স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-০৩

0
418

#স্বপ্নছায়া
#দ্বিতীয়_খন্ড
#৩য়_পর্ব

বসার ঘরে থমথমে মুখে বসে রয়েছে নীলাদ্রি। তার হাতজোড়া কাঁপছে। মুখ রক্তশূণ্য। ভেতরের ঘরে পিউ শুয়ে রয়েছে। নীচতলার নতুন ভাড়াটের ছোট মেয়েটা তাকে দেখছে। বদরুল সাহেব, শরীফ সাহেব এবং আসমা বেগম ছুটে এসেছে নীলাদ্রির চিৎকারে। নীলাদ্রি যখন রান্নাঘরে প্রবেশ করে তখন দেখতে পায় পিউ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে যায়। পিউকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখে বুকে কামড় পড়ে তার। ছুটে যায় তার কাছে। মাথাটা হাতে তুলে জ্ঞান ফেরাবার চেষ্টা করে। কিয়ৎকাল বাদে পানির ঝাপটায় জ্ঞান ফিরে পিউ এর। নীলাদ্রি তাকে পাঁজাকোল করে নিজ ঘরে শুইয়ে দেয়৷ তারপর সবাইকে চিৎকার করে ডাকে। তার চিৎকারে নিচতলার মেয়েটিও ছুটে আসে। মেয়েটির নাম সুমাইয়া, পেশায় ডাক্তার। নীলাদ্রির চিৎকারে প্রেশারের মেশিন নিয়ে ছুটে আসে সে৷ পিউ এর এরুপ অবস্থা দেখে কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না সে। তাদের বিয়ের বয়স চার বছরের বেশি। পিউ এর গড়ণ ছিমছাম হলেও বেশ সবল। খুব কম তাকে দূর্বল হতে দেখে নীলাদ্রি। তাই পিউকে মেঝেতে মূর্ছানোবস্থায় দেখে হৃদয় কেঁপে উঠে তার। শরীফ সাহেব স্বান্তনা দিয়ে বললো,
— “চিন্তা করিস না, হয়তো খাবারের অনিয়মের কারণে প্রেসার ফল করেছে”

হ্যা, হতেই পারে প্রেসার ফল করেছে। হতেই পারে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটে নি। চিন্তা করাটা অহেতুক। তবুও চিন্তা চলে আসে, দুঃচিন্তা। তার সাথে আত্মগ্লানি। প্রমোশন পাবার পর থেকে পরিবার কিংবা পিউ এর প্রতি দায়িত্বগুলো কাজের ভারে চাপা পড়ে যাচ্ছে। শুক্রবার দিনটাই একমাত্র পায় তাদের সাথে সময় কাটানোর জন্য। হয়তো পিউ এর আক্ষেপ হয়, নীলাদ্রির প্রতি তার অভিমানের ঘড়াটা জমতে থাকে। কিন্তু অভিযোগ করে না। ঠোঁটের কোনায় অমলিন হাসির প্রলেপখানা অব্যহত থাকে। সেকারণেই এই আত্মগ্লানির বোঝাটা বাড়ছে। তখন সুমাইয়া রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। নীলাদ্রি উঠে দাঁড়ায়, দ্রুত পায়ে তার সামনে যায়। ঈষৎ কম্পিত কন্ঠে বলে,
— “পিউ এর কি প্রেসার ফল করেছিলো? এখন কেমন আছে?”

মেয়েটি একটু চিন্তিত মুখে বললো,
— “ভাবীকে একটু ডাক্তার দেখাতে হবে ভাই, কিছু পরীক্ষা করাতে হবে”

মেয়েটির মুখখানা দেখে মন বসে যায় নীলাদ্রির। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
— “পিউ এর শরীর কি খুব খারাপ?”
— “না না, খুব খারাপ নয়। আসলে আমি ভাবীর নার্ভ চেক করেছিলাম। হয়তো খুব বড় ডাক্তার আমি নই, কিন্তু আমার ভুল হয় নি। আমার মনে হয় ভাবী প্রেগন্যান্ট। তাও আপনারা পরীক্ষাগুলো করিয়ে নিন। আমার আন্দাজ ভাবীর আড়াই মাসের মতো চলে। এই সময় মাথা ঘুরানো, বমি খুব স্বাভাবিক। প্রেসারটা একটু লো আছে। কিন্তু সমস্যা নেই। আমি স্যালাইন খাওয়িয়ে দিয়েছি।”

নীলাদ্রি বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। পিউ মা হতে চলেছে কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো। মস্তিষ্কে পেন্ডুলামের মতো পর্যাবৃত্ত হারে ঘুরতে লাগলো। বদরুল সাহেব এবং শরীফ সাহেবের খুশি দেখে কে! দুজন জড়িয়ে ধরে নিজেদেরকে অভিনন্দিত করলেন৷ এদিকে নীলাদ্রি বলদের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। ফোনটি হুক্কাহুয়া করতে লাগলে সে ধাতস্থ হয় বর্তমানে। কলিগ ফোন করেছে। ফোন ধরতেই বললো,
— “ভাই আপনি কই? প্রেজেন্টেশনের দেরি হয়ে যাচ্ছে”
— “আমি আসছি না।”
— “হ্যা? কি বলেন! আপনি ছাড়া কে দিবে এই প্রেজেন্টেশন? চেয়ারম্যান আইতেসে ভাই! এমন কইরেন না”
— “মামুর বেটা, আমার বউ অসুস্থ। ওরে ছেড়ে কি আমি এখন প্রেজেন্টেশন দিতে ছুটবো? মেইল করে দিচ্ছি, সীমা আমার বদলে দিয়ে দিবে৷ ও জানে সব কিছু। আর যদি কিছু এদিক ওদিক হয়, আমি খায়ে ফেলাবো বলে দিচ্ছি”

বলেই ফোন রেখে দিলো নীলাদ্রি। কলিগ বেচারা চিন্তিত চিত্তে শুকনো ঢোক গিললো। আজ চেয়ারম্যান আসবে৷ অথচ তাদের ডিপার্মেন্টের ম্যানেজার ই নেই। কি যে হবে সেটাই বুঝতে পারছে না সে। নীলাদ্রি ফোন কেটে ধীর পায়ে নিজ ঘরে গেলো। আসমা বেগম তাকে দেখে মুচকি হেসে বাইরে চলে যান। পিউ হাটু আকড়ে জড়ো সড়ো হয়ে বসে রয়েছে। এক অন্যরকম অনুভূতি তার৷ অনেকটা মিশ্র, যে খুব খুশি হচ্ছে আবার ভয় করছে আবার খানিকটা চিন্তিত ও হচ্ছে। সব অনুভূতিগুলো একত্রে দলা পাকাচ্ছে। নীলাদ্রি এসে তার সম্মুখে বসে। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না! অনুভূতিটা নতুন, খুব ভিন্ন। হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বললো,
— “এতো বড় একটা খবর জানাস নি কেনো? এটা কি লুকানোর মতো কোনো খবর?”

পিউ মাথা উঁচু করে বললো,
— “বুঝবো কি করে? কিটে তো নেগেটিভ এসেছিলো। তাই ভাবলাম হয়তো চিন্তার কারণে মাসিক হচ্ছে না। সুমাইয়া বলাতেই না জানলাম।”
— “মাথা ঘুরানোটা আগেও হয়েছিলো?”
— “টের পাই নি, ভেবেছি এমনি”

নীলাদ্রির মনটা খারাপ হয়ে গেলো। হুটকরেই পিউকে জড়িয়ে ধরলো সে। খানিকটা অপরাধী কন্ঠে বললো,
— “আমি খুব বাজে তাই না? এতো বেপোরয়া, খামখেয়ালী যে তোর খেয়াল অবধি রাখি না। এই নতুন পরিস্থিতিতেও তোর একাই সব করতে হয়েছে।”

নীলাদ্রি কন্ঠ কাঁপছে। হ্যা, এটা সত্যি নীলাদ্রি তার খেয়াল রাখে না। কিভাবে রাখবে, সপ্তাহের ছ’টা দিন তার অফিসের কাজের বোঝা বয়ে নিয়ে যেতে হয়। সেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সে বাইরেই থাকে। বাসায় আসলেও ক্লান্তি এসে ভর করে ফলে চাইলেও পিউ এর সাথে খুব একটা কথা বলা হয় না তার। আগামী দিনের কাজটাও করে রাখতে হয় তার। যতক্ষণ তার কাছে ল্যাপটপ থাকে ততসময় সে কাজ করে। শুধু শুক্রবারটাই একান্ত পরিবারের জন্য। তার মাঝে পিউ ও থাকে, কিন্তু সবার মাঝে আলাদা করে এই ছোট খাটো ব্যাপারগুলো বলতে ইচ্ছে হয় না পিউ এর। সে সেই সময়টা নীলের সাথে স্বাভাবিকভাবেই কাটাতে চায়। পিউ নীলের বুকে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে করতে বললো,
— “দোষ টা তোমার নয়, আমি বুঝতে পারি নি এই সাধারণ ব্যাপারগুলো বলার মতো। আচ্ছা, তুমি খুশি তো?”
— “আমি তোকে বুঝাতে পারবো না, ঠিক কেমন লাগছে। আমার চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে, তোকে কোলে তুলে নাচতে ইচ্ছে করছে। সব করতে ইচ্ছে করছে। আমি বলে বুঝাতে পারবো না। আনন্দ, উত্তেজনা, ভয় সব দলা পাকাচ্ছে। আমি প্রকাশ করতে পারছি না। এর আগে মামা হয়েছি কিন্তু এই প্রথম বাবা হবার অনুভূতি হচ্ছে। একটা ছোট প্রাণ আমাদের মাঝে আসবে, যে কি না আমাদের অংশ। আমি বোঝাতে পারবো না এই অনুভূতিটা কেমন?”

পিউ মাথা তুলে তাকালো নীলাদ্রির পানে। তার চোখজোড়া চিকচিক করছে। মূহুর্তটা আবেগঘন, এই বড় পৃথিবীর মাঝে তাদের একটা ছোট পৃথিবী। ভাবতেই চোখ ছলছল করে উঠে পিউ এর। সকল সূখ এক পাশে আর মাতৃত্বের সুখ এক পাশে। এ যেনো বর্ণনাতীত____________

৩.
অভ্র বাড়ি ফিরলো আটটার দিক। মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে না। শীতটাও হুট করেই বেড়ে গেলো ঢাকায়। নিম্ম চাপ চলছে সারা দেশে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয় হুটহাট। কোট টা ভিজে যাওয়ায় আরো ঠান্ডা লাগছে৷ এখন গরম পানি দিয়ে গোসল না করলে এই ঠান্ডা যাবে না। ঘরের কাজের মেয়ে মাহফুজা দরজাটা খুলে দিলো। অভ্র তাকে বললো,
— “ভাবী কোথায়?”
— “দিশানের রুমে। ওরে পড়ায়”
— “অদ্রি?”
— “ও চাচার রুমে। চাচীর সাথে খেলে।”
— “আচ্ছা, আমার ঘরে এক কাপ কফি পাঠিয়ে দিও তো মাহফুজা”
— “জ্বে আচ্ছা”

অভ্র দিশানের রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমের বাহিরে যেতেই কানে এলো,
— “মাম্মাম, দেখো এই রিংটা সুন্দর না? আজ আমাকে আমার নতুন মিস আমার রেজাল্ট ভালো হবার কারণে এই রিং টা আমাকে গিফট দিয়েছেন।”

সত্যি চমৎকার আংটি। ঐন্দ্রিলা হাতে নিয়ে দেখছিলো। তখন ই তড়িৎ গতিতে অভ্রের প্রবেশ ঘটে। ক্ষিপ্র থাবা দিয়ে আংটিটা ছিনিয়ে নেয় সে। তারপর ছুড়ে ফেলে মেঝেতে। অভ্রের এমন কার্যে হতবাক হয়ে যায় ঐন্দ্রিলা। এমন প্রতিক্রিয়া যেনো কল্পনাতীত……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি