স্নিগ্ধ প্রেমের সম্মোহন পর্ব-০৮

0
1336

#স্নিগ্ধ_প্রেমের_সম্মোহন
–[পর্ব-০৮]
লেখিকাঃ #সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

সেই লোমহর্ষক দিনটির পর আজ প্রায় তিনদিন কেটে গিয়েছে। আমি এখন সুস্থ। তাই আজ কলেজে এসেছি এডমিট কার্ড সংগ্রহ করতে। ধরণীতে গত তিনদিন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ে আজ আবার সেই উত্তপ্তকর রৌদ্দুর হানা দিয়েছে আমাদের মাঝে! পৃথিবীর পৃষ্ঠে!

কলেজ মাঠে একটা প্লাস্টিকের পলিথিন জাতীয় কিছু বিছিয়ে বন্ধু মহলের মধ্যমনি হয়ে বসে আছি। সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাতে নিবদ্ধ। এমন দৃষ্টি দেখে আমার মন গহীনে বিরক্তি এসে হানা দেয়। ওদের সবার এমন তীক্ষ্ণকর ভাবে তাকানোর কারনটা হচ্ছে দ্যা ঐতিহাসিক ‘চিরকুট’!

চিরকুট টা হচ্ছে সেই অদ্ভুত লোকটার দেয়া। যাকে স্বাভাবিক ভাষায় সাইকো বলে সম্মোধন করা যেতে পারে। এটা আগের চিরকুট টা নয় আজ সকালে প্রেরণ করা হয়েছে!

চিরকুটে লিখা ছিলো এরূপ কিছু….,

স্নিগ্ধপরী,
আমায় মাফ করো প্রাণোসী! মাফ করো আমায়। তোমায় সেই অপ্রীতিকর মূর্হতটা থেকে রক্ষা করতে পারিনি। তবে আল্লাহ সহায় হয়েছেন বলে বেশি কিছু ক্ষতি করতে পারেনি ঐ জানোয়ার টা। আমি ঐ কু** টাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছি স্নিগ্ধপরী! খুব কঠিন শাস্তি। সে আর কখনো তোমার দিকে হাত বাড়ানোর সাহস করবেনা। কারণ তাকে এই পৃথিবীতে আমি বাঁচিয়ে রাখিনি! নিশ্চিতে থাকো তুমি। নিজের খেয়াল রেখো! আর কেও দ্বিতীয় বার তোমায় বাজে ভাবে স্পর্শ করার ভুল করবেনা কখনোই!

এতটুকুই লিখা ছিলো চিরকুটে। চিরকুটের সাথে পাঠানো হয়েছিলো কিছু ব্লাক রোজ যা আমার অতী পছন্দের আর কালো একটা খামে কিছু ছবি! ছবিগুলো দেখে দুবার বমি করে অবস্থা আমার করুন প্রায়!

ছবিতে ছিলো আশফির ঘাড় থেকে আলাদা করা মাথা। দুহাত এর ছয় টুকরো অংশ! শরীরের অংশ টা চোখে পড়েনি। হয়তো শরীরটাকে একদম টুকরো টুকরো করে ফেলেছে তাইতো ছবি দেয়নি!

এই ছবিগুলো দেখে আমার ক্ষনেই মনে হয়েছিলো লোকটা একটা সাইকো! মারাত্মক সাইকো। সাইক্রিয়েটিষ্ট তাকে দেখানো হলে নিশ্চিত বলবে ‘এই লোক চরম পাগল, সাইরেন কিলার’

ভাবনা গহীন থেকে বেড়িয়ে আসি নীরবের কর্কশ কন্ঠস্বর শুনে! সে বলছে,

— দোলের বাচ্চা দোলা! তলে তলে প্রেম করোছ আর আমারে একবার কইলি না। কেমন বন্ধু তুই?বেষ্টফ্রেন্ড রে বললি না?

নীরবের কথায় আমার মন নিভৃতে রাগ জমা হয়। ইচ্ছে করছে বেয়াদব টাকে ঠাস করে একটা থাপ্পড় লাগাই। আমি রেগে গিয়ে বলি,,,

— থাপ্পড় খাবি নীরব, এসব কি বলিস উল্টো পাল্টা? চিরকুট দেখে বুঝিস নি কিছু? এই লোককে আমি চিনিনা! আই ডোন্ট নো হিম! আর স্লাং ওয়ার্ড ইউজ করবিনা একদম।

— প্রেম না করলে এমন চিঠি পাঠাইবো ক্যা?আর আমি স্লাং ওয়ার্ড ইউজ কইরাই কথা কমু। তোর কি? বাই দা পদ্নাব্রিজ কি ভয়ংকর মৃত্যু দিছে রে আশফিরে, বাবাগো!

এরমাঝে ফোড়ন কেটে আদ্রাফ বলল,,,

— দোল? তুই কাকে স্লাং ওয়ার্ড ইউজ করতে মানা করিস? কুকুরের লেজ যেমন সোজা হয়না কখনো তেমনি আমাদের নীরা আপুরও স্লাং ব্যাবহার করা বন্ধ হবেনা!

আদ্রাফের কথায় রেগে ফায়ার নীরব! ব্যাস আর কি?লেগে গেলো ঝগড়া! এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে থাকা অরিন ও ওদের মাঝে ফোড়ন কেটে কথা বলে ঝগড়াতে নিযুক্ত হলো।

আমার ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় বাশ দিয়ে বাড়ি দেই কয়েকটা।
লাইক সিরিয়াসলি? এদের কাছে নিয়ে এসেছিলাম চিরকুট? যাতে আমি একটু সলিউশন পাই। বাট এই তিনজন মানব আমায় পাত্তা দিলোনা?

আমার মনে খটকা জন্মেছে। খটকা লাগছে এই তিনজন এর বিভেবে। কারণ এতোটা সিরিয়াস কথায় ওরা কখনো হেলাফেলা করতো না বা করেনি। স্কুলে ক্লাস এইটে পড়াকালীন এক ছেলে এসে আমায় লাভ লেটার দিয়েছিলো। আমি সাথে সাথে তার প্রেমপত্র তাকে ফিরিয়ে দিয়ে অগ্রাহ্য করি । এতে রেগে যায় ছেলেটি, শাশিয়ে বলে আমায় দেখে নিবে। আর তখনই নীরব আর আদ্রাফ কোথা থেকে উড়ে এসে ধুপধাপ মাইর শুরু করে। ছেলেটাকে গন ধোলাই দেয় এক প্রকার।

কিন্তু আজ যখন আমি এতটা সিরিয়াস কথা বললাম। এতে তাদের কোনো মাথা ব্যাথাই নেই?হুয়াই ম্যান?

ঝগড়ার মধ্যমনি নীরব হটাৎ ঝগড়া থামিয়ে বিষ্ময়কর দৃষ্টি ফেলে আমার পিছনে। চিন্তিত কন্ঠে বলল,,,

— দোলা?তোর একটা কাজিন আছে না?ঐ যে মোষ্ট হ্যান্ডসাম বান্দা?কানাডা যার নিজস্ব কোম্পানি আছে। তার নাম যেনো কি?

নিরবের বিবরণ শুনে আমার একজনেরই নাম মাথায় আসে! তা হচ্ছেন ‘পূর্ব ভাই’
আমি ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে বলি,,,

— পূর্ব ভাইয়ার কথা বলছিস?

—হ হ!
ওপরে নিচে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয় নীরব।

— হটাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করছিস কেনো?

—কারণ সে তোর পিছে, পিছে তো দেখ্ পিছে…!

তড়িৎ গতীতে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকাই।
নীরবের কথা সঠিক! পূর্ব ভাইয়া দাড়িয়ে আছেন তার কালো রঙের গাড়িটার সাথে মিশে প্রায়। তার চোখমুখে বিরক্তি আর অস্বস্তির আভাস! এই আভাসের কারণ খুজতে চারপাশে তাকাতেই লক্ষ করি কয়েকজোরা হা করে থাকা মুখশ্রী! কলেজের সব মেয়েরা হা করে তাকিয়ে আছে পূর্ব ভাইয়ার দিকে। কেও কেও তো যেনো চোখ দিয়ে গিলে খাওয়া শুরু করেছে! হাসি প্রায় প্রচুর। পূর্ব ভাইয়ার বর্তমান ফেসটা দেখার মতো।

এবার আমার পূর্ণ দৃষ্টি যায় তার দিকে। ঠিকভাবে পরখ করে দেখি তাকে। সাথে সাথে যেনো থমকে যায় দৃষ্টি! সাদা শার্ট, কালো কুচকুচে রঙের ড্যানিম প্যান্ট, আহা কি সৌন্দর্য…! ইশ… লোকটা এতোটা সুন্দর কেনোওওও?

আমরা চারজন বসা থেকে উঠে দাড়াই।দু কদম সামনে এগোতেই পূর্ব ভাইয়াকে দেখলাম বকের মতো বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসছেন। ধুপধাপ পা ফেলে একদম আমার পাশে এসে দাড়ান! সাথে সাথে মাতাল করা এক ঘ্রাণ নাকে এসে বাড়ি খায়। এটা পূর্ব ভাইয়ার শরীর থেকে আসছে স্মেলটা!

পূর্ব ভাইয়া পাশে এসে দাড়াতেই নীরব গমগম সুরে বলল,,,

— বস আমি আপনার অনেক বড় ফ্যান!ছেলে হয়েও আপনার প্রতি চরম ক্রাশিত আমি।

নীরবের কথ্যে হাসে পূর্ব ভাইয়া! সঙ্গে সঙ্গে আমার হৃদপিন্ড যেনো স্পন্দন করা বন্ধ করে দেয়। পূর্ব ভাইয়া যতোটা সুন্দর তার থেকেও মারাত্মক সুন্দর তার হাসি। ঘায়েল করা হাসি তার!
তিনি হেসেই উত্তর দিল,,,

— ক্রাশের ব্যাপারটা বুঝলাম বাট ফ্যান কি কারণে?

— বস এতো অল্প বয়সে এতবড় একটা কোম্পানি বানায় ফেললেন তাও কানাডার মতো দেশে? তাই আমি আপনার ফ্যান বস!

পূর্ব ভাইয়া হাসি বন্ধ করেন। ফের বললেন,,,

— বস বস করছো কেনো?তুমি কি আমার এমপ্লয়ি নাকি?ভাই বলে ডাকো।

— আচ্ছা সরি ভাই বলবো,

— দ্যাট’স গুড! তা পড়াশোনার কি খবর তোমাদের?

পূর্ব ভাইয়া আদ্রাফ আর নীরবের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। আমি ওদের কথা কানে না নিয়ে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে আছি পূর্ব ভাই এর দিকে। প্যান্টের পকেটে হাত গুজে অন্য হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছেন! ঠোঁটে তার মনকাড়া এক টুকরো হাসি।
ইশ..! লোকটার স্টাইল আমায় প্রতি মূর্হতে নেশায় ফেলে। মনে জাগায় অন্য রকম অনুভূতি! যেই অনুভূতি ব্যাখা করলে কষ্ট বুক চিড়ে বেড়িয়ে আসে।

পূর্ব ভাইয়ার হটাৎ দৃষ্টি আমার ওপর পড়ে! তিনি নীরবদের উদ্দেশ্য করে বলে,,,

— আমি দোলকে হসপিটালে নিয়ে যেতে এসেছি আজকে ওর ব্যান্ডেজ চেন্জ করতে হবে!

এতে নীরব স্লান হেসে বলল,,,,

— জ্বী ভাই অবশ্যই, দোলকে নিয়া যান। আমাদের তো এখন আর ক্লাস হয়না। আজ শুধু এডমিট কার্ড নিতে কলেজে আসা।

পূর্ব ভাইয়া সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমায় ইশারা করে সামনে এগিয়ে যেতে। আমি মাথা নাড়িয়ে সামনে আগাই। পার্কিং লটে আসতেই নজরে পড়ে তার কালো গাড়িটা! সেদিকে এগিয়ে যেতেই গাড়ির দরজা খুলতে নিলে পূর্ব ভাইয়া চট জলদি আমার পাশে এসে দাড়িয়ে দরজা খুলে দেন!

আমি তার দিকে একবার তাকিয়ে কোনো কথা ছাড়াই ভিতরে বসে পড়ি। পূর্ব ভাইয়া ঘুড়ে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়েন।চোখেমুখে বিরক্তির রেশ ফুটে উঠেছে! তিনি আমায় বললেন,,,

— তোর কলেজের মেয়েগুলো এমন কেনো? পুরো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো।ডিজগাস্টিং!

ভাইয়ার কথায় হাসি পায়। ফিক করে হেসে দিতেই তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে চট জলদি আমার দিকে তাকান! তার দৃষ্টি অন্য রকম! চাহনিতে আলাদা কিছু প্রকাশ পাচ্ছে।

হুট করে তিনি তার মাথা আমার মুখের দিকে এগিয়ে আনেন। ভড়কে গিয়ে পিছু যেতেই তিনি তার দুহাত দিয়ে আমার বাহু আঁকড়ে ধরেন! এক হাত গলার পিছনটায় দিয়ে টেনে তার সন্নিকটে নিয়ে যান!আকষ্মিক কান্ডে আমি হতবিহ্বল! কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিনা। শব্দ ভান্ডারে শব্দগুচ্ছো লোপ পেয়েছে যেন!

পূর্ব ভাইয়া তার মাথা নিচু করে গলায় একটা কামড় বসান! চেঁচিয়ে চোখমুখ কুচকে নেই! দুহাত দিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে গলার কামড় দেয়া জায়গাটা চেপে ধরে! দাগ বসে গেছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করেই টের পাচ্ছি।
পূর্ব ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখি তিনি বাঁকা হাসছেন!

আমি আমার ভয়গুলো মন কোঠর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে কন্ঠস্বরে রাগী ভাব এনে বলি,,,,

— কামড় দিলেন কেনো পূর্ব ভাইয়া?

পূর্ব ভাইয়া সিটে মাথা এলিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,,,

— তুই হেসেছিস কেনো?তার কারনে,

— মানে কি?এরজন্য কামড় দেয়া লাগবে?

— হু! তুই আমার সামনে হাসবি না। আমার সামনে তো দূর কারো সামনেই হাসবি না! গট ইট?

হতবিহ্বল আমি! এই লোক পাগল হয়ে গেছে নিশ্চিত।

পূর্ব ভাইয়া তৎক্ষনাৎ বিড়বিড় করে বললেন,,,,

— তার হাসিতে আছে এক অন্যরকম নেশা
যেই নেশাতে আমি হয়েছি তার প্রতি মাতাল
উন্মাদনায় প্রকাশ করেছি তাকে আমি ভালোবাসি!

বিড়বিড় করে বললেও পুরো কথাগুলো আমার কানে এসেছে!
যার ভয়টা আমি মন নিভৃতে এতোদিন পাচ্ছিলাম তা যেনো বাস্তবে রূপান্তর হচ্ছে!
ভয় লাগছে খুব! আমার কারনে আপুর ভালোবাসা যেনো বিলীন না হোক! বোনের ভালোবাসা বোন হয়ে কিভাবে কেড়ে নেই?

চলবে,

_________________________________

[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন ]