স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-১৬

0
1285

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[পর্ব-১৬]
লেখিকা: #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

গ্রীষ্মকাল বিরাজমান! চারিদিকে ঠা ঠা রৌদ্দুর এড়িয়ে আজ বিরাট আকাশ পানে ফালি ফালি কালো মেঘের আনাগোনা চলছে। মেঘেরা গড়গড় আওয়াজ দিচ্ছে। মেঘ থেকে বিপুল পরিমানে চার্জ মাটিতে নেমে এসে তা বজ্রপাতে রূপান্তর হচ্ছে! ক্ষনের মাঝেই শুরু হয় ঝড়ের তান্ডব। ধুলোবালি দিয়ে পুরো শহরটাকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে ফেলছে যেনো। তবে তার কিছু সময় পরই নামে ঝুম বৃষ্টি! চারিদিকে এঁটে সেঁটে থাকা ধুলোবালি ধুয়ে দিয়ে স্বচ্ছতায় পরিনত করছে। নির্জীব গাছগুলো যেনো মূর্হতেই সজীবতা ফিরে পেলো!

হাতে করে হুমায়ুন আহমেদ এর ‘ অপেক্ষা ‘ বইটি নিয়ে প্রকৃতি বিলাস করছি। আজই পরিক্ষা শেষ হলো। দেখতে দেখতে যে কিভাবে একটি মাস পার হয়ে গেলো তার বিন্দুমাত্র খেয়ালই নেই। পরিক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই নিজেকে খাঁচা থেকে মুক্ত হওয়া পাখির মতো লাগছে! তবে বেশিদিন যে মুক্ত থাকতে পারবো না তা নিশ্চিত। ভর্তি পরিক্ষার জন্য ফের প্রস্তুতি নিতে হবে। তাও আবার মেডিকেল ভর্তি পরিক্ষা!

এই একমাসে নিজেকে পূর্ব ভাইয়ের থেকে গুটিয়ে চলেছি। পূর্ব ভাইয়াকেও তেমন আমার কাছে আসতে দেখিনি। আজকাল যখনই তার মুখপানে তাকাই তখনই লক্ষ হয় হাজার চিন্তার রেশটুকু! এত কিসের চিন্তা?
তবে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা হয়নি! আর হয়েও উঠবে না হয়তো।

অরা আপু আর কিছুদিনের মাঝেই দেশে ফিরবে। এটা মনে করতেই বুকের গহীনে কেমন হাহাকার ভাবটা জন্মে উঠে। পূর্ব ভাইয়ারও ছুটি বেড়েছে। তিন মাসের জায়গায় তিনি ছয়মাস থাকবেন! এটা শুনে মনটা ভালো হওয়ার থেকে বিষিয়ে গিয়েছে। আমি কি পারবো চোখের সামনে তাদের দুজনকে এক হতে দেখতে?

সন্ধ্যা নেমেছে ধরণীর বুকে। মাথায় ওড়না টেনে ওযু করে সুষ্ঠুরুপে নামাজ সম্পূর্ণ করি।
হুট করে দরজায় নক করার শব্দ প্রতিফলিত হয়ে আমার কানে এসে বাড়ি খায়!
হাতের জায়নামাজ টা সঠিক জায়গায় রেখে দিয়ে মাথার ওড়নাটা ফেলে দেই।

দরজা খুলতেই আমার সর্বপ্রথম নজরে আসে পূর্ব ভাইয়ার মুখখানি! তাকে দেখেই বুকের হৃদস্পন্দন তার স্পন্দিত হওয়ার গতিটা বাড়িয়ে দেয়। কাঁপা কন্ঠে আমি বলে উঠি,,,

‘ ভা…ভাইয়া ক..কিছু ব.লব…বেন? ‘

পূর্ব ভাইয়া মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যা’ বলল!
অতঃপর আমায় এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে তিনি ভিতরে ঢুকে যান। ভেতরে প্রবেশ করে ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আমার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টি দেন। আমি কাঁধে ফেলে রাখা ওড়নার শেষাংশ টুকু দিয়ে আঙ্গুলে পেঁচাতে থাকি। অস্বস্তি হচ্ছে তার সামনে দাড়িয়ে থাকতে।

পূর্ব ভাই বড় বড় পা ফেলে আমার নিকটে এসে দাড়ান। আমি মাথা তুলে কিছু বলবো তার আগেই তিনি আমায় শক্ত করে জরীয়ে ধরেন। আমার কাঁধে নিজের থুতনি রেখে পিঠে আড়াআড়ি ভাবে নিজের বলিষ্ঠ হাতজোড়া স্থাপন করেন!

আকষ্মিক কান্ডে আমি হতবিহ্বল!
তার এভাবে জরীয়ে ধরার কারণটা আমার বোধগম্য হচ্ছেনা।
ফের আমি কাঁপাটে কন্ঠে প্রশ্ন করি,,,

‘ ভাইয়া ক..কি হয়েছে? এ..ভাবে জরীয়ে ধ..ধরে আছেন ক…কেনো? ‘

ভেসে আসে কয়েক গুচ্ছো গম্ভীর শব্দফালি!
তিনি বললেন,,,,

‘ আমার ইচ্ছে, হোয়াট’স ইউর’স?’

তার উত্তর শুনে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাই প্রায়। আজব! এ কেমন কথা? হটাৎ কথা বলে থেমে যায় আমার। শব্দগুচ্ছো গুলো দলা পাকিয়ে গলার কাছেই আঁটকে পড়ে। আমার কানে ভেসে আসছে ‘ধুকধুক’ শব্দ! পূর্ব ভাইয়ার হৃদস্পন্দন এর শব্দ! যেনো তারা আমার নামে স্পন্দিত হচ্ছে।

হটাৎ পূর্ব ভাইয়া আমায় আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন,,,

‘ শুনতে পাচ্ছিস? হৃদস্পন্দন এর শব্দ? তোর নামে স্পন্দিত হচ্ছে? ‘

কথাটা শ্রবন করা মাত্রই শিহরণ বয়ে যায় মনে। অনন্য ভালো লাগার শিহরণ। তবে সব ভালো লাগাগুলো কে এক সাইডে রেখে ধাক্কা দেই পূর্ব ভাইয়াকে। তিনি আমায় আলতো করে জরীয়ে ধরেছিলেন। হয়তো আশা করেনি আমি তাকে ধাক্কা দিবো।

আমি মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বলি,,,,

‘ নিজের রুমে যান পূর্ব ভাই। কেও দেখে ফেললে ভুল ভেবে বসতে পারে। তখন অনেক সমস্যা হবে। প্লিজ যান! ‘

পূর্ব ভাই এগোলেন। তার দুহাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,,,,

‘ মন থেকে বলছিস চলে যাওয়ার কথা?’

আমার একবার বলতে ইচ্ছে হলো ‘না ‘!
মব থেকে বলছি না পূর্ব ভাই। আমি যে বাধ্য! বাধ্যতার বেড়াজালে ফেসে গিয়েছি আমি।

তবে মুখে বললাম,,,

‘ মন থেকেই বলেছি। প্লিজ চলে যান! ‘

আমার কথায় তার মাঝে চলে যাওয়ার কোনো ব্যাতিব্যাস্ততা লক্ষ করলাম না। তিনি ধুপধাপ পা ফেলে আমার বেডে গিয়ে শুয়ে পড়েন! চোখদুটো বড় বড় করে সেদিকে চেয়ে আছি।

পূর্ব ভাই আমায় হাতের ইশারায় তার দিকে ডাকেন। আমি নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে যেতেই তিনি আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে তার পাশে বসিয়ে দেন। পরিশেষে হুট করে তিনি আমায় কোলে মাথা দিয়ে কোমড় চেপে চক্ষুযুগল বন্ধ করে নেন!

হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছি।
ঘটনাটা এতটাই দ্রুত হ’য়েছে যে আমার বুঝতে একটু বেগ পেতে হয়েছে।

আমি ইতস্তত কন্ঠে বলি,,,

‘ পূর্ব ভাইয়া কি করছেন? আমার কোল থেকে সরুন। ‘

তিনি সরলেন না। বরং আরেকটু শক্ত করে ধরলেন। তার গরম নিঃশ্বাস অনুভূত হতেই কেঁপে কেঁপে উঠি! লোকটা এতো ত্যাড়া কেনো?কেনো সে বারবার আমার কাছেই আসে?আমায় তার প্রতি চরম ভাবে দূর্বল করে দেয়?

পূর্ব ভাইয়া বললেন,,,,,

‘ হেডেকে হচ্ছে অনেক! মাথায় চেপে দে! ‘

খানিক সাহস নিয়ে বলি,,,

‘ পারবোনা। আপনি রুমে গিয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। ‘

‘ উঁহু! যাবোনা। মাথা চেপে দে! ব্যাথায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ‘

আমি ঠোঁট প্রসারিত করে কিছু বলবো তার আগেই তিনি ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললেন,,,,

‘ আরেকটা কথা যদি বলিস তাহলে আমি অন্যকিছু করবো। নয়তো কড়া শাস্তি দিবো।বল! এটা চাস তুই?’

মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলি!
কাঁপাটে হাত দিয়ে তার মাথায় রেখে আস্তে আস্তে ম্যাসাজ করে দিতেই ক্ষনেই তিনি ঘুমিয়ে যান।
অদ্ভুত! এতো তাড়াতাড়ি কেও ঘুমোতে পারে?

কানাডার এক আলিশান হোটেলে মাতাল হয়ে পড়ে আছে অরা। চোখের কার্নিশে এখনো ফোঁটা ফোঁটা পানি বহমান।

কর্কশ ফোনের এলার্মে নড়েচড়ে উঠে বসে অরা! মাথা চেপে ধরে চারিপাশে তাকায়। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুক চিড়ে! চোখের কার্নিশে থাকা পানিটুকু মুছে নেয়।
কাল রাতে ক্লাবে আসার পর আর বাসায় যাওয়া হয়নি। অতীত এসে হানা দিয়েছিলো ওর তরে! কেঁদে কেটে ড্রিংক করে শেষ রাতে ঘুমিয়ে গিয়েছে।

ফোন বেজে উঠে অরার!
ফোন স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই চোখমুখে ছেয়ে যায় একরাশ ভয়, আতংক!

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ফোন রিসিভ করতেই অপাশ থেকে বাজখাঁই কন্ঠস্বরে কেও বলল,,,

‘ কই থাকো তুমি?কতক্ষণ ধরে ফোন দিচ্ছি তার খেয়াল আছে কোনো?’

‘ সরি স্যার! ড্রিংক করাতে একটু লেট করে ঘুম ভেঙ্গেছে। ‘

এবার অপাশ থেকে ভেসে আসে কর্কশ কন্ঠস্বর! সে বলল,,,

‘ তোমাকে আমি ক্লাবে ড্রিংক করে মাতাল হয়ে পড়ে থাকার জন্য টাকা দেইনা অরা। কাজে ফোকাস করো। বাংলাদেশে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। তার খেয়াল আছে? নিজের পরিবারের প্রতি কি তোমার মায়া নেই?তুমি কি চাও ওদের আমি মেরে ফেলি?’

অরা উত্তেজিত কন্ঠে বলল,,,,

‘ এমন আর দ্বিতীয় বার হবেনা স্যার। আপনি প্লিজ আমার পরিবারের কোনো ক্ষতি করবেন না। আপনি যেমনটা চেয়েছিলেন তেমনই হবে। দোলার লাইফ ধ্বংস করে দিবো। ওর পরিবারকে কষ্টে কষ্টে শেষ করে দিবো।’

শয়তানি হাসি দেয় অপর পাশের ব্যাক্তি।সেই হাসি শুনে গা গুলিয়ে আসে অরার! কি বিশ্রি হাসির শব্দ!
অপাশ থেকে বলল,,,,

‘ দ্যাট’স লাইক এ গুড গার্ল!মিশনের মূল পয়েন্ট মনে আছে তাহলে! শুনে রেখো আরেকবার, আমাদের এতো বছরের মিশন শুধুমাত্র দোলা এবং ওর পরিবারকে ধ্বংস করা! আবরার ম্যানশন ধ্বংস করা। ‘

অরা সায় জানিয়ে ফোন কেটে দেয়!
চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ে বর্ষনের মতোন পানি।

আজানের মধুর সুর কানে এসে বাড়ি খেতেই চট করে কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। পূর্ব ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কখন যে চোখ লেগে এসেছে খেয়াল নেই। পুরোটা সময় আমি চেয়ে ছিলাম পূর্ব ভাইয়ার সম্মোহীত কারী মুখশ্রীর প্রতি!

চোখ খুলতেই বেশ অবাক আমি। আমি বেডে কিভাবে?তাও আবার বালিশে মাথা দেয়া? আশপাশে তাকিয়ে পূর্ব ভাইয়াকে খোঁজার চেষ্টা চালাতে তাকে কোথাও দেখতে পেলাম না! চলে গেছেন বোধহয়। যাক! নাহলে কেও দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি ঘটে যেতো।

আমি আবার ঘুমোতে বালিশে মাথা দিবো তখনই হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করে অরিন। বিরক্তিমাখা চাহনি দিয়ে ওর মুখপানে তাকাই! মেয়েটা কখনো স্থির রূপে রুমে প্রবেশ করেনা।

অরিন অস্থির কন্ঠে বলল,,,,

‘ দোস্ত একটা ব্যাড নিউজ আছে। ‘

আমি একটু নড়েচড়ে বসে বলি,,,

‘ কি ব্যাড নিউজ?’

‘ অভ্র ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে! ‘

‘ তো?এখানে ব্যাড নিউজের কি আছে আজব?’

‘ আরেহ, কার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে জানিস? ‘

‘ কার সাথে?’

অরিন লম্বা শ্বাস টেনে বলল,,,

‘ তোর সাথে!’

‘তোর সাথে’ কথাটা কর্ণকুহরে বাড়ি খেতেই আমি স্তব্ধ! আমার বিয়ে?অভ্র ভাইয়ার সাথে?
চোখের কার্নিশে পানি এসে জমে। শেষে কিনা যাকে পছন্দ করতাম তার বড় ভাইয়ের সাথে বিয়ে?

চলবে,