স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-০৬

0
1381

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[পর্ব-০৬]
লেখিকাঃ #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

গ্রীষ্মকালের প্রথম ভাগ! চারিদিকে এক গুমোট ভাব বিরাজ করছে! উত্তপ্ত রৌদ্দুরে মানুষের নাজেহাল অবস্থা। তবুও কাজের তাগিদে বেড়িয়ে পড়েছে অনেকে।

মাথায় সাদা ওড়নাটা ভালোমতো পেচিয়ে কলেজ বিল্ডিং থেকে বেড়িয়ে আসি! ভ্যাপসা গরমে মূ্র্হতেই কলেজ ইউনিফর্ম টা ঘেমে গিয়ে ভিজে একাকার অবস্থা! আমি দ্রুত পায়ে কলেজ গেট পেরুতেই সামনে তাকিয়ে থতমত খেয়ে যাই। সামনে আশফি দাড়িয়ে! ওকে দেখে ভয় ঝেকে ধরে আমায়। আশফি আমার সিনিয়র। কলেজ এটাচ ভার্সিটি টায় পড়ে।

আশফি কে দেখে ভয় পাওয়ার কারন ছিলো ওকে আমি থাপ্পড় মেরে পুরো রাস্তার উপস্থিত মানুষদের সামনে অপমান করেছিলাম! যদিও অপমান করার যৌক্তিক কারণ ছিলো। ও প্রতিদিন এক একটা মেয়েকে রাস্তার মাঝে বিরক্ত করে। বাজে ইঙ্গিত করে! কখনো তো দেখা যায় মেয়েদের স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দিয়ে তাকে হ্যারেজ করে। তবে স্ট্রেন্জ ব্যাপার হচ্ছে এইসব ঘটনা রাস্তার মাঝে হতে দেখে কেও মুখ ফুটে কিছু বলেনা। তবে আমার সহ্য হয়নি! তাই প্রতিবাদ করেছি।

কিন্তু তার পরদিনই ও আমাকে তার চেলাপালা নিয়ে কলেজে এসে শাশিয়ে গিয়েছে যে সে আমাকে ছেড়ে কথা বলবেনা।পরে জানতে পারি ও সন্ত্রাসী! এরজন্য বেশি ভয় লাগে। ঐদিন পাত্তা না দিলেও আজ ভয় হচ্ছে আশফিকে দেখে। কারন আমি এখন যেখানে রয়েছি সেখান থেকে হাজারটা চিৎকার দিলেও কেও শুনবেনা!

আমি উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিবো তখনই আশফি এক প্রকার দৌড়ে এসে আমার হাত চেপে ধরে শক্ত ভাবে। ব্যাথায় চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে যাই। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশফির দিকে তাকাতেই খেয়াল করি সে শয়তানি হাসি দিচ্ছে!

আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বলি,,,,

— কি সমস্যা? হাত ধরলেন কোন সাহসে?

আশফি বিশ্রি হেসে বলল,,,

— ভুলে গেছো সোনা? সেদিন বলেছিলাম না প্রতিশোধ নিবো?আজ সেই প্রতিশোধই নিতে এসেছি!

আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও তা সামনে প্রকাশ করলাম না। এতে আশফি আমায় দূর্বল ভাবতে পারে! কড়া কন্ঠে বলি,,,

— জেলে যেতে না চাইলে সোজা হাত ছাড়ুন! আর আমার কাছে ঘেসবেন না কোনোদিন।

আশফি হাত ছাড়ার বদলে দুহাত চেপে ধরে পিঠে বিশ্রী ভাবে স্পর্শ করে। হলুদ দাঁত গুলো দিয়ে হেসে বলল,,,

— ছাড়ার জন্য তো ধরিনি। সেদিন আমায় অপমান করেছিলি না? থাপ্পড় মেরেছিলি আবার! কোন হাত দিয়ে যেনো বাম নাকি ডান? ওহ হ্যা.. ডান হাত!

বলেই ডান হাত টা জোরে চেপে ধরে । আমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। চোখের পলকেই আশফি আমার ডান হাত মুচড়িয়ে ভেঙ্গে দেয়! খুব জোরে চিৎকার করে কেঁদে দেই আমি। ব্যাথায় চোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি পড়ছে। হাতটা লাল হয়ে গেছে!

আশফি ফের অপ্রীতিকর হেসে বলল,,,,

— মাত্র এতটুকু ব্যাথায় কান্না করে দিলি? মাত্র তো শুরু! এবার তোর পুরো শরীরে ব্যাথা দিবো।

কথ্য সম্পূর্ণ করে আশফি আমার চোখমুখ একটা স্প্রে করে দেয়। মাথা ঝিম দিয়ে ঘুম পাচ্ছে খুব। সেন্সলেস হওয়ার আগে খেয়াল করলাম আশফি আমায় কাঁধে তুলে নিচ্ছে! অতঃপর চোখযুগল বন্ধ হয়ে যায়। আর কিছু মনে নেই।

_______________________________

তিনঘন্টা পর……!

প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা নিয়ে চোখ খুলি! তবে হাত পা একদমই নড়চড় করতে পারছি না। ভালোভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করি আমার হাত পা চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা। হুট করে মনে পরে কলেজের ঘটনা। ভয়ে শিউরে উঠি। ফুপিয়ে কেঁদে দিয়ে চারিপাশে লক্ষ করি। এখানে যে আমায় আশফি আটকে রেখেছে তা একদম নিশ্চিত আমি।

আশেপাশে তাকাতে খেয়াল হয় এটা একটা পরিত্যাক্ত টিনের ঘর! খুব বাজে গন্ধ ভেসে আসছে চারপাশ থেকে। গন্ধটা ঠিক কিসের তা বোঝা দায়! টিনের ঘরটায় চেয়ার ব্যাতীত রয়েছে সামনে বিছানো একটা খড়কুটোর বিছানা! এটা লক্ষ করে যা মনে হলো কিছু সময় আগেই তা তৈরি করা। পুরো ঘরটায় ধুলোমাখা!

নিজের দিকে তাকিয়ে একবার পরখ করে নেই! নাহ সব ঠিক আছে। ডানহাতটা একদমই নাড়ানো যাচ্ছেনা। ব্যাথায় শ্বাস আটকে আসার উপক্রম! হাতটা কালচে আকার ধারণ করেছে। হাত পায়ের রশি খোলার অবস্থাতে আমি নেই।

আমি আলতো চিৎকার দিয়ে বলি,,,

— কেও আছেন?প্লিজ হেল্প মি! আমি এখানে থাকতে পারছিনা। দম আটকে যাচ্ছে আমার! এখা থেকে একটু বাহিরে নিয়ে যান।

বলতে বলতেই কেঁদে দেই! পূর্ব ভাইয়া মনে পড়ছে হটাৎ! মনপ্রাণে শুধু তাকে ডাকছি। তিনি আসুক! আমায় এই নরক থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাক। কিন্তু ভাইয়া কি আসবেন?

________________________________

ফাজ পুরো তন্নতন্ন করে দোলাকে খুজছে! ওর অবস্থা দেখে সবার ভীত মনে গলে যায়! ফাজের অবস্থা দেখে ওর সাথে কাজ করা লোকদের ইচ্ছে করছে তারা একটা ম্যাজিক করে ফাজ স্যারের স্নিগ্ধপরীকে তার সামনে হাজির করে দিক। ফাজের বাহিরটা পাষাণ হলেও ও ভেতর থেকে নরম! কারো কষ্ট চোখে দেখতে পারে না। তাই তো বিদেশ ছেড়ে দেশের মাটিতে ছুটে এসেছে। গরীব মানুষদের সুখ, আশা, আকাঙ্খার জায়গা ফাজ!

আজ সকালেই ফাজের পিএ জানায় তার স্নিগ্ধপরীকে কলেজ থেকে কেও উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে! তার পর থেকেই ফাজ উন্মাদাপ্রায়! ওর অবস্থা করুন। বারবার স্নিগ্ধপরীর নামে বিলাপ করে সে নিজেকে আঘাত করছে। নিজেকে দোষারোপ করছে কেনো সে তাকে ঠিকভাবে রক্ষা করতে পারলো না?

ফাজ আপাতত ঢাকার গুলশান এলাকায় এসেছে। ইনফরমেশন পেয়ে জানা গিয়েছে দোলাকে যে কিডন্যাপ করেছে সে তাকে গুলশান এর দিকে নিয়ে এসেছে। কোনো এক পরিত্যাক্ত জায়গায় তাকে আঁটকে রেখেছে! এটা শুনে ফাজের মনে আশার আলো চিকচিক করে জ্বলে উঠেছে। বুকে খা খা করছে একবার তার স্নিগ্ধপরীকে বুকের সাথে জরীয়ে ধরার জন্য। ইশ..মেয়েটা কেমন আছে? ভালো তো? যেই কিডন্যাপ করুক না কেনো তার স্নিগ্ধপরীকে একবার তাকে হাতে পেলে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলবে ফাজ!

_____________________________

হাতের ব্যাথায় যখন ছটফট করছি তখন সেই টিনের ঘরটার দরজা খোলার শব্দ হলো! কেও আসছে। পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অশ্রুসিক্ত নয়নে সেদিকে তাকাতেই দেখি আশফি! বুকে মোচড় দিয়ে উঠে। তাকে দেখে একদমই সুবিধার মনে হচ্ছে না আমার।

আশফি টিনের দরজাটা চাপিয়ে রেখে আমার কাছে বড় বড় পা ফেলে আসে। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যাই! অজান্তেই এখন ভয়টা দ্বিগুণ হচ্ছে। মনে মনে দোয়া করছি পূর্ব ভাইয়া আসুক! একবার আসুক। আমায় এই নরক থেকে নিয়ে যাক।

আমি কাঁপা কন্ঠে বলি,,,

— প্লিজ যেতে দিন।

আশফি আমার কথা শুনে শয়তানি হাসি দেয়। উদ্ভট একটা শব্দ করে বলে,,,

— যাওয়ার জন্য তো এখানে আনি নি ফুলটুসি! তোমাকে টেষ্ট না করে কিভাবে যেতে দেই?

আশফির এমন বিশ্রী কথা শুনে কান্নাটা যেনো বেড়ে যায় খুব করে। চোখ বন্ধ করে একাধারে কেঁদে যাচ্ছি। তখনই অনুভব হয় আমার ঘাড়ে কেও হাত দিচ্ছে। চট জলদি চোখ খুলতেই আশফির মুখশ্রী ভেসে উঠলে! ও আমার ঘাড়ে হাত দিয়েছে। গায়ে জরানো ওড়নাটা টান দিয়ে ফেলে দিতে নিবে তখনই বিকট শব্দ হয়ে টিনের ঘরটার দরজা খুলে যায়। মনে আশার আলো সন্ধার হয়!

আশফি রেগে সেদিকে গিয়ে কিছু বলবে তার আগেই মুখ থুবরে মাটিতে পড়ে যায় সে! আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি পূর্ব ভাইয়া দাড়িয়ে। তাকে দেখে শব্দ করে কান্না করে দেই।

পূর্ব ভাইয়া দৌড়ে আমার কাছে এসে আমার মাথা তার বুকে চেপে ধরেন। অনুভব করি তার হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত চলছে!

পূর্ব ভাই আমায় বুকে জরীয়ে আমার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেন। হাত উন্মুক্ত হতেই সবকিছু ভুলে তাকে ঝাপটে ধরি! আপাতত তার বুকটাই সেফ মনে হচ্ছে। তিনিও আমায় শক্ত করে আগলে নেন তার বক্ষ মাঝারে! অস্থির কন্ঠে বললেন,,,

— তুই ঠিক আছিস দোল? কাঁদছিস কেনো?কাঁদিস না আর! আমি এসে গিয়েছি না?হু?স্টপ ক্রায়িং!

চলবে,

________________________________