স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-০২

0
498

#স্বপ্নছায়া
#দ্বিতীয়_খন্ড
#২য়_পর্ব

ছোট দিশানের কথায় ঐন্দ্রিলার বিস্ময় আসমান ছুলো। হাজারো প্রশ্ন অবিশ্বাসের মোড়কে মুড়ে তার মনে ধাওয়া দিচ্ছে। প্রতি রাতেই অভ্র দিশানের ঘরে যায় এই বাক্যটি ঐন্দ্রিলাকে অবাক না করলেও দিশানকে জড়িয়ে কাঁদার কথাটা প্রচন্ড ভাবে ভাবাচ্ছে ঐন্দ্রিলাকে। অথচ পাশে থেকেও ব্যাপারগুলো আন্দাজ করতে পারে নি সে। ঐন্দ্রিলা নিশ্চিত হতে পুনরায় প্রশ্ন করে দিশানকে,
— “তুমি ঠিক জানো? বাবা প্রতি তোমার ঘরে যায়?”
— “হু, জানি। আগের একদিন আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। তখন আমি দেখলাম বাবা আমাকে হামি দিচ্ছিলো আর কাঁদছিলো। বাবা যেনো টের না পায় তাই আমি চোখ বুজে অভিনয় করছিলাম। তারপর থেকে প্রায় আমি দেখি বাবা আমার রুমে আসে। আমাকে আদর করে৷ আমি বাবাকে বুঝতে দেই নি যে আমি তাকে কাঁদতে দেখে ফেলেছি। তুমি আমাকে বলেছিলে কেউ কাঁদলে তাকে স্বান্তনা দিতে। কিন্তু আমি তো সেটা পারি না। তাই আমি বাবাকে বুঝতে দেই নি যে আমি সজাগ”

দিশানের গুছানো কথাগুলো শুনে হেসে দিলো ঐন্দ্রিলা। ছেলেটা যত বড় হচ্ছে তত যেনো আরোও বেশি বুঝদার এবং বুদ্ধিমান হচ্ছে। কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে সে! ঐন্দ্রিলা স্মিত হেসে দিশানের কপালে চুমু একে বলে,
— “আমার সোনা ছেলে”

তারপর সে দিশানকে খাওয়িয়ে দেয়। এতোকিছুর মাঝেও সে দিশানের কথাগুলো ভুলে নি। কথাগুলো তাকে ভাবেচ্ছে। এই প্রশ্নের ঝড় থামানোর উপায় এক জন ই সে হলো অভ্র৷ ঐন্দ্রিলা মনে মনে ঠিক করলো অভ্র ঘুম থেকে উঠলে সে সরাসরি অভ্রকে প্রশ্ন করবে। এর মাঝেই অভ্রের কন্ঠ কানে এলো,
— “মা এক কাপ কফি হবে?”

শারমিন বেগম তরকারি কাটতে কাটতে বললেন,
— “এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠলে কোনো কফি পাবে না। একটা চুলোও খালি নেই। সুতরাং বসতে হবে”

অভ্র মাথা চুলকাতে চুলকাতে ঐন্দ্রিলার দিকে চাইলো এই আশায় যেনো ঐন্দ্রিলা একটা সমাধান করে তার সমস্যার। ঐন্দ্রিলার বেশ হাসি পেলো অভ্রের মুখখানা দেখে। ফর্সা মুখখানা মায়ের কাছে আবদারের অমনোনয়নের জন্য লজ্জায় লাল হয়ে রয়েছে। ঐন্দ্রিলার পানে চেয়ে আছে এই আশায় যেনো তার প্রতি কিঞ্চিত হলেও করুনা হয়। অথচ তার বউটি দয়া দেখাবার বদলে মিটিমিটি হেসেই চলেছে। যা অভ্রের আতে লাগলো। তাই গোমড়া মুখ করে সে নিজের ঘরে গেলো। ঐন্দ্রিলার বুঝতে বাকি নেই, তার গোমড়ামুখো স্বামীটির বড্ড গোসা হয়েছে। এই গোসা একটি উপায় ই আছে তা হলো ঐন্দ্রিলার হাতের এক কাপ গরম গরম কফি। তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি দিশানকে খাওয়িয়ে দিলো ঐন্দ্রিলা। কফি দেবার বাহানায় গতরাতের কথাগুলোও জিজ্ঞেস করা যাবে!

মিনিট বিশেক বাদে, কফির কাপ হাতে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র তখন ল্যাপটপে মুখ গুজে রয়েছে। মুখখানা এখনো লাল হয়ে আছে। ঐন্দ্রিলা বেশ শব্দ করেই কপির কাপটা টেবিলে রাখলো৷ অভ্র এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,
— “শব্দ করছো কেনো?”
— “কি করবো বলুন, আমার আসা তো আপনি বুঝতে পারেন না। তাই শব্দ করেই জানান দিতে হয় আমি এসেছি। নিন, আপনার কফি। কোথায় ভেবেছি, আমি মায়ের বকুনি শুনে কফি আনলাম বলে একটু ধন্যবাদ পাবো। কিন্তু না, অভ্রমশাই এর সবসময় বিরক্তি।”

বলেই বিছানা গুছাতে লাগলো ঐন্দ্রিলা। অভ্র ল্যাপটপ টা রেখে গরম কফির কাপে চুমুক দিলো। মাথাটা যেনো হালকা লাগছে। সব ভার যেনো কর্পুরের মতো উবে গেছে। প্রফুল্ল কন্ঠে বললো,
— “এজন্যই তোমাকে এতো ভালোবাসি জানো। আমি জানতাম তুমি ঠিক আমার কষ্ট বুঝবে।”
— “হাহ! ভালোবাসা না ছাই। আসলে বরেরা সব সমান। কফির কাপ অবধি তাদের আদিক্ষেতা”

ঐন্দ্রিলার বিদ্রুপের মাঝে খানিকটা আক্ষেপ লুকানো ছিলো যা অভ্রের বুঝতে বাকি রইলো না। তাই কফিটা শেষ করে উঠে এলো সে। পৌরষ সুঠাম হাতজোড়া ঐন্দ্রিলার কোমড়খানা নিবৃত্তে জড়িয়ে ধরলো সে। নিগুঢ় স্পর্শে ঈষৎ কম্পিত হলো ঐন্দ্রিলার হৃদয়। তার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে অভ্র বললো,
— “তবে তো আমার ভালোবাসা বুঝাতে হচ্ছে!”

অভ্রের কন্ঠে দুষ্টুমির ইঙ্গিত। তার চোখে ঘোর লাগানো নেশা। ঐন্দ্রিলা লজ্জায় নেতিয়ে পড়লো। পাঁচ বছর পরও যখন অভ্রের স্পর্শ পায় তখন ই লজ্জায় গলে যায় ঐন্দ্রিলা। শ্যামলা গালজোড়া রক্তিম হয়ে উঠে। অভ্র গভীর চুম্বন আঁকলো ঐন্দ্রিলার ঘাড়ে। তারপর তাকে নিজের দিকে ফেরালো। নতমস্তক খানা আলতো হাতে তুলে ধরলো সে। ঐন্দ্রিলার অধর জোড়া কাঁপছে। লজ্জায় দৃষ্টি তুলতে পারছে না সে। কাঁপা ঠোঁটজোড়া নিজের আয়ত্তে আনার নিষিদ্ধ ইচ্ছে জাগলো অভ্রের মনে। তবে সেই ইচ্ছেটা ইচ্ছে ই রয়ে গেলো। কারণ তখন ই শারমিন বেগমের কন্ঠ কানে এলো,
— “ঐন্দ্রি, একটু আসো। অদ্রি ডাইপার বদলাতে হবে।”

সাথে সাথেই সব রোমান্স হাওয়ায় উবে গেলো অভ্রের। আর ঐন্দ্রিলা খিলখিল করে হেসে উঠলো। হতাশ কন্ঠে অভ্র বললো,
— “আমার রোমান্সের মুডের উপর পানি ঢেলে দিলো, ধ্যাত।”
— “বুঝুন তাহলে, আপনার ই মেয়ে।”
— “স্বভাবটা একেবারেই তোমার মতো”
— “হ্যা, হ্যা, এখন দোষ তো আমার। ছাড়ুন এবার। আর খেতে আসুন।”

উপায়ন্তর না পেয়ে অভ্র ঐন্দ্রিলার বাধন আলগা করলো। অদ্রিটা হবার পর ঐন্দ্রিলাকে দুদ্বন্দ একাকিত্বে পাওয়াটা খুব মুশকিল। হুটহাট মেয়েটি কেঁদে উঠে নয়তো এমন কিছু করবে যেনো ঐন্দ্রিলা তার কাছে ছুটে যায়। অভ্রের মাঝে মাঝে মনে হয়, অদ্রি পণ নিয়েছে কিছুতেই মাকে একাকিত্বে সময় কাটাতে দিবে না। দুটো ছেলে মেয়েই মা ঘেষা, মা ছাড়া যেনো তাদের দুনিয়াতে কিছুই নেই। ঐন্দ্রিলা বাহিরে যাবার জন্য পা বাড়াতে যেয়েও থেমে গেলো। পেছনে ফিরে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “আচ্ছা, আপনি গত রাতে দিশানের রুমে কি করছিলেন?”

ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে চমকে উঠে অভ্র। মসৃণ কপালে চিন্তার সংকীর্ণ রেখার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তার চেহারার রঙ পালটে যায়। আমতা আমতা করে বললো,
— “আসলে দিশান ভয় পেয়েছিলো তো তাই দেখতে গিয়েছিলাম”

ঐন্দ্রিলা বেশ অবাক হলো। অভ্র কি সুনিপুন ভাবে তাকে মিথ্যে কথা বললো! যা ঐন্দ্রিলাকে অবাক ই করে নি। বরং প্রচন্ড চিন্তার মেঘগুলো সুগাঢ় করলো। ঐন্দ্রিলার ইচ্ছে হলো আরোও কিছু প্রশ্ন করতে কিন্তু সে পারলো না। কারণ দিশানের কথাকে বাচ্চার মনে ভুল বলে চালাতে দেরি হবে না অভ্রের। ঐন্দ্রিলা কথা বাড়ালো না। সে ছোট একটা “হু” বলেই বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ঐন্দ্রিলার প্রস্থানে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অভ্র। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বস্তি পেলো না সে। যা করার দ্রুত করতে হবে! ঐন্দ্রিলাকে কিছুতে ব্যাপারগুলো জানানো যাবে না। তাহলে হিতের বিপরীত ছাড়া কিছুই হবে না।

আয়নার সামনে শার্ট পড়ছে নীলাদ্রি। আজ তার একটা প্রেজেন্টেশন রয়েছে।বেশ বড় একটা প্রজেক্টের কাজ করছে সে। তাই খুব সুন্দর করে তৈরি হচ্ছে সে। হঠাৎ খেয়াল করলো শার্টের মাঝের একটি বোতাম খোলা। তাড়ার সময় এমনটা হবার ই ছিলো! মুখ থেকে অস্পষ্ট শব্দ বের হলো তার। এই শার্টটি পড়া যাবে না। তাই উচ্চস্বরে হাক দিলো,
— “পিউ, আমাকে নতুন একটা শার্ট বের করে দে তো, এই পিউ, পিউ?”

নীলাদ্রির গলার জোর বাড়ালো কিন্তু আরোও সাড়া পেলো না। সময় কেটে যাচ্ছে কিন্তু পিউ এর আসার নাম নেই। তাই অপরিপাটি শার্টটি পড়েই ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো নীল। রান্নাঘরের কাছে যেতেই তার চোখ আতঙ্কে বড় হয়ে উঠলো। এক রাশ ভয় জড়ো হলো বক্ষস্থলে। অস্পষ্ট চিৎকার বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে,
— “পিউ….”

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি