স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-৪৬

0
1210

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
|পর্ব-৪৬|

ভোরের স্নিগ্ধ আলো পৃথিবী পৃষ্ঠে প্রবেশ করেছে মাত্র। বিরাট আকাশে আজ ফালি ফালি শুভ্র মেঘের আনাগোনা। নীল আকাশ পানে শুভ্র রঙের ছড়াছড়ি! মনকাড়া দৃশ্য একেই বলে হয়তো। শুভ্র রাঙা সকালের মিষ্টি বাতাস গায়ে এসে বাড়ি খাচ্ছে, মনে অনুভব হচ্ছে অন্য রকম ভালোলাগা। পাখির কিচির মিচির শব্দে চারিপাশ হয়ে উঠেছে মুখরিত। বদ্ধ চোখজোড়া খুলতেই পূর্বদিকে দৃষ্টি দেয়াতে দৃশ্যমান হয় পৃথিবীতে প্রবেশ করে কমলা হলুদ রঙের মিশ্রণ সূর্যের! সে নিজ মনে পৃথিবীতে আলো দেয়াতে ব্যাস্ত।

টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুলগুলোকে আলত স্পর্শে মুছতে মুছতে ভোরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলাসে ব্যাস্ত আমি! টাওয়াল টা বেলকনিতে মেলে দিয়ে আঁড়চোখে রুমে দৃষ্টি দিতেই নজরে আসে পূর্বের সুঠাম দেহ! কালো ব্লাঙ্কেটে কোমড় অব্দি ঢাকা। পিঠ উন্মুক্ত! কালো বেডশিটের মাঝে ধবধবে ফর্সা শরীর চকচক করে ফুটে উঠেছে। পূর্বের মুখশ্রী আমার চোখে নিবদ্ধ হয়নি। তার মুখ ডানদিকে, আর আমি বাম দিকে!

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফের সামনে দৃষ্টি আবদ্ধ করি। কেনো যেনো পূর্বের দিকে তাকালে লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হয়ে যাই মূর্হতে! তার গভীর দৃষ্টি দেখলে ইচ্ছে করে মাটি ফাঁক করে তার ভিতর প্রবেশ করি। ইশ! এতো লজ্জা কেনো পাচ্ছি?

চক্ষুযুগল বন্ধ করে ভাবনার গহীনে যখন মত্ত আমি তখন একজোড়া শক্ত হাত আমার পেটের কাছে এসে আবদ্ধ হয়! শক্ত করে চেপে ধরে ঘাড়ে মাথা রাখে! শিউরে উঠে কাঁপা কন্ঠে বলি,

-‘ প..পূর্ব? ‘

চাপ দাঁড়ি দিয়ে পূর্ব আমার ঘাড়ে আলত স্পর্শ করেন।ধারালো খানেক দাঁড়ির খোঁচায় ব্যাথায় কুকিয়ে উঠে নরম কন্ঠে বলি,

-‘ কি করছেন?ব্যাথা পাচ্ছি আমি!’

পূর্ব ঘাড় থেকে নিজের মুখ তুললেন। আমাট গালের সঙ্গে তার গালের সংস্পর্শ করিয়ে অতি শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘ ঘুম থেকে কখন উঠেছিস?’

-‘ আধা ঘন্টা হবে! কেনো? আপনি কখন উঠলেন?’

-‘ মাত্রই! আমার আগে ওঠার জন্য তোকে কি শাস্তি দেয়া যায় বলতো?’

আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলি,

-‘ অদ্ভুত! এখানে শাস্তি দেয়ার কি আছে?’

পূর্ব মিহি কন্ঠে বললেন,

-‘ সবকিছু যদি নতুন করে শুরু করি একসাথে তাহলে এটা কেনো বাকি থাকবে?’

আমি বুঝতে না পেরে বললাম,

-‘ কিসের কথা বলছেন?’

পূর্ব নিশ্চুপ! কাঁধে হাত দিয়ে তিনি একটানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেন। তার সেই বিশ্ব বিখ্যাত গভীরতর ঘোর লাগা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছেন। এক পর্যায়ে তিনি আমার কোমড়ে হাত দিয়ে পাঁজা কোলা করে তুলে নিতেই আমি হকচকিয়ে বলি,

-‘ কোলে নিলেন কেনো? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

পূর্ব সামনে এগোতে এগোতে ধীর কন্ঠে বললেন,

-‘ আমার আগে ঘুম থেকে ওঠার অপরাধে তোকে দ্বিতীয় বার সাওয়ার নিতে হবে এন্ড আমার সাথে! তুই আগে ঘুম থেকে উঠে আমার ঘুম নষ্ট করেছিস!’

পূর্বের কথায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ! লজ্জায় লাল নীল এ রূপান্তর হয়ে গিয়েছি বোধহয়। আমি অস্ফুটস্বরে স্বরে বললাম,

-‘ নাহ, পূর্ব প্লিজ! আমি কিন্তু চিৎকার দিবো। ‘

পূর্ব হাঁটার বেগ কমিয়ে দিলেন। কন্ঠের খাদ নামিয়ে বললেন,

-‘ দে, প্রবলেম কি? তুই নিজেই লজ্জায় পড়বি! সবাই যখন এসে চিৎকার করার রিজন জানতে চাইবে তখন কি বলবি হু?’

ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি! আমি কাঁদো কন্ঠে বলি,

-‘ আপনি একটা চরম অসভ্য লোক। ‘

পূর্ব ফিক করে হেঁসে দেন। অতঃপর নিজের কাজে সমাপ্ত করার উদ্দেশ্যে পা বাড়ান সামনে। এই অসভ্য, নিলজ্জ লোককে এখন আমার পক্ষে থামানো সম্ভব না! ব্যাটা দুনিয়ার ত্যাড়া!

-‘ হাতে কি হয়েছে দোল?’

রক্তাক্ত আঙ্গুলটি ওড়নার নিচে লুকিয়ে পিছু ফিরে তাকাই। বড় চাচী চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলি,

-‘ কিছুনা মামনি। জাষ্ট একটু গুঁতো লেগেছিলো।’

মামনির চোখমুখে চিন্তার রেশখানি কমলো না। তিনি উদ্যিগ্ন হয়ে বললেন,

-‘ সে কি কিভাবে? আর তুই কিচেনে কি করছিস এতো সকালে?’

-‘ ব্রেকফাস্ট বানাতে এসেছিলাম। দেখো শেষ! হাতে তেমন কোনো গুরুতর চোট পাইনি। আচ্ছা বলো তো আর কিছু বানাবো কি না?’

মামনি দ্রুত পায়ে আমার কাছে এগিয়ে আসলেন। চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

-‘ তুই রান্না করতে এসেছিস কেনো? বাড়িতে সার্ভেন্ট আছে, আমি আর তোর মেঝ চাচী আছি! যা রুমে যা, তুই কিচেনে এসেছিস জানলে পূর্ব বাড়ি মাথায় তুলবে! ‘

আমি আলত হেঁসে বলি,

-‘ কিছু বলবেনা তিনি। এ বাড়ির বউ হিসেবে এতটুকু করা তো আমার দায়িত্ব। ‘

মামনি একগাল হাসলেন। আদুরে কন্ঠে বললেন,

-‘ হয়েছে আর কোনো দায়িত্ব পালন করতে হবে না। যতটুকু করেছিস যথেষ্ট। তাছাড়া তুই এ বাড়ির বউ না মেয়ে! পূর্বের সাথে বিয়ে হয়েছে বলে কিছু পরিবর্তন হবেনা। তুই আগে যেভাবে থাকতি সেভাবেই থাকবি! এখন বের হ তো কিচেন থেকে। পূর্ব উঠেছে? উঠলে ওর জন্য কফি নিয়ে যা সাথে তোর জন্যও। ‘

আমি মাথা নাড়িয়ে ‘ হ্যা ‘ বলি! মামনি অন্য কাজে ব্যাস্ত হতে কাটা আঙ্গুলটা বের করি। ফল কাটতে গিয়ে অসাবধানতা বশত কেটে গিয়েছে। পূর্ব দেখলে আমায় বকে আস্ত রাখবে না নিশ্চিত! শুকনো ঢোক গিলে মামনির চক্ষু আড়ালে রক্ত ধুয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে চট জলদি ওপরে চলে যাই। সাওয়ার নেয়া শেষে পূর্বের জরুরি এক মিটিং থাকায় তিনি আমায় রুমে থাকতে বলে লাইব্রেরি রুমে চলে যান! আর সেই ফাঁকেই নিচে চলে আসি আমি।
___________________

রুমের কাছে এসে চোরাচোখে রুমে উঁকি ঝুঁকি দিতে আমার দৃষ্টি আবদ্ধ হয় বেলকনিতে। শুভ্র রঙের পর্দার আড়ালে স্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছে পূর্বকে। কানে ফোন লাগিয়ে অন্য হাত নাড়িয়ে সিরিয়াস কন্ঠে কথা বলছেন! স্বস্তির শ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে পড়ি। আমার উদ্দেশ্য টি- টেবিলের ওপর কফিটা রাখবো আর এক দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যাবো পূর্বের অগোচরেই।
সিরিয়াসলি কথা বলছেন যেহেতু তাহলে এক ঘন্টার আগে ফোন থেকে আলাদা হবেন না তিনি সিয়র।

পা টিপেটিপে টি টেবিলের কাছে গিয়ে খানিকটা নিচু হয়ে কফির মগ রেখে দেই। সোজা হয়ে দাঁড়াতে অনুভূত হয় ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস এর আবির্ভাব! শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন পিছন থেকে ভেসে আসে ভারী কন্ঠস্বর! পূর্ব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

-‘ কই ছিলি? রুম থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলাম না?’

আমি পিছে ঘুরে আমতা আমতা করে বলি,

-‘ নিচে গিয়েছিলাম একটু। রুমে কতক্ষণ বসে থাকা যায়? বাসার সবাই কি ভাববে? আপনার কফি,’

কাটা হাত ওড়নার পাশে লুকিয়ে রাখি। তাড়াহুড়োর কারণে ব্যান্ডেজটা করা হয়নি। পূর্ব ভ্রু কুঁচকে আমার ওড়নায় ঢাকা হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। এক পর্যায়ে হুট করে ওড়না টান দিতেই উন্মুক্ত হয় আমার কাটা আঙ্গুলটা! আকস্মিক কান্ডে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি তারদিকে। তার চোখমুখে রাগের আভাসটা উপচে পড়ছে। শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলতে নিবো তার আগেই পূর্ব চিবিয়ে বললেন,

-‘ হাত কেটেছে কিভাবে?’

আমি নিচু কন্ঠে বলি,

-‘ ছুরি দিয়ে। ‘

-‘ কিচেনে গিয়েছিলি?’

-‘ হু! ‘

-‘ নিষেধ করেছিলাম না? যেই কাজ পারিস না সেই কাজে কেনো বারবার করতে যাস? তোর যে রক্ত শূন্যতা আছে ভুলে গেছিস? হাত পা কাটলে তো রক্ত বন্ধ হতে চায় না! কিচেনে গেলে কোনো না কোনো কিছু অঘটন ঘটাস, তবুও কেনো? কতবার করে বলেছি যাবিনা! শুনিস না কেনো কথা?’

অতি রেগে কথাগুলো গরগর করে উগলে দেন তিনি। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। তার কথাগুলো কাঁটায় কাঁটায় সত্য! কিচেনে গেলে আজ পর্যন্ত সুস্থরূপে বের হতে পারিনি। কোনো না কোনো কিছু হয়েই থাকে। কখনো হাত, কখনো পা কাটে নয়তো হাত পুরে যায়! ডাক্তার পইপই করে বলে দিয়েছে যাতে শরীরের রক্তক্ষরণ না হয়! কোথায় কেটে না যায়, কারণ একবার হাত পা কাটলে রক্ত বন্ধ করে মুশকিল।

মাথা তুলে পূর্বের দিকে তাকাতে দৃশ্যমান হয় তার কষ্টে জর্জরিত মুখ আর রাগী চাহনি! পূর্ব দ্রুত পায়ে হেঁটে কার্বাডের কাছে যান। ফাস্ট এইড বক্স হাতে করে এনে ইশারা করেন বেডে বসতে! বিনাবাক্যে বেডে বসতেই তিনি কাটা হাতটা কোমল ভাবে ধরে নিয়ে ড্রেসিং করতে থাকেন। তবুও কোনোভাবে রক্ত থামানো যাচ্ছেনা, শুকনো ঢোক গিলে চুপচাপ বসে আছি! পূর্বের মুখে থাকা চিন্তার রেশ ক্রমশই বাড়ছে। অতঃপর পনের মিনিট পর দুই চারটা অয়েন্টমেন্ট লাগানো শেষে রক্ত পড়া থেমে যায়। তিনি হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে দ্রুত পায়ে উঠে দাড়িয়ে বেলকনিতে চলে যান!

নিশ্চুপ চাহনিতে কতক্ষণ সোফায় বসে থেকে বেলকনিতে ধীর পায়ে এগোই! পূর্ব যে আমার কতটা রেগে আছে তা বোঝা হয়ে গেছে।

বেলকনিতে গিয়ে দেখি কর্নারে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। নিঃশব্দে তার পিছে গিয়ে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে জরীয়ে ধরি। নরম কন্ঠ বলি,

-‘ পূর্ব! আ’ম সরি, আর এমন করবোনা। প্রমিস! ‘

পূর্ব নিশ্চুপ। লম্বা শ্বাস টেনে তার হাতের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পূর্বের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। তীক্ষ্ণ চোখে তিনি আমার দিকে তাকাতেই ফট করে চুমু খাই তার গালে! মৃদু কন্ঠে ঠোঁট উল্টে বলি,

-‘ সরি তো!এতো রাগার কি আছে?ভুল কি মানুষের হয়..’

বাকি কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেলো। ঠোঁটের ওপর অতর্কিত হামলায় আমি নিস্তব্ধতা ধারণ করি। পূর্ব আমার মাথার পিছে হাত দিয়ে আরেক হাত বহমান রাখেন কোমড়ে! নিজের অধর যুগল দিয়ে আয়ত্ত করে নেন আমার ওষ্ঠদ্বয়! বিস্ফোরিত নয়নে তার দিকে দৃষ্টি দিতে তিনি একচোখ টিপ মেরে বন্ধ করে নেন। দৃশ্যমান হয় তার ঘন পাপড়ি,

দুই মিনিট পর তিনি সরে এসে নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে বললেন,

-‘ আমার সামনে ঠোঁট উল্টবি না! কেমন গিলে ফেলা টাইপ ফিলিং’স আসে! ইচ্ছে করে তোর গোলাপি ঠোঁটদুটো গিলে ফেলি জাষ্ট, ‘

কানসহ গালদুটো গরম হয়ে আসে তার এই লাগামহীন কথায়। ঠোঁটে দুহাত দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলি,

-‘ অতিরিক্ত রোমান্টিক হয়ে গেছেন আপনি! বিয়ের আগেই ভালো ছিলেন। গম্ভীর, রাগী স্বভাবের! আপনি এতোটা রোমান্টিক জানলে কখনো আপনাকে ভালোবাসতাম না। আচ্ছা, আপনি এতোটা রোমান্টিক তা আপনাকে দেখে বুঝতে পারলাম না কেনো? সবসময় তো ঝাড়ি, আর বকা দেয়ার তালে থাকতেন। ‘

ঘন কালো ভ্রু জোরা কুঁচকে নেয় পূর্ব। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,

-‘ হোয়াট ডু ইউ মিন? আমি রোমান্টিক তা কি সবাই চিল্লিয়ে বলে বেড়াবো? যেই মেয়েগুলো আমায় চোখ দিয়ে গিলে খায় তাদের সাথে রোমান্স করে তোকে বোঝাবো আমি রোমান্টিক? ‘

আমি থতমত খেয়ে বলি,

-‘ অদ্ভুত তো, এটা আমি কখন বললাম?’

পূর্ব স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,

-‘ জামাকাপড় গুছিয়ে নে। সন্ধ্যায় আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি! ‘

-‘ হটাৎ? ‘
কিছুটা চমকিত কন্ঠে তাকে প্রশ্ন করি।

পূর্ব বাঁকা হেঁসে বললেন,

-‘ হানিমুন করতে! এখানে তো শুধু পালিয়ে পালিয়ে ছুটে যাস! কক্সবাজার গেলে এক মূর্হতের জন্যও একা থাকতে দিবো না। আর না পালাপালি করতে দিবো। ‘

চলবে…..

[গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।]