স্বপ্নছায়া পর্ব-০৬

0
351

#স্বপ্নছায়া
#দ্বিতীয়_খন্ড
#৬ষ্ঠ_পর্ব

ঐন্দ্রিলা একটি তাকিয়ে রয়েছে সামনে বসে থাকা মেয়েটির দিকে। মেয়েটি বসে রয়েছে বেশ স্বাভাবিকভাবে। বেশ নির্লিপ্তচিত্তে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। মেয়েটি দেখতে হুবহু জ্যানিফ্যারের মতো। সেই মুখের গরণ, সেই ব্রাউন রঙ্গের চুল, সেই হাসি। শুধু মেয়েটির চোখের রঙ্গটা জ্যানির মতো নয়। ঘোলাটে চোখ তার। সবথেকে অবাককর এবং সূক্ষ্ণ পার্থক্য হলো মেয়েটির মুখশ্রীতে সেই মায়াটি নেই যা জ্যানিফারের মুখশ্রীতে ছিলো। তবে প্রথম দেখায় যে কেউ অভ্রের মতো ভুল করে বসতে পারে। ভাবতেই পারে মৃত জ্যানিফার বুঝি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্রের মতো ঐন্দ্রিলাও অবাক হয়েছিলো মেয়েটিকে দেখে। কিন্তু সেই বিস্ময় বেশিসময় টিকে নি। যখন মেয়েটি এক চিলতে হাসি দিয়ে বললো,
— “গুড আফটারনুন, মিস্টার এবং মিসেস চৌধুরী। আই এম জ্যানেট, জ্যানেট মার্টিন। সিস্টার অফ জ্যানিফার মার্টিন”

মেয়েটির কথাটি কর্ণপাত হতেই সব কাঁচের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেলো অভ্র এবং ঐন্দ্রিলার কাছে। অভ্র জানতো জ্যানিফারের একটি বোন আছে। কিন্তু সেই বোন সম্পর্কে খুব একটা তথ্য জানা ছিলো না। কারণ জ্যানিফার এবং অভ্রের কাটানো সময়টা ছিলো ক্ষণ। তাই এতোটা কখনোই অভ্রের জানা হয় নি। মার্টিন পরিবার থেকে পালানোর পর থেকে জ্যানিফারের সাথে তাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ রুপে বিচ্ছিদ্ধ হয়ে যায়। অভ্র যদি কখনো তাদের কথা তুলতো জ্যানিফার কেঁদে উঠলো। মেয়েটাকে কষ্ট দেবার কোনো ইচ্ছে ছিলো না বিধায় কখনো তার পরিবারের মানুষদের নিয়ে ঘাটায় নি অভ্র। সুতরাং জ্যানেটকে দেখে সে বেশ অবাক হয়েছিলো।

অভ্রের প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছে। পরিবেশটা প্রচন্ড গুমোট। এক মূহুর্ত এই জ্যানেটের সামনে বসে থাকা তার পক্ষে অসহনীয়। বেশ কিছুক্ষণ শুধু একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো জ্যানেট। ইংলিশে কথা বলতে শুরু করলো সে, যা বাংলায় অনুবাদ করলে যা হয়,
— “দেখুন মিস্টার এন্ড মিসেস চৌধুরী, আমার সময়ের একটা দাম আছে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকাটা অত্যন্ত বিরক্তিকর।”

এবার মুখ খুললো ঐন্দ্রিলা। শান্ত স্বরে বললো,
— “আপনি খুব ভালো করেই জানেন আমরা আপনাকে এখানে কেনো আসতে বলেছি। ভনীতা ব্যতীত ই বলি! দিশানের কাস্টেডি আমাদের কাছেই থাকবে। আমাদের ছেলে আমাদের কাছে বেড়ে উঠবে। জ্যানিফারের পরিবারের লিগালি তার উপর কোনো অধিকার নেই। তাই আপনারা আমাদের উত্ত্যক্ত করাটা বন্ধ করুন। আমাদের শান্তির জীবনে অশান্তির লহর আনার মানে নেই। আপনারা ওর আপনজন। যদি সে তার নানার সাথে দেখা করতেই যায় এটা কোনো বড় ব্যাপার নয়৷ তবে তাকে কেড়ে নেবার এই প্রস্তাবটা আমাদের পছন্দ হয় নি।”
— “আপনাদের পছন্দ হওয়া না হওয়াতে কি আমার কিছু যায় আসার কথা? আর সত্যি বলতে ছেলেটা আমাদের উত্তরাধিকারী। আমাদের ফ্যামিলি আপনাদের থেকে অনেক ধনী। সুতরাং তার কোনো অসুবিধা হবে না। দিশানের জন্য এই সিদ্ধান্ত একেবারে যৌক্তিক। দেখুন আমার বাবা অসুস্থ, খুব তাড়াতাড়ি তিনি ঈশ্বরের কাছে চলে যাবেন। আমার যেহেতু বিয়ে হয় নি, সুতরাং দিশান ই একমাত্র ছেলে যে বাবার সব কিছুর উত্তরাধিকারী। যাকে বলা হয় ওয়ারিশ। আর বাবা জ্যানিফারকে অনেক ভালোবাসতো। ও একটা ভুল করেছে তাই বাবা রেগে ছিলেন। এখন যখন জ্যানি নেই, নিজের সিদ্ধান্তে আত্মগ্লানিতে ভুগছেন। তাই এই সবকিছুর মালিক তিনি দিশানকে করতে চান। আর এই গরীব দেশে দিশানের কতটুকু ভালো হবে বলুন। আপনি অনেক বুদ্ধিমান ঐন্দ্রিলা৷ ঠিক বলেছি তো নামটা? আমার ধারণা আপনি আমার কথাটা বুঝতে পারবেন। আর আপনাদের ছোট একটা বাচ্চা আছে। আপনি আবার মা হতে পারবেন, শুধু কেনো দিশানকে নিজের কাছে রাখছেন। হি ডাজ নট বিলং হেয়ার।”

জ্যানেটের কথাগুলো হজম করতে বিরক্ত লাগছে অভ্রের। সে দাঁত কিটমিট করে তাকিয়ে আছে জ্যানেটের দিকে। মহিলার চেহারাটাই জ্যানিফারের মতো। অথচ স্বভাব একেবারেই অসহনীয়। নিজেকে সংযত রাখাটা দুষ্কর হয়ে উঠলো তার জন্য। শীতল কন্ঠে বললো,
— “কিসের অধিকারে ওকে নিজের কাছে চাচ্ছেন? যখন জ্যানিফার অসুস্থ ছিলো! আমি টাকার জিন্য হন্নে হয়ে ঘুরেছি, আমার জ্যানিকে বাঁচানোর চেষ্টায় দিনরাত এক করে দিয়েছি কোথায় ছিলো এই অর্থের অহমিকা? এখন আমার ছেলেকে কাড়তে এসেছেন আপনারা! শুনে রাখুন আমার ছেলে আমার কাছেই থাকবে। সে শুধু আমার। কোনো অধিকার নেই আপনাদের”

অভ্রের কথায় জ্যানেট দমলো না। উলটো ঠোঁটে বাঁকা হাসি একে কফিতে চুমুক দিলো। তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললো,
— “আমি যতদূর জানি মিস্টার অভ্র দিশানকে এডোপ্ট করেছেন। তাহলে আপনার ছেলে সে হয় কিভাবে? আর যদি সে আপনার ছেলেই হয় তাহলে তাকে এডোপ্ট কেনো করেছিলেন? দেখুন কোর্ট সেন্টিমেন্ট বুঝে না। আইন শুধু বুঝে লোজিক, প্রমাণ, যুক্তি, তর্ক আর পয়সা। আমার কাছে প্রতিটা আছে। তাই বলছি, সমঝোতা করে নেয়াই উত্তম।”

এবার আর বসে থাকতে পারলো না অভ্র। উঠে দাঁড়ালো সে। তার গা গুলোচ্ছে এই মহিলার সামনে বসতে। এক সময়ের প্রিয় চেহারাটাও যে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে আজ সেটা বুঝতে পারছে সে। দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে বললো,
— “চলো ঐন্দ্রি, আমি এখানে বসতে পারছি না। আমার অসহ্য লাগছে”

ঐন্দ্রিলাও উঠে দাঁড়ালো। সে ভেবেছিলো জ্যানেটের মাঝে কিঞ্চিত হলেও দয়া মায়া থাকবে কিন্তু সে ভুল ছিলো। পা বাড়িয়েও থেমে গেলো। পিছনে ফিরে বললো,
— “আপনি আপনার পয়সার জোড় দেখান। আমরাও দেখবো আমাদের ছেলেকে আমাদের থেকে কে কেড়ে নেয়। ছেলেটা এই হাতে মানুষ করছি আমি। “মাম্মাম” বলে ডাকে সে। তার দাদা-দাদী, ফুফু, মামা, নানা সবাই এই দেশে। এদের ভালোবাসায় সে বড় হয়েছে। হুট করে উড়ে আসলেই কি এই সম্পর্কগুলো মিথ্যে হয়ে যায়? রক্তের সম্পর্ক ই সবকিছু নয় মিস জ্যানেট”

ঐন্দ্রিলার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জ্যানেট। ঐন্দ্রির স্পষ্ট জড়তাহীন কন্ঠ তাকে ঈষৎ চমকিত করেছে। মহিলাটা এতো স্থিরভাবেও কথা বলবে তা কল্পনা করে নি জ্যানেট। ঐন্দ্রিলার মুখে মৃদুর হাসির রেশ হয়ে গিয়েছে। সে অভ্রের হাত ধরে বেড়িয়ে গেলো। অভ্রের গা কাঁপছে, তার সবকিছু ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বাংলাদেশে আসার পর দিশানের মঙ্গলের জন্য শওকত সাহেবের উপদেশে এই কাজটি করেছিলো সে। এখন সবকিছুই বৃথা মনে হচ্ছে। এই একটা ভুল দিশানকে সারাজীবনের জন্য কেড়ে নিবে। গাড়ির কাছে এসে সজোড়ে একটা আঘাত করলো সে। ঐন্দ্রিলা চুপ করে রয়েছে। অভ্রকে কিভাবে স্বান্তনা দিবে বুঝে উঠছে না সে। বিধাতার এই কি মায়াজাল! এক দিকে পিউ এবং নীলাদ্রি তাদের সন্তানের আগমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে অপরদিকে অভ্র ও ঐন্দ্রিলা তাদের সন্তানকে হারাতে বসেছে। এর পরিণতি কি হবে জানা নেই! জীবনগুলো অনিশ্চিতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু তিনি ই জানেন অদূর ভবিষ্যৎ কেমন হবে!!!!________

৫.
পিউ এর রিপোর্ট এসেছে। সত্যি যে মা হতে চলেছে। তার অষ্টম সপ্তাহ চলছে। হাসপাতালের করিডোরে বসে রয়েছে সে। তার সিরিয়াল আসতে চলেছে। নীলাদ্রি আজ অফিস কামাই করেছে। পিউ এর যত্নের কোনো কমতি সে রাখছে না। আজ ডাক্তারের কাছেও সেই নিয়ে এসেছে। এতোসময় পিউ এর পাশেই বসে ছিলো সে। হঠাৎ ফোন আসাতে কথা বলতে গিয়েছে। পিউ এর প্রচন্ড ভালো লাগছে ব্যাপারগুলো। কারণ এই সময়টা নারীর জীবনের অনন্য অনুভূতি। তাই ভালোবাসার মানুষটিকে পাশে পাওয়াটা নিজের সৌভাগ্যই বটে। এর মাঝেই ডাক্তারের ডাক পড়ে। নীলাদ্রি ফোনে কথা বলে ছুটে আসে পিউ এর কাছে। পিউ খেয়াল করলো তাকে প্রচন্ড চিন্তিত লাগছে। কপালে তীক্ষ্ণ রেখা ভেসে উঠেছে। মুখটা পাংশুটে। তাই অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি হয়েছে? তোমাকে চিন্তিত লাগছে? অফিসে কিছু হয়েছে?”

নীলাদ্রি মৃদু হাসলো। তারপর বললো,
— “আরে ধুর, কিছু না। চল, চল দেরি হয়ে যাচ্ছে”

নীলাদ্রি জোর পূর্বক হাসি বজায় রাখলো। সে এই সময় পিউকে কোনো প্রকার উত্তেজনা দিতে চায় না। সে কিভাবে বলবে, তার চাকরিটা আর নেই……

চলবে।

মুশফিকা রহমান মৈথি