সে এবং আমরা পর্ব-০১

0
332

#সে_এবং_আমরা(১)
*******************
দরজা খুলে সামনে যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, সে আমার স্বামীর আগের স্ত্রী, লিমা। সামনাসামনি তার সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি; কিন্তু তার ছবি দেখেছি বলে তার চেহারাটা মনে আছে। আমি যে তাকে চিনতে পেরেছি, এটা তাকে বুঝতে দিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাকে চাচ্ছেন?’

‘এটা কী সজলের বাসা?’

‘কোন সজলের কথা বলছেন?’

‘এটা মাহমুদুল ইসলাম সজলের বাসা?’

‘জি।’

কী আশ্চর্য ব্যাপার, তার মুখে সজলের নামটা শুনতে আমার একদম ভালো লাগল না। কেন এমন লাগল, আমি নিজেই বুঝলাম না!

‘ও কী বাসায় আছে?’

‘না।’

‘কোথায় গেছে? আমার একটু দরকার ছিল।’

‘সজল অফিসে।’

এরপর যেন তার কথা শেষ হয়ে গেল। সে হয়ত ভেবেছিল সন্ধ্যার পর এই সময়টায় সজল বাসায় থাকবে। সজল থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতো। আমার কাছে নিজের কোন পরিচয় দেবে, এটা নিয়ে সে হয়ত চিন্তিত। আমিও কিছু না বলে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে সে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সজল কখন আসবে?’

‘ওর আসতে রাত হবে।’

আমি কথা বলছি আর ভাবছি এক্স হাজব্যান্ডের কাছে তার কী এমন দরকার থাকতে পারে, যে কারণে তাকে রাতের বেলায় সরাসরি বাসায় এসে হাজির হতে হবে? ফোন করলেও তো পারত। সজল তো ওর ফোন নাম্বার পালটায়নি।

‘আমি এক গ্লাস পানি পেতে পারি?’

এবার আমি ভালো করে তার দিকে তাকালাম। আজকাল খুব কম মেয়েকেই শাড়ি পরতে দেখা যায়। লিমার পরনে জাম রঙের সুন্দর একটা সুতির শাড়ি। কাঁধে ঝুলছে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। খোঁপাটা হয়ত সকালে বেঁধেছিল। সারাদিনের ছোটাছুটিতে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, তার মাঝেই কালো টিপটা জ্বলজ্বল করছে। ভাদ্র মাসের গরমে সাততলায় হেঁটে ওঠার কারণে সে শুরুতে একটু হাঁপাচ্ছিল। এখন ঠিক আছে।

কেউ পানি চাইলে, তাকে না বলা অসম্ভব। আমি তাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে পানি আনতে ভেতরে চলে এলাম। গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে চিন্তা করছি, পানি খাওয়ার পর সে কী চলে যাবে, নাকি নতুন কোনও আবদার করবে? আবদার করলে, আমি তখন কী করব? গ্লাসটা ট্রেতে বসিয়ে হাতে তুলে নিলাম। পরক্ষনেই নামিয়ে রেখে কিচেন কেবিনেট থেকে বিস্কুটের জারটা নিয়ে এসে একটা পিরিচে চারটা বিস্কুট নিলাম। আমার তো তাকে বিস্কুট দেওয়ার কথা না। বিস্কুট যে কেন নিলাম, নিজেই বুঝলাম না! আশ্চর্য তো, এত না বোঝাবুঝি কেন একসঙ্গে এসে হাজির হচ্ছে? চেয়ার টেনে বসে, নিজেই এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে নিলাম। তারপর ট্রে হাতে নিয়ে এসে দরজা খুলে দেখি, সে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ নামিয়ে ট্রে দেখে বলল, ‘আমি শুধু পানি চেয়েছিলাম।’

তার ক্লান্ত চেহারা দেখে খারাপ লাগল। বললাম, ‘ভেতরে এসে বসে খান, প্লিজ।’

সে বোধহয় এই কথাটার অপেক্ষাতেই ছিল। আমি বলার সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকে ফ্যানের নীচে গিয়ে বসল। আমি তার সামনের টেবিলে ট্রে নামিয়ে রেখে, ফ্যান চালিয়ে দিলাম। তাকে বসতে বলে কিচেনে চলে এলাম। চুলায় আলু-ডাঁটার তরকারি বসিয়েছিলাম। পানি শুকিয়ে তলাটা ধরে এসেছে। আরেক চুলায় মশলা কষানো চলছিল। মশলায় মুরগি দিতে যাব, ঠিক তখনই কলিংবেলটা বেজেছিল। এখন আর রান্নাবান্না করতে পারব না। যা করার, সে যাওয়ার পর করব। চুলাটা বন্ধ করে দিলাম। বেডরুমে গিয়ে মোবাইলটা নিয়ে এসে তার মুখোমুখি বসে বললাম, ‘একটা বিস্কুট মুখে দিয়ে পানি খেতেন।’

‘এখন কিছু খাব না। পানির তেষ্টা পেয়েছিল ভীষণ। বাইরে যা গরম!’

‘হুম, অনেক গরম পড়েছে। অবশ্য এই সময়ে এমনই গরম থাকে। তারওপর সাততলায় হেঁটে উঠেছেন দেখে আরও বেশি খারাপ লাগছে। লিফটটা সার্ভিসিং এর জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।’

‘তা একটু খারাপ লাগছে। আপনাদের ঢাকায় বেশি গরম। আমাদের ওখানে এত গরম পড়ে না। ঢাকায় তো গাছপালা নেই বললেই চলে। আমাদের ওখানে অনেক গাছ। সেই কারণেই গরমটা তুলনামূলক কম।’

আবহাওয়া বিষয়ক কথাবার্তার পর কিছুক্ষণ রুমের ভেতর নিরবতা রাজত্ব করল। সে হয়ত ভেবেছিল, আমি তার গ্রামের বাড়ি কোন জায়গায়, তা জানতে চাইব। আমি জানতে না চাওয়ায়, কথার গাড়ি সামনে এগোল না।

অস্বস্তি কাটিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।’

‘আপনি আমাকে চিনবেন না।’

‘আপনার নাম, পরিচয় কিছুই তো বললেন না। না বললে চিনব কেমন করে?’

‘নাম বললেও চিনবেন না বোধহয়। আমার নাম লিমা। সজল আমাকে চেনে।’

‘সজলের কাছে কেন এসেছিলেন? কোনও কাজ ছিল?’

‘হুম।’

‘কী কাজ?’

‘আমি আসলে সজলকেই বলতে চাচ্ছিলাম।’

‘আপনি ওকে ফোন করতে পারতেন? ফোন না করে সরাসরি বাসায় আসাটা কী ঠিক হল?’

‘আমার কাছে ওর ফোন নাম্বার নেই। থাকলে তো অবশ্যই ফোন করতাম।’

কী মিথ্যুক! তার কাছে নাকি ফোন নাম্বার নেই? অথচ বাসা চিনে ঠিক চলে এসেছে!

‘আপনি আমাদের বাসা চিনলেন কী করে?’

‘বাসার ঠিকানাটা আমার কাছে ছিল। আমরা দুজন একই গ্রামের। আমাদেরই এক বড়ো ভাইয়ের কাছ থেকে ঠিকানাটা নিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে।’

‘সজলের আজকে বাসায় ফিরতে রাত হবে। আপনি কী ততক্ষণ অপেক্ষা করবেন?’

‘আমার সমস্যা নেই। আমি অপেক্ষা করতে পারব।’

তোমার তো সমস্যা থাকবে না; কিন্তু আমার সমস্যা আছে। বরের এক্স ওয়াইফকে ঘরে বসিয়ে গল্প করার কোনও ইচ্ছাই আমার নেই।

‘আপনার বাসাটা অনেক সুন্দর।’

‘ধন্যবাদ।’

‘আপনারা দুজনেই থাকেন এখানে?’

‘না। আমার আম্মাও থাকেন। এখন অবশ্য আম্মা আমার আপার বসায় আছেন।’

‘ঢাকায় নাকি অচেনা কাউকে বসায় ঢুকতে দেওয়া না? আপনি আমাকে ঢুকতে দিলেন যে?’

‘হুম। অচেনা কাউকে বাসায় ঢোকানোর অনেক বিপদ। ঢাকা শহর হচ্ছে ভেলকিবাজির শহর। সারাক্ষণ সবাই সবাইকে ভেলকিবাজি দেখানোর চেষ্টায় থাকে। কেউই এখন অচেনা মানুষকে বাসায় ঢোকান না। তবে আমাদের এখানে সিকিউরিটি খুব ভালো। নীচে দুইজন গার্ড থাকেন। সিসি ক্যামেরা আছে। আচ্ছা আপনি ওপরে এলেন কী করে? অচেনা কাউকে তো এরা ফোন না করে বাসায় ঢুকতে দেয় না। আমাকে তো কেউ ফোন করেনি।’

‘আমাকে তো দিল। গার্ড অবশ্য বুঝতে পারেননি। আরও দুইজন তাঁদের পরিচয় দিয়ে ওপরে আসলেন। আমি তাঁদের সঙ্গেই চলে এসেছি। গার্ড ভেবেছে, আমরা তিনজন একসঙ্গে।’

‘আপনি কী কাজটা ঠিক করেছেন? এভাবে গার্ডকে ফাঁকি দিয়ে ওপরে চলে আসাটা কী উচিত হয়েছে?’

‘স্যরি। আমি আসলে এতকিছু চিন্তা করিনি।’

‘আমি সজলকে ফোন করছি। আপনি ওর সঙ্গে কথা বলেন।’

‘ফোন করতে হবে না। সজল আসুক, তারপর কথা বলি। আমার অপেক্ষা করতে কোনও সমস্যা নেই।’

‘না না, আপনি এতক্ষণ কেন অপেক্ষা করবেন? ওর তো আসতে রাত দশটার বেশি বাজবে।’

আমি সজলকে ফোনে পেলাম না। রিং হচ্ছে; কিন্তু সে ফোন রিসিভ করছে না। ফোনটা হয়ত সাইলেন্ট করে রেখেছে।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার বাসা কোথায়?’

‘আমি ঝিকরগাছা থেকে এসেছি।’

‘সেটা তো বুঝলাম, আপনাদের দুজনের গ্রামের বাড়ি এক জায়গায়; কিন্তু ঢাকায় কোথায় থাকেন?’

‘আমি ঢাকায় থাকি না। আমি সরাসরি ঝিকরগাছা থেকে এসেছি।’

‘ঢাকায় কোথায় উঠেছেন?’

‘এক বড়ো আপার বাসায়।’

‘ওহ। আপনি কী আরও অপেক্ষা করবেন?’

‘জি। একটু আগেই আপনাকে বলেছি, এসেছি যখন দেখা করেই যাই।’

সজলের ওপর ভীষণ বিরক্ত লাগছে। দরকারের সময় তাকে কখনও ফোনে পাওয়া যায় না। মানুষের তো ইমারজেন্সি বলেও একটা ব্যাপার থাকে। বিশ মিনিট হয়ে গেল, তাকে ফোন করেছি। সে কী একবার ফোনটা চেক করার সময় পাচ্ছে না? ভাবতে ভাবতেই সজলের ফোন এল। আমি উঠে বারান্দার কাছে এসে ফোন রিসিভ করলাম। ‘হ্যালো, এতক্ষণ লাগল কেন কলব্যাক করতে?’

‘স্যারের রুমে ছিলাম।’

‘তুমি কখন আসবে?’

‘সকালে বললাম না, আজকে ফিরতে দেরি হবে। দশটা-এগারোটা তো বাজবেই। কেন, তোমার কিছু লাগবে?’

‘আমার কিছু লাগবে না। তোমার গেস্ট এসেছে।’

‘আমার গেস্ট মানে কী, কে এসেছে?’

‘লিমা।’

‘লিমা কে?’

‘লিমা কে? কয়জন লিমাকে চেনো তুমি?’

‘লিমা এসেছে!’

‘সেটাই তো বললাম।’

‘লিমা এখানে আসবে কেন?’

‘সেটা তুমি তাকে জিজ্ঞেস করো।’

‘তোমাকে কিছু বলেছে?’

‘আমাকে কী বলবে? সে তো আমাকে তার পরিচয়ই দেয়নি। শুধু বলল, তোমরা একই গ্রামের লোক।’

‘তাহলে তুমি ওকে চিনলে কী করে?’

‘ওকে কী করে চিনলাম, সেটা কথা না। কথা হচ্ছে, সে এখানে কেন এসেছে?’

‘আমি কীভাবে বলব?’

‘সে আমাদের বাসা চিনল কীভাবে? ‘

‘আমি কীভাবে বলব?’

‘তাকে ফোন দিচ্ছি। কথা বলে ঝামেলা শেষ করো।’

‘শোনো, তরী, ফোন দিয়ো না। আমি বাসায় আসছি। এসে কথা বলছি।’

‘তুমি না বললে, তোমার দশটা-এগারোটা বাজবে। এখন বাজে মাত্র সাড়ে সাতটা। এতক্ষণ সে এখানে বসে থাকবে?’

‘না, না, আমি এখনই বের হচ্ছি।’

‘কেন, তোমার কাজ শেষ?’

‘কাজ শেষ হয়নি। ম্যানেজ করে চলে আসছি।’

‘ম্যানেজ করে চলে আসার দরকার নাই। ফোনে কথা বলে ঝামেলা শেষ করো।’

‘তরী, আমি আসছি। এসে কথা বলছি। কিছু আনতে হবে?’

‘একবার তো বলেছি কিছু লাগবে না।’

‘তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? ফোন রাখলাম, আসছি আমি।’

সজলের ফোন রেখে, ড্রইংরুমে এসে বললাম, আপনি কী ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন? ফোন করে দেবো?’

‘আমার হাতে সময় আছে। আমি অপেক্ষা করতে পারব।’

‘ঠিক আছে, বসেন। সজল আসছে।’

সজলের ওপর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এতক্ষণ তার হাতে দুনিয়ার কাজ জমে ছিল। আমি কখনও আগে আসতে বললে, সে অজুহাতে লিস্ট খুলে বসে আর প্রাক্তনের কথা শুনে এখন দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে।……….……………