স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-০৫

0
371

#স্বপ্নছায়া
#দ্বিতীয়_খন্ড
#৫ম_পর্ব

অভ্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে ঐন্দ্রিলা। তার মুখশ্রীতে কৌতুহল, চোখে হাজারো জিজ্ঞাসা। বুকে ভয়ের নিকষকৃষ্ণ ছায়া। কার সাথে কথা বলছিলো অভ্র! কাকে সতর্ক করছিলো সে! কেউ কি দিশানের ক্ষতি করতে চায়! টলমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “কে ফোন করেছিলো অভ্র? কেউ কি দিশানের ক্ষতি করতে চাচ্ছে?”

অভ্র নিশ্চুপ। সে মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে। তার চোয়াল শক্ত, চোখ স্থির। তার শরীর কাঁপছে রাগে। মাঝে মাঝে চুল টেনে নিজেকে শান্ত করছে। তারপর শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে ঐন্দ্রিলার দিকে। সে আশা করে নি ঐন্দ্রিলা তার কথা শুনে ফেলবে। ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সে। উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে। তারপর ফোন কেটে পেছনে ফিরতেই দেখে ঐন্দ্রিলা দাঁড়িয়ে আছে। ঐন্দ্রিলার মুখের দিকে এক নজর দেখেই ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে মেরেই ধপ করে বসে পড়ে সে। ঐন্দ্রিলা অভ্রের অপেক্ষা করছে। তার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে গেছে। এক বিশ্রী অস্থিরতা কাজ করছে তার ভেতরে। ধৈর্য্যহারা হয়ে পুনরায় একই প্রশ্ন ছুড়লো সে,
— “দিশানের ব্যাপারে কি কথা বলছিলেন অভ্র? কে ফোন করেছিলো?”

এবার মুখ খুললো অভ্র। ধীর স্বরে বলে উঠলো,
— “ওরা আমার দিশানকে নিয়ে যেতে চায় ঐন্দ্রি”

অভ্রের কন্ঠ কাঁপছে। তার টলমলে কন্ঠের কথাটা কর্ণকুহরে ঝংকার তুললো। মস্তিষ্ক শূন্য লাগছে ঐন্দ্রিলা। সাথে জাগলো কিছু প্রশ্ন। অবাক কন্ঠে বলে উঠলো,
— “কারা নিতে চায় দিশানকে? কেনো? উত্তর দিন অভ্র”
— “জ্যানির পরিবার। জ্যানির নানার মতে দিশান তাদের পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকার। উনি অসুস্থ বিধায় ওরা চায় দিশানকে কানাডায় নিয়ে যেতে। ওখানেই ওর দেখাশোনা করবে, ওখানেই ও বড় হয়ে উঠবে। বিগত দু সপ্তাহ ধরে আমাকে ওদের উকিল নানা ভাবে আমাকে উত্ত্যক্ত করছে। আমি তোমাকে ব্যাপারটা জানাতে চাই নি। সারাদিন বাচ্চাদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকো তুমি। অহেতুক আরেকটি যন্ত্রণা দেবার কোনো মানেই হয় না। জানো ঐন্দ্রি, তাদের ধারণা আমি বাবা হিসেবে একেবারেই অকেজো এবং অপদার্থ একজন মানুষ। তাই তারা আমার দিশানকে কেড়ে নিতে চায়। আমি এটা কিভাবে হতে দেই বলতো! দিশান আমার কলিজার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওকে কেঁড়ে নিলে আমি কিভাবে থাকবো?”

অভ্রের কথাগুলো দলা পাকাচ্ছে। তার চোখ টলমল করছে। বুকে আড়াল করা যন্ত্রণাগুলো চোখে ভেসে উঠছে। ঐন্দ্রিলার বুঝতে বাকি রইলো না অভ্রের অদ্ভুত আচারণের কারণ। লোকটা নিজের ভেতর এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভা চেপে রেখেছিলো। দিশান অভ্রের জন্য কতটা জরুরী সেটা ঐন্দ্রিলা থেকে ভালো কেউ জানে না। তাই অভ্রের এমন আচারণ করাটা অস্বাভাবিক নয়। ঐন্দ্রিলা ধীর পায়ে এগিয়ে এলো। তার পাশে বসলো। অভ্রের ডানটা আলতো করে চেপে ধরলো। ধীর স্বরে বললো,
— “আমার কাছ থেকে লুকোনোর কি দরকার ছিলো অভ্র?”
— “লুকোতে চাই নি, কিন্তু তোমাকে অহেতুক টেনশন ও দিতে চাই নি। আজ আর পারলাম না লুকোতে। আমি বুঝতে পারছি না কি করবো? ওরা দিশানের কাস্টেডি নিতে চায় লিগালি!”
— “কিন্তু আপনি তো তার বাবা, ওরা চাইলেও তো সেটা পারবে না।”
— “ওদের উকিলটা ভালো না ঐন্দ্রি, খুব চালু। বারংবার আমার দ্বিতীয় বিয়ের কথা তুলছে। আমার ছেলে নাকি আমার কাছে প্রোপার ভালোবাসা পায় না। আমি জানি না ওরা কি করতে চাইছে। ওরা এতোটা খারাপ যে আমাকে আমার সন্তান ত্যাগের জন্য টাকা ও অফার করেছে।”

ঐন্দ্রিলা কিয়ৎকাল চুপ করে থাকলো। বুঝতে পারছে না এই বিপদের সমাধান কি! কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,
— “আচ্ছা আমরা ওদের সাথে সরাসরি কথা বলি? ওদের জন্য দিশান একটা উত্তরাধিকারী মাত্র। কিন্তু আমাদের কাছে সে আমাদের সন্তান। ওদের পক্ষের কেউ তো নিশ্চয়ই দেশে এসেছে। কেনোনা উনার সাথেই কথা বলি।”
— “জেনির পরিবার থেকে একজন এসেছে। সেই মহিলা হয়তো দিশানের স্কুলের নতুন ম্যাডাম। কারণ যে আংটিটা দিশানকে দিয়েছিলো সেটা জ্যানিদের ফ্যামিলির আংটি। জ্যানির কাছেও একটা ছিলো।”
— “আপনি সেকারণে ভয় পেয়েছিলেন আর দিশানের স্কুল বদলের কথা বলছিলেন?”

অভ্র চুপ করে রইলো। ঐন্দ্রিলা মৃদু হাসলো। তারপর বলল,
— “দিশান আমাদের অভ্র। কেউ ওকে কেড়ে নিতে পারবে না। আমরা হতে দিবো না। আপনি অহেতুক ভয় পাচ্ছেন।”

ঐন্দ্রিলার কন্ঠে এক অটুট আত্মবিশ্বাস ছিলো। যা অভ্রের ভীতু হৃদয়কে উজ্জ্বলমান কিরণের আভাষ দিলো। মূহুর্তের জন্য সকল ভয়, অন্ধকার কেটে গেলো। মনের আকাশে সোনালী প্রভাতের উদয় হলো। মলিন হাসি ঠোঁটে একে বললো,
— “আমি কাল কথা বলছি। যদি একটা মিটিং এর ব্যাবস্থা করা যায়!”
— “আমি আছি অভ্র। সবসময়।”

অভ্র ঐন্দ্রিলা কোলে মাথা রাখলো। কোমড়টা জড়িয়ে ধরে মুখ গুজলো। অভ্রের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ঐন্দ্রিলার দেহ ছুয়ে যাচ্ছে। ঐন্দ্রিলা আলতো হাতে তার স্বামীর মাথায় বিলি কেটে দিলো। অভ্রকে সাহস দিলেও কোথাও যেনো নিজেও ভয় পাচ্ছে সে। ভয়টা দিশানকে হারাবার। ঠেকাতে পারবে তো আসন্ন বিপদকে!

ক্যাফে তে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা এবং অভ্র। অপেক্ষা জ্যানির পরিবারের সেই মানুষটির। কোনো ভাবে তার সময়টা পেয়েছে অভ্র। ওই পক্ষের উকিলটা প্রচন্ড ধূর্ত। অভ্র হয়তো তাকে মেরেই বসতো। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে অনেক কষ্টে। এই পর্যন্ত দুকাপ কফি খাওয়া হয়ে গিয়েছে অভ্রের। বারংবার ঘড়ির দিকে সে দেখে যাচ্ছে। মহিলাটির সময় জ্ঞান একেবারেই নেই। হঠাৎ একজন কালো পোষাক ধারী মহিলা তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ঐন্দ্রিলা অভ্রকে ইশারা দেয়। অভ্র মহিলাটির দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে চোখ বিস্ফোরিত হয়। মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে যায়,
— “জ্যানি..”

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি