শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-০১

0
578

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#সূচনা_অংশ
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

সন্তান জন্মদানে অক্ষমতার শাস্তি স্বরুপ যে, নিজের ছোট বোনকে সতীন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এমনটা স্বপ্নেও কখনো ভাবেনি চারুলতা।

কিন্তুু ভাগ্য তাকে আজ এমন একটি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখে দাঁড় করিয়েছে। তার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে গতরাতেও যে মানুষটা তাকে পরম যত্নে নিজের বুকে আগলে নিয়ে ঘুমিয়েছিল সে মানুষটা সকাল হতেই তাকে এমন কিছু উপহার দিবে।
আর অন্যদিকে নিজের সবচেয়ে আদরের সবচেয়ে প্রিয় বোন-ই যে তার জীবনের এতো বড় ভাঙ্গনের প্রত্যাক্ষ দোষী হবে তাও যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না তার।আজ এক মূহুর্তে সে শুধু নিজের স্বামী-সংসার আর প্রিয় বোনটিকেই কেবল হারায়নি একই সঙ্গে সে হারিয়েছে বিশ্বাস নামক একটা শব্দকেও।

বিশ্বাস কী অদ্ভুত একটা শব্দ তাই না?যেখানে একই সাথে বিষ এবং আশ্ব দুটো শব্দই রয়েছে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে।যার মধ্যে আজ থেকে চারুর কাছে বিশ্বাস শব্দটি একটি বিষ বৃক্ষের মতন আকার ধারণ করেছে।এ জীবনে সে যে আর কখনোই কাওকে বিশ্বাস করতে পারবে না,কারণ তার বিশ্বাসের ভিত টা-ই যে আজ সম্পূর্ণ নড়ে গেছে।

টলমল চোখে সে তার সামনে চুপচাপ বসে থাকা নবদম্পতিকে একবার দেখে নিয়ে এতোক্ষণে ছুঁটে চলে গেলো ভিতরের দিকে। অনুজ চারুলতা বলে ডাক দিতেই মুখ খুলতে যাচ্ছিলো তখনই এতোক্ষণ চুপ করে বসে থাকা তার বাবা মুখ খুললেন,

=শেষ পর্যন্ত বউমার ছোট বোনকেই তোমার বিয়ে করতে হলো অনুজ।আর তুমিই বা কেমন বোন তরু যে কিনা নিজের বোনের স্বামীকে বিয়ে করে নিলে।

মহসিন হাসানের কথা শুনে নিরবে কান্না করতে থাকা তরু আরও ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো।এতে করে মহসিন হাসান আরও কিছুটা বিরক্তিকর গলায় বললেন,

=যা করার তা তো করেই ফেলেছো এখন আর কেঁদে কী হবে।

তখন অনুজ তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

= বাবা তরুর এতে কোন দোষ নেই যা করার বা যা হয়েছে সবটাই আমার ইচ্ছেতেই হয়েছে।তোমরা শুধু শুধু ওকে দোষারোপ করো নাহ্।

=ছি্ অনুজ তোমার এতোটা অধঃপতন হয়েছে যে ঠিক বেঠিক সব ভুলে গেছো।শেষ পর্যন্ত নিজের বোনের মতন শালীকেই বিয়ে করে ঘরে তুললে।ছি্

=আহ্ তুমি এমন ছি্ ছি্ করছো কেনো।বউমা আর তরুতো আর আপন বোন নয় যে অনুজ তাকে বিয়ে করতে পারবে না।আর আমার ছেলের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে দুটো বউয়ের খরচ একসাথে চালানোর।বড় বউমার সব কিছু ঠিকঠাক চললেই তো হলো।
অনুজের মা তরুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কথাগুলো বলল।
মেয়েটাকে ধমকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছো কেনো!

=দেখ অনুজের মা তুমি যে বউমা কে বিশেষ পছন্দ করো না তা আমি জানি।তাই বলে এতোটা পক্ষপাতীত্ব করছো দেখে আমি অবাক হচ্ছি।তুমিই তো বউমাকে পছন্দ করে এ বাড়ির বউ করে এনেছিলে আমার অমতে।আজ সে তোমারই চক্ষুশুল হয়ে গেলো যে তার সাজানো সংসার ভাঙতেও তোমার একটুও খারাপ লাগছে না।

=আমি তো আর আগে থেকে জানতাম না ওই মেয়ে একটা আঁট খুরো। জানলে কখনো ওকে এ বাড়ির বউ তো দূরের কথা বাড়ির আশেপাশেও জায়গা দিতাম না।
নাক শিটকে অনুজের মা রহিমা এ কথাটি বলতেই অনুজ তার মাকে বলল,

=মা তোমাকে কতবার বলেছি চারুলতাকে এসব না বলতে।সবটা তো তোমার ইচ্ছেমতনই হচ্ছে। এবার অন্তত ওই মেয়েটাকে একটু রহম করো।
বলেই সে হনহন করে বেড়িয়ে গেলে ড্রয়িং রুম থেকে।
____________________________________
একেক করে রুমের প্রতিটি কোন থেকে নিজের ছোট থেকে ছোট্ট সকল জিনিসপত্র একত্র করে মেঝেতে রাখছে চারু।তিনবছরের সাজানো সংসার, সাজানো ঘর যে তার আর নিজের নেই।বিয়ের পর থেকে অনুজের রুমটার উপর তার যে অধিকার ছিল আজ থেকে তা যে আর তার নেই।তার অনুজ-ই যে এখন ভাগ হয়ে গেছে অন্য কারো মাঝে।আজ থেকে এ ঘর, এ সংসার এমনকি অনুজের উপরোও যে অন্য কারোও অধিকার তৈরি হয়ে গেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা সে অন্য কেউ টা আর কেউ নয় তারই আদরের বোন।

থাকবে না সে আর এ বাড়িতে।নিজের বাবার বাড়িতেও যাবেনা ঠিক করেছে।ইশ্ মেয়েদের যদি একটা নিজের বাড়ি হতো তবে কত ভালোই না হত,তখন তাকে আর আত্মসম্মানের হানি করে অন্যের অনুগ্রহ নিয়ে বাঁচতে হতোনা।আজ চারুর বারংবার মনে হচ্ছে প্রতিটি মেয়ের একটা নিজের বাড়ি থাকার বড্ড দরকার,ভীষণ ভাবে দরকার। নিজের বাড়ি না থাকলে অন্তত নিজের খরচ চালানোর সামর্থ্যটা থাকার দরকার।যতই বাবার,বা স্বামীর অঢেল টাকা থাকুক না কেনো।বিপদের সময় নিজের বলতেও কিছু থাকার জন্য একটা মেয়েকে স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে তার যে একটা আত্মসম্মান আছে তা যেনো এ সমাজ ভুলেই যায়।
ভাগ্য সহায় চারুর যে অন্তত সুখের সাগরে ভেসে নিজের পড়াশোনাটাকে বিসর্জন দেয়নি।আজ এমন দূর্যোগে তার এই পড়াশোনাটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা হারে হারে বুঝছে সে।অবশ্য এ পড়াশোনা শেষ করার পিছনেও অনুজের অবদান অনেক।হয়তো তার এমন একটা দিন আসবে বলেই সেদিন আল্লাহ অনুজকে দিয়ে তার এই উপকারটা করেছে।তাইতো আজ যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যাবে চারু,কিন্তু আর কারোও অনুগ্রহে সে থাকবেনা।

এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করেই চারুর চোখ যায় দেয়াল জুড়ে টাঙানো মস্ত বড় একটা ছবির দিকে। তার আর অনুজের হাস্যজ্জল মুখগুলো যেনো এখনো জ্বল জ্বল করছে ছবিটার মধ্যে। আলাদা একটা প্রাণ আছে যেনো ছবিটার মাঝে। অশ্রুসিক্ত চোখে ধীর পায়ে মোহাচ্ছন্ন ভাবে হেঁটে যায় সে ওই ছবিটার দিকে।

ছবিটি তার আর অনুজের হানিমুনে থাকাকালীন তোলা একটি ছবি।
বিছিয়ে রাখা মনোমুগ্ধকর জায়গায় ঘোর বর্ষায় বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে গিয়েছিলো তারা।
কষ্টকর যাত্রার ক্লান্তি নিমিষেই চলে গিয়েছিলো পাহাড়ের হাতছানিতে। মেঘে ঢাকা পাহাড় যেন ডাকছিলো চারুকে। আর সে ডাক কি এড়ানো সম্ভব? পাহাড়ের বুকের মধ্যে ঝর্না গুলো থেকে অবিরাম জল পড়ছিলো।ওই ঝর্না গুলো যেন নিদারুন উদাসীন ও নির্বিকার। একটা জায়গা যে এরকম নির্বিকার অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে তা কখনো ভাববেইনি চারু।সভ্যতার বিবর্তন,বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, মানুষের দ্রুত পরিবর্তন কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। এই প্রকৃতির কাছাকাছি এসে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র ও অপাঙ্কেয় মনে হয়।চোখের ভেতরে জমে থাকা সবটুকু ক্লান্তি নিয়ে পরিত্রান খুঁজতে খুঁজতে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলো চারু কোথাও যদি দুদন্ড শান্তির দেখা মেলে!!বিছানাকান্দি—-আমায় শান্তি দিয়েছ তুমি!চারু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চিৎকার করে বলল।
চারুর হাসোজ্জল মুখ দেখে তার দিকে মুগ্ধতার হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো অনুজ।তখনই কোনো এক ভ্রাম্যমান ক্যামেরা ম্যানের ক্যামেরা বন্দি হয়েছিলো তারা দুজন।পরে সন্ধ্যায় যখন তারা কটেজের উদ্দেশ্যে ফিরে আসছিলো তখনই ওই ফটোগ্রাফার তাদের দাঁড় করিয়ে কয়েকটি ছবি দিয়েছিলো।চারু প্রচন্ড খুশি হয়েছিল ছবিগুলো দেখে আর চারুর চোখে মুখে খুশির ঝলক দেখে তৃপ্ত হয়েছিল অনুজও।পরে ঢাকায় ফেরার পর এক সন্ধ্যায় সেই ছবিগুলোর মধ্যে থেকে এ ছবিটি রুপোলী কাঁচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে এনে আরেকদফা অবাক করে দেয় অনুজ তার চারুলতাকে।

চোখ বুঝে চোখে জমা জলটুকু ফেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল চারু।কি সুন্দর ছবির মতন রঙিন ছিলো দিনগুলো, এ যেনো কোনো এক ঊপন্যাসিক এর কলমের আঁচড়ে লেখা কোনো রুপকথার গল্প ছিলো।কত প্রেম,কত মান-অভিমান, কত আমোদ-প্রমোদের মধ্যে ছিলো সে দিনগুলো।কিন্তু একটা রিপোর্ট-ই যেনো কাল হয়ে এলো তার জীবনে।শশুর বাড়ির লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে যখন সে ছিলো অপয়া,অলক্ষি,আট খুঁড়ো, অপমানে অপমানে সে যখন প্রতিনিয়ত শেষ হয়ে যাচ্ছিলো তখন এক সমুদ্র সমান ভালোবাসা নিয়ে তার পাশে ছিলো অনুজ।এই একটা মানুষের ভালোবাসায় নিজেকে সামলেছে সে কিন্তু আজ সে মানুষটাও তাকে পর করে দিয়ে অন্য কারোও সাথে বেঁধেছে ঘর। তার কথাতে যে মানুষ টা সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিবে তাও নিজের বোনকে তা হয়তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি।তাইতো এখন তার আর কিছু বলার নেই সবটা মেনে নেয়া ছাড়া।আচ্ছা ভালোবাসলে কী ছাড়া যায়,নাকি মেনে নেয়া যায়?শ্রাবণের এই বারিধারা যেনো তার জীবনে সারাজীবনের জন্য নেমে এসেছে। শ্রাবণের এই কালো ঘনঘটায় সে সব কিছু হারিয়ে ফেলল এক নিমিষে,,,,,,,,,,,,,

তারপর চলবে,,,,,