর থেকে একটা লোক হাতে ফোন চাপতে চাপতে নিচে নেমে আসছে। বন্যা নিশ্চিত এটা কালকের সেই লোকটা। যদিও কাল সে লোকটার চেহারা পরিষ্কারভাবে দেখেনি তবুও আবছা আবছা ভাবে লোকটার মুখের কাঠামো তার মনে আছে। কি এক অস্বস্তিকর মুহূর্তে সে পড়লো। বুকের ভেতর মনে হচ্ছে কেউ হাতুরিপেটা করছে। কেন যে কাল সে এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়ার দুঃসাহস দেখাতে গেল!

লোকটা নিজ মনে ফোন চাপতে চপতেই নামছে। বন্যার মনে হলো লোকটা বোধহয় তাকে চিনতে পারেনি ভেবে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। লোকটা যে মুহূর্তে তাকে পাশ কাটিয়ে নিচে নামতে লাগল সে ভাবল এই সুযোগে কেটে পড়ি। যেই ভাবা সেই কাজ, দিলো এক দৌড়। কিন্তু তার সেগুড়ে বালি। আবারো সেই পুরুষালি কণ্ঠস্বর।

-এই যে মিস!

বন্যা থামলো। কিন্তু পরক্ষণেই লোকটার ডাক তোয়াক্কা না করে ভোঁ দৌড় দিতে পা বাড়ালো।

-বৃষ্টিকন্যা দাঁড়ান!

বন্যার এবারেও পালানোর পরিকল্পনা সফল হলো না। কি যেন ছিল এই ডাকটায়। যা উপেক্ষা করার সামর্থ্য বন্যার নেই।

বন্যা যে জায়গায় ছিল সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এদিকে লোকটা নিজের ঠোঁট কামড়ে হাসছে। বন্যাকে এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে সে কি সুখ পেলো তা শুধু সেই জানে। বন্যাকে একপলক আপাদমস্তক দেখে নিলো। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।

বন্যা যে সিঁড়িতে দাঁড়ানো লোকটা তার দুই সিঁড়ি নিচে এসে দাঁড়ালো। একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ বন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে অতি নিচু স্বরে বলল
–মায়াবী!

লোকটার মুখে এই একটা শব্দ শুনে বন্যার পুরো শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। লোকটার অভিব্যক্তি বুঝতে লোকটার দিকে তাকালো।
সাথে সাথে লোকটার চোখে চোখ পড়লো বন্যার। সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার সাধ্যি বন্যা দেখাতে পারলো না। পরক্ষণেই আবার চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এবারেও লোকটা ঠোঁট কামড়ে হাসলো। কিছুক্ষণ বন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কিযেন ভেবে নিজের প্যান্টের পকেটে হাত দিলো।

পকেট থেকে কিছু একটা বের করে বন্যার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। বন্যা কি করবে ভেবে না পেয়ে দুই সিঁড়ি উপরে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লোকটা ভ্রু কুচকে একপলক তার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠে দাঁড়ালো। দুই সিঁড়ি উপরে উঠে আবারো বন্যার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। এবার বন্যাকে কোনো প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ না দিয়ে পকেট থেকে বের করা নুপুরটা বন্যার ডান পায়ে পড়িয়ে দিল।

বন্যা চোখ গোলগোল করে ঘটনা হজম করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পায়ের নুপুরটা দেখে সে কিছু আঁচ করতে পারলো। নুপুরটা বন্যারই। বন্যার মায়ের শেষ স্মৃতি। আজ সকালে তার খেয়াল হয় তার ডান পায়ের নুপুরটা নেই। তন্নতন্ন করে পুরো বাড়ি খুঁজেও নুপুরের ‘ন’ ও খুঁজে পেল না। এবার তার কাছে বিষয়টা পরিষ্কার। কাল রাতে হয়তো তার পা থেকে নুপুরটা খুলে গিয়েছিল সে টের পায়নি।

একবার ভাবলো লোকটাকে ধন্যবাদ দিবে। কিন্তু কাল রাতে তার করা বোকামির কথা মনে পড়তেই সে গুটিয়ে গেল। লোকটা তার ব্যাপারে কি ভেবেছে কে জানে! তার চেয়ে বরং মানুষটাকে এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। বন্যা আর কিছু না ভেবে দৌড়ে উপরে উঠে গেল।

এদিকে লোকটা বন্যার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে
-এবারেও আমার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য ছিল, মিস। আপনি কি কোনোভাবে উসাইন বোল্টকে টেক্কা দেয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন?

লোকটা নিঃশব্দে হাসলো। বাম হাত দিয়ে নিজের মাথার পেছনটা চুলকিয়ে এবার একটু শব্দ করেই হাসলো। আবারো বিরবিরিয়ে বলতে লাগলো
-প্রথম দেখায় ভেবেছিলাম আপনার হয়তো উপরওয়ালার কাছে যাওয়ার খুব তাড়া। কিন্তু নাহ, এখন বুঝলাম আপনার উপরওয়ালার কাছে যাওয়ার না বরং কারো হৃদমাঝারে নিজের জায়গা করার তাড়া। একটু বেশিই তাড়া।

ফোন কানে নিয়ে কপাল কুচকে নিজ অফিসের ডেস্কে বসে আছে শাবাব। ফোনের ওপাশে জুঁইয়ের ঘ্যানঘ্যান শুনতে শুনতে সে বিরক্ত। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা ওআর পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। না পেরে কান থেকে ফোন সরিয়ে কল কেটে দেয়। সে বেশ ভালো করেই জানে তার এ কাজের জন্য জুঁই তার মায়ের কান ভাঙাবে আর তার মাও তাকে হাজারটা কথা শোনাতে উদ্যত হবে।
এখন রোজকার সাধারণ ঘটনা এটা। রোজ রোজ জুঁই ফোন করে বলবে তার এটা চাই-ওটা চাই। এমনকি শাবাবের ক্রেডিট কার্ডটা পর্যন্ত সে নিয়ে নিয়েছে। শাবাব মাঝে মাঝে চিন্তা করে জুঁই কি তাকে বিয়ে করেছে নাকি তার টাকাকে। শাবাবের এমন নিয়তির জন্য এতদিন শাবাব তার মাকে দায়ী ভাবতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুলটা তারই। বন্যা তো ঠিকই বলেছিল সেদিন একটু সাহস দেখিয়ে যদি সে বন্যাকে বিয়ে করে নিতো তাহলে আজ তার জীবন এমন অনির্দিষ্ট দিকে এগোতো না।

গোসল সেরে বন্যা গেলো রান্নাঘরে। তার খালামণি মহিমা বেগম সেখানে রান্নায় ব্যস্ত। মহিমা বেগম বন্যাকে দেখে মুচকি হেসে নিজ কাজে মন দিলেন। বন্যাও তার সাথে হাতে হাতে কাজ করে দিতে থাকলো।

হুট করে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করলো বন্যার ছোট্ট মস্তিষ্কে। অকপটে প্রশ্নটা মহিমা বেগমকে করেই ফেললো।
-খালামণি তোমরা না বিদেশে ছিলে?

মহিমা বেগম ঘাড় ঘুরিয়ে বন্যার দিকে তাকিয়ে হেসে জবাব দিলেন।
-ছিলামতো। দুই সপ্তাহ হলো দেশে ফিরেছি। এসে থেকেই সুযোগ খুঁজছিলাম কবে তোর সাথে দেখা করতে যাবো। কিন্তু তোর খালুর নতুন অফিসে জয়েন হওয়ার সাথে সাথে ব্যস্ততা শুরু তাই আর যাওয়া হয়ে উঠছিল না।

-আচ্ছা খালামণি, তোমার সাথে বাবার কোনো যোগাযোগ ছিল না। আমাকে যে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো তা বাড়ির মানুষ ছাড়া কেউ জানতোও না। তাহলে তুমি আর খালু কীভাবে জানলে? আমি নিজেতো তোমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি।

মহিমা বেগম নিজ কাজে মন দিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলেন।
-এত জেনে কি করবি বলতো? বিয়েটা যে হয়নি তার জন্য হাজার শুকরিয়া।

বন্যার বুঝতে অসুবিধা হয় না তার খালামণি তার থেকে কিছু লুকাতে চাইছে। আবার প্রশ্ন করতে যাবে তখনই কলিং বেল বাজলো। মহিমা বেগম বন্যাকে তাড়া দিয়ে বললেন
-বন্যা যাতো দেখ কে এলো। বোধহয় তোর খালু এসছে।

বন্যা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চললো দরজা খুলতে। দরজা খুলতে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে তার চোখ কপালে উঠলো। মানুষটা এখানে কেন এসেছে?

চলবে!