শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-০৫

0
276

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#পর্ব_৫
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

ভোরের আলো ফুটতেই জায়নামাজ থেকে উঠে রুমের বাহিরে গেলো চারু।উদ্দেশ্য রান্নাঘরে যাওয়া। এককাপ কড়া লিকার চা এখন তার বড্ড দরকার। টানা দুদিন পর্যাপ্ত পরিমানে না ঘুমানো সাথে মানসিক দুশ্চিন্তা সব মিলিয়ে মাথাটা হ্যাং হয়ে আছে তার।
রান্না ঘরের কাছে যেতেই হাড়ি পাতিলের টুংটাং আওয়াজ কানে এলো চারুর।এতো ভোরে রান্নাঘরে কে ঢুকতে পারে তা চিন্তা করতে লাগলো সে।
নাহ্ এতো ভোরে মা তো কখনো রান্নাঘরে ঢুকেন না।আর বাবা বা অনুজতো এসময় রান্নাঘরে আসবেনা।তারা হয়তো মসজিদ থেকে এসে এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। পরক্ষণেই তার মনে হলো হয়তো তরু কোনো কারণে রান্নাঘরে এসেছে।এটাই সুযোগ ভাবল চারু।এখন অনুজ এবং বাসার সবাই ঘুমিয়ে আছে এ সুযোগে সে তরুর পেট থেকে আসল রহস্য টা হয়তো বের করতে পারবে।তার চিন্তিত মুখে হঠাৎ কিঞ্চিৎ হাসি ফুটলো।খুশি মনে সে রান্নাঘরের দিকে ঢুকতেই অবাকের চরম পর্যায়ে পৌছে গেলো।এতো ভোরে রান্নাঘরে সে অনুজকে দেখবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।কিন্তু সেটা বাস্তবে ঘটছে।অনুজ চুলোর উপর থেকে একটা পাতিল নামিয়ে তা থেকে একটা গ্লাসে দুধ ঢাললো।তারপর সে যখন দুধ নিয়ে বের হতে যাবে তখন চারু জিজ্ঞেস করলো,

=হঠাৎ আজ এতো সকালে দুধ খেতে মন চাইলো আপনার অনুজ।আমাকে ডাকলে আমিই দুধ গরম করে দিতাম।

=আমি ভেবেছি তুমি হয়তো ঘুমোচ্ছো তাই আর ডাকিনি।তবে দুধটা আমার জন নয় তরুর জন্য।

=এতো ভোরে হঠাৎ তরু দুধ কেনো খেতে চাইলো।অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো চারু।

=ওর পুরো শরীর ব্যাথা হয়ে আছে।তাছাড়া রাতে তেমন কিছু খায়নি।তাই ভাবলাম একটু গরম দুধ খাওয়ালে হয়তো সে আরাম পাবে।
দ্রুত বলেই অনুজ চারুর পাশ কাটিয়ে চলে গেলো রান্নাঘর থেকে।
অনুজের কথা শুনে চারুরও তরুর জন্য চিন্তা হতে লাগলো তাই অনুজের পিছু পিছু সেও অনুলেখার ঘরের দিকে গেলো।

=গরম গরম দুধ টুকু খেয়ে নেও তরু,দেখবে শরীরে আরাম পাবে।সাথে এ ঔষুধটাও খেয়ে নাও।তাহলে হালকা যে জ্বরটা আছে সেটা আর বাড়বে না।
ব্যাস এতোটুকু দেখেই সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না চারু।যেটুকু বিশ্বাস বা ভরসা অনুজের জন্য তার মনে ছিলো সেটুকও যেনো এখন কর্পূরের মতোন উবে গেলো।
সদ্য গোসোল করা ভিজে চুলে আধশোয়া তরুকে দেখে চারুরও মনে পড়ে গেলো ৩ বছর আগে এমনই এক ভোরের কথা।যে ভোরে সে ছিলো এ বাড়ির নতুন বউ।বাসর রাতের পরদিন যখন তার পুরো শরীর ব্যাথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলো ঠিক এমন করেই অনুজ তার জন্যেও দুধ আর ঔষুধ এনেছিলো,নিজ হাতে খাইয়েও দিয়েছিলো।আজ সেই একই ঘটনা গুলো তারই চোখের সামনে তারই ছোট বোনের সাথে ঘটাচ্ছে অনুজ।হঠাৎ করেই যেনো তার পায়ের নিচ থেকে মাটিটা সরে গেলো।তার মনে হলো,পুরুষ বুঝি এমনই হয়,তাদের কাছে বুঝি মানসিক চাহিদার চেয়ে দৈহিক চাহিদাটাই বেশি প্রিয় হয়!তা না হলে গতরাতে তার সাথের অসম্পূর্ণ মূহুর্তের সমাপ্তিটা অনুজ কখনোই তরুর সাথে কাটাতে পারতো না।

নাহ্ অনুজ হয়তো ধর্মীয় দৃষ্টিতে কোন পাপ করেনি,সে যা করেছে তার বিবাহিত স্ত্রীর সাথেই করেছে। কিন্তু সে যে একটা মানুষের মনকে দুমড়েমুচড়ে গুড়িয়ে দিয়েছে আজ তা কী অন্যায় নয়।কথায় আছে মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা নাকি এক সমতুল্য! তাহলে অনুজতো সেই অপরাধটাই আজ করেছে।বিয়ে যদি করারই হতো,দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে যদি সহবাস করারই হতো তাহলে সে কেনো বারংবার চারুর মনে তার জন্য নতুন করে ভালোবাসার কুড়ি ফুটিয়েছে, আবার সে কুড়িটাকে নিজের হাতে নষ্ট করে দিলো এ লহমায়!
কাল অবধিও চারুর মনে হয়েছিলো সে বুঝি ভুল,অনুজ হয়তো তাকেই ভালোবাসে।কিন্তু নাহ্ সে ভুল করেছে।মনে হচ্ছে তার চিন্তাভাবনা গুলো সব ভুল,সব মিথ্যে ছিলো।অনুজ তার ভরসা,তার বিশ্বাস সব কিছু একেবারে ভেঙে ঘুড়িয়ে দিয়েছে আজ।নাহ্ আর এক মুহূর্তও সে থাকবেনা এ বাড়ি।সে ভেবেছিলো তার সামনে যা ঘটছে তার সবটাই হয়তো লোক দেখানো, বানোয়াট, হয়তো অনুজ তাকে শিক্ষা দিতেই এমন করছে।কিন্তু নাহ্ সে ভুল ছিলো,তার ভাবনাগুলো সব ভুল ছিলো।পরিশেষে সব পুরুষগুলোই এক।এরা নতুন শরীল পেলে আর কিচ্ছু চায় না।এরা ভালোবাসার মানেটাই বুঝেনা এরা কেবল দৈহিক চাহিদাকেই বুঝে।
এত কিছুর পরেও সে কেবল অনুজের ভালোবাসার জন্যই এতোটা বেহায়ার মতন এ বাড়ি ছেড়ে যায়নি।তবে এখন তার মনে হচ্ছে সে ভুল করেছে,তার হয়তো চলে যাওয়াটাই উচিত ছিলো।নিজের দেহে অক্ষমতা নিয়ে এতোটাও আশা করা যায়না।আজ নিজের চোখে যা দেখেছে, যা শুনেছে তার পরে আর এ বাড়িতে তার হয়তো থাকা উচিত নয়।কারণ তার প্রতি হয়তো অনুজের ভালোবাসাটা আজকাল ফিকে হয়ে গেছে,যা ধীরে ধীরে বড্ড ফিকে হয়ে যাবে।আর সেটা চারুর পক্ষে সয্য করা মোটেও সম্ভব হবেনা।যেখানে আর ভালোবাসাটাই নেই সেখানে তার থাকাটা অনুচিত!
_______________________________________
=তরু এখন কেমন লাগছে তোমার?

= আগের চেয়ে অনেকটা ভালো।
মুচকি হেসে অনুজের কথার জবাব দিলো তরু।

=যদি খুব বেশি কষ্ট হয়, বা খারাপ লাগে তাহলে আমাকে বলো,প্রয়োজনে ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাবো।তুমি কোন ধিধা করোনা।

=হুম,আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো?

=আরে একটা কেনো হাজারটা প্রশ্ন করো।
মুচকি হেসে তরুকে অভয় দিয়ে বলল অনুজ।

=আমরা যা করছি এতে কিন্তু আপুমনির কষ্ট হচ্ছে। আপনি কী আপুমনির অবস্থা দেখছেন।সে যদি সয্য না করতে পেরে কোথাও চলে যায় বা কোনো ভুল কাজ,,,

=তরু,
তরুর কথার সমাপ্তি ঘটাতে দিলো না অনুজ তার আগেই তাকে থামিয়ে দিলো।এরপর শান্ত গলায় বলল,

=তুমি শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবো।বাকিটা আমি সামলে নিবো।তুমি এখন আমার দায়িত্ব। আর আমার কাছে ভালোবাসার আগে সেই মানুষটার দিয়ে যাওয়া দায়িত্বটা অনেক বড়।সো তুমি নিশ্চিন্ত থাকো বুঝলে!
আচ্ছা আমি এখন গেলাম শাওয়াড় নিবো,সারা রাত যা গেলো গোসল করাটা এখন আমার জন্য ফরজ কাজ।

=আচ্ছা



অনুজ নিজের রুমে গিয়ে কাভার্ড থেকে জামা কাপড় নিতে গিয়ে দেখলো চারু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। চারুর কাছে গিয়ে তাকে ধরতে চেয়েও কিছু একটা ভেবে আবার ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।শরীরের যা অবস্থা, এ অবস্থায় সে তার লতা ছুঁতে পারবে না।তার চেয়ে বরং গোসল করে তারপর সে তার লতার কাছে যাবে।
অনুজ ওয়াশরুমের দরজা লাগাতেই চারুর চোখ থেকে দু’ফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো।আজ তার অনুজের তার লতার কাছে আসতেও ভাবতে হচ্ছে, সংকোচবোধ করছে সে।সত্যিই সময়ের সাথে ভালোবাসার রংও বদলায়!



গোসল সেরে ফুরফুরে মনে ওয়াশরুম থেকে বের হলো অনুজ।মানুষ যতই ক্লান্ত থাকুক না কেনো, সে যদি একটা লম্বা শাওয়ার নেয় তাহলে তার সকল ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়।তোয়ালে দিয়ে ভিজা চুল মুচতে মুচতে লতাকে ডাকলো অনুজ,

=লাজুকলতা বউ আমার তাড়াতাড়ি এক কাপ কড়া লিকার চা বানিয়ে দাও তো।সারারাত একফোঁটা ঘুমও হয়নি।তোমার হাতে চা টা খেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিবো ভাবছি।
চারুর কোনো সাড়া না পেয়ে বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো অনুজ,নাহ্ চারু রুমে নেই তাই হয়তো তার ডাকে সাড়া দেয়নি।এমনটা ভেবে চুল আঁচড়াতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অনুজ।চিরুনি হাতে নিয়ে তা চুলে চালাতেই যাবে তখনই তার নজর যায় ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসের উপর। সেখানে একটা কাগজ আঠা দিয়ে আটকানো।কাগজ আটকানো দেখে ভ্রু কুচকে গেলো অনুজের,তাদের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় কে লাগালো এমন কাগজ?লতা?
কিন্তু লতা এমনটা কেনো করবে এসব ভাবতে ভাবতেই চিরকুট টা হাতে নিয়ে খুলল অনুজ।কাগজ খুলতেই তার ভিতরের ঘোটা ঘোটা কলমের কালিতে লেখা দেখে অনুজের পুরো পৃথিবীটা যেনো এক মুহুর্তে অন্ধকার হয়ে গেলো,সে কী সত্যি সত্যিই এটা দেখছে নাকি চোখের ভ্রম তা বুঝতে না পেরে আবারো একবার চিরকুট টা পড়ে দেখলো সে,

“যেখানে ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেছে আজ,সেখানে আমার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে।মুক্তি দিলাম আপনাকে, সুখে থাকুন,তরুকে ভালো রাখবেন এ কামনাই করি”

চলবে,,,,,,,