স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-৪৭

0
1097

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
|পর্ব-৪৭|

চুপসে যাওয়া লজ্জা মিশ্রিত মুখ নিয়ে মাথা নিচু করে আছি। অস্বস্তি, লজ্জা সব আমায় এই মূর্হতটায় তুমুলভাবে গ্রাস করেছে। আড়চোখে ডাইনিং টেবিলের সবার দিকে পরখ করতেই দেখি মিটিমিটি হাসছে সবাই।

মামনি আমার পাশে বসে চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

-‘ তোকে বারবার বলেছি না কিচেনে যাবিনা দোল? হাত কি বেশি কেটেছে? তখন আমায় মিথ্যা বললি কেনো? ‘

আমি অপরাধী কন্ঠে বলি,

-‘ সরি মামনি আসলে,, ‘

মাঝপথে থামিয়ে দেয় মামনি। নরম কন্ঠে বললেন,

-‘ হয়েছে থাম! আর বলতে হবেনা। আমি তোকে বকতাম না। ‘

পূর্ব আমার মুখের দিকে আরেক লোকমা এগিয়ে দিতেই আমি রাগী দৃষ্টিতে তাকাতে নিবো তৎক্ষনাৎ সে চোখ গরম করে ইশারায় বলে খাবার খেতে! বিনাবাক্যে ফোস করে শ্বাস ফেলে তার হাতের অবশিষ্ট খাবার খেয়ে নেই! মূলত এটাই হচ্ছে আমার লজ্জার কারণ। ড্রইং রুমে উপস্থিত সবার সামনে এভাবে খাইয়ে দেয়াতে অস্বস্তি, লজ্জা দুটোই কাজ করছে। সামান্য এক আঙ্গুল কাটায় কত তামাশা,

মাথা নিচু করে ভাবনার গহীনে থাকাকালীন পূর্বের কন্ঠস্বর শুনি।তিনি কাট কাট কন্ঠে বললেন,

-‘ আম্মু, এই পাকনি যেনো কিচেনে আর দ্বিতীয়বার না যায়। গেলে আমাকে বলবে! ঠ্যাং ভেঙে রুমে বসিয়ে রাখবো। ‘

মামনি সহ উপস্থিত সবাই হো হো করো হেঁসে দেয়। আমি চুপচাপ বসে হজম করছি। এই অসভ্য লোক একবার রুমে যাক, তার চুলগুলো সব ছিঁড়ে ফেলবো!

মামনি বললেন,

-‘ আর কখনো যাওয়ার সুযোগ দিলে তো যাবে! ‘

পূর্ব প্লেট থেকে রুটি ছিঁড়ে এক টুকরো আমার মুখে দিচ্ছে তো একবার নিজে খাচ্ছে। তার পুরো ধ্যান এখন আমার ওপর। তাই চাইলেও উঠে পালিয়ে যেতে পারছি না। অসহায় চাহনি দিয়ে তার পানে দ্বিতীয় বার তাকাতেই তিনি বললেন,

-‘ এটাই লাষ্ট, হা কর! ‘

খাওয়ার মাঝে পূর্ব বললেন,

-‘ বাবা আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি। একটা জরুরি মিটিং আছে! সরাসরি শাখায় যেতে হবে। আমার সাথে ভাইয়া, দোল আর অরিন যাচ্ছে। তিনদিন পর চলে আসবো।’

পূর্বের কথায় মামনি চিন্তিত কন্ঠে বললেন,

-‘ তোরা দুজন যাচ্ছিস যা। অরিন, দোলকে টানছিস কেনো? অরিন প্রেগন্যান্ট আর দোল তো কতদিন হলো নিজের বাসায় যায় না। একটু ঘুরে আসুক নিজের বাসা থেকে! ‘

মামনির কথায় পূর্ব শক্ত কন্ঠে বললেন,

-‘ এটাই ওর বাসা। দেখতে যাবে বাবা মাকে তা এসেও দেখতে পারবে। বাট ও আমার সাথে যাচ্ছে এটা ফাইনাল! অরিন সঙ্গে যাবে কারণ ওর ও মাইন্ড রিফ্রেশমেন্ট এর দরকার আছে। আমি ওখানে গেলে দোলের কাছে থাকতে পারবো না। অরিন আর দোল একসাথে থাকতে পারবে। ‘

পূর্বের কথা শেষ হতেই অভ্র ভাইয়া তাকে পিন্চ মেরে বললেন,

-‘ আরেহ্ আম্মু, বুঝোনা কেন? তোমার ছেলে যে বউ পাগল হয়ে গিয়েছে তা জানোনা? বউ ছাড়া তো সে কিছুই বুঝেনা। ‘

অভ্র ভাইয়া কথাটা বলে হেঁসে উঠলেন সাথে সবাই। পূর্ব আঁড়চোখে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অভ্র ভাইয়ার দিকে। এতে ভাইয়া থতমত খেয়ে হাসি থামিয়ে দিয়ে বললেন,

-‘ আরে অদ্ভুত তো, বড় ভাই হই তোর! এভাবে তাকাস কেন?সম্মান দিয়ে তাকাবি বুঝছিস?’

পূর্ব এমন একটা ভাব করলেন যেনো সে কিছুই শুনেনি। অভ্র ভাইয়া বিরক্তি সুরে বললেন,

-‘ শালার ত্যাড়া একটা ছোট ভাই হয়ে জন্মাইছে! ‘

দুই ভাইয়ের এরূপ আচরণে ফের আরেকদফা হাসির রোল পড়ে। মামনি কে বলে উঠে চলে আসি। পূর্বের ওপর রাগ লাগছে! কিছু সময় আগের ঘটা ঘটনায় লজ্জায় কোথাও লুকিয়ে যেতে মন চাইছে কখনো। বেডে পা ঝুলিয়ে বসার ঠিক তিন, চার মিনিট পর পূর্ব রুমে আসেন। তাকে দেখে রাগ তরতর করে বেড়ে যায়! বেড থেকে একলাফে দাঁড়িয়ে তার সামনে যাই। দুহাত দিয়ে তার কলার টেনে ধরে তিক্ত কন্ঠে বলি,

-‘ আপনি, আপনি খুব খারাপ মানুষ পূর্ব! ‘

পূর্ব স্বাভাবিক। সে নিজের দু – পকেটে হাত গুঁজে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন,

-‘ কেনো? ‘

-‘ সবার সামনে খাইয়ে দেয়ার কি ছিলো? আমার আঙ্গুল কেটেছে হাত না! জানেন কতটা লজ্জায় পড়েছিলাম সবার সামনে? ‘

-‘ এখানে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?তুই আমার ওয়াইফ, সেই হিসেবে খাইয়ে দেয়াতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে? স্ট্রেঞ্জ! ‘
তীক্ষ্ণ চাহনি দিয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি।

হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। কাকে বুঝাচ্ছি আমি?এই নিলজ্জবান লোককে? যার কিনা লজ্জার ‘ল ‘ পর্যন্ত নেই। তাকে কিভাবে বুঝাই, ছোটকাল থেকে যারা আমাদের দুজনকে ভাই বোনের নজরে দেখেছে আজ তারাই যদি দেখে আমরা হ্যাজবেন্ড, ওয়াইফ! ব্যাপারটা জঘন্যতর!

কোমড়ে কারো হাতের স্পর্শ টের পেতে সামনে তাকাই। পূর্ব মৃদু ভঙ্গিতে হাসছেন। নিবিড়ভাবে জরীয়ে নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

-‘ কি ভাবছিস?’

আমি থতমত খেয়ে বলি,

-‘ কিছুনা। ছাড়ুন, কাজ আছে! ‘

পূর্ব ছাড়লেন না। দুহাত দিয়ে শক্ত করে জরীয়ে ধরে এক পর্যায়ে পাঁজা কোলা করে তুলে নেন। হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। পূর্ব আমায় বেডে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আমার ওপর উবু হয়ে বসেন। গালে হাত রেখে নরম কন্ঠে বললেন,

-‘ স্নিগ্ধপরী কি জানে?তার প্রেমকুঞ্জ শহরে ডুবে গিয়েছি তার মাতাল প্রেমিক হয়ে। তার শীতল চাহনিতে যে আমার হৃদপিণ্ডে তোলপাড় শুরু হয়, তার কোমল মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনে বুকে প্রেমের ঝড় বয়ে যায়! তার মধুর রূপ দেখলে ইচ্ছে করে সেই রূপের মাধুরীতে মিশে একাকার হয়ে যাই। ‘

মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে তার সমস্ত কথাগুলো বুকে গেঁথে রাখি। পূর্বের বলা বিশেষ বিশেষ লাইনগুলো শুনলে ইচ্ছে করে সারাজীবন শুধু তার মুগ্ধকর কন্ঠে একই কথাগুলো শুনে যাই!

পূর্ব মাথা নিচু করে দুই গালে শব্দ করে চুমু খান। কপালে চুমু খেয়ে নাকে নেমে এসে আলত করে চুমু খেয়ে পাশে শুয়ে পড়েন। আমার একহাত তার হাতের মাঝে আবদ্ধ করে শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘ আমার স্নিগ্ধপরীর সৌন্দর্য পৃথিবীর সকল অপ্সরি, পরী, হুরদের কাছে ফিকে পড়ে যায়। তার রূপ চোখ ঝলসানো। তাকে ভালোবেসে মন কোঠরে স্থাপন করে নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবান পুরুষ মনে হয়!

-‘ ইউ নো হোয়াট স্নিগ্ধপরী, আমি হচ্ছি পৃথিবীর সকল ভাগ্যবান পুরুষদের মধ্যে অন্যতম। কারণ আমার কাছে ‘স্নিগ্ধপরী ‘ আছে! মাঝেমধ্যে বিশ্বাস হয়না, কল্পনা লাগে সবকিছু। মনে ভয় জাগে হারিয়ে ফেলবো নাতো তোকে? আমায় কখনো ছেড়ে যাবি নাতো? ‘[পূর্ব ]
পূর্ব খানিকটা করুন স্বরে বললেন। চোখ দিয়ে সুখের অশ্রু বেয়ে পড়ে আমার। তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরি নরম কন্ঠে বলি,

-‘ যতদিন বেঁচে আছি আপনার সাথে থাকবো! কখনো ছেড়ে যাবোনা প্রমিস। ‘

পূর্ব ভুবন ভোলানো হাসি দেয়। একহাতে আমায় আঁকড়ে ধরেন শক্ত করে। পাড়ি দেন এক ভালোবাসার সাগরে! যেই সাগরের শুধুমাত্র ভালোবাসা এঁটে সেঁটে আছে।

মনো মুগ্ধকর আজানের ধ্বনি কানে এসে বাড়ি খেতেই চোখ পিটপিট করে খুলি। মাথার নিচে শক্ত কিছুর আভাস মিলে! চোখ মেলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে নজরে আসে পূর্বের ঘুমন্ত মুখখানি। সে ঘুমে বিভোর। সিল্কি কিছু চুল কপালের সামনে পড়ে আছে। সাবধানে চুলগুলোকে পিছে ঠেলে দিয়ে তার কপালে আলত করে চুমু খাই!

তার উন্মুক্ত বুকে ব্লাঙ্কেট টেনে দিয়ে উঠে চলে যাই ওয়াশরুম এর উদ্দেশ্যে। সাওয়ার শেষে ওযু করে নামাজ পড়া শেষ করে বেলকনিতে চলে যাই। মিষ্টি বাতাস এসে গায়ে বাড়ি দিয়ে যাচ্ছে।

সাদা ওড়না মাথায় চেপে কাঁধব্যাগ হাতে নিয়ে নেই! পূর্ব লাগেজ এর চেইন লাগিয়ে বললেন,

-‘ সবকিছু ঠিক আছে?আর কিছু নিবি?’

আমি সেদিকে তাকিয়ে ফোন হাতে নিতে নিতে বলি,

-‘ উঁহু! ‘

-‘ আচ্ছা চল। ড্রাইভার কে বলে দিবোনে লাগেজ গাড়িতে রাখতে। ‘

মাথা নাড়িয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। রাত ৯ টা বাজে। জরুরি কাজ থাকায় আজ রাতেই কক্সবাজার রওনা দিতে হবে।

নিচে এসে সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসি। অরিন আর অভ্র ভাইয়া আলাদা গাড়িতে করে পেছনে আছেন! পূর্ব সিটবেল্ট লাগিয়ে দিয়ে নিজের সিটে বসে পড়লেন। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার পর আমার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে বললেন,

-‘ ঘুমা! ঘুম পাচ্ছে না?’

আমি চোখ বাকিয়ে বলি,

-‘ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তো ঘুমিয়েই কাটিয়েছি। আর কি ঘুমাবো?হুহ্!’

পূর্ব হাসলেন। জানালার বাহিরে দৃষ্টি দিয়ে মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকি রাতের প্রকৃতির রূপ। সৌন্দর্য যেনো দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায় রাতের শহরের! ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় হাতে হেঁচকা টান পড়ে। হতবিহ্বল হয়ে ডানে তাকাতেই দেখি পূর্বকে। রাস্তার সোডিয়ামের আলোয় তার মুখচ্ছবি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

পূর্ব বললেন,

-‘ বাহিরে মাথা দিচ্ছিস কেনো? এটা কতটা রিস্কি জানিস?’

আমি নিম্নস্বরে বলি,

-‘ সরি! তাই বলে এভাবে টান দিতে হবে? ডাক দিলেই তো হতো। ‘

পূর্ব তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বললেন,

-‘ যেভাবে চোখ বড়বড় করে দেখছিলি, মাইক দিয়ে ডাকলে টের পেতি কিনা সন্দেহ! ‘

ভ্রু কুচকে তার দিকে কিছুক্ষন পূর্বের তাকিয়ে থেকে
ফের বাহিরে তাকাই। তৎক্ষনাৎ গাড়ি থেমে যায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে তিনি আমার সন্নিকটে এসে ঝুঁকে সিটবেল্ট খুলে নেন। অতঃপর হাত ধরে টেনে এনে তার কোলে বসিয়ে দিয়ে আমি সহ আমার এবং তার সঙ্গে সিটবেল্ট লাগিয়ে দেন। আমি হকচকিয়ে বলি,

-‘ আরে আশ্চর্য তো! কি করছেন? কোলে বসাচ্ছেন কেনো, আর দুজন একই সিটবেল্ট? শ্বাস নিতে কষ্ট হবে! ‘

পূর্ব একহাতে আমায় জরীয়ে ধরে অন্যহাত স্ট্যায়ারিং এ রেখে গাড়ি চালানো শুরু করেন। তীক্ষ্ণ চোখে একবার তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন,

-‘ আই ডোন্ট ওয়ান্ট তুই আমি ছাড়া অন্য কিছু মনোযোগ দিয়ে দেখিস! দেখার হলে আমাকে দেখ।অন্য কিছুতে এতোটা গভীর দৃষ্টি দিলে তা পূর্ব মানবেনা। ‘

আমি চোখমুখ কুঁচকে বলি,

-‘ আপনি জেলাস?’

-‘ অবিয়াসলি! ‘

আর কোনো কথা মুখ দিয়ে বের করলাম না। কোনো কিছু বলে লাভ নেই। পুরো রাস্তায় পূর্বের বুকে মাথা এলিয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম। ঘুম নেই চোখে! এই সময়টা পূর্ব এক মিনিটে কমপক্ষে ১০ বার আমাতে দৃষ্টি দিয়েছেন। যার কারণে আমি তাকে কড়া কন্ঠে বলেছি আরেকবার তাকালে আমি নিজের সিটে গিয়ে বসবো। অতঃপর তিনি আর তাকাননি, তবে হাস ফাঁস করেছেন এক নজর দেখার জন্য! বাকি পুরোটা সময় তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম আমি।

_______________________,

অতঃপর দীর্ঘ সময় বাদে আমরা গিয়ে পৌছাই কক্সবাজারে! গাড়ি থেকে নামার দশ মিনিট আগে ঘুম কাবু করে নিয়েছিলো আমায়। ঢুলুঢুলু পায়ে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যেতে নিলেই পূর্ব বাহু ধরে হেঁচকা টানে কোলে তুলে নেন।

রুমে এসে বেডে বসিয়ে দিয়ে খাবার ওর্ডার করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে খাওয়ানো শেষ করে গায়ে পাতলা কম্বল টেনে দিয়ে কপালে উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে ঘুমোতে বলে চলে যান তিনি। ব্যাস এতটুকুই মনে আছে আমার তারপর ঘুমে বিভোর আমি!

____________

দোলাকে রুমে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে পূর্ব বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। ফোন বের করে কাওকে ফোন দিয়ে বলল,

-‘ সবকিছু রেডি?’

ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠস্বর…

-‘ জ্বী স্যার। ‘

-‘ ওকে ফাইন! রেডি থাকো, আমি আসছি। ‘

পরিশেষে মেয়েটি অতি চিন্তুিত কন্ঠে বলল,

-‘ স্যার প্লিজ রিকুয়েষ্ট! আপনি যাবেন না। লাইফ রিস্ক আছে এতে। আপনার কিছু হলে দোলা ম্যামের কি হবে?’

পূর্ব ধরা কন্ঠে বলল,

-‘ ও নিজেকে সামলে নিবে। দোল অনেক স্ট্রং গার্ল।’

ফোন কেটে দেয় পূর্ব। চোখের কার্নিশ বেয়ে আজ বেয়ে পড়ে দু’ফোটা অশ্রুকণা। আজ সে কত বছর পর কাঁদছে জানা নেই। ২৯ বছরের জীবনে এসে কাঁদছে সে, নিজের স্নিগ্ধপরীর থেকে দূরে থাকতে হবে তা ভেবে, বহুদূরে!

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
|অতিরিক্ত অংশ|

(৪৭ তম পর্বের পরবর্তী অংশ)

চোখের কার্নিশে এসে জমে থাকা পানিগুলোকে পূর্ব নিজের ডান হাত দিয়ে চট জলদি মুছে নেয়। নিজের চোখে পানি দেখে সে হতভম্ব! দোলার প্রতি কতটা দূর্বল সে এই অশ্রুজল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কাঁধ বাকিয়ে সে রুমের দিকে দৃষ্টি দেয়। বেডে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে দোলা! পূর্বের হটাৎ ক্লান্তি লাগে প্রচুর। সে ফোন পকেট থেকে বের করে লিবা কে ম্যাসেজ টাইপিং করে বলল,

-‘ নট নাউ লিবা! আ’ম টায়ার্ড। আই উইল কাম এট নাইট। ‘

ম্যাসেজটা সেন্ড করে ক্লান্ত দেহ নিয়ে সে বেডের দিকে এগিয়ে যায়। একটা ঘুম প্রয়োজন। আজ তার গোয়েন্দা বিভাগের ক্যারিয়ার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা দিন। টেররিজম (জঙ্গি) টিম বাংলাদেশে এসেছে। তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে। প্রায় ২০ বছরের ট্রেনিং নিয়ে। এদের সাথে লড়াই করা অনেকটা বাঘের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার মতো। টেররিজম টিমের সবাই এই ২০ বছর খাওয়া দাওয়া ভুলে শুধুমাত্র ট্রেনিং নিয়েছে। একদম কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া তাদের সাথে লড়াই করতে যাওয়া মানেই মৃত্যু।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ফোর্স কাজে লেগে গিয়েছে ইতিমধ্যে। মৃত্যুর ভয় থাকলেও তাদের এই মূর্হতে দেশ রক্ষা করাটাই বিশাল ব্যাপার!

পূর্ব আগে থেকেই জানতো ওরা এসেছে। তাই কক্সবাজার চলে আসে সে! এখানে ওর কোম্পানির একটা শাখা সহ, গোয়েন্দা বিভাগের মেইন শাখাটা ও এখানেই অবস্থিত। ওদের টিমকে দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে পেছন থেকে হামলা করতে যাতে কোনো রক্তক্ষরণ ছাড়া টেররিজম টিমের লিডার প্যানেলের সবাইকে ধরে ফেলতে পারে! বাকিদের সামলাবে পুলিশ এবং র্্যাব।

পূর্বের সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে তারা টেররিজম দের খুব সহজেই ধরে ফেলবে যেহেতু জায়িন আকবর আছেন। কিন্তু ওর ভয় হচ্ছে, তার কিছু হয়ে গেলে দোলাকে কে সামলাবে? তাছাড়া দোলার পাশে অন্য কেও আসুক তা মেনে নিতে পারবে না সে! সে কোনো মহান প্রেমিক নয়। তার সম্পদ একান্তই তার।

সকল চিন্তা সাইডে রেখে পূর্ব দোলাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জরীয়ে ধরে ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ে। মাথা ব্যাথা করছে তার চিন্তায়। মৃত্যুর ভয়টা বারবার নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে, মৃত্যু আসলে সে সাদরে গ্রহণ করবে কিন্তু তার স্নিগ্ধপরীর কি হবে?পূর্ব তো চায় সে দোলার সাথে বার্ধ্যকের ঢলে পড়া চামড়া, শুভ্র রঙের চুল, দাত ছাড়া মাড়ি সেই বয়স অব্দি থাকুক।

নিজের ওপর ভারী কিছু মনে হতে কাঁচা ঘুম ক্ষন এর মাঝেই ভেঙে যায়। কপাল কুঁচকে চোখ খুলতেই সর্ব প্রথম নজরে আসে আমার পূর্বের স্নান ঘুমন্ত চেহারা। ক্লান্তি নেমে আসা চেহারা ঘুমে বিভোর! ভারী নিঃশ্বাস এসে বাড়ি খাচ্ছে আমার গালে। পূর্ব আমার ওপর হাত পা উঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে। প্রথম সময়টায় বিরক্ত এবং রাগ লাগে ঘুম ভেঙে দেয়ার কারণে কিন্তু পরক্ষণে তার সুদর্শন চেহারা দেখে সব ফুস! রাগ, বিরক্তি নিমিষেই গায়েভ। একটা মানুষ এতোটা সুদর্শন রূপি কিভাবে হতে হবে?

হটাৎ পূর্ব চোখমুখ কুঁচকে নেয়। আমার কোমড়ে থাকা ডান হাত দিয়ে তিনি আরো নিবিড় ভাবে আমায় জরীয়ে নেন তার সাথে। ঘুমের ঘোরে এমনটা করেছেন তা বুঝতে দেরী নেই! অতঃপর তার ঘুম নষ্ট করতে ইচ্ছে জাগলো না। পূর্বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফের ঘুমিয়ে যাই।

পরবর্তী ঘুম ভাঙে আছরের আজানের শব্দে। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসি। ইশ! জোহরের নামাজ টা পড়া হলো না।

মলিন মুখে ডানে তাকাতে দেখি পূর্ব পায়ের ওপর পা তুলে কফি খাচ্ছেন আর আমার দিকে চেয়ে মৃদু হাসি দিচ্ছেন। ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই তিনি বললেন,

-‘ এতক্ষণে ঘুম ভাঙ্গলো ম্যাম? সেই সকালে ঘুমিয়েছিলে। ‘

আমি চোখমুখ কুঁচকে বলি,

-‘ ঘুম অনেক আগেই ভেঙ্গেছে আমার, শুধুমাত্র আপনার জন্য.. ‘

কথাটা অর্ধ সম্পূর্ণ রেখে চুপ হয়ে যাই। পূর্ব তীক্ষ্ণ চাহনি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আরেক সিপ কফি খেয়ে প্রশ্নাত্তর কন্ঠে বললেন,

-‘ আমার জন্য? নেক্সট কি?থেমে গেলে কেন?সেন্টেস কমপ্লিট কর! ‘

আমি আমতা আমতা করে বলি,

-‘ কিছু না। ‘

পূর্ব হাতের কফির মগটা টেবিলে রেখে আমার দিকে এগিয়ে আসেন। বেডে বসে পড়ে বাম হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে কোমড় জরীয়ে ধরেন। ঘাড়ে নিজের নাক দিয়ে ঘসে শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘ ওড়না ছাড়া তোকে কিন্তু অতিরিক্ত হট লাগে স্নিগ্ধপরী! ‘

লজ্জা কাটিয়ে হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছি পূর্বের দিকে। তার ঠোঁটের কোনায় জ্বলজ্বল করছে বাঁকা হাসি। সে তার হাত দিয়ে গালে স্লাইড করে বললেন,

-‘ এখন থেকে আমার সামনে ওড়না ছাড়াই ঘুরে বেড়াবি ওকে?হু? ‘

একরাশ লজ্জা নিয়ে পূর্বের বুকে ধাক্কা দেই। তবে কাজ হয়না, তাকে এক ফোঁটা নড়াতে পেরেছি কিনা সন্দেহ। চোখ সামনে দিয়ে চারপাশে ওড়না খুঁজতে যখন আমি ব্যাস্ত ইতিমধ্যে তিনি পুনরায় বললেন,

-‘ তোর এই নরম তুলতুলে হাত দিয়ে আমার মতো ৭৮ কেজি ওয়েট এর ব্যাক্তিকে ধাক্কা দিস?ভালো তো! ‘

বলে হেঁসে দেন তিনি। অবিশ্বাস্য চাহনি নিয়ে হা করে তাকিয়ে আছি তার দিকে। কৌতূহল নিয়ে বলি,

-‘ হোয়াট? আপনার ওয়েট ৭৮ কেজি? আপনাকে দেখলে মনে হয় ৬০ বা ৬৫ কেজি! ‘

পূর্ব ঠোঁটের কোনায় হাসি বিদ্যমান রেখে বললেন,

-‘ প্রতি ঘাম ঝড়িয়ে জিম করি, তা কি অযথাই?’

অতঃপর বুঝতে পারি এসব! বেডের কর্নারে অবহেলায় পড়ে থাকা ওড়নাটাকে পা দিয়ে টেনে এনে গলায় জরীয়ে পূর্বকে বুকে চিমটি দিয়ে বলি,

-‘ সরুন, এভাবে জরীয়ে ধরে বসে আছেন কেনো?কাজ নেই? কাজের জন্য এখানে এসেছেন, ভুলে গেছেন?যান এখান থেকে! ‘

-‘ উঁহু! ‘

-‘ পূর্ব প্লিজ ছাড়ুন, সাওয়ার নিবো আমি। ‘
কিছুটা জোরালো কন্ঠে বলতেই কোমড় থেকে পূর্বের হাত যুগল নরম হয়ে এসে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলে তিনি একহাত আঁকড়ে ধরে বললেন,

-‘ সাওয়ার তো আমিও নেইনি! তাহলে আয়..’

চোখ পাকিয়ে পূর্বের দিকে তাকাতে সে বাঁকা হাসলো। পাজা কোলা করে তুলে নিতেই চিৎকার দেই। তবে সে শুনলো না। অতঃপর নিজের কার্য হাসিল করাই এখন তার একমাত্র কর্ম!

ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে বেলকনিতে এসে দাঁড়াই। পশ্চিম আকাশে লাল হলদেটে সূর্য ঢলে পড়েছে। তার সময় সীমা পৃথিবী থেকে শেষ! যেকোনো সময় সে বিদায় নিবে পৃথিবী পৃষ্ঠ হতে। দূর দূরান্তের সবুজ শ্যাওলা পড়া পাহাড় এই মূর্হত টায় মনো মুগ্ধকর লাগছে। সমুদ্রের পানিতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে পড়ে পুরো পানি এখন সূর্যের রঙ ধারণ করছে।

গভীর দৃষ্টি দিয়ে চারিপাশ দেখতে দেখতে এক সময় অনুভব হয় কড়া পারফিউম এর ঘ্রাণ। পিছে ফিরে দেখি পূর্ব ফর্মাল ড্রেস পড়ে রেডি হচ্ছে। তা দেখে ভ্রু দুটি কুঁচকে যায়। ভেজা টাওয়াল ডিভানে ছুঁড়ে মেরে রুমে চলে যাই। পূর্বের পিছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি,

-‘ এই সময় কোথায় যাচ্ছেন? অফিস তো এতক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে না?’

পূর্ব কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বললেন,

-‘ হু! আমার কাজ অফিসের বাহিরে। ক্লাইন্ট এর সাথে মিট করতে একটু দূরে যেতে হবে দুই বা তিন দিন লাগতে পারে ফিরতে। তুই অরিন আর ভাইয়ার কাছে থাকিস। বাহিরে বের হবিনা একদম। আমি এসে দরকার পড়লে বাহিরে নিয়ে যাবো। ‘

দুই তিনদিন দূরে থাকবে! কথাটা মনে আওড়ালে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। অসহায় চাহনি দিয়ে পূর্বের দিকে তাকাতে সে দুই কদম এগিয়ে এসে আমার দুগালে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বললেন,

-‘ একদম মন খারাপ করবি না। এসে পড়বো আমি। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবি। নিজের খেয়াল রাখবি। হেঁয়ালি করবি না নিজের প্রতি! ‘

আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে মাথা নাড়িয়ে ‘ হ্যা’ বলি! কেনো যেনো বেশ খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হতে চলেছে। খুব খারাপ কিছু। পূর্ব আপাতত দূরে যেতে ইচ্ছে করছে একটুও! আমি ধরা কন্ঠে বলি,

-‘ না গেলে হয়না?’

-‘ আমি না গেলে কে যাবে? অরিন প্রেগন্যান্ট, ভাইয়ার ওকে প্রয়োজন। ভাইয়াকে পাঠাই কিভাবে? প্রেগন্যান্সির টাইমে একজন ওয়াইফ এর সবচেয়ে বেশি দরকার পড়ে তার হ্যাজবেন্ড। আর আমি এসে প..পড়বো ত..তো। ‘

শেষের কথাগুলো কাঁপা কন্ঠে বললেন তিনি। এতে ভয়টা দ্বিগুণ হয় আমার। চুপচাপ দু পা এগিয়ে তাকে জরীয়ে ধরি। আলত কন্ঠে বলি,

-‘ আমাকে কি আপনি কোনো মিথ্যা কথা বলছেন পূর্ব? আমার এতো খারাপ লাগছে কেনো?’

পূর্ব ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বললেন,

-‘ নাহ! মিথ্যা বলার কি আছে?খারাপ লাগছে কারণ দূরে যাচ্ছি তাই হয়তো। ‘

-‘ চলে আসবো কথাটা বলার সময় আপনার কন্ঠ কাঁপলো কেনো?’

-‘ এমনি! তেমন কিছু না। নিজের খেয়াল রাখিস, আমার দেরী হচ্ছে। ‘

আমি মলিন কন্ঠে বলি,

-‘ নিজের খেয়াল রাখবেন পূর্ব। ‘

পূর্ব চলে যায় দ্রুত। তবে মাঝপথে পিছু ঘুরে তিনি শীতল কন্ঠে বললেন,

-‘ স্নিগ্ধপরী যদি জানে সে আর নেই।ফিরে আসবেনা আর কখনো। বহুদূরে পাড়ি দিয়েছে সে, তাহলে স্নিগ্ধপরী যেনো অশ্রু বিসর্জন না দেয়। এতে সে যে দূরে গিয়েও প্রচন্ড কষ্ট পাবে। জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাবে সে! ‘

তড়িৎ বেগে চলে যায় পূর্ব। অস্থিরতা নিয়ে সেদিকে চেয়ে আছি। কি বলে গেলেন তিনি? ‘স্নিগ্ধপরী ‘ তো তিনি আমায় সম্মোধন করেন। তাহলে ‘সে’ কে?প..পূর্ব নয়তো?

দুইদিন কেটে গিয়েছে আজ। পূর্বের কোনো খোঁজ নেই, না দিয়েছে কোনো ফোনকল না কোনো ম্যাসেজ। এই দুইটা দিন কিভাবে কেটেছে তা একমাত্র আমি নিজেই জানি।

আপেল কেটে দিয়ে অরিনের দিকে এগিয়ে দেই। হটাৎ টিভিতে একটা নিউজ শুনে নিস্তব্ধ হয়ে যাই। ঝাপসা দেখতে শুরু করি। এক সময় শক সামলাতে না পেরে ব্রেন কাজ করা বন্ধ করে দেয়! টলে পড়ি মাটিতে। শেষবার চোখদুটো পূর্বকেই খুঁজছিলো।

চলবে…