শ্রাবণের অশ্রুধারা পর্ব-০৭

0
235

#শ্রাবণের_অশ্রুধারা
#পর্ব_৭
#লেখনিতে_আসমা_মজুমদার_তিথি

চৈত্র মাসের শেষদিকে নাগাদ অর্থাৎ বসন্ত তার বিদায় ঘোষণা করবার কিছুদিন আগে থেকেই যেন শোনা যেতে থাকে রুদ্র গ্রীষ্মের গম্ভীর পদধ্বনি। বসন্তের বাতাসে একটু একটু করে মিশতে থাকে কঠোরতার গন্ধ। বৈশাখের দুপুরে এর রূপ হয়ে ওঠে কঠিন, কঠোর ও রুদ্র। মধ্য গগনে বিরাজমান জলন্ত সূর্য তার সম্পূর্ণ তেজ উজাড় করে ঢেলে দেয় পৃথিবীর বুকে। পিছ ঢালা রাস্তায় প্রখোর রোদ মাথায় নিয়ে চারু হেঁটে চলছে দ্রুত গতিতে। উদ্দেশ্য ফাইনাল পরীক্ষার নোটস কালেক্ট করা।বাবা অসুস্থ থাকায় দীর্ঘদিন ভার্সিটিতে যেতে পারেনি সে।তবে তার অনুপস্থিতিতে সে অনুকে বারবার অনুরোধ করেছিলো সে যেনো একটা ক্লাসও মিস না দেয়।বেঁচারা অনু বেস্ট ফ্রেন্ড এর আদেশে তাকে ছাড়াই এতিমের মতন অনেকগুলো ক্লাস একা এটেন্ড করেছে।আসলে সে আর চারু একে অপরের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু, চারুর সাথে তার আলাপ সেই কলেজ জীবন থেকে। এরপর তাদের বন্ধুত্ব এখন আরোও অনেক গভীর হয়। অনুদের বাসায় অনেক বার যেতে চাইলেও নানা কারনে আর তার যাওয়া হয়নি।আজ অনু এক প্রকার ব্ল্যাকমেইল করেই চারুকে তাদের বাসায় নিচ্ছে। চারু যদি তার বাসায় না যায় তাহলে কোনো নোটস সে তাকে দিবে না,অগ্যতা চারু বাধ্য হয়ে এখন এই দুপুরের ফাঁটা রোদ্দুরে ছুঁটছে অনুর বাসায়।চারুদের বাসা থেকে অনুর বাসার দুরত্ব ৩০ মিনিট।দুপুরের প্রথম প্রহর হওয়ায় একটা ওটোও পায়নি চারু।রিক্সায় যাওয়ার মতন ভাড়া তার কাছে হবে না তাই পা দুটোই তার ভরসা।



বাসায় থেকে থেকে অনু অস্থির ভাবে পায়চারি করছে আর বারবার মেইন গেইটের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু কাঙ্খিত মানুষটি এখনো এসে পৌঁছায় নি।চারু এই প্রথম তাদের বাসায় আসবে এ নিয়ে তার যে কত উত্তেজনা হচ্ছে ভিতর ভিতর তা বলা বাহুল্য। চারুকে সেই কলেজ থেকে সে কতবার তাদের বাসয় আনতে চেয়েছে কিন্তু বরাবরই কোন না কোন কারণে শেষ পর্যন্ত তার আর আসা হয়নি।চারুকে এ বাসায় আনার অবশ্য অনুর অন্যতম একটা উদ্দেশ্য আছে আর তা হলো তাকে তার মাকে দেখানো।নিজের সবচেয়ে কাছের এবং ঘনিষ্ঠ বান্ধবীটিকে সে তার ভাবি করে সারাজীবন নিজেদের বাড়িতে রাখতে চায়।একবার শুধু চারুকে তার মার পছন্দ হয়ে যাক তাহলেই কেল্লা ফতে।উফ তার ভিতরে যে কী রকম উত্তেজনা কাজ করছে,এর মাঝেই কলিংবেলের আওয়াজে অনুর অস্থিরতা মাখা মুখে হাসি ফুটে উঠলো।দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল চারু এসেছে ভেবে।যতটা হাসি মুখে দরজাটা খুলেছে ততটাই নিরাশ মুখে দরজাটা বন্ধ করলো সে।
অনুজ বোনের এমন পরিবর্তন দেখে তার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

=কিরে আমাকে দেখে মুখটা অমন পেঁচার মতন করে উঠলি কেনো।আজকে কী আমাকে দেখতে এতই খারাপ লাগছে।

=দূর ভাইয়া সবসময় তোমার আমাকে কথায় কথায় গাট্টা মারতেই হবে এটা কী দিনে দিনে তোমার অভ্যেশ হয়ে গেছে।নিজের মাথা ঢলতে ঢলতে বলে অনু।

=এটা নাহয় আমার অভ্যেশ কিন্তু তুই এমন বাংলার পাঁচের মতন মুখটা করে নিলি কেনো আমাকে দেখে।

=আমি তোমাকে আশা করিনি এখন তাই।

=তাহলে কাকে আশা করেছিস হুম
ভ্রু কুচকে বলে অনুজ।

=আমার বেস্টি চারুল,,,
পুরো নামটা উচ্চারণ করার আগেই আবার বেল বেজে উঠলো।অনুও ভাইয়ের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে দরজা খুলতে চলে গেলো।বোনের কাওকে নিয়ে এতো আগ্রহ দেখে অনুজেরও ইচ্ছে হলো সেই আগুন্তকঃ কে দেখার তাই সেও দাঁড়িয়ে রইলো হাতে অফিসের ফাইল নিয়ে।
অনু দরজা খুলতেই তার সামনে আসা মানুষটির উপর ঝাপিয়ে পরে বল,
=দোস্ত ফাইনালি তুই এলি আমার বাসায়।তখনই চারু বলে উঠলো,

=এ খাচ্ছর মাইয়া আমারে ছার তো পুরা শরীর ঘামে চুব চুব করছে আর সে আসছে এখন পিরিত করতে।বলতেই অনু চারুর নাক টেনে বলল,

=সত্যিকারের ভালোবাসলে ঘামে ভেজা চুবচুবে শরীরেও সুঘ্রাণ পাওয়া যায় চারুমনি।
বলেই দুজন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
এদিকে চারুর হাসির শব্দে অনুজের বুকটা যেনো মৃদু কেঁপে উঠলো।তার চোখ হঠাৎই অনুর আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখতে চাইছে।কেনো যেনো তার মন বলছে ওই মুখটা দেখার জন্যই সে এতোকাল অপেক্ষা করছে।দূর থেকে দাঁড়িয়েই দেখার চেষ্টা করছিলো অনুজ।ততক্ষণে অনু চারুকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
পরনে নীল থ্রিপিছ,চুলে বেনুনি,চোখে হালকা কাজল যা ঘামে লেপ্টে গিয়ে পুরো মুখে ছড়িয়ে গেছে। কি দরুন মায়াবি চোখ মেয়েটার।এই চোখ দেখেই যেনো সে অনন্ত কাল কাটিয়ে দিতে পারবে।তার হঠাৎই মনে হলো এ মেয়েটাকেই তার চাই,তার প্রতিটা কিছুতে তার বিস্তার সে চায়,ঘামে লেপ্ট থাকা শরীরেও যেনো হাজরো সৌরভ ভাসছে মেয়েটার।লতানো শরীর যে তার মনে প্রেমের দোল খেয়ে গেছিলো সেই প্রথম যার অনুভূতি আজও ভুলতে পারেনি অনুজ।তার সেই ঘোরে দাঁড়িয়ে থাকার কোন এক মুহুর্তেই অনু চারুকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য বলে,

=ভাইয়া ও হলো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড চারুল,,
অনুর কথা শেষ করার আগেই অনুজ বলে উঠে লতা,আমার লাজুকলতা!
ততক্ষণে চারুর মুখ হা আর অনুতো ভাইয়ের কান্ডে দিশেহারা।



এরপর চারুকে পেতে অনুজকে চর তেমন বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি কারন অনুজের মায়েরও চারুকে অনেক পছন্দ হয়েছে। এর পরের সপ্তাহেই চারুর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় অনুজের মা।ছেলে,ছেলের পরিবার সবকিছু মনের মতন হওয়ায় চারুর বাবা-মাও আর বিয়েতে অমত করেনি।তার ফাইনাল পরীক্ষার পরেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে অনুজ চারুকে নিজের স্ত্রী রুপে ঘরে তুলে।
চারুলতার বিয়ের দিন সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলো তরু।ছোট বেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে যখন তার জেঠু তাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে তখন থেকেই সে নিজের বড় বোন রুপে চারুকে সবসময় পেয়েছে।চারু সবসময় আগলে রাখতো তরুকে।চারুর যখন বিয়ে হয় তখন তরু সবেমাত্র একাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিলো।তার জীবনে এই ষোলটি বছর তার আপুমনিই তাকে আগলে রেখেছে সব বিপদ থেকে।আজ সে আপুমনির হঠাৎ দূরে চলে যাওয়াটা অনেকটা কষ্টদায় তরুর কাছে।তবুও সব শেষে চারুকে নিজের পিত্রালয় ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।
অনুজের সাথে চারুর বিয়ের পর তার জীবনে যেনো সুখের এক অন্য ফুয়ারা চলে এসেছিলো।সে তখন নিজেদের নতুন জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
এদিকে চারুর অবর্তমানে তরু একা হয়ে গেলো।এই একাকিত্বের সময়টায় তার বেশি বেশি করে নিজেদের অতীতের কথা মনে পড়ত।তার বাবা-মায়ের এক্সিডেন্ট, তার সাজানো জীবনে হঠাৎ বিপর্যয় সবটা মিলে সে দিনকে দিন একটা ট্রমার মধ্যে চলে যাচ্ছিল।ঠিক তখনই তার জীবনে আসে এক আগুন্তকঃ। যে কিনা তখন তাকে নতুন এক অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়েছিলো,যাকে পেয়ে ধীরে ধীরে তরুও যেমন নিজের ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠছিলো তেমনি নতুন ভাবে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলো সে।একটা সময় সে আগুন্তকঃই হয়ে উঠলো তার নেশা!যে নেশা কাটানো সম্ভব ছিলো না,যে নেশা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে তাকে ধীরে ধীরে খাদের কিনারায় নিয়ে যাচ্ছিল,যা সে টেরও পায়নি।আসলে অতিরিক্তই দুঃখে মানুষ যেমন ভুল সিদ্ধান্ত নেয় তেমনি অতিরিক্ত আবেগে মানুষ দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ে।যেটা তরুর সাথে ঘটেছিলো।সে ভুল সময়ে ভুল মানুষকে নিজের সাথে জড়িয়ে ফেলছিলো।যদিও সে মানুষটার কর্ম ভুল থাকলেও তার ভালোবাসাটা ছিলো খাঁটি। কিন্তু ভুল তো ভুলই হয় সব সময় তাকে শোধরানো যায় না।আর যদিও বা শোধরানো যায় তবে তাকে অনেক বড় মূল্য দিতে হয়।তরুকেও দিতে হয়েছে মূল্য, কিন্তু সে তার ভুলের মূল্য দিতে গিয়ে অনেকগুলো সম্পর্কের সমীকরণ বদলে দিয়েছে। যে সমীকরণ সে চাইকেও আগের রুপে ফিরিয়ে আনতে পারবে না!!!

অতঃপর বাকীটা পরবর্তী পর্বে,

ইডিট করিনি ভুল-ক্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।।