শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-০৬

0
232

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#পর্ব_৬
#কলমে_আসমা_মজুমদার_তিথি

“যেখানে ভালোবাসা ফিকে হয়ে গেছে আজ,সেখানে আমার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে।মুক্তি দিলাম আপনাকে, সুখে থাকুন,তরুকে ভালো রাখবেন এ কামনাই করি”

এ কয়েকটি লাইন পড়ে এই শ্রাবণ মাসের শীতলতায় অনুজ দর দর করে ঘামছে।চিরকুট হাতেই সে ড্রেসিং টেবিলের সামনেই নিচে বসে পড়লো। তার লতা তাকে মুক্তি দিয়েছে মানে সে তাকে ছেড়ে চলে গেছে?এ যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না অনুজের।মূহুর্তেই সে বসা থেকে উঠে হন্নে হয়ে পুরো বাসায় চারুকে খুঁজতে লাগলো,এমনকি ছাঁদও বাকি রাখেনি, নাহ্ চারু নেই, পুরো বাড়ির কোথাও সে চারুকে খুঁজে পায়নি।এটুকু সময়েই যেনো পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে তার কাছে।নিজেদের রুমে গিয়ে চারু, চারু বলে আর্তনাদ শুরু করলো। তার করুন আর্তনাদ শুনে মহসিন হাসান সহ রহিমা বেগম এমনকি তরুলতাও ছুটে এলো।মহসিন হাসান কিছুক্ষণ আগেই ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় ঢুকেছেন,আর রহিমা বেগম নিত্যদিনকার মতনই জায়নামাজের বিছানা থেকে উঠে আসেন।তরু সবার পরে আসে কারণ সে কিছুক্ষণ আগেই ঔষুধ খেয়ে একটু শুয়েছিলো।চোখ লেগে আসতেই অনুজের এমন আর্তচিৎকার শুনে ঘুম উবে যায় তার।সবাই এসে দেখে অনুজ খাটের কোন ঘেঁসে নিচে বসে চিৎকার করে লতা, লতা বলে আর্তনাদ করছে।মহসিন হাসান ছেলের পাশে গিয়ে কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই অনুজ তার হাতে চারুর লিখে যাওয়া চিরকুট টা দিয়ে দিলো।তিনি সেটা দুবার পড়লেন। তারপর তরুলতার দিকে তাকিয়ে বললেন,
=আজ তোমাদের বেহায়াপনার জন্য আমার ঘরের লক্ষী বাড়ি ছাড়া হলো।

=কি বলছো কী এসব!কি হয়েছে, আর চিরকুটেই বা কী লিখা আছে যার জন্য তুমি আমার ছেলেকে কথা শুনাচ্ছো।আর বউমাই বা কোথায়?

=এ বাড়িতে ওর থাকার কোন পরিস্থিতি তোমরা রেখেছো যে ও এখানে থাকবে।তারপর অনুজের দিকে তাকিয়ে আবার বলেন,
এখন আর কেঁদে কী হবে?যা করার তা তো করেই নিয়েছো।
বলেই তিনি চিরকুট টা অনুজের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেলেন।রহিমা বেগমও স্বামীর পিছু পিছু চলে গেলেন।সবটা জানতে,
এতোক্ষণ তরুলতা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।অনুজের বাবা-মা চলে যেতেই সে অনুজের পাশে গিয়ে বসল,

=আমি এমন কিছুরই আশংকা করছিলাম।আর তাই হলো,আমার জন্যই সবকিছু হলো।আপনি দয়া করে আপুমনিকে খুঁজে আনুন।আমি তার কাছে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইবো।প্রয়োজনে এ বাড়ি ছেড়েও চলে যাবো।তবুও আমার আপুমনিকে খুঁজে আনুন আপনি।
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো তরু।অনুজের এখন সে দিকে খেয়াল নেই সে এখন চারুর চলে যাওয়া নিয়েই বিধ্বস্ত!
______________________________________
মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সামনে বসে থাকা দুটো মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে চারুলতা।অপর দিকের বসে থাকা মানুষ দুটোর তাকে নিয়ে হাজারো কৌতুহল, হাজারো প্রশ্ন কিন্তু চারুর নিশ্চুপ চাহনিতে তারা কি বলবে,কোথা থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছেনা।

=তুই কেনো ভাইয়াকে খবর দিতে দিচ্ছিস না।আর ওই ভাবে অন্যমনষ্ক হয়ে মাঝ রাস্তায় উদভ্রান্তের মতনই বা কেনো হাঁটছিলিস?
কি হয়েছে চারু,আমাকেও বলবি না?আমিতো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড আমাকে অন্তত সবটা বল নাহলে আমি তোকে কোন সমাধান দিবো করে বলতো।নিজের কী হাল করেছিস দেখেছিস আয়নায় একবারো।আর ভাইয়া বা কেমন তোর এতো অযত্ন করছে!

=যত্ন নেয়ার নতুন মানুষ পেয়েছে যে সে এখন!

সামনে বসে থাকা মেয়েটি একের পর এক বিরতিহীন প্রশ্নের মাঝেই চারু বলে উঠলো কথাটি।

=মানেহ্,কি বলছিসটা কী তুই।নতুন মানুষ বলতে তুই কী বুঝাতে চাইছিস?

=তুই যেটা বুঝেছিস আমি সেটাই বুঝাতে চেয়েছি।

=নাহ্,তোর হয়ত কোথাও ভুল হচ্ছে চারু,ভাইয়া তোকে অনেক ভালোবাসে, আমার জানা মতে তার জীবনে তুই প্রথম এবং তুই শেষ নারী যাকে সে ভালোবাসে!

=প্রথম নারী হয়তো ঠিক কিন্তু শেষ নারী হয়তো হতে পারলাম না।

=কি হয়েছে সবটা আমাকে খুলে বল চারু।আমি প্রথম থেকে সবটা শুনতে চাই।
সামনে বসে থাকা মেয়েটির কথায় চারু প্রথম থেকে তাকে সবটা বলল।কারণ চারু এ মেয়েটিকে কখনোই কিছু লুকায়নি।আর আজও সে তার ব্যতিক্রম করেনি।
সবটা শোনার পর মেয়েটি বলল,

=আচ্ছা সবটাই বুঝলাম,কিন্তু ভাইয়া বা তরু কেউ কী একবারো নিজ মুখে এটা বলেছে যে তারা বিয়ে করছে? বা কি এমন হয়েছিল সেদিন যাতে করে তোরা ভেবে নিলি ভাইয়া সত্যি সত্যি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে?
মেয়েটির কথায় চারু কিছুটা চমকালো,আবার কিছুটা থমকে গেলো তারপর সেদিনের অনুজ-তরুর কথাগুলো মনে করতে লাগলো। তারপর মাথা নেড়ে সে বলল,

=নাহ্ অনুজ বলেন নি ওনি তরুকে বিয়ে করেছেন।

=তাহলে তোরা বুঝলি কী করে ভাইয়া বিয়ে করেছেন তাও আবার তরুকে?
ভাইয়া কি বলেছিলো সেদিন সেটা বল!

=আম্মা তরু আজ থেকে এ বাসায় থাকবে।আজ থেকে ওর সমস্ত দায়িত্ব আমার।চারু যে মর্যাদায় এ বাড়িতে থাকে ঠিক সেই মর্যাদায় তরুও আজ থেকে এ বাড়িতে থাকবে।
মেয়েটির কথায় চারু হুবহু অনুজের বলা কথাগুলো তাকে বলল।

=কিন্তু এতে বিয়ে করেছে তা তো বলেনি সে।তোরা নিজেরাই বুঝে নিলি সবটা।

=আম্মা বলেছিলো,চারু এ বাড়ির বউ,তরু চারুর বোনের মর্যাদা ছাড়া এ বাড়িতে ওরই মতন মর্যাদায় থাকবে মানে?তুমি কী তবে তরুকে বিয়ে করেছো?

=আমার কথার মানে যদি এটা বুঝো তোমরা তাহলে সেটাই সত্যি মা।তরুর কোন অমর্যাদা বা অসম্মান যেনো নাহয় সেটা খেয়াল রেখো।বাবা বার কয়েক জিজ্ঞেস করেছিলো সে সত্যি তরুকে বিয়ে করেছে কিনা কিন্তু সে বরাবরই চুপ থেকেছে।আর নিরবতাকে সম্মতির লক্ষ্মণ বলা হয় সেটা তো তুই জানিস।

=সব ক্ষেত্রেই নিরবতা সম্মতি হয় না চারু।

=আচ্ছা বিয়ে করেনি সেটা নাহয় মানলাম।কিন্তু তরুর সাথে এক সাথে রাত কাটানো সেটাকে তুই কি বলবি?

=তুই কী ভাইয়াকে দেখেছিস তরুর সাথে এক ঘরে রাতে থাকতে?

=দেখিনি কিন্তু,,
বলেই কিছুটা চুপ হয়ে যায় চারু।মেয়েটি আবার বলে,

=কিন্তু কি চারু,পুরোটা বল আমাকে!

চারু পাশে বসা পুরুষটির দিকে তাকিয়ে মাথ মত করে রইলো।এতে করে মেয়েটি বুঝলো চারুর হয়তো সংকোচ হচ্ছে ছেলেটির সামনে কথাগুলো বলতে তাই সে ছেলেটিকে ইশারা করতেই সে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।তারপর মেয়েটি চারুকে বল,

=এবার বল,নির্ভীক চলে গেছে।
তখন চারু গতকাল রাত থেকে আজ ভোরে ঘটে যাওয়া সবটা মেয়েটাকে খুলে বলল।
এতে করে মেয়েটা কিছুটা সময় নিরব হয়ে ভাবল তারপর বলে,

=তোর উচিত ছিলো ভাইয়াকে সরাসরি এ বিষয়ে প্রশ্ন করা তুই কী সেটা করেছিস?

=নাহ্ কিন্তু তরুকে জিজ্ঞেস করতেই অনুজ আমার কথা এড়িয়ে গিয়েছে।

মেয়েটি কিছুটা ভেবে বলল,
=ভাইয়ার সাথে তোর খোলামেলা কথা বলে সবটা ক্লিয়ার হওয়া উচিত ছিলো। তা না করে শুধু মাত্র কিছু ঘটনা দেখেই তুই এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারিস না চারু।

চারু কিছুটা সময় চুপ থেকে বলে,

=আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে দোস্ত, ঠিক বেঠিক সবটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার।আমার কিছুটা সময় লাগবে নিজেকে সামলাতে।
মেয়েটা চারুর মনের অবস্থা বুঝে বলে,

=আচ্ছা তাহলে তুই সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সময় নে।আরোও একবার পুরো বিষয় টা ভেবে দেখ,কথা বলে সবটা মিটিয়ে নেয়া যায় কিনা।তারপর নাহয় সিদ্ধান্ত নিস।আমি বাঁধা দিবো না।মনে রাখিস একটা সম্পর্ক গড়তে বা ভাঙতে বেশি সময় লাগেনা।কিন্তু সেটাকে সারাজীবন টিকিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে বড় বিষয়।আশা করি তুই আমার কথাগুলো ঠান্ডা মাথায় একবার ভাববি।আমি গেলাম তোর মেডিসিনের সময় হয়ে গেছে তার আগে কিছু পেটে দেয়া দরকার। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
মেয়েটি উঠে যেতেই তার হাত ধরে টান দিলো চারু,

=আমি যে তোর কাছে আছি এটা আপাতত কাওকে জানাস না।
মুচকি হেসে মেয়েটি বলল,
=ভাইয়াকে আমি জানাবো না।তুই সময় নে, সুস্থ হ,তারপর নাহয় কথা হবে।
মেয়েটি চলে গেলো।আর চারুর মনে আবার জন্ম দিয়ে গেলো এক গাঁধা নতুন প্রশ্নের ঝুড়ি।চারু আবার নতুন ভাবনায় বিভোর হয়ে গেলো।তাহলে কী তার দেখায় বা শোনায় কোন ভুল হয়েছে। অনুজ কী তবে তাকে ঠাকায়নি।কিন্তু অনুজ এমনটা কেনো করছে,কেনই বা তাকে খোলসা করে কিছু বলছে না।কি উদ্দেশ্য তার,আর তরুই বা এতোটা নির্বাক কেনো।এমন হাজারো নতুন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে চারুলতার মনে।

সকালে যখন সে অনুজদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছিলো তখন সে অনেকটা উম্মাদের মতন রাস্তা দিয়ে হাটছিলো।আর হাটবে নাই বা কেনো যার ঘর,মন,বিশ্বাস সব কিছু এক সাথে ভাঙে সে কী সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারে,চারুও পারেনি,আর যার ফলস্বরূপ একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগে তার।ভাগ্য ভালো গাড়িতে থাকা লোকগুলো তার পরিচিত ছিলো। তাইতো তারাই ওকে হসপিটালাইজড করে।চারুর শরীরে আঘাত লাগলেও তার তখনো অল্প বিস্তর হুশ ছিলো।তাইতো সে বারবার তার সেই পরিচিত মুখদের অনুরোধ করেছে তার যেনো কাওকে তার কথা না জানায়।চারুর আকুতি ভরা অনুরোধ ফেলতে পারেনি তারা।তাইতো প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তারা তাকে তাদের বাসাতেই নিয়ে এসেছে।এরপর বাকিটা উপরিউক্ত!

________________________________________
আজ টানা ৭দিন লতার মুখটা দেখেনি অনুজ।পাগল প্রায় অবস্থা এখন তার।কোথাও খুঁজতে বাকি রাখেনি সে পরিচিত থেকে শুরু করে হসপিটালের মর্গে পর্যন্ত সে খোঁজ করেছে চারুলতার।কিন্তু চারুকে কোথাও খুঁজে পায়নি সে।উদভ্রান্তের মতন জীবন কাটছে তার।মধ্যে রাতে আজ বাসায় ফিরেছে সে।নিজেদের রুমটাতে ঢুকলেই তার ভিতরটা হাহাকার করে উঠে,হাজারো সৃতি ঘেরা রুমটায়,কিন্তু যাকে ঘিরে এতো সৃতি সে মানুষটাই আজ নেই,কোথায় আছে চারু,কোথায় গেলো তার লতা তার উপর অভিমান করে?কোন খারাপ কিছু যে হয়নি এটা তার মন বারবার বলছে তবুও অবাধ্য মন বারংবার কূ ডেকে চলেছে।তার কেবলই মনে হচ্ছে সে বুঝি তার লতাকে চিরকালের মতন হারিয়ে ফেলবে।যে দায়িত্বের জন্য নিজের ভালোবাসা কে সে বাজি রেখেছে সে দায়িত্ব যেনো এখন তার কাছে যন্ত্রণায় রুপ নিয়েছে।কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ, তাকে যে সবকিছুর বিনিময়ে হলেও তার দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে,আবার তার পাশে সে লতাকেও চায়।কিন্তু আজ ভালোবাসার মাঝে দায়িত্ব যেনো দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।আচ্ছা খুব কি কষ্ট হতো চারুর আরেকটু অপেক্ষা করলে,সে কী তার অনুজের উপর একটু ভরসা করতে পারলো না!একটুখানি বিশ্বাস নিয়ে সে কি অপেক্ষা করতে পারতো না?খুব কী ক্ষতি হয়ে যেতো তাতে।এতোগুলা বছরে সে কি বুঝেনি তার প্রতি অনুজের ভালোবাসর গভীরতা? নাকি সেই বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছে?
নিজের মনে মনে এমন অনেক কথা জপতে থাকে অনুজ।যার কোন উত্তর মিলে না,পরিশেষে নিজেই নিজের প্রশ্নের একটা একটা করে যৌক্তিক উত্তর দেয়,নিজের মতন করে।তারই ভুল হয়েছে লতাকে সবটা পরিষ্কার করে না বলা আজ সেটা বুঝতে পারছে অনুজ কিন্তু কিছু করতে পারছেনা।

=অনুজ তাড়াতাড়ি তরুর রুমে আয়,মেয়েটা মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে,শরীর পুরো জ্বরে পুরে যাচ্ছে, ডাক্তার কে খবর দে।
মায়ের কথায় ধ্যন ভাঙে অনুজের।পরক্ষণেই নিজেকে সামলে ছুটে যায় তরুর রুমের দিকে।তরুর আবার খারাপ কিছু হলো না তো,অজানা এক শঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো তার!!!

অতঃপর চলবে,,,,,