সম্পর্কের দেয়াল পর্ব-০৯

0
362

#সম্পর্কের__দেয়াল
#নবম__পর্ব
|#Writer_AnaHita_Ayat_SumaiYa|
রিধির বাবা মা সহ পাভেলের মা ড্রয়িংরুমে বসে আছে। রিধির মা হায় হায় করছেন আর রিধির বাবার মাথায় হাত। ঘর থেকে বাহিরে পা বাড়ালেই শুনতে হচ্ছে কটু কথা। রিমি শেষে এরকম একটা কাজ করবে কারো ই ভাবান্তরে ছিলো না। রিধি কথা টা জানার পর খুব আপসেট হয়ে পড়ে। এতো কিছু করার পর রিমি কে আটকাতে পারে নি সে! ধীর পায়ে রিমির পুরো ঘর খুঁজে দেখলো সব উলট পালট। আলমারি ওবারড্রপে কোনো জামা কাপড় নেই একে বারে খালি। রিমির কোনো সাজ সজ্জার সরঞ্জাম ও নেই। এতে করে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে রিমি প্ল্যান করেই পালিয়েছে। রিধি চোখ বন্ধ জোড়ে জোড়ে কয়েক টা নিশ্বাস নেয়। খুব সাবধানে সিড়ি বেয়ে নিচে আসার চেষ্টা করে। শরীর দুর্বল লাগছে পেটে ব্যথা আর নেই। কান্না করতে করতে পাথর হয়ে গেছে সে। তবে এখনো ছোট্ট প্রাণ টার মৃত্যুর দায় পাভেল বা রিমি কাউকে দিতে পারছে না। কারণ কোনো উপায় নেই ওদের দোষী বলার। তবে রিমির এই পালিয়ে যাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে এতে ওদের কোনো না কোনো সংযোগ অবশ্যই আছে। যখন দেখলো সবাই রিধি কে নিয়ে ব্যস্ত ব্যাস রিমির রাস্তা একেবারে ক্লিয়ার। কারো বিন্দু পরিমান ও জানার অবকাশ ছিলো না।

রিধি কে আসতে দেখে পাভেলের দ্রুত এগিয়ে যায় তার দিকে। সতর্কতার সুরে বললো,
‘রিধি তুই কেন নিচে আসতে গেলি? তুই অসুস্থ!’

‘আমি ঠিক আছি মা!’

পাভেলের মা রিধি কে ধরে সোফার রিধির বাবা মায়ের মাঝখানে বসিয়ে দেন। ভীষণ মন মরা দেখাচ্ছে উনাদের। পাভেলের মা নিজে কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। শান্তনা দেওয়ার ভাষা উনার জানা নেই। রিমি শেষে পরিবার মাথা সমাজের কাছে নিচু করে কোনো ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাবে তিনি ঠিক মানতে পারছেন না। রিমির যদি একান্তই পছন্দ থাকতো তাহলে বলতো কিন্তু তা না করে যা করলো এটা একেবারেই কারো কাম্য নয়। এমন টা না করলেও পারতো রিমি। রিধির এই খারাপ সময়ে কিভাবে এরকম একটা বাজে করতে পারলো সে? রিমি যেখানেই থাকুক ধরে নিয়ে এসে কষে চড় মারা উচিত। ছিঃ বংশের মান ইজ্জত আর রাখলো না।

আচ্ছা বাবা মা রা কি ছেলেমেয়েদের এই জন্য লালন পালন করে বড় করে তোলে? শেষে সকলের কাছে বাবা মায়ের মাথা কাটানোর জন্য? এমন সন্তান থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো! পাভেলের মা রান্না ঘরের দিকে যায়। উনি চলে যেতেই রিধির মা রিধির এক হাত চেপে ধরে। রিধি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখছে সব! তিনি প্রচন্ড রকমের অসহায়ত্ব জড়ানো কন্ঠে গেঁথে বললেন,

‘রিধি… রিধি রে এটা কি হলো বলতো! আমার মনে হচ্ছে রিমি ই তোর এতো বড় ক্ষতি টা করেছে! নাহলে ও এভাবে পালাতো না।’

‘মা…

রিধির বাবা রিধি কে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘দুধ কলা দিয়ে আমরা এতোদিন একটা কাল সাপ পুষেছিলাম। আমাদের খেয়ে আমাদের পড়ে আমাদের মুখেই চুন কালি মাখালো ছিঃ। লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার।’

‘আমি নিশ্চিত রিমি আর পাভেল ই আসল খুনি। ওরা মেরেছে নিষ্পাপ বাচ্চা টা কে। রিমি পাভেলের কথাতেই পালিয়েছে। কিভাবে পারলো ওরা এটা করতে? এতো নিষ্ঠুর কিভাবে হয় মানুষ?’

৩ জন ই কাঁদছে। ৩ জন ই কম পাহারায় রাখে নি রিমি আর পাভেল কে কিন্তু কিভাবে ফাঁদ কেটে বেরিয়ে গেলো কারো বুঝার উপায় ছিলো না।
রিধির মা বললেন,

‘রিধি রিমির ফোনের কল দিয়ে দেখ তো কল যায় কিনা?’

‘মা আমি ওর সিম টা আগেই খুলে আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম যাতে ও পাভেলের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে না পারে!তাও বুঝতে পারছি না ও গেলো কি করে?’

‘বেয়ান কে কি উনার ছেলের এই কুকাজের কথা জানাবো?’

রিধি আতঁকে উঠলো।

‘মা আমাদের কাছে এখন কোনো প্রমাণ নেই। এই কাজ টা করা কি আদৌ ঠিক হবে? উনি তো বিশ্বাস ই করবেন না। পরে অন্য আরেক ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে মা!’

‘কিন্তু এখন আমরা কি করবো বল?’

রিধির বাবা বললো,
‘তুই পাভেলের কাছে কল দে তো!’

‘আচ্ছা দিচ্ছি!’

রিধি পাভেলের নাম্বারে কল দেওয়ার ট্রাই করলো কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে। ব্যাস বুঝতে বাকি রইল না কাহিনী।

‘দেখেছিস বলছিলাম না আমি। দুই শুয়োর একসাথেই আছে। দুইটাকে পেলে মেরে পিঠের চামড়া তুলে ফেলবো দেখিস!’

‘রিধি কি করবো এখন আমরা?’

‘চলো আমরা গিয়ে পুলিশ কে ইনফর্ম করি। উনারা যদি কিছু একটা করতে পারেন!’

রিধির কথা শেষ করতে পারলো না। হঠাৎ রিধির বাবার ফোনে ইমনের বাবা কল করেন। বুঝার বাকি রইল না যে রিমির পালিয়ে যাবার খবর রটতে রটতে তাদের কান ওবধি ও চলে গেছে। রিধির বাবা কল রিসিভ করলো,

‘এসব কি শুনছি আমরা? কাল গায়ে হলুদ আর আজ মেয়ে পালিয়েছে?’

‘সত্য কখনো গোপন থাকে না!’

‘আপনাদের মেয়ে এমন ছিঃ দেখতে শুনতে তো আপনাদের ভদ্রলোক ভেবেছিলাম কিন্তু মেয়ে এমন তাহলে বাবা মা ই বা কেমন হবে? এই শিক্ষা দেন মেয়ে কে?’

আরো কিছুক্ষণ কথা শোনালো রিধির বাবা কে তিনি একদম নিশ্চুপ। রিধি সব শুনে রেগে যায় অতঃপর ফোন টা তার বাবার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বললো,

‘আমরা অভদ্র আর আপনারা ও বুঝি খুব ভদ্রলোক? এই আপনাদের ভদ্রলোকের পরিচয়? আমরা যদি জানতাম ই রিমি এমন কিছু করবে পায়ে শিকল বেঁধে রাখতাম বুঝলেন। হাহ নিজেদের ভদ্রতা আগে একবার ভেবে দেখবেন। থাক রিমির হয়ে আমরাই ক্ষমা চাচ্ছি আপনাদের কাছে। ক্ষমা করে দেবেন। রিমি না পালালে আপনাদের মতো এতো ভদ্রলোক দের কাছে আমি আমার বোন কে বিয়ে দিতাম ও না।’

আরো কিছুক্ষণ রিধি শাসিয়ে কল কেটে ফোন বন্ধ করে দেয়। মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক বলতে কিছু নেই। মেয়ে আকাম করেছে কোনো পরিবার ই নিশ্চয়ই এটা জেনে বুঝে মেয়ে কে করতে দেন না! কোনো পরিবার চায় ও এটা! আর অন্য মানুষ তা না ভেবে উল্টো কথা শোনাতে চলে আসবে। অথচ পরিবারের কথা একটা বার ও ভাববে না। যত্তসব আজাইরা!

———————
রিমি নিজের জমানো টাকা পয়সা গয়নাগাটি সব নিয়ে গাছ গোছ বেঁধে তবেই এই দুঃসাহসিক কাজ টি করেছে। বাড়ি…এলাকা‌‌ এবং..শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে আসে সে। ঠিক তার বিপরীত পাশের মানুষটির কথা মতো!রিমির এই দূর সাধ্য কাজ টি তে একজন তো সাপোর্টার হিসেবে ছিলোই। আর সেই মানুষটি পাভেল! রিমি গাড়ি থেকে নেমে মুখ থেকে হিজাব টা সরিয়ে প্রাণ ভরে অক্সিজেন গ্রহণ করতে থাকে। টানা ৪ ঘন্টা গাড়ি তে থেকে থেকে অবস্থা খারাপ তার উপর বোরখা হিজাব পরে। পাভেল মুগ্ধ নয়নে রিমি কে দেখছে। কারণ এই রিমি কে আজ অন্য রকম লাগছে। রিমি তা দেখে দৌড়ে এসে পাভেল কে জাপটে ধরে। পাভেল ও সেইম। পরম আবেশে কোনো অন্য জগতে হারায় দুজন। সে জগত ভালোবাসার প্রশান্তির। আর ওদিকে সব লন্ডভন্ড। এদিকে সব গোছানো। রিমি এক গাল হেসে ভ্রুঁ নাচিয়ে বললো,

‘কেমন দিলাম বলো তো?’

‘একদম ফাটাফাটি!’

‘এই কাজে আমি একা পারতাম না তুমি ছিলে বলেই সফল হয়েছি! থ্যাঙ্কিউ!’

‘হু। আর ওদিকে কি অবস্থা?’

‘বাচ্চা টা মরেছে নিশ্চয়। হাহাহা এখন আমাদের পথ পরিষ্কার কোনো বাঁধা বিপত্তি নেই আর কেউ খুঁজে ও পাবে না আমাদের তাই না?’

‘হুম কারণ আমরা এখন শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি!’

মূলত এইসব পাভেলের সাজানো ছিলো। রিধির অসুস্থতা আর রিমির পালানো টা। পাভেল তার এই প্ল্যানের জন্য মিটিং এ পর্যন্ত এটেন্ড করে নি। অথচ এতে তার চাকরি হারানোর আসঙ্কা ও আছে। বস কে ফোন দিয়ে ও দেখে নি। পাভেলের ফোন তারা যেই লোকেশনে আছে তার থেকে আরো ১০০ কিলোমিটার দূরে থাকাকালীন সে ফোন বন্ধ করে ফেলে। সাবধানতার জন্য এই কাজ কেননা পাভেলের কল ট্রেস করে যদি তাদের খুঁজে বের করে ফেলে তাহলে?

পাভেল আর রিমি এখন কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আছে। হোটেল বুক করে রেখেছে পাভেল আগে থেকেই। বাহ কি শান্তি। দুজনার স্বপ্নের রাজ্য যেনো এটি। ওদিকের কোনো রকম চিন্তা টেনশন ওদের মনে আনাচে কানাচে ভুলে ও নেই। রিমি হঠাৎ করে বলে উঠলো,

‘এই যে মিস্টার পাভেল শুনুন আপনি আমাকে বিয়ে না করা ওবধি আর টাচ্ করতে পারবেন না বুঝেছেন?’

‘ও ম্যাডাম তাই নাকি? আচ্ছা চলুন তাহলে!’

‘কোথায়?’

‘বিয়ে করতে’

‘কিহ সত্যি?’

‘হুম একদম ফরমালিন মুক্ত!’

রিমি খিলখিল করে হাসছে সাথে পাভেল ও।

‘তা আমাদের বিয়ের সাক্ষী কে হবে শুনি?’

‘ব্যবস্থা হয়ে যাবে চলো তো!’

তারা দুজন সত্যি ই বিয়ে করে নেয়। সাক্ষী ছিলো এখানের কয়েকজন লোক। কারণ তারা পরিচয় দিয়েছে এই ভূবনে সাত কুলে তাদের গার্ডিয়ান বলতে কেউ নেই। দুজন অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। কতটা নিচে নামলে মানুষের পক্ষে এসব করতে সম্ভব হয় আমার জানা নেই!

তারা হোটেলে ফিরে আসে। রিমির মাথায় চেপে বসলো অন্য এক ভূত। সে মুখ গোমড়া করে বসে আছে তা দেখে পাভেল বললো,

‘কি ব্যাপার বউ মন খারাপ কেন? এখন তো অনেক খুশি হওয়ার কথা তাই না? আমরা বিয়ে করেছি তোমার স্বপ্ন এখন বাস্তব!’

‘হুম!’

পাভেল দেখলো তাও রিমির মন খারাপ…

‘ও বউ কি হয়েছে বলবে তো!’

‘তুমি আমাকে বিয়ে করেছো ঠিকই কিন্তু ওই ডাইনী টা কে কি ডিভোর্স দিয়েছো? দাওনি! নিয়ম মাফিক তো ও এখনো তোমার বউ!’

‘ও আচ্ছা এই ব্যাপার!’

পাভেল হো হো করে হাসলো। রিমি ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,

‘হাসছো কেন তুমি? আমি হাসার মতো কিছু বলেছি?’

‘তোমাকে কে বলেছে আমি রিধি কে ডিভোর্স দেইনি?’

‘তার মানে? (রিমি পাভেলের কথা টা শুনে বেশ উৎসুক হয়ে তার দিকে তাকালো?’

‘তার মানে হলো…. (পাভেল সুটকেস থেকে একটা ছোট্ট ব্যাগ বের করলো। সেখান থেকে একটা কাগজ বের করে হেসে রিমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো) মানে হলো এইটা!’

‘এইটা কি?’

‘দেখো ই না!’

রিমি পাভেলের হাত থেকে কাগজ টা নিয়ে সমস্তটা পড়ে দেখে চোখ বড় বড় করে মুখে হাত দিয়ে হা করে বললো,

‘তোমার আর ওই ডাইনীর সিগনেচার দেওয়া এই ডিভোর্স পেপার?’

রিমি পাভেল কে আবারো জাপটে ধরে খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললো,

‘ও মাই গড……! পাভেল তুমি যে আমায় কি খুশি করলে তা বলে বুঝাতে পারবো না গো…..!

চলবে____________