স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-১৭

0
1266

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[পর্ব-১৭]
লেখিকা: #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

অভ্র ভাইয়ার সাথে বিয়েটা শত চেষ্টা করেও আর আটকানো সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে। বাবার কঠোর আদেশ অভ্র ভাইয়াকে বিয়ে করতেই হবে। বাবাকে বলার সাহসটা হয়নি যে আমি অভ্র ভাইকে বিয়ে করবো না। তবে মা কে বলেছিলাম। মায়ের উত্তর ছিলো এরূপ….

‘ দেখ দোল, এই বিয়েটা ভাঙ্গা সম্ভব না মা। তোর বাবা আর তোর বড় চাচুর অনেক ইচ্ছে ছিলো তার ছেলেদের মধ্য থেকে একজন কে তোর সাথে বিয়ে দিবে। অভ্র বড় তাই অভ্রর সাথেই বিয়ে ঠিক করেছে তোর। না করিস না মা! তোর বাবা আর তোর চাচার মনটা তাহলে ভেঙ্গে যাবে! ‘

তখন আম্মুর কথাটা শুনে বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো
‘ আম্মু আমি পূর্ব ভাইকে বিয়ে করবো। ‘ তবে তার সাথে বিয়ে হওয়াটা যে অসম্ভব প্রায়! তিনি যে অন্যকারো।

রুমের দরজা লাগিয়ে একাধারে কেঁদে চলেছি। এত কষ্ট কেনো হচ্ছে?
কাল সকালেই এংগেইজমেন্ট আর কাবিন হবে! অতঃপর আমার মেডিকেল কোর্স কমপ্লিট হলে ধুমধাম করে বিয়ে দেয়া হবে।

পূর্ব ভাইয়া বাসায় নেই! তিনি ঢাকার বাহিরে এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে গিয়েছেন। সেখানে নেট থাকবে না তাই আগে থেকেই বলে দিয়েছেন ফোনে না পেলে টেনশন না করতে। পূর্ব ভাইয়া আরো তিনদিন পর আসবেন। কিন্তু, ততদিনে তো বিয়েটা হয়ে যাবে!
এটা মনে হতেই কষ্টটা আরো দ্বিগুণ হয়!
জীবন এত কষ্টের কেনো?এই কষ্টের ক্ষনটা যে বড্ড যন্ত্রনাদায়ক!

আঁধারের মায়া কাটিয়ে প্রকৃতিতে এসেছে স্নিগ্ধ ভোরের আলো। সূর্যিমামা সবেমাত্র পৃথিবীতে উঁকি দিয়েছে। পাখির কিচির মিচির শব্দে মুখরিত চারিপাশ!

বেলকনিতে দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে আছি। চোখদুটো লাল হয়ে আছে। মাথা ব্যাথার যন্ত্রণাটা যেনো ক্রমশই বাড়ছে!

বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রুমের দিকে তাকাই। বেডে লেহেঙ্গা রাখা সাথে কিছু গয়না। এগুলো বড় চাচি দিয়ে গিয়েছেন। রেডি হওয়ার জন্য। একটু পর পার্লার থেকে মেয়েরা আসবে। সকালে এংগেইজমেন্ট আর সন্ধ্যার দিকে কাবিন ঠিক হয়েছে। আমি শূন্য দৃষ্টি দিয়ে সেদিকে চেয়ে আছি। মন বারবার একটাই প্রশ্ন সৃষ্টি করছে, ‘ পূর্ব ভাই কি আসবেন না?’

অরা একটা পরিত্যাক্ত গোডাউনে এসেছে। পড়নে ওয়েস্টার্ন ড্রেস! চোখেমুখে খুশিরা উপচে পড়ছে। আজ কতদিন পর সে এতোটা খুশি জানা নেই!

অরা সামনে এগিয়ে যায়। সামনে থাকা কাচের গ্লাসটায় পার্সওয়ার্ড দেয়া মাত্রই দরজা খুলে যায়। দরজা খোলার পর তার সামনে দৃশ্যমান হয় একজন লোক আর একজন মহিলাকে! যাদের দুজনকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখেছে। পাশেই রয়েছে একটা ছেলে! বয়স বাইশ কি তেইশ হবে। তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

অরা তাদেরকে দেখে হু হু করে কেঁদে দেয়। কি অবস্থা হয়েছে তার বাবা মার! ইশ! ভাইটার দিকে তো তাকানোই যাচ্ছেনা। শিকল দিয়ে বেঁধে রাখাতে হাতে ঘা হয়ে গিয়েছে।

অরা মৃদ্যু প্রায়ে এগিয়ে যায়।
এখানে উপস্থিত এই তিনজন মানুষের মধ্যে কারোরই ঠিকমতো জ্ঞান নেই। ড্রাগ দিয়ে নিস্তেজ করে রাখা হয়েছে।

অরা সর্বপ্রথম পা টিপেটিপে তার মায়ের কাছে যায়। আলতো করে হাত রাখে মায়ের মাথায়। সাদা পাকা মিশ্রণের চুলগুলোতে আদুরে হাত বুলিয়ে দেয়। চোখ দিয়ে এখনো পানি ঝড়ছে!
অরা হাটুগেড়ে বসে মায়ের কানে ফিসফিস করে বলল,,,

‘ আর কয়েকটা দিন মা। জাষ্ট আর কয়েকটা দিন। তারপর তোমাদের এই নরক থেকে আমি নিয়ে যাবো। খুব দূরে নিয়ে যাবো তোমাদের। তখন কোনো কালো ছায়া তোমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। ‘

কান্নারত কন্ঠে কথাগুলো বলে অরা উঠে দাড়ায়।
বাবা আর ভাইয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে চট জলদি রুমটা থেকে বেড়িয়ে আসে। তাকে বেশিক্ষণ থাকার অনুমতি দেয়া হয়নি। একমাসে শুধু একবারই দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়। তাও চার পাঁচ মিনিটের জন্য।

অরা বের হতেই তার ফোনে কল আসে। চোখের পানিগুলো মুছে নিয়ে কল রিসিভ করে সে! অপাশ থেকে ভারী সুরে কেও বলল,,,

‘ দেখেছো? ‘

‘ জ্বী স্যার! ‘

‘ ফাইন! এখন কাজে লেগে যাও। মিশন সফল হলে পুরোদিনই বাবা মা, ভাইয়ের সাথে থাকতে পারবে। ‘

‘ জ্বী স্যার। ‘

অরা ফোন কেটে দেয়।
এখন তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সামনে যে বেশ কিছু ফেস করতে হবে তাকে। তারজন্য সর্বপ্রথম নিজেকে তৈরি করা প্রয়োজন!

পার্লারের মেয়েগুলো নিজেদের মতো করে আমায় সাজাতে ব্যাস্ত। তবে সেদিকে আমার কোনো খেয়াল নেই। পাথর হয়ে বসে আছি। অনুভূতি শূন্য মানবী নিজেকে মনে হচ্ছে। মা এসেছিলো দুবার।অসহায় দৃষ্টি দেয়াতে তার চোখ পানি ছাড়া কিছুই দেখতে পারিনি। তাই আমিও আর কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া করেনি। যা হচ্ছে হোক!

অরিন এসে আমায় নিচে নিয়ে যায়। নিচে যেতেই আমার দৃষ্টি যায় অভ্র ভাইয়ার ওপর। কালো রঙের পান্জাবি পড়ে গম্ভীর হয়ে ফোনে কথা বলছেন। হটাৎ করে মনে হলো, আচ্ছা? অভ্র ভাইয়া কি এই বিয়েতে রাজি?
তিনি তো আমায় তার ছোট বোন মনে করেন। তার তো এ বিয়েতে মত দেয়ার কথা ছিলোনা।
পরক্ষণে মনে হয়, হয়তো তিনি আমার মতোই বাধ্য! অভ্র ভাইয়া কখনো তার বাবার আদেশ অমান্য করেন না। একদমই না!

নিচে নেমে এসে অরিন আমায় অভ্র ভাইয়ার পাশে বসিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই এংগেইজমেন্ট হয়ে যায়! আমি হয়ে যাই অভ্র ভাইয়ার বাগদত্তা! ভাবতেই দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে মারা যাবো মনে হচ্ছে।

সন্ধ্যা নেমেছে!
পুরোটা দিন অস্থিরতা আর কান্নার মাধ্যমে কেটেছে। হাসফাস করেছি শুধু। মন শুধু বলতো এই পূর্ব ভাই আসলো বলে, এসেই তিনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন! কঠোর কন্ঠে বলবেন আমি তার! শুধু তারই।
তবে তা হয়নি!

ফের আরেকদফা সাজাসাজি করানো হলো।
আবারও আমার অমতে! চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিয়তি এতো নিষ্ঠুর কেনো?
হাতের রিং টার দিকে তাকালে ইচ্ছে করে ছুড়ে ফেলে দেই। যত দূরে ছুড়ে ফেলা সম্ভব ততোদূরে!

আর কিছু সময় পরই কাবিন। আত্নীয় স্বজন তেমন কাওকে ইনভাইট করেনি। ছোট করে খুব তাড়াহুড়ো করে বিয়েটা করানো হচ্ছে। তবে এতোটা তাড়াহুড়ো করার কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না!

রুমে সবাই যখন আমার সাথে ছিলো। তখন অরিন তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,,,

‘ তোমাদের বড় মা ডাকছে। ওখানে যাও! দোলাকে একা থাকতে দাও। ‘

সবাই অরিনের কথা শুনে বেড়িয়ে যায়। আমি নির্বাক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে আছি। তখন অরিন পিছু থেকে বলল,,,

‘ হইছে আর মরার মতো থাকতে হবেনা। যার জন্য এভাবে আছো সে এসে গেছে। ‘

অরিনের কথা শুনে আমি চমকিত পানে ওর দিকে তাকাই। সে একটা হাসি দিয়ে বেড়িয়ে যায়। আমি এখনো বুঝতে পারছিনা অরিন কি বললো?কার কথা বললো? কে এসেছে?

হুট করে রুমটা পুরো অন্ধকার হয়ে যায়। শুধু রুম নয় পুরো বাড়ি! দমকা বাতাসে ভেসে আসে এক সু – পরিচিত ঘ্রাণ! মোহমীয় সেই ঘ্রাণটা নাকে বাড়ি খেতে ফুপিয়ে কেঁদে দেই।
তখনই আমার ঘাড়ে কারো স্পর্শ টের পাই। কিছু বলতে নিবো তার আগেই কেও রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে দেয়! কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,,,

‘ একদম ছটফর করবি না। যেখানে নিয়ে যাচ্ছি চুপচাপ যাবি। ‘

পূর্ব ভাইয়া! হ্যা তিনিই!
তিনি আমাকে তার কাঁধে উঠিয়ে সবার দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে বাহিরে নিয়ে আসেন। অন্ধকার থাকায় কেও কিছু বুঝতে পারেনি বা দেখতে পারেনি আমাদের।

পূর্ব ভাইয়া আমায় গাড়ির ব্যাকসিটে বসিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেন। বেশ কিছুদূর গিয়ে গাড়ি থামান। আমার বুকে ধকধক আওয়াজ হচ্ছে! হৃদপিন্ডটা মনে হচ্ছে বেড়িয়ে আসবে প্রায়!
তিনি গাড়ি থামাতে আমার মন নিভৃতে প্রশ্ন জাগে। চারিপাশে আঁধার! কালো কুচকুচে আলোতে ছেয়ে আছে আশপাশ!

পূর্ব ভাইয়া ড্রাইভিং সিট থেকে বেড় হয়ে ব্যাকসিটে এসে বসেন। আমি জরোসরো হয়ে দূরে যেতে নিলেই তিনি আমায় হেঁচকা টানে তার সাথে মিশিয়ে নেন। দুহাত দিয়ে আমার মুখ তুলে শব্দ করে চুমু খান কপালে।

চলবে,