শেষ গল্পটা তুমি পর্ব-০৯

0
362

#শেষ_গল্পটা_তুমি
#পর্ব_০৯
#সামিয়া_মেহেরিন

রাতের আঁধার পৃথিবীকে গ্রাস করেছে। আকাশে আজ চাঁদের অস্তিত্ব হয়েছে বিলীন। ছিটেফোঁটা কিছু তারা লুকোচুরি খেলায় মেতেছে।
কৃত্রিম আলোয় নিজের ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেও মিললো না আদিত্যর ওয়ালেট। বিরক্তিতে আদিত্যর কাপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। ওয়ালেট হারালে সমস্যা নেই কিন্তু ওয়ালেটের ভিতর আদিত্যর ন্যাশনাল আইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স আর ক্রেডিট কার্ড রয়েছে। এসব হারালে মহা মুশকিলে পড়তে হবে ভেবে আদিত্যর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
হুট করে মাথায় এলো বন্যাদের বাসায় ফেলে আসেনি তো। আদিত্য সময় নষ্ট না করে ফোন নিয়ে বন্যার নম্বরে ডায়াল করে। দুইবার রিং হলে বন্যা তার ফোন ধরে।
বন্যা ফোন কানে ধরে চুপ করে থাকে। যা আদিত্যর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটা এখনো সম্পর্কটাতে মানিয়ে উঠতে পারেনি।

আদিত্য স্বাভাবিক গলায় বন্যাকে বলে
-বন্যা, আমি বোধহয় আমার ওয়ালেটটা আপনাদের বাসায় ফেলে এসেছি। একটু দেখুন তো।

বন্যা একবার তার পুরো ঘরে নজর বুলিয়ে যেই না বলতে নেবে ঘরে ওয়ালেট নেই তখনই চোখ যায় বিছানা আর স্টাডি টেবিলের মাঝখানে ছোট চাপা জায়গায় আদিত্যর ওয়ালেটাটা পড়ে আসে।

বন্যা এগিয়ে গিয়ে ওয়ালেটটা উঠিয়ে বিছানায় বসে। আদিত্যকে ছোট্ট করে জবাব দেয়।
-জ্বি, পেয়েছি।
আদিত্যর স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে
-বন্যা কাল ভার্সিটি যাওয়ার সময় ওয়ালেটটা নিয়ে আসবেন প্লিজ।

বন্যার ছোট্ট জবাব-আচ্ছা।
আদিত্যর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে কর কেটে দেয়। হতাশ চেহারা নিয়ে আপন মনে বিরবির করতে থাকে।
-বন্যা, আপনার কে কথা বলতে অসুবিধা হয় নাকি কথা বলার শক্তি পান না কোনটা বলুন তো। একজন মানুষ এতটাও চুপচাষ হয় নাকি আমার সাথেই শুধু এমন অত্যাচার করেন।

ওদিকে বন্যা ভাবে ওয়ালেটটা এখনই তার ব্যাগে ভরে রাখবে। নয়তো কাল যদি নিয়ে যেতে ভুলে যায়!
বন্যা বিছানা থেকে উঠে ওয়ালেটটা ব্যাগে রাখতে যাওয়ার সময় ভুলবশত স্টাডি টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারে ধাক্কা খায়। বিধায় হাতে থাকা আদিত্যর ওয়ালেটটা মেঝেতে পড়ে যায়। নিচু হয়ে ওয়ালেটটা তুলতে গিয়ে বন্যার চোখে ধরা পড়ে অবিশ্বাস্য কিছু। বন্যার কাছে তা অষ্টম আশ্চর্যের চেয়ে কিছু কম না।
আদিত্যর ওয়ালেটে বন্যার ছবি রয়েছে। এও বুঝি সম্ভব! বন্যা কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নীল শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বৃষ্টি বিলাসে মত্ত বৃষ্টিকন্যার ছবি আদিত্য তার ওয়ালেটে সযত্নে তুলে রেখেছে।
———-
বন্যা তার ভার্সিটির পাশের কফিশপটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্যের তীব্র আলোয় চোখ মেলে তাকানো মুশকিল। তবু কিছু করার নেই। আদিত্যর জিনিস তাকে বুঝিয়ে দিয়ে তবে সে ভার্সিটি যাবে। কিন্তু মানুষটার আসার নাম-গন্ধ নেই।
আরো পাঁচ মিনিট কেটে যাওয়ার পর আদিত্যর আগমন ঘটে। বন্যাকে দেখেই অপরাধী গলায় বলে
-মাফ করবেন বৃষ্টিকন্যা। জ্যামে আটকে গিয়েছিলাম।

বন্যা মানুষটার দিকে একপলক তাকায়। ঘামে সাদা শার্টটা গায়ের সাথে আটকে আছে। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা। আদিত্য বাম হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নেয়। বন্যার মায়া হয় মানুষটার জন্যে। ব্যাগ থেকে আদিত্যর ওয়ালেটটা বের করে সামনে ধরে।
আদিত্য ম্লান হেসে ওয়ালেটটা নিয়ে প্যান্টের পকেটে পুরে নেয়। বন্যা মিনমিনে গলায় বলে
-আমার ক্লাস বোধহয় শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি এখন আসি।

বন্যা ভার্সিটির দিকে পা বাড়াতে নিলে আদিত্য পিছু ডাকে।
-বন্যা শুনুন।

আদিত্যর ডাকে বন্যা পিছন ফিরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আদিত্য মুচকি হেসে বলে
-ভার্সিটির পরে দাঁড়াবেন। আমি নিতে আসব।
বন্যা হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে চলে যায়। আর আদিত্য ছোটে তার অফিসের উদ্দেশ্যে।

ভার্সিটির শেষ বন্যাকে আর আদিত্যর জন্য অপেক্ষা করতে হয়ে নি। আদিত্য আগে থেকে এসে হাজির হয়েছে।
বন্যা বাইকে উঠে বসলে আদিত্য বাইক স্টার্ট দেয়। তবে বন্যাদের বাসার রাস্তায় না গিয়ে যায় অন্য রাস্তায়। তা দেখে বন্যা আদিত্যর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
-একি! আপনি বাইক ঘোরালেন কেন? উল্টো রাস্তায় কেন যাচ্ছেন?

আদিত্য হতাশা নিয়ে বলে
-কাল থেকে তো আপনাদের ভার্সিটিতে রোজার ছুটি পড়বে। দেখা হবে না আমাদের। তাই আজ নাহয় একটু বেশি সময় কাটান আমার সাথে।

বন্যা চিন্তিত গলায় বলে
-খালামণি-খালু চিন্তা করবে সময়মত বাসায় না পৌঁছালে।
আদিত্য ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয়।
-তাদের বলে দিয়েছি আজ আমি আমার বউকে নিয়ে আমার বাসায় যাব।

আদিত্য চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে। দরজা খুলে পিছন বন্যাকে আগে বাসায় ঢোকার জন্য ইশারা করে। বন্যা তার সকল জড়তা-দ্বিধাদন্দ নিয়ে বাসায় প্রবেশ করে। চারিদিকটায় চোখ বুলিয়ে দেখে নেয়। দুই রুমের বাসা। সাথে ডাইনিং-ড্রইংরুম। আদিত্য বাসায় ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। বন্যার উদ্দেশ্যে বলে
-এখানে হবে আমাদের টোনাটুনির সংসার। যদিও বাসাটা আমার না, ভাড়া নিয়েছি। আপনার বর ওতটাও বড়লোক নয়। এবার বলুন বাসা পছন্দ হয়েছে।
বন্যা মুখে কিছু না বলে শুধু ঘাড় ঘুরায়। যার অর্থ তার পছন্দ হয়েছে।
আদিত্য কিছু একটা চিন্তা করে বলে
-বন্যা আপনি এক কাজ করুন ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি ততক্ষণে খাবার গরম করি।

তারপর ইশারায় একটা ঘর দেখিয়ে দিয়ে বলে
-এটা আমাদের বেডরুম।

বন্যা বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। যা গরম পড়েছে গোসল করলে বেশি ভালো লাগতো। কিন্তু কিছু করার নেই।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে বন্যা বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। বন্যার মনে প্রশ্ন জাগে। সে যতদূর জানে আদিত্যর বাবা সরকারি চাকুরিজীবী। ঢাকায় তার নিজস্ব বাড়ি আছে। তাহলে আদিত্য আলাদা কেন থাকে?
আদিত্য রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বন্যাকে বাসা দেখতে ব্যস্ত দেখে আফসোসের সুরে বলে
-বরের বাসাটা যতটা মনোযোগ দৃষ্টি দিয়ে দেখছেন, তার একাংশও যদি বরের দিকে দিতেন এই অবলা স্বামীটাও ধন্য হত।

আদিত্যর কথায় বন্যার গালে লাল আভা ফুটে ওঠে। তা দেখে আদিত্য হাসে। ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে বলে
-খাবার গরম হয়ে গিয়েছে। টেবিলে চলুন।

বন্যা বিনাবাক্য ব্যয়ে টেবিলের দিকে অগ্রসর হয়। এই মানুষটার থেকে দূরে গেলেই সে বাঁচে। নয়তো লোকটা লজ্জা দিতে থাকবে।
আদিত্য ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বন্যার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে ঘোর লাগা গলায় বলে
-আপনার দৃষ্টি আমায় ধন্য করে না বৃষ্টিকন্যা, আমায় ধ্বংস করে।

বন্যা আদিত্যর ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপরাহ্নের প্রকৃতি দেখছে। সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে। বাড়ির পাশের খোলা মাঠে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন খেলাধুলায় মত্ত। আদিত্য এসে বন্যার পাশে দাঁড়ায়।
বন্যা তার উপস্থিতি টের পেয়েও কোনো হেলদোল দেখায় না। আদিত্য তার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য খুক খুক করে কেশে বলে
-কিছুদিন পর থেকে স্থায়ী ভাবে এখানে থাকতে হবে আপনাকে বন্যা। তখন নাহয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাচ্চাগুলোর খেলা দেখবেন। এখন একটু এই অসহায় মানুষটার দিকে নজর দিন।

বন্যার ঠোঁটে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফোটে। তবে মুখে কিছু বলে না। তার দৃষ্টি মাঠের বাচ্চাগুলোর দিকেই। কিছুক্ষণ নিরবে কাটে। বন্যা আদিত্যকে প্রশ্ন করে বসে।
-আপনি চাইলে আমাকে বিয়ে করে সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছে আনতে পারতেন। তবু তা করলেন না কেন?

মুহূর্তেই আদিত্যর মুখের রং পাল্টে যায়। ঠোঁটের হাসির রেখা গায়েব হয়ে যায়। কথা ঘোরানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যে হেসে বলে
-ওসব ছাড়ুন তো। আগে বলুন আমার হাতের রান্না কেমন লাগল।

বন্যা আদিত্যর দিকে ফেরে। বেশ ভালোই বুঝতে পারে আদিত্য কথা ঘুরাতে চাইছে। তাই সে আর আদিত্যকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইছে না। বন্যা নিজেও প্রশ্নটা করে অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। হুট করে কথাটা মাথায় আসায় কিছু না ভেবেই প্রশ্নটা করে ভেলেছিল সে।
ম্লান হেসে আদিত্যকে জবাব দেয়।
-আমার হাতের রান্না থেকে ভালো।
বন্যার কথায় আদিত্য হাসে।

সন্ধ্যার আগেই আদিত্য বন্যাকে বন্যাদের বাসায় দিয়ে আসে। বন্যাকে বিল্ডিংয়ের সামনে নামিয়ে দিয়ে সে চলে যায়।
বন্যা আদিত্যর সাথে কাটানো দিনটার কথা ভাবতে ভাবতে বাসায় আসে। বাসায় এসে নিজের শাশুড়ি মা আর ননদ অদিতিকে তাদের বাসায় দেখে একটু অবাক হয় সে। নিজের অবাক হওয়াকে আপাতত মাটিচাপা দিয়ে সৌজন্যতার সাথে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করে।

রাত অবধি দিশারী বেগম আর অদিতি বন্যাদের বাসাতেই ছিল। বন্যার তার শাশুড়ি মা আর ননদকে বেশ ভালো লেগেছে। অদিতির সাথে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই দুষ্টু-মিষ্টি একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।

যাওয়ার আগে দিশারী বেগম বন্যাকে নিজের সামনে বসান। স্নেহ ভরা গলায় বলেন
-আমার ছেলেটা তোমাকে বড্ড ভালোবাসে বন্যা।
বন্যা অবাক দৃষ্টিতে দীশারী বেগমের দিকে তাকায়। দিশারী বেগম মুচকি হেসে বলেন
-শাশুড়ির মুখে এমন কথা শুনে অবাক হচ্ছো তাই তো? অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেটা সত্য আমি তোমাকে সেটাই বললাম।

দিশারী বেগম একটু থামলেন। সময় নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন।
-জানো বন্যা, আমার ছেলেটা না সেই ছোট্ট থেকেই নম্র-ভদ্র ছিল। কখনো গুরুজনদের মুখের ওপর উঁচু গলায় কথা বলেনি। একদম বাবা-মায়ের বাধ্য ছেলে। কিন্তু ওই যে বলে না সঙ্গদোষে লোহা ভাসে।

দিশারী বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
-আমার বড় ভাইয়ের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে দীপ্ত। দীপ্তর সঙ্গদোষে আমার যে ছেলে কোনোদিন একটা সিগারেট পর্যন্ত মুখে দেয়নি সেই ছেলে মদ খেয়ে রাত দুপুরে বাড়ি ফেরে। তোমার শশুরমশাই ছেলের এমন অধঃপতন দেখে কষে একটা চড় বসিয়ে দেন আদিত্যর গালে। সেই যে আমার ছেলেটা ঘর ছেড়েছে। গত দুই বছরে বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত পেরোয়নি।

এবার দিশারী বেগম হেসে দেন। হাসি হাসি মুখে বলেন
-দুই বছর পর ছেলেটা আমার সাথে যোগাযোগ করে। জানো সে আমার কাছে সেদিন কী চেয়েছিল?

আদিত্যর কুকর্মগুলোর কথা শুনে বন্যার খুব রাগ লাগে। মানুষটা নিজে ভুল করেছে, আবার নিজেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। কি অদ্ভুদ সে! ভাবতে ভাবতে দিশারী বেগমের প্রশ্ন তার কানে আসে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দিশারী বেগমের দিকে তাকায়। দিশারী বেগম তার ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত করে বলেন
-আদিত্য তার বৃষ্টিকন্যাকে বিয়ে করার আবদার করে বসেছিল।

দিশারী বেগমের কথায় বন্যার সব রাগ অভিমান ফুরুৎ করে জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। মানুষটার ভালোবাসা দেখে বন্যারও ইচ্ছে করে নতুন করে ভালোবাসতে।

দিশারী বেগম ছলছল দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকিয়ে আবদার করে বসেন।
-বন্যা, আমার বিশ্বাস আদিত্য তোমার কথা কখনো ফেলবে না। তোমার কাছে মা হয়ে আমি অনুরোধ করছি যদি সম্ভব হয় আমার ছেলেটাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। ঘরের ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।

চলবে!