শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-০৩

0
298

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#পর্ব_৩
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

রাতের আধার শেষ হতে না হতেই চারিপাশে স্নিগ্ধ প্রলেপ মাখিয়ে আবার শুরু হলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। শ্রাবণের বৃষ্টির মৃদঙ্গ সুরে যেনো প্রাণে হিল্লোল বয়ে যাওয়ার যোগার, যতদূর দৃষ্টি যায় দেখা যায় বিরামহীন বৃষ্টি রিমঝিম ছন্দের তাল বোনছে। যে তালে নিজেকে ছাপিয়ে নিয়ে যেতে মন চায় অনন্য এক সৌন্দর্য্য।কয়েকদিনের একটানা বর্ষণকে বাংলায় সাওতা বলে। সাওতায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম বর্ষণের পর বর্ষণ হয়। সেই বর্ষণে এলোমেলো পাগলা হাওয়ায় একপায়ে দাঁড়িয়ে তাকে অনুভব করা যে কতটা প্রশান্তির তা যে না করেছে সে কখনো বুঝেনি।অন্য কোনো সময় হলে হয়তো আজও চারু -তরু দু বোন একে অন্যের সাথে তাল মিলিয়ে এ বর্ষনের সাক্ষী হতো ঠিক যেমন এতোগুলো বছর হয়ে আসছে।
কিন্তু অতীতের সাথে বর্তমানের আজ বড্ড ফারাক।তাইতো দু বোন আজ একই ছাঁদের নিচে থেকেও একে-অপরের থেকে কতটা দূরে।


সারারাত নির্ঘুম রাত কেটেছে চারুর।আর কাটবেনাই বা কেনো যার ঘর ভাঙে সে কী নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে?চারদিকে ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।পুরোটা রাত সে ঠায় বসে কেঁদেছে নিজের জীবনের এমন আকস্মিক বিপর্যয়ের জন্য। আজানের ধ্বনি কানে আসতে তার গতকাল ভোরের কথা মনে পড়ে যায়।এইতো গতকালও অনুজ এই সময়টা তাকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বেঘোরে ঘুমুচ্ছিলো আর আজ হয়তো একইভাবে তরুকেও,,,আর ভাবতে পারছেনা চারু।তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।সে বসা থেকে উঠে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে নিজেকে তৈরি করে নিলো।এরপর জায়নামাজে নামাজ শেষ করে আল্লাহর কাছে তার কতশত অভিযোগ যা বলে শেষ করা যাবেনা।


সকাল সাতটা,
কলিং বেলের অনবরত আওয়াজে রহিমা বেগম উঠে এলেন জায়নামাজের বিছানা থেকে বিরক্ত মুখে।অনুজের মায়ের এটা নিত্যদিনকার অভ্যেশ ওনি সকাল ৮টার আগে জায়নামাজ থেকে উঠেন না।আর অনুজের বিয়ের পরেই এই অভ্যেশটা ওনার বেশি করে হয়েছে।সংসারের প্রায় সমস্ত কাজই চারু করে ওনি শুধু বলে দেন কি কি করা লাগবে।আর অন্যদিকে বাসায় ছুটা কাজের লোক দুজন আছে তারাও ৮টার পরে আসে।
কিন্তু আজ এতোবার কলিং বেল বাজলেও কেউ যখন দরজা খুলল না তখন তিনি অনেকটা বিরক্ত হলো চারুর উপর তারপর আবার পরিস্থিতি মাথায় আসতেই বিরক্ত মুখে উঠে গেলেন।

দরজা খুলতেই রহিমা বেগম অনেক টা হকচকিয়ে গেলেন দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখে।
বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো অনুজের মায়ের অভিব্যাক্তির তোয়াক্কা না করেই ওনাকে এক প্রকার সরিয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে এলেন।এসেই তরু তরু বলে চিৎকার করতে লাগলেন একজন।
তরু পরিচিত গলার আওয়াজ পেয়ে দ্রুত অনুলেখার রুম থেকে বেড়িয়ে ড্রয়িং রুমে ছুটে এলো,একই সঙ্গে চারুও এসে দাঁড়ালো নিশ্চুপভাবে।

ডাকতে থাকা আগুন্তকঃ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তরুর কাছে।তরুর সামনে আসতেই তার দু-বাহু চেপে ধরে বলল,

=ছোট থেকে আজ ১৮ বছর পর্যন্ত এক মুহুর্তের জন্য তোকে নিজের মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু কখনো ভাবিনি।নিজের মেয়ের সমস্ত কিছুর ভাগ তোকেও সমান ভাবে দিয়ে গেছি।তাই বলে আজ তার স্বামীর ভাগও নিয়ে নিলি তুই তরু।
ঠান্ডা গলায় প্রশ্নগুলো করলো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি।তরু তার কথায় নিশ্চুপভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এই প্রশ্নগুলোর কী জবাব দিবে তা তো সে জানে না। তাই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা আগুন্তুক তরুর কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে আরও জোরে জোরে তাকে ঝাঁকিয়ে প্রলাপের মতন বারে বারে একই কথা জিজ্ঞেস করছে,

=কেনো করলি তরু,কেনো আমার মেয়ের জীবনটা শেষ করে দিলি,ওর সুখটুকুও তোর শ্বয্য হলো না।ওর স্বামীটাকেও ভাগ করে নিলি।তোর কী ছেলের অবাব হতো, তুই কেনো আমার মেয়ের জীবনটা তছনছ করে দিলি।

চারুর মা বারে বারে একই কথা বলতে বলতে অনেকটা শ্বাস উঠে যায় তার।চারুর মায়ের মারাত্মক রকম শ্বাসের সমস্যা আছে।বেশি উত্তেজিত হওয়া ওনার শরীরের জন্য ভালো নয়।সেটা তরুও জানে তাই সে তার জেঠিমাকে শান্ত হতে বললে চারুর মা তরুকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দিলো যাতে করে তাল সামলাতে না পেরে তরু প্রায় পিছনের একটা টেবিলে ধাক্কা খেতেই যাচ্ছিলো তখনই পিছন থেকে কেউ একজন তাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। তরু নিজেকে সামলে পিছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো অনুজ তাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

=তরু তুমি ঠিক আছো।কোথাও লাগেনি তো!
মাথা নাড়িয়ে না বলল তরু।

অবাক হয়ে চারু তার অনুজকে দেখছে।কাল অবধি যেভাবে সে তাকে আগলে রেখেছে সকল কিছু থেকে সেভাবেই আজ তরুকে আগলে রাখছে।সময়ের সাথে তাহলে সত্যি সত্যিই সব কিছু বদলায় তা বুঝে গেলো চারু।এদিকে অনুজের উপস্থিতি আরও বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছে চারুর মাকে।তিনি অনুজের দিকে এগিয়ে গিয়ে জোর গলায় বলল,

=আমার মেয়েকে দিয়ে তোমার চলছিলো না সেটা আমাদের বললেই হতো,তা না করে তুমি তারই চাচাতো বোনকে তার সতিন বানিয়ে আনলে অনুজ!
আমরা তো বিয়ের সময় আমাদের মেয়ের সকল দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম।এ তোমার দায়িত্ব পালনের নমুনা?

=আম্মা আপনি এতো অবাক হচ্ছেন কেনো?
আমিতো আপনার মেয়ের কথাতেই দ্বিতীয় বিয়ে করেছি।বিশ্বাস না করলে তাকে জিজ্ঞেস করুন সেতো এখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

চারুর মা অনুজের কথায় নিজের মেয়ের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো।চারুর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকায় তিনি বুঝে নিলেন অনুজের বলা কথাই সত্যি। তবুও তিনি দমে না গিয়ে আবার বললেন,

=তাই বলে তুমি বিয়ে করে নিবে।ও যদি এখন তোমার কাছে আকাশের চাঁদ চায় তাহলে তুমি কী ওকে তাই এনে দিবে।তুমি কী আমাকে ছেলে ভুলানো কথা বলছো অনুজ!

=নাহ্ আম্মা আমি আপনাকে কোনো ছেলে ভুলানো কথা বলছিনা।বিয়ের পর থেকে আমি আপনার মেয়ের কোনো আবদার বা ইচ্ছে অপূর্ণ রাখিনি।তাই তার এ চাওয়াটাও পূরণ করে দিয়েছি।আর রইলো বাকি লতা আমার কাছে চাঁদ চাইলে আমি তা এনে দিবো কিনা এ প্রশ্ন, তাহলে আমি বলব আম্মা আকাশের চাঁদ তো অনেক তুচ্ছ আমার কাছে আপনার মেয়ে যদি আমার প্রানটাও চায় আমি সেটাও তাকে হাসতে হাসতে দিয়ে দিবো বিনা বাক্য ব্যয়ে।
শেষ কথাটি চারুর দিকে তাকিয়ে বলল অনুজ।

=এসব সিনেমার লেকচার তুমি তোমার কাছেই রাখো।আমাকে এসব বলে ভুলাতে এসোনা।আমি আজই আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো এ বাড়ি থেকে।ওর বাবা দেশের বাহিরে তিনি ফিরলে আইনি ভাবে তোমাদের বিচ্ছেদ করার ব্যাবস্থাও আমি নিজ হাতে করবো।
বলেই চারুর মা চারুর হাত ধরে চলে যেতে চাইলে অনুজ চারুকে উদ্দেশ্য করে বলে,

=লতা আমি রাতে যে কথাগুলো বলেছি, তুমি যদি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাও আমি সত্যি সত্যিই সেই কাজগুলোই করবো। রিমেম্বার করে দিচ্ছি তোমাকে লতা!

বলেই অনুজ তরুর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো অনুলেখার রুমে।
_____________________________________

বাহিরে প্রবল বেগে ঝড় বইছে।বাতাসের দমকা হাওয়ার চারপাশের বাসা গুলোতে দরজা-জানলার ঠাস ঠুস বারির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে অনবরত। চারুর তাতে কোন হেলদোল নেই।সে আনমনে দৃষ্টিতে দক্ষিণের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাহিরে বয়ে যাওয়া ঝড় দেখে যাচ্ছে। সে ভাবছে বাহিরে বয়ে যাওয়া ঝড়টা তো সবাই দেখছে কিন্তু তার ভিতরে যে ঝড় সে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তাতো সে কাওকে দেখাতে পারছেনা না কখনো পারবে।
তার মা আজ তার উপর বড্ড রেগে গেছে তা জানে চারু।কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অটল।সে এর শেষ অবধি দেখতে চায়।তার মন আর মস্তিষ্কের মাঝে একটা দোটানা কাজ করছে।তার মন বলছে অনুজকে ছেড়ে চলে যেতে, কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে চলে গেলি তো হেরে গেলি।সে তার মস্তিষ্কের কথাই শুনেছে।তাই নিজের মাকে ফিরিয়ে দিয়েছে আজ সে।মাকে নিয়ে এখন তার আবার চিন্তা হচ্ছে ভীষণ মা আবার তার চিন্তায় না আবার অসুস্থ হয়ে পরে।এসব নিয়ে সে যখন বিভোর তখন পিছন থেকে কেও তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।চারুর বুঝতে বাকি রইলো না তাকে জড়িয়ে ধরা ব্যাক্তিটি কে।এ স্পর্শ তার ভিষণ পরিচিত, এ স্পর্শ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে।তার এখন ভিষণ করে মনে হচ্ছে এ দুদিন যা ঘটেছে তার সবটা মিথ্যে হোক,এ মুহূর্তটুকু আটকে থাকুক চিরকাল। এ মানুষটাকে ছাড়া যে সে কতটা অসম্পূর্ণ তা সে হারে হারে টের পেয়েছে এতোটুকু সময়ে।সে চায় এ দুদিনের সবটা মিথ্যে হয়ে যাক,তাহলে সে আর কোনদিনও অনুজের কাছে এমন আবদার করবে না,যে আবদার পূরণ হওয়ার পরও তাকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে।
অনুজের স্পর্শ গুলো ধীরে ধীরে খুবই গভীর হচ্ছে। নিজেকে অনুজের হাতে যেনো ছেড়ে দিচ্ছে চারু, অন্য সময় হলে হয়তো সে এটা কখনো করতো না।কিন্তু আজ তার মন তাকে অনুজকে বাঁধা দিতে যেন সায় দিচ্ছে না।তার মন কেবলই বলছে অনুজকে নিষেধ করলে সে যদি তাকে একেবারেই হারিয়ে ফেলে তবে সে কি করে বাঁচবে!
তাই সে আজ অনুজের মাঝে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চায়,খুব করে চায়!

কিন্তু চারু এটা ভুলে গেছে সুখ ক্ষণিকের জন্যই কেবল আসে,কিন্তু দুঃখ সে তো দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী!

অতঃপর চলছে চলবে,,,,,,🙂