শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-০৪

0
265

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#পর্ব_৪
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

=তুমি কী এভাবেই আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করে দিবে এটা ঠিক করেই নিয়েছো বউমা।
শাশুড়ির এমন কথায় চারু বিষ্ময় নিয়ে তাকে বলে,

=মা আপনি এসব কী বলছেন।আমি কেনো আপনার ছেলের জীবন নষ্ট করতে চাইবো!

=চাও না বলছো।

=জ্বি মা আমি কখনোই আপনার ছেলের খারাপ চাইনি আর আল্লাহ নাহ্ করুক কখনো যেনো না চাইতে হয় দোয়াই প্রতিনিয়ত করি আমি।

=তাহলে আমার ছেলেটা কে মুক্তি দিয়ে ওকে একটা শান্তিময় জীবন দাও।একজন মা হয়ে আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি বউমা!

শাশুড়ির করুন সুরে এমন কঠিন একটা চাওয়া শুনে চারুলতা থমকে গেলো। কি বলবে,কি করবে তার কিছুই সে বুঝতে পারছে না।চুপচাপ ঠাঁ দাঁড়িয়ে রইলো সে। রহিমা বেগম চারুর কাছে গিয়ে তার হাত দুটো ধরে আবার বলল,

=দেখো বউমা ইসলামে তো চার নিয়ে জায়েজ আছে।আমার ছেলে তোমার কোন অভাব রাখবে না আমি কথা দিচ্ছি। তুমি শুধু ওকে একবার রাজি করে দ্বিতীয় বিয়ে করতে।আগেকার দিনে তো এমন হরহামেশাই হতো।তুমি কী চাও না আমার ছেলেটা বাবা ডাক শুনুক।ওর বিয়ে হলে সে ঘরে সন্তান হলে তুমিও তো তার মা হবে।তুমি দয়া করে ওকে বুঝাও।একমাত্র তুমি বললেই ও বিয়েতে রাজি হবে।
শ্রাবণের ঠান্ডা আবহাওয়াতেও ধর ধর করে ঘামছে চারু।তার শাশুড়ীর চাওয়াটা তো ভুল নয়।কিন্তু কোনো মেয়ে কী নিজের স্বামীর ভাগ অন্যকে দিতে পারে,আর সতীনের সন্তান কী নিজের সন্তান হয়?
কিন্তু শাশুড়ীর অনুরোধটাকেও যে সে ফেলে দিতে পারবে না।মানুষটা তো খারাপ নয়,পরিস্থিতি তাকে এমন হতে বাধ্য করেছে।কোন মা-ই তার সন্তানে অসুখী জীবনটা সয্য করতে পারেনা।তার শাশুড়ীও তার ব্যাতিক্রম নয়!



রাত ১১টা,
বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে ঘরে ফিরলো অনুজ।শ্রাবণ মাসের এই এক সমস্যা হুটহাট করে আকাশ কালো হয়ে বর্ষন শুরু হয়।সকালে অফিসে যাওয়ার আগে চারু বারবার করে তাকে ছাতা নিয়ে যেতে বলেছে।কিন্তু তাড়াহুড়োতে সে আজ ছাতা নিয়ে যেতেই ভুলে গিয়েছে। আজ চারুর যে তাকে কি পরিমাণ বকাবকি করবে তা ভেবেই অনুজ আতংকে আছে।মেয়েটা তাকে বড্ড ভালোবাসে তার একটু অসুবিধাও যেনো তার সয্য হয়না।সারাক্ষণ তার সব কিছুর খেয়াল রাখে।অনুজও তার লতাকে অনেক ভালোবাসে।তাইতো পৃথিবীর সব কিছুর বিনিময়েও সে শুধু তার লতাকে চায়।
বাসায় ঢুকেই সে সোজা নিজের রুমে গিয়ে শুকনো কাপড় নিয়ে আগে শাওয়াড় নিতে ঢুকলো।শাওয়াড় শেষ করেই সে রুমে এসে ব্যাগ থেকে দুটো কদম ফুল বের করলো।অফিস থেকে আসার পথে ট্রাফিক সিগন্যালের সময় একটা পার্কের গাছে কদম গুলো দেখেছিলো সে।তার লতা যে ফুল খুব পছন্দ করে তা অজানা নয় অনুজের।সে প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরার পথে কোন না কোন ফুল তার লতার জন্য কিনে আনে।কিন্তু কদম ফুল সচরাচর কিনতে পাওয়া যায়না। তাই তার লতাকেও কদমফুল দেয়া হয় না।আজ যখন কদমফুল গুলো সে দেখলো তখনই সেগুলো নিজ হাতে গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এসেছে।চারদিকে ভারী বর্ষনের জন্য তাকে ফুল পাড়তে কেউ দেখেনি হয়তো দেখলে চোর অপবাদ নিয়ে মার খেতে হতো হয়তো।সে যাই হোক একটু ঝুঁকি নিয়ে সে যে শেষ পর্যন্ত তার লতার জন্য কদমফুল গুলো অবশেষে আনতে পেরেছে এটাই অনেক।কিন্তু লতা গেলো কোথায়।সে যে বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে বাসায় ঢুকলো অথচ এখন পর্যন্ত তাকে কেউ বকাবকি শুরু করলো না এটা তার কাছে কেমন অদ্ভুত ঠেকালো।কদমফুল হাত ভ্রু কুচকে সে কিছু ভাবলো।তারপর হাতের ফুলগুলো নিয়েই সে ছাঁদের দিকে গেলো।



সারাদিন আজ অনেক ভেবেছে চারু তার শাশুড়ির বলা কথা গুলো।তারপর তার মনে হলো অনুজের সক্ষমতা থাকতেও সে কেনো নিজের ঔরসজাত সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনা থেকে বঞ্চিত হবে।যেহেতু আল্লাহ তার মাঝে এ অক্ষমতা দিয়েছেন তাহলে নিশ্চয়ই তার পিছনে কোনো কারণ আছে। তাই আজ চারুলতা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে অনুজকে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য রাজি কারাবে,এতে তার হাজার কষ্ট হলেও সে এটা করবে।একজন মায়ের অনুরোধ সে রাখবে।

=আমি জানতাম আমার লাজুকলতা বউটি ছাঁদে এসে বর্ষার মেঘাচ্ছন্ন আকাশ বিলাস করছে।
পিছিন থেকে চারুকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মুখ রেখে তার কানে ফিসফিস করে বলল অনুজ।
অনুজের কথায় চারু কোন প্রতুত্তর করলো না।
তাতে করে চারুকে আরও গভীর ভাবে স্পর্শ করে তার গাড়ে একটা চুম্বম একে অনুজ বলল,

=আমার বউয়ের কী মনটা কী আজ খুব বেশি খারাপ।
চারু তবুও চুপ,
=কি হলো বউ আমার কথা কয় না কেনো।সে কী তবে মান করেছে আজ তার বরের সাথে।
ঠোঁট উল্টে বলল অনুজ।তারপর পিছন থেকে তার আনা কদমফুল দুটো চারুর সামনে ধরে বলল,
=এখনো কথা বলবে না আমার লতা আমার সাথে।
চোখদুটো আবারও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো চারুর।মানুষটা এতো কিছুর পরেও তাকে এতোটা ভালোবাসে।সেই মানুষটাকে সে কী করে দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা বলবে!তবুও পরিস্থিতি আজ চারুর অনূকূলে তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে চারু অনুজের দিকে ঘুরে তাকালো

=যাক বউয়ের তাহলে উপহারটা পছন্দ হয়েছে!
মুচকি হেসে বলে অনুজ।

=আপনার দেয়া সব কিছুই আমার পছন্দ হয় অনুজ।

=জানি তো আমি,আমি তো চিনি আমার এই পাগলি বউটকে।তো বউ তুমি কী খেয়েছো নাকি এখনো না খেয়ে আমার অপেক্ষা করছিলে?
ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে অনুজ।
চারু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে,তাতেই অনুজ যা বুঝার বুঝে গেছে।চারুর হয়তো মন খারাপ তাই না খেয়ে ছাঁদে এসে দাড়িয়ে আছে সে।হয়তো আজও বাসায় কোনো জামেলা হয়েছে।তাই তার লতা এতোটা বিষন্ন হয়ে আছে আজ।
চারুর বাহু ধরে নিজের কিছুটা কাছে নিয়ে তার দু গালে নিজের হাত দিয়ে তার দিকে ঘুরালো অনুজ।তারপর বলল,

=লতা আমার চোখের দিকে তাকাও।কি হয়েছে তোমার। বাসায় কি আজও,,
চারু তাকালো অনুজের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল,
=আপনি কী আমাকে ভালোবাসেন অনুজ?

=তোমার এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে লাজুকলতা!

=কতটা ভালোবাসেন আমাকে অনুজ?

=ভালোবাসার পরিমাপক কোন যন্ত্র আজ অবধি আবিষ্কার হয়নি লতা,যদি হতো তাহলে আমি আমার ভালোবাসা পরিমাপ করে তোমাকে দেখিয়ে দিতাম কতটা ভালোবাসি তোমায়।

=আমি যদি আপনার কাছে কিছু চাই তবে কী তা দিবেন আমাকে?

=আমার সাধ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই দিবো!একবার বলেই দেখো না তুমি।

= তাহলে কথা দিন আমি যা চাইবো তাই দিবেন আমায়?

=কি হয়েছে বলোতো তোমার লতা।আজ হঠাৎ আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছো তুমি?
সন্দিহান গলায় বলল অনুজ।
=উহু, কোন প্রশ্ন না, আমি যা বলছি তার উত্তর দিন।

=আচ্ছা বলো কী চাও তুমি?কথা দিলাম আমার সাধ্যের মধ্যে হলে আমি তোমাকে তাই দিবো।
কিছুটা সময় নিলো চারু নিজের মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে সে অনুজের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

=আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করুন অনুজ।আমি চাই আপনি আপনার ঔরসজাত সন্তানের মুখে বাবা ডাক শুনুন।এটা আপনার সাধ্যের মধ্যেই আছে অনুজ।দয়া করে আমাকে আর দোষের ভাগিদার করবেন না আপনি।আমি বড্ড ক্লান্ত দায় নিতে নিতে!
এক দমে সবগুলো কথা বলে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকালো চারু।সে অনুজের প্রতুত্তরের অপেক্ষা করছে।কিন্তু অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়ার পরেও অনুজের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে সে আবার তাকালো অনুজের দিকে।সে দেখলো অনুজ এ দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।অনুজের দিকে তাকিয়ে তার মনের কথা বুঝার চেষ্টা করলো চারু, কিন্তু অনুজের শান্ত, স্থির চোখের ভাষা কিছুই বুঝলো না চারু।কিছুক্ষণ পরে অনুজ নিজেই বলল,

=অনেক রাত হয়েছে, নিচে চলো ঘুমাতে হবে।কাল আমার অফিস আছে।
বলে নিজেই চারুর হাত ধরে নিচে নিয়ে গেলো সে।চারু অনুজের কোন অভিব্যাক্তিই বুঝতে পারলো না।অনুজের এতো শান্ত ভাব যেনো সয্য হচ্ছিল না চারুর।কিন্তু পাল্টা কিছু বলার সাহসও সে পাচ্ছিলো না।কারণ সে অনুজের এতো নির্লিপ্ততার মানে খুঁজে পাচ্ছিলো না।

গত রাতের ঘটে যাওয়া কথা গুলো ভাবছিলো এতোক্ষণ চারুলতা।যে মানুষ টা গতও রাতেও তার জন্য এতো গভীর ভালোবাসা প্রকাশ করেছে সে মানুষটা যে রাতারাতিই এতোটা বদলে যাবে তা যেনো চারুর মন মানতে চাইছে না।আসলে কাওকে ভালোবাসলে তাকে এতো সহজে অবিশ্বাস করা যায় না।আমরা যতই ভালোবাসার মানুষটির কাছে প্রতারিত হইনা কেনো সেই আমরাই আবার নিজের মনকে শান্তানা দিই যে হয়তো মানুষটা কোন পরিস্থিতির চাপে পড়েই এমনটা করছি।আসলে ভালোবাসা এমনটাই হয়।যেখানে ভালোবাসা থাকে সেখানে অবিশ্বাস শব্দটা আসে না।যাও বা হয় তা ঠুনকো সন্দেহ। যা সময়ের বিবর্তনে আবাট্র হারিয়েও যায়। তাইতো চারু তার অনুজকে ছেড়ে একেবারে চলেও যেতে পারছে না আবার সবটা মানতেও তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। তবুও তার মনের কোনো এক কোনে একটা আশ্বাস আছে যে অনুজ এতোটা বদলে যেতে পারেনা।কিন্তু বারবার অনুজ তার ভাবনাকে ভুল প্রমানিত করে।যেমন, একটু আগেই তাকে কতটা ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছিলো অনুজ।কিন্তু হঠাৎ করেই তরুর ফোন পেয়ে মানুষ টা এক মুহুর্তে তাকে ছেড়ে তরুর কাছে চলে গেলো।তাহলে দিন শেষে কী ভালোবাসার রংও বদলায়।তার ভালোবাসার মানুষটাও কী তবে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে, সেও কী তবে তার ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছে নিজের করা বোকামির জন্য?
চারুর বুকটা ভারী হয়ে আসে এসব ভাবলে,কী,কেনো এসব কিছুই যেনো একটা বড় ধোঁয়াসা, যার রহস্য সমাধান করতে গেলে আবারও সবটা এলোমেলো হয়ে যাবে!!

অতঃপর চলছে চলবে😊