সম্পর্কের দেয়াল পর্ব-১৮

0
339

#সম্পর্কের__দেয়াল
#Writer_AnaHita_Ayat_SumaiYa
#পর্ব__১৮
কেটে গেছে এক সপ্তাহ,

আজ থেকে এক সপ্তাহ আগে যেদিন রিমি রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় সেদিন আবার যখন সে বাড়ি ফিরে আসে, ঠিক সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত পাভেলের মায়ের সব অপমান মূলক কথা বার্তা অবহেলা মুখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে গেছে সে। এর কারণ একটাই এক সপ্তাহ পরেই এই অাগাছা জীবন থেকে চিরতরে বিদায় হয়ে যাবে। তবে তার আগে প্যারালাইসিসে আক্রান্ত একবার হয়ে গেলেই রিমি এই সব অবহেলা অপমানের প্রতিশোধ একটু একটু করে তুলবে। মজার ব্যাপার হলো তখন তিনি মুখ ফুটে বলতে পারবেন না কেননা প্যারালাইসিস হলে তিনি বাকশক্তি ও হারাবেন।

এই এক সপ্তাহে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। কারণ এই সব সহ্য করার কথা তার কখনো কল্পনায় ও আসে না। যতবার ই পাভেল মায়ের কার্যকলাপ শুনে রিমি কে শান্তনা দিতে এসেছে যে, ‘দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে!’ ঠিক তখনি রিমি এক্টিং করা চোখের পানি মুছে মনে মনে হাসি ও বাস্তবে কান্নার ভং ধরে বলেছিলো,

‘আমি কিছু মনে করি নি পাভেল। উনি ই তো আমার মা। মা রা তো মেয়েদের ভুল হলে কথা শোনাবেই। আমি কিছু মনে করি নি!’

পাভেল রিমির দু গালে হাত রেখে সন্তুষ্টির হাসি হেসে বললো,

‘আমার লক্ষ্মী বউ!’

পাভেল রিমি কে জড়িয়ে ধরে। আর সে তো মনে মনে মায়ের শেষ পরিণতির কথা মনে করে হাসছেই! আজ শত অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। রিমি তো প্রচন্ড খুশি। তবে একটা স্যাড নিউজ রয়ে গেছেই। তা হলো পাভেল ৭ দিনে ৩ টা ইন্টারভিউ দিয়েছে কিন্তু জব পায় নি একটা তে ও। এখন জব পাওয়া খুব মুশকিলের ব্যাপার কিনা! তবে রিমি সমানে পাভেলের পাশে আছে! তার ভরসা জব একদিন সে পেয়ে যাবে। এবং তা অতি শীঘ্রই!

দিশা কে সাথে নিয়ে রিমি আজ ও সেই হাসপাতালে যাবে তাই সে রেডি হয়ে নেয়। পাভেল কে আগেই বলে দিয়েছে যে দিশার সাথে একটা জরুরী কাজ আছে। তাই যাবে। তবে কাজ টা নিজের বলে নি বলেছে দিশার। তাই ও আর আপত্তি করে নি। যথারীতি নিচে আসে সে আর পাভেলের মায়ের সামনে তাকে পড়তে হয়! চোখ রাঙিয়ে কিছুক্ষণ দেখলো তাকে। ভারী বেহায়া মেয়ে বলা চলে একে। কারণ এই কয়েক টা দিনে কয়েক শ অপমান করেও বাড়ি ছাড়া করতে তিনি সক্ষম হন নি।

‘কোথায় যাচ্ছিস তুই?’

‘আসলে মা দিশার বাসায় যাচ্ছি ওর নাকি কি জরুরী কাজ আছে!’

‘কতো নারে বলেছি তোকে যে আমাকে মা ডাকবি না!’

‘তো কি হয়েছে আপনি তো আমার মা ই!’

তিনি আর কিছু না বলে রেগে মেগে সেখান থেকে চলে যেতে পা বাড়ান। ও ফের বলে উঠে,

‘দোয়া করবেন মা যেনো আমি সাবধানে গিয়ে পৌঁছালো আর উদ্দেশ্য সফল করতে পারি!’

আর মনে মনে বললো,
‘আপনাকে যেনো খুব সুন্দর করে সহিহ্ সালামতে উপরে পাঠিয়ে দিতে পারি মেরি পেয়ারি মাম্মিজি!’

বাড়ি থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে নেয় সে। খুশির ঠেলায় উৎসাহ চেপে রাখতে না পেরে দিশা কে কল দেয়। কল দুবার রিং হওয়ার সাথে সাথেই তুললো সে।

‘হ্যাঁ দিশা তুই রেডি হয়েছিস?’

‘হুম! আমি ও ভাবলাম এক্ষুনি তোকে কল দিবো তার আগে তুই ই দিলি যাক ভালোই হলো কই তুই? রেডি হয়েছিস?’

‘হুম এই তো আমি রিকশা নিলাম মোড়েই দুজন এক হবো। তুই এখানে আয় আর একটু অপেক্ষা কর আমি চলে‌ আসবো!’

‘আচ্ছা ঠিক আছে আয়!’

‘আর শোন…

‘হ্যাঁ বল!’

‘আস..আসলে ওই টাকা…

‘আরে এতো আমতা আমতা করার কি আছে আমি টাকা নিয়েছি তোর ম্যানেজ হয়েছে?’

‘হুম!’

‘গুড তাড়াতাড়ি আয়!’

‘আচ্ছা বায়!’

‘বায়!’

কথা বলে বেশ খুশি হলো দুজন ই। মোড়ে গিয়ে দুজন এক হয় এন্ড সেখান থেকে একটা সিএনজি নিয়ে দুজন ই বেরিয়ে পড়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।

হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছায় দুজন কিন্তু তৃতীয় জন কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ওয়েট করতে করতে বিরক্ত হয়ে যায় তারা। এভাবে আর কতক্ষণ? তাছাড়া উনার নাম্বার টা থাকলে কল করে অবস্থা জানা ও তাড়াতাড়ি আসতে বলা যেতো কিন্তু নাম্বার ও রাখে নি বলদামি করে। যাই হোক কি আর করা অপেক্ষা ছাড়া কিছুই করার রইল না। প্রায় ১ ঘন্টা লেট করে আসে‌ কবির। বেচারা কে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করেই এসেছে। ঘেনে শার্ট ভিজে এককার।

‘আর ইউ ওকে?’

‘ইয়াহ আ’ম ওকে! আসলে আমি একটু জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিলাম কাজ শেষ হতেই প্রাণপনে ছুটে এসেছি!’

‘ইট্স ওকে আমাদের জিনিস টা?’

‘বিয়ে এসেছি!’

কবির রিমির হাতে ঔষধ গুলো দেয় পর বলে,
‘এগুলা খেলেই অটোমেটিক্যালি শরীর অবশ হয়ে যাবে। শরীরের শিরা উপশিরা নিজেকে কাজে ব্যাঘাত ঘটাবে!’

রিমির আনন্দ আর দেখে কে।

‘ধন্যবাদ ভাই অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক বড় উপকার করলেন!’

‘এখন আমাকে আমার টাকা টা?’

‘এই নিন!’

দিশা নিজের দশ হাজার আর রিমি ভিশ হাজার টাকা দিলো। মোট ত্রিশ হাজার টাকা বুঝে পেয়ে কাবির নিজেও খুব খুশি হয়। কারণ এই টাকায় তার বউ আর বাচ্চা বেঁচে যাবে। অথচ সে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারে নি পাপা বাপ কেও ছাড়ে না। তার টাকা পাওয়ার পদ্ধতি টা অবৈধ ও জায়েজ নয়‌ একে বারেই। অন্য কারো জীবন সংকটে ফেলে নিজের আপন জন কে বাঁচাতে চেয়ে সে বিরাট বড় ভুল করেছে নিজের অজান্তেই। যা বিপদ কে টেনে নিয়ে আসে নিজের দিকে। কেননা একটা কথা আছে সৎ সঙ্গে সর্গবাস আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। এই অসৎ কে সঙ্গ দিতে সে নিজের সর্বনাশ কেই নিজ থেকে ডেকে বসে আছে।

কবির খুশি মনে নিজে ও ওদের দুজন কে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে যায় নিজ গন্তব্যে। দিশা কে রিমি নিজের বাড়ি তে নিয়ে যায়। খুশির চোটে রিমি কতো উল্টা পাল্টা কাজ করে ফেলছে নিজেও জানে না। তার অবস্থা দেখে দিশা হাসলো,

‘পাগলী একটা.!’

রিমি বিকেলেই নিজ গন্তব্যে ফিরে যায়। কিন্তু ঔষধ গুলো পাভেলের মা কে খাওয়ানোর আগেই সে বাড়িতে এসে জানতে পারে তিনি আর এখানে নেই!

‘মানে কি? পাভেল এসব কি বলছো তুমি?’

‘রিল্যাক্স রিমি! এমন রিয়েক্ট করছো কেন?’

‘আরে আ্ আমি ত্ তো জাস্ট জানতে চাচ্ছি!’

‘মা উনার বোন মানে আমার খালার বাসায় গেছে কয়েক দিনের জন্য!’

সিটট! প্ল্যানে একবারে জল ঢেলে দিলেন যেনো। তাও যেই সেই জল নয় একবারে ঘোলা জল। হাতের আঙ্গুল ফঁসকে বেরিয়ে গেছেন তিনি। মুহুর্তের মধ্যেই রিমির সব খুশি উধাও হয়ে গেলি। মন হয়ে গেলো ভার। মুডের অবস্থা চূড়ান্ত পর্যায়ে খারাপ। সে কি ভেবেছিলো আর কি হলো ধ্যাত!

রাগ নিজের উপরেই ঢাললো এ ছাড়া তো আর করার কিছু নেই। ১৫ দিন কেটে যায় পাভেলের মা আর এখানে আসে না। রিমি তো অপেক্ষা করতে করতে শেষ। দিশা কে সব জানিয়েছে দিশা বলেছে ভালো কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে! কিন্তু আর কত?

পাভেল দেখলো রিমি মন খারাপ করে বসে আছে। তাই সে এসে আলতো করে রিমির হাত ধরে বললো,

‘কি হয়েছে রিমি? কোনো সমস্যা?’

‘হুম!’

‘কি?’

‘মা কে খুব মিস করছি প্লিজ উনাকে বাড়িতে চলে আসতে বলো না প্লিজ প্লিজ!’

পাভেল চমকালো না বরং মায়ের প্রতি তার বউয়ের এতো ভালোবাসা দেখে দারুণ খুশি হলো। সঙ্গে সঙ্গেই ফোন দেয় পাভেল। কল রিসিভ করলে রিমি কে ধরিয়ে দেয়। রিমি বললো,

‘মা আপনি এখানে চলে এসুন না। আমার এই বাড়িতে ভীষণ একা একা লাগছে। প্লিজ চলে আসুন না। কত দিন আপনাকে দেখি না!’

এতেও কোনো কাজ হলো না তিনি মুখের উপর নাকোচ করে দেন। জানিয়ে দিলেন আসবেন না। সে আবারো হতাশ হয়। যেহুতু সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠলো না তাই আঙ্গুল এবার বাঁকানো প্রয়োজন তাই পাভেলের সাথে প্ল্যান করে বললো,

‘এবার দেখবা মা ঠিক ই চলে আসবে।’

‘বাহ বউ তোমার আইডিয়া টা তো জোস!’

পাভেলের মিথ্যা অসুস্থতার কথা জানানো হয় তাকে। এতে যখন তিনি বিশ্বাস করলেন না তো পাভেল অসুস্থতার এক্টিং করে কথা বলে মায়ের সাথে। যত যাই হোক ছেলে তো তাই তিনি ঠিক করে নেন এবার তার যাওয়া উচিত। সব গুছিয়ে ঠিক করেন বিকেলেই রওয়া দিবেন।

এদিকে উনি আসবে শুনে রিমি খুশি হয়ে যায়। তাই পাভেল কে কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি বলে বসিয়ে রেখে খুশি মনে রান্না ঘরে চলে যায়। পাভেল একা একা বসে ছিলো। হঠাৎ করে তার ফোনে ফের কল আসে। তবে এবার তার মা নয় মায়া কল দিয়েছে। রিধির সেই পরিচিত ডাক্তার আপা যার নাম মায়া। পাভেল ভাবলো ইনি আবার কেন কল দিবে কিছু একটা ভেবে রিসিভ ও করলো,

‘কি ব্যাপার পাভেল সাহেব আপনাদের তো দেখি খোঁজ খবর ও নেই। রিধির নাম্বার ও বন্ধ পাচ্ছি। আপনাদের সাথে একবার দেখা করা প্রয়োজন বাট দেখুন না আমার সময় ই হয়ে উঠছে না। তাছাড়া অনেক দিন অন্য এক জায়গায় ছিলাম আজ ই এখানে এই হাসপাতালে এসেছি যাগ্গে আজ একটু ফ্রি আছি চলে আসুন জরুরি কথা আছে!’

মায়ার কথা শেষ হতেই কল টা কেটে যায়। পাভেল দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যায় রিমির নাম নিতে গিয়ে মায়া ভুলে রিধির নাম নিয়ে নেয় নি তো। আর কি জরুরী কথা থাকতে পারে? আবার সে যে এদিক থেকে আবার কল ব্যাক করবে তার ও উপায় নেই। কারণ ফোনের ব্যালেন্স তার মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়েই তা শেষ হয়ে গেছে। পাভেল আবারো কিছু একটা ভেবে শার্ট গায়ে দিয়ে রিমি কে বললো,

‘বউ আমি এক জায়গায় যাচ্ছি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো!’

‘আরে তোমার কফি টা?’

‘এসে খাবো!’

‘আচ্ছা সাবধানে যেও!’

পাভেল রওয়ানা দেয় হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

এদিকে আজ কবিরের বউয়ের সিজার হয়। খুব সুন্দর ফুটফুটে একটা ছেলে হয়েছে তার। মা আর বাবু দুজন ই ঠিক ছিলো কবির কে কিছু টাকা পে করতে বলা হয়। টাকা দিয়ে কবির ফিরে আসতেই মিনিট কয়েকের মধ্যেই যেনো মা আর বাবু টার মধ্যে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এক পর্যায়ে জলজ্যান্ত সুস্থ্য বাচ্চা টা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। আর কবিরের বউয়ের অবস্থা ও খুব সিরিয়াস হয়ে যায়। উক্ত কান্ডে উপস্থিত সব ডক্টর সব মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়ে। জাস্ট কয়েক মিনিটে কিভাবে সব এভাবে গন্ডগোল হয়েছে গেলো কারো মাথায় ই আসছে না। আইসিইউ তে নিয়ে যাওয়া হয় কবিরের বউ কে। কবির ছোট বাচ্চাদের মতো পড়ে কাঁদতে থাকে। তার মা বলে আল্লাহ কে ডাকতে। যাতে তার বউয়ের প্রাণ ভিক্ষা দেয়। কবির তার মায়ের কথা শুনে জায়নামাজ বিছিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে প্রভুর দরবারে।

দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে চোখের পানি বাঁধ ভাঙা নদির মতো ছেড়ে দিয়ে সালাম ফিরাতেই। তার মনে হতে থাকলো পুরো ব্যাপারটি। হয়তো প্রভু ই তার ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন ভেবে কবির সেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ছুটতে থাকে ঐ হাসপাতালে। যেখানে সে রিমি আর দিশার দেখা পেয়েছিলো সেখানে। তার মনে হতে থাকলো তার পাপ মোচনের শেষ চেষ্টা করেও যদি তার বউ কে বাঁচানো যায় তো…..!

চলবে________________