শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-০২

0
345

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#পর্ব_২
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

শ্রাবণ দাঁড়িয়েছে মেঘ ভরা নিসর্গের বারান্দায়। বৃষ্টির ডোরবেল বাজিয়ে বর্ষার নিসর্গের আগমনে সংবাদটি দিয়ে দেয় রেশমীজ্বলা কদম, কেয়া, কেতকী, কামিনী, সাদা গন্ধরাজ, জুঁই, বেলী, হাসনাহেনা প্রভৃতি ফুলের সৌরভ। বর্ষার নিবিড় গুঞ্জরণে চঞ্চল হয়ে ওঠে মন। উদাস ভাবনায় ডুবে যায় সত্তার স্পন্দন। খিড়কিজাগা ভোরের ঊষায় যখন বর্ষণের আবছায়া মুখটুকু জেগে ওঠে, মনে হয় বর্ষার এই রূপ, বাদলদিনের এ ছবিটি এই বাংলারই আদি প্রতিচ্ছবি। যার মর্মে প্রকৃতির আবহমানতা এক অনন্য আবেশে লালিত হচ্ছে পৃথিবী সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের হিসেব কষছে তরু।অনুজের বোন অনুলেখার খালি রুমে তার থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে অনুজের মা।অনুলেখা আপাতত শ্বশুড় বাড়িতে আছে তাই তার খালি রুমেই তরুর আপাতত থাকা ব্যবস্থা হলো।যদিও অনুজের মা চেয়েছিলো তরু যেনো আজ থেকে অনুজের রুমেই থাকে কিন্তু অনুজের কড়া নিষেধে তিনি সে কাজ আর করে উঠতে পারেন নি।তবে সে যাই হোক অনুজ যে এতোদিনে চারুলতার মোহ্ থেকে বেড়িয়ে নতুন করে নিজের জীবনটাকে আবার শুরু করেছে এতেই ওনার শান্তি।আসলে চারুকে ওনার অতোটাও অপছন্দ নয় কিন্তু প্রতিটি মা-ই চায় তার সন্তান যেনো সুখে থাকে।আর তার মতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে সন্তানই হলো একমাত্র মাধ্যম যা তাদের সারাজীবন এক করে রাখে,সংসারী করে তোলে।সেখানে চারুর যখন এটাই সবচেয়ে বড় অক্ষমতা সেহেতু তার ছেলে কেনো সারাজীবন একটা চাপা আর্তনাদ নিয়ে বাঁচবে।তাইতো তিনি মনে প্রাণে চাইতেন তার ছেলে আবার বিয়ে করুক।অবশেষে ছেলের যে মতি ফিরেছে এতেই তিনি মহা খুশি।এখন তরুর গর্ভে যদি তার বংশের বাতি জন্মায় তাহলেই তার যেনো শান্তি।

তরুর জীবনটা আজ একটা ভুলের কারণে সম্পূর্ণ তছনছ হয়ে গেছে। পরিবারের সবচেয়ে ছোট আর আদরের মেয়ে থেকে যে সে আজ সবচেয়ে খারাপ হয়ে গেছে এটা তরুর বুঝতে একটুও বেগ পেতে হচ্ছে না। কিন্তু সে যে সত্যিই নিরুপায় হয়ে এ কাজটা করতে বাধ্য হয়েছে। তা না হলে সে কি কখনো নিজের বড় বোনের সতীন হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভেবেছিলো!
কিন্তু মানুষ যা চায় তা পায় না,যা পায় তা চায় না এ বাক্যটি যেনো আজ তরুর সাথে বড্ড মিলে যাচ্ছে। আচ্ছা তার আপুমনির কী খুব কষ্ট হচ্ছে তার এই কাজে,সে কী আর কোনদিন কথা বলবে না তার তরু পাখির সাথে,আর জেঠু-জেঠিমাই বা কি করবে সবটা জানার পর।মা-বাবা হারানো যে মেয়েকে তারা নিজের মেয়ের চেয়ে কোন অংশে কম ভালোবাসা দিয়েছে, যাকে তারা বড় করেছে আজ সেই কিনা তাদের মেয়ের জীবনের বিচ্ছেদের কারণ হয়ে গেলো।আচ্ছা জেঠিমা কী খুব কষ্ট পাবে?আর জেঠুই বা কি করবে এসব নানা এলোমেলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তরুলতার মনে।ভাগ্য আজ তাকে সম্পর্কের এ কোন টানাপোড়েনে এনে দাঁড় করিয়েছে তার কোন কূল-কিনারা পাচ্ছে না সে।কিন্তু এ কাজ করা ছাড়া তারও যে কোন উপায় ছিল না। সে যে ব্ড্ড নিরুপায়,বড্ড অসহায়।
__________________________________
=কোথায় যাচ্ছো এসব নিয়ে লতা?

নিজের সবকিছু গুছিয়ে যখন চারু চলে যাচ্ছিলো তাদের রুম ছেড়ে তখনই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুজ তাকে কথাটি বলল।
অনুজের এমন প্রশ্ন শুনে চারু একটা তাচ্ছিল্যভরা হাসি হাসলো।অনুজের এমন একটা প্রশ্ন করা যেনো তার বোকামির প্রমান দিচ্ছে আজ।চারু অনুজের দিকে না তাকিয়েই বলল,

=আজ থেকে এ ঘরের অধিকার অন্য কারোও।তাই তাকে স্থান দিয়ে চলে যাচ্ছি।

বলেই সে অনুজকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে অনুজ তার দুহাত দিয়ে চারুর কোমড় জড়িয়ে তাকে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসলো।
অনুজের হঠাৎ এমন একটা কাজে অনেকটা হকচকিয়ে গেলো চারু,মুহূর্তেই আবার নিজেকে অনুজের কাছ থেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিলো সে।
তবে অনুজ তখনো স্থির দৃষ্টিতে তার চারুলতার দিকে তাকিয়ে আছে।যেনো সে বুঝার চেষ্টা করছে চারুর মনের কথা।

=কি হচ্ছেটা কী অনুজ।সামনের রুমেই আপনার নতুন বউ বসে আছে আর আপনি কিনা এখন পুরনো বউয়ের কোমড় জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।সে দেখলে কি ভাববে বলুন তো।
বলেই আবার মোচড়ানো শুরু করে সে।
অনুজ তবুও চুপ।
চারু আবারোও ধরা গলায় বলে,

=কি হলো ছাড়ুন আমাকে।এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো।

=এতোই যখন কষ্ট হচ্ছে তবে আমাকে বিয়ে করতে ওতো জোড় করেছিলে কেনো লতা।আমার পাশে অন্য কাওকে দেখলে যার এতোটা জ্বলে সেই আমাকে বিয়ে করো বিয়ে করো বলে কানের মাথা খেয়েছে।আর আজ তারই কিনা চোখে জ্বল!
মুচকি হেসে স্থির চোখে চারুর দিকে তাকিয়ে বলল অনুজ।
অনুজের কথায় চারুও হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলো,আবার পর মূহুর্তেই উঁচু গলায় বলল,

=তাই বলে আপনি আমার ছোট বোনটাকেই বিয়ে করবেন এতোটাও আমি আশা করিনি অনুজ।

=তুমিতো আর আমাকে নিষেধ করোনি যে আমি তোমার কোন বোনকে বিয়ে করতে পারবো না।

=সব কি মুখে বলে দিতে হয় অনুজ।তরুকে তো আপনি পিচ্চি বলে ডাকতেন।আর আজ তাকেই কিনা আমার সতিন বানালেন?
বিষ্ময়কর চাহনি নিয়ে ধরা গলায় বলল চারু।
মুচকি হেসে চারুকে নিজের আরোও কাছে টেনে নিয়ে অনুজ বলল,

=তুমি চেয়েছো আমি বিয়ে করি, আমি তাই করেছি।এখন আমি যা চাইবো তুমি তাই করবে।তা না হলে তোমার বোনের জীবন আমি নরক করে দিবো।তরু তোমার জন্যই নিজের জীবনের এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলো এখন তুমিই ভেবে দেখো তুমি কী করবে।

=মানে,,,

=আমি অনেক ক্লান্ত লতা।এখন তোমাকে ওতো মানে টানে বুঝানোর এনার্জি আমার নেই।
শুধু একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো আমি শুধু তোমার কথা রাখতেই তরুকে বিয়ে করেছি।এখন আমি যা বলব তুমি তাই করবে।যেমন- এখন তুমি এ রুম ছেড়ে কোথাও যাবেনা,এখন কেনো কোনোদিনও যাবেনা।এরুম থেকে যদি তুমি বের হও তবে সেটা তোমার নিথর দেহো বের হবে বুঝেছো!
বলেই চারুলতার অধরে নিজের ঠোঁট আলতো করে ছুঁইয়ে তাকে ছেড়ে দিলো অনুজ।এরপর জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।

এদিকে অনুজের কথার কোনো মানেই খুঁজে পেলো না চারু।হ্যাঁ এটা ঠিক যে সে নিজেই অনুজকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছে কিন্তু সেটাতো নিজের ইচ্ছেতে নয়।তার শাশুড়ীর চাপে পড়ে সে এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে।কিন্তু তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিলো যে অনুজ আর যাই করুক তাকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিয়ে কখনোই করবেনা।তাইতো সে গতরাতে অনুজকে অমন ভাবে বলেছিলো শাশুড়ির সামনে।কিন্তুু রাতেও তো সে বুঝতে পারেনি অনুজ এমনটা করবে।বরং প্রতিদিনকার মতন গতরাতেও অনুজ তাকে পরম আদরে নিজের বাহুডোরে নিয়ে ঘুমিয়েছে। চারুর মাথায় নানারকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। হচ্ছেটা কী এসব তার সাথে।তারপরই তার মনে হলো অনুজ তাকে কিছু না বললেও তরুতো আছে।তরুকে জিজ্ঞেস করলেই সে সবটা বলে দিবে তাকে।এটা মাথায় আসতেই হাতের জিনিসগুলো রুমের এক পাশে রেখে সে তরুর খোঁজে বের হয়ে গেলো।

________________________________________
=আমাকে সবটা বল পিচ্ছু, কি এমন ঘটেছিলো যে তুই শেষ পর্যন্ত নিজের বোনের সংসারটা ভাঙতে তারই সতিন হয়ে এলি?
তরুর রুমে ঢুকেই তার দিকে এমন একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো চারু।চারুকে নিজের রুমে দেখে তরু মনে মনে এমন কিছুরই আশংকা করছিলো।
কিন্তু এখন সে কি জবাব দিবে তার আপুমনিকে,কি বলবে সে,সেতো নিরুপায় হয়ে এমনটা করতে বাধ্য হয়েছিলো কিন্তু কি কারণে তা তো এখন কাওকে সে বলতে পারবে না।বললে যে সবটা শেষ হয়ে যাবে।সমাজকে যে বড্ড ভয় পায় তরু।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তরু।তা দেখে চারুর অনেকটা রাগ হয়।সে দরজার সামনে থেকে আরোও কিছুটা হেঁটে ভিতরে গিয়ে তরুর সামনে দাঁড়িয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,

=কিরে বল কেনো করলি আমার সাথে এমনটা।আমি তো তোকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবেসেছি।আর সে তুই কিনা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করলি।বল কেন করেছিস বল।
বলতে বলতে হঠাৎ ক্ষিপ্র হয়ে উঠলো চারু।সে তরুর দু-বাহু ঝাঁকিয়ে বারংবার একই প্রশ্ন করতে লাগলো।তখনই পিছন থেকে অনুজ বলে উঠলো,

=ওকে ছেড়ে দাও চারুলতা!
অনুজের মুখে চারুলতা নামটি শুনে অনেকটা শান্ত আর অবাক হয়ে গেলো চারু।কেননা অনুজ তাকে কখনোই লতা ছাড়া অন্য কিছু ডাকেনা।আর যখন তার উপরে কোনো কারনে রেগে যায় কেবল তখনই তাকে চারুলতা বলে ডাকে।তবে কী এখন অনুজ তার উপর রেগে গেছে।কিছুটা ভেবে তার মনে হলো হ্যাঁ রাগবেই তো তার নতুন বউকে এমন ভাবে জিজ্ঞেস করছি বলেই হয়তো রেগে গেছে।এতো প্রেম ভাবা যায়।অথচ কিছুক্ষণ আগেই তাদের রুমে লোকটা তার সাথে কতটা প্রেমময় আচরণ করেছে।তখন একবারের জন্যেও চারুর মনে হয়েছিলো এসব কিছু মিথ্যে, অনুজ আর তরু তার সাথে মজা করছে।কিন্তু এখন,
ঘুরে তাকালো চারু অনুজের দিকে।
অনুজ চারুর সামনে এসে বলল,

=রুমে যাও চারুলতা।সারাদিন আমাদের উপর অনেক ধকল গিয়েছে এখন আমরা একটু ঘুমাবো।তুৃমি যাও।

তুমি যাও কথাটি যেনো পুরো ঘরে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো চারুর তেমনটাই মনে হলো।নাহ্ তার মনের কোনো এক কোনে যপ ক্ষুদ্র আশাটুকুও ছিলো তাও আর নেই অনুজের একথা শুনার পর।সবটা সত্যি, সে কোনো স্বপ্ন দেখছেনা,সবটা ধ্রুব সত্যি যা তাকে কষ্ট করে হলেও মেনে নিতে হবে।আবারোও দু-চোখ ভর্তি পানি নিয়ে ছুটে বেড়িয়ে গেলো সে।
শ্রাবণের ধারা যে কেবল শুরু হয়েছে মাত্র, এ ধারার শেষের যে অনেক দেরি তাতো চারু জানে না!

চলবে,,,,,,,,,