স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-০৮

0
317

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#৮ম_পর্ব

আহাশ বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে দিশার দিকে। দিশার শুভ্র মুখশ্রী লাল হয়ে উঠেছে। তার চোখে ক্ষুদ্ধতা স্পষ্ট। কিন্তু এই ক্ষুদ্ধতার কারণ বুঝতে পারছে না আহাশ। একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে প্রশ্ন করলো,
— “কিসের কি সমস্যা?”
— “সেটাই তো আমি জানতে চাচ্ছি, আপনি হুট করে রিত্তকে অতোগুলো কথা শুনাতেন গেলেন কেনো? সবার দৃষ্টির মধ্যমনি হতে আপনার ভালো লাগতে পারে আমার নয়। এমনিতেই আপনাকে নিয়ে আমাদের ক্লাসে বেশ কানাগোসা হয়। আমি চাই না ব্যাপারটা বৃদ্ধি পাক। কিন্তু আপনি, আপনি হুটহাট এমন এমন কাজ করেন যে গোসিপ কমার বদলে দ্বিগুন হয়ে যায়”

দিশা দম নিলো। দিশার রাগান্বিত কন্ঠ তার আক্রোশের জানান দিচ্ছে। কিন্তু আহাশের মুখোভাব নির্বিকার। সে ভ্রুখানা কুঞ্চিত করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে দিশার দিকে। দিশা এবার শীতল কন্ঠে বললো,
— “এবার একটু ক্ষান্ত হন আমাকে আহাশ স্যার। আমাকে বিরক্ত করাটা এবার বন্ধ করুন”

দিশা অপেক্ষা করলো না আহাশের উত্তরের। সে পা বাড়ালো যাবার জন্য। তখন আহাশ নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
— “তাহলে তোমার মতে তখন রিত্তকে কথা না শুনিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসা আমার উচিত ছিলো?”

দিশা থমকে গেলো। সে ভেবেছিলো আহাশ উত্তর দিবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে আহাশ নির্লিপ্ত কন্ঠে তাকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। দিশা তার দিকে চাইলো। ধীর স্বরে বললো,
— “সেটাই হয়তো আমাদের জন্য ভালো হবে”
— “দুঃখিত, কিন্তু আমি সেটা করতে পাড়বো না”
— “জ্বী”
— “আমি সেখানে তোমার পক্ষ নিয়ে কথাগুলো বলি নি, বলেছিলাম নিজের রেপোটেশন বাঁচাতে। একজন শিক্ষক হয়ে অহেতুক আজেবাজে কথা মেনে নেওয়াটা আমার জন্য কঠিন। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও আমি সেটাই করতাম। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তার মানে এটা নয় আমি তোমাকে অন্য ছাত্র-ছাত্রী থেকে পৃথক করি। তুমি এই সাবজেক্ট এ ফেল করলে আমি তোমাকে ফেল ই করাবো। অহেতুক মার্ক দিয়ে তোমাকে পাশ করাবো না। তাই আমার সম্পর্কে তোমার এই ভুল ধারণা ঝেড়ে ফেলো। আর একটা কথা, আমি তোমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করতে পারবো না। তোমার প্রতি যত্নশীল হওয়া যদি তোমার কাছে বিরক্তিকর মনে হয়, আমার সত্যি কিছুই করার নেই। কারণ তোমাকে নিয়ে ভাবাটা আমি ছাড়তে পারবো না। আরোও একটা বাজে খবর আছে, সামনের সে্মিস্টার থেকে আমার ক্লাস দুটো করে পাবে। কারণ “Stochastic calculus” আর “Abstract Algebra” এই দুটো কোর্স আমার। এখন বাড়ি যাও। রেস্ট নাও। সামনে সেমিস্টার আবার দেখা হচ্ছে”

আহাশের ঠোঁটের কোনায় হাসি লেগে রয়েছে। যা দিশা গার জ্বালিয়ে দিচ্ছে। দিশার উত্তরের প্রতীক্ষা সে করলো না। ভাবলেশহীন চিত্তে হেটে চলে গেলো। নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে তার। ভেবেছিলো এবার হয়তো লোকটির উপর তার কথার কোনো প্রভাব ফেলবে। কিন্তু দিশা ভুল ছিলো। লোকটির গন্ডারের চামড়া আর চরম মাথামোটা গোছের। তাই তো তার শুদ্ধ বাংলাটিও মাথায় ঢুকলো না। ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হতেই একটা রিক্সাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে। কিছু বলার আগেই রিক্সা ওয়ালা বললো,
— “উঠেন আফা”

দিশার বুঝতে বাকি রইলো আবারো একই কাজ করেছে অসহ্য লোকটা। আচ্ছা, লোকটা কেনো বুঝে না! কেনো বুঝে না সে অহেতুক সময় ব্যয় করছে। এই সময়টা ভালো কাজে ব্যয় করলে বেশ নাম কামাতে পারতো সে। রুদ্ধশ্বাস ফেললো দিশা। তারপর উঠে পড়লো রিক্সায়। রিক্সা পিচের রাস্তা চিরে এগিয়ে যাচ্ছে। শীত বাড়ছে, সাথে উচাটন ও। দিশা খেয়াল করলো আজ বছরের শেষ সপ্তাহ। একটি বছর কেটে গেছে। আরোও একটি বছর জীবন থেকে হারিয়ে গেলো। এই বছরের পাওয়ার লিস্টে প্রতিবারের মতোই কিছু না কিছু জুটেছে, একজন অসহ্য প্রেমিক, একই সাথে ফুপি এবং খালা হবার আনন্দ। এই অনুভূতির মাঝেই বছরের অন্ত হলো। আগামী বছরে পুনরায় নতুন অনুভূতির জাগরণ হবে। এই আলাভোলা লোকটা যদি সেই বছরে একটু বুঝে। দিশা এবং আহাশ রেললাইনের দুটো লাইনের মতো যাদের এক হওয়া অসম্ভব______________________

৬.
অন্তরীক্ষে লাল রঙ্গের ছটা ছড়িয়ে যাচ্ছে। আঁধার নামার ক্ষণসময় বাকি। সূর্যটা পুরোপুরি ডুবে গেছে। শুধু তার রশ্নি এখনো ছাপ ছেড়ে আছে। শীতল বায়ু বহমান। ক্লান্ত নগরীর ব্যাস্ত দিনটা অন্ত গেলো। এখন বাড়ি ফেরার তাড়া, তাড়া প্রিয়জনের মুখশ্রী দেখার। আযান শেষ হয়েছে মাত্র। নামায শেষে বারান্দায় দাঁড়ালো ঐন্দ্রিলা। ঠান্ডায় লোমগুলো দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। মোটা কাশ্মিরী শালটা জড়ালো সে। অদ্রি হবার আগে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়েছিলো তারা তিনজন। তখন লোকাল থেকে শালটি কিনে দেয় অভ্র। সাদার মাঝে রানী গোলাপীর মিশ্রণ শালটাকে অতুলনীয় সুন্দর করে তুলেছে। ঐন্দ্রির শীতের অতি পছন্দের কাপড় এটা। এতে এক অনন্য উষ্ণতা পায় ঐন্দ্রি। হয়তো অভ্রের ভালোবাসার উষ্ণতা। সেদিন জ্যানেটের সাথে দেখা করে আসার পর থেকেই মনে এক অব্যক্ত ভয় ঢুকে গিয়েছে ঐন্দ্রিলার, অভ্র ভালো উকিলের সাথে কথাও বলেছে। তারা নিশ্চিত করেছ দিশানের কাস্টেডী কখনোই জ্যানেট বা মার্টিনরা পাবে না। আর জ্যানেট একজন অবিবাহিত নারী। সাতবছরের একটা বাচ্চাকে সে কখনোই পার্ফেক্ট ফ্যামিলি দিতে পারবে না। কিন্তু এক নিকষকৃষ্ণ ভয় ঐন্দ্রিলাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নিজ সন্তান না হলেও দিশান তার কাছে সর্বদা নিজের প্রথম সন্তান। সেই বিয়ের দিন যখন ছেলেটি তাকে “মাম্মাম” বলেছিলো সেদিন থেকেই মাতৃত্বের এক অদৃশ্য বাঁধন এদের মাঝে সৃষ্টি হয়। একটা বাচ্চাকে নিজ হাতে বড় করার পর অন্য কেউ তাকে ছিনিয়ে নিবে ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না ঐন্দ্রি। চিন্তায় ছেদ পড়লো যখন মাহফুজা দরজায় কড়া নাড়লো,
— “ভাবী, খালাম্মায় মুড়ি মাখা পাঠাইছে”

ঐন্দ্রিলা চোখ মুছে নিলো। হৃদয় ভারী হয়ে এসেছিলো তার। তারপর ঘরের দিকে পা বাড়ালো সে। মাহফুজার কাছে থেকে মুড়িটা নিয়ে বললো,
— “বাবারা ফিরেছেন?”
— “হ, পিয়াজী, বেগুনী, ছোলা লয়ে আসছে তারা। আপনের শরীর ভালা না বলে খালাম্মায় আমারে দিয়ে পাঠাইলো”
— “আচ্ছা, তুমি চায়ের পানি বসাও। আমি আসছি”
— “খালাম্মায় চা বানায়ে লাইছে। আপনেরে জ্বালাইতে মানা করলো। আপনি মুড়ি খান আমি চা লয়ে আসছি”
— “তার দরকার নেই, তুমি অদ্রির কাছে বসো। আমি মার কাছে যাচ্ছি। একটু দেখো যেনো মশা না কামড়ায়। যা মশার প্রভাব বেড়েছে”
— “জ্বে”

মাহফুজা মাথা কাত করলো। ঐন্দ্রিলা তার মোবাইলটা নিয়ে ঘর ছাড়লো। একা ঘরে গুমোট লাগছিলো তার। শারমিন বেগমের সাথে কথা বললে হয়তো মনটা একটু ভালো হবে। এর মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠলো। ঐন্দ্রিলা এগিয়ে গেলো দরজা খুলতে। একজন অচেনা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। শওকত সাহেব বলে উঠলেন,
— “কে এসেছে ঐন্দ্রিলা?”
— “চিনি না বাবা, আমি দেখছি”

ঐন্দ্রি সালাম দিয়ে বললো,
— “কাকে চাই?”
— “অভ্র চৌধুরীর বাসা কি এটাই?”
— “জ্বী, বলুন”
— “উনার নামে একটা সমন এসেছে। আপনি কি সেটা গ্রহন করবেন?”

ঐন্দ্রিলার বুঝতে কিঞ্চিত অসুবিধা হলো। সে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “বুঝলাম না ঠিক”
— “জ্যানেট মার্টিন নামে একজন মহিলা উনার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। উনার নামে সমন বের হয়েছে। আগামী জানুয়ারীতে কোর্টের ডেট। আপনি এই কাগজটা পড়ে দেখতে পারেন”

লোকটি একটি কাগজ এগিয়ে দিলো ঐন্দ্রিলার দিকে। ঐন্দ্রিলা মনোযোগ দিয়ে কাগজটা পড়লো। জ্যানেট সত্যি কেস করেছে। এর মাঝেই একটা ম্যাসেজ আছে ঐন্দ্রিলার মোবাইলে,
“game on”

চলবে।