স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-০৭

0
369

#স্বপ্নছায়া
#দ্বিতীয়_খন্ড
#৭ম_পর্ব

নীলাদ্রির চাকরীটা নেই বললে ভুল হবে, কিন্তু যাবার দোয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। কারণটা অবশ্য নীলাদ্রির জানা। সেদিনের মিটিংটা অত্যন্ত জরুরী ছিলো, অথচ পিউ এর অসুস্থততার জন্য অফিস যাওয়াটা জরুরি মনে করে নি নীলাদ্রি। সেই সময়টা পিউ এর কাছে থাকাটাই আবশ্যক ভেবেছিলো সে। ফলে খুব চেয়ারম্যানের কাছে একজন দায়িত্বহীন কর্মকতায় পরিণত হয়েছে। নীলাদ্রির বস তাকে এ নিয়ে কম বকাঝকা ও করে নি। তিনি রীতিমতো তাকে শাসিয়েছেন। আজ আরেকবার নীলাদ্রি সেই কাজটি ই করেছে। বস নীলাদ্রির উপর প্রচন্ড চটে রয়েছে। এবং এই চাকরিটি যে থাকছে না সেটা আন্দাজ করাটা খুব একটা কঠিন নয় তার কাছে। নীলাদ্রি সব জানা সত্ত্বেও সেই ভুলটার পুনরাবৃত্তি করছে। কারণ সে এই সময়গুলো হারাতে চায় না। অনেক সময় এই টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে সে হারিয়েছে। আর হারাবার ইচ্ছে নেই।
— “মি. নীলাদ্রি, আপনি কি আমার কথাগুলো শুনছেন?”

ডা. শিল্পীর কথায় চিন্তায় ছেঁদ পড়ে নীলাদ্রির। মৃদু হাসি একে বলে সে,
— “জ্বী, বুঝতে পারছি”

ডা. শিল্পী তখন ধীর গলায় বলে,
— “দেখুন, বেবি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। পজিশন ও ভালো, গ্রোথ ও। পিউ এর বডি ও যথেষ্ট ফিট। এই সময় ফলিক এসিডটা বেশি করে খাওয়াবেন, বাড়তি কোনো ঔষধ আমি দিবো না আপাতত। দুধ, শাক, ফল এগুলো বেশি করে খাওয়াবেন। ফার্স্ট ট্রাইমিস্টারে বাচ্চার মিসক্যারেজের চান্স থাকে। আর উনার ভারী কাজ করতে দিবেন না। প্রতিদিন ১৫-২০ মিনিট করে হাটবেন, উনার যেহেতু ডায়াবেটিকস কিংবা বিপি এর ইস্যু নেই তাই গা ছাড়া দিলে হবে না। উনার মার ডায়াবেটিকস ছিলো, সো চান্স আছে। সো বি কেয়ারফুল। সামনের মাসে এসে দেখিয়ে যাবেন। এই সময় বাবাদের কাজ কিন্তু অনেক বেড়ে যায়। কারণ এই সময়ে মায়েরা অনেক সেন্সিটিভ থাকে। ইস্যু হয়, শরীরের পরিবর্তন তারা মানতে পারে না। আয়রন জনিত খাবার খেলে বমি আসবে, শরীর যখন তখন খারাপ হয়। তাই আপনাকে কেয়ারফুল বেশি থাকতে হবে।“
— “জ্বী, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সামলে নিবো ইন শা আল্লাহ”

ডা.শিল্পী মুচকি হাসলো। পিউ এখনো সেই আলট্রাসোনোর ছবিটির দিকেই তাকিয়ে আছে। ছোট্ট একটা বিন্দু অথচ এই বিন্দুটাই তার গর্ভে বেড়ে চলেছে। বেড়ে চলেছে একটা মাংসপিণ্ড। এর হৃদস্পন্দন শুনে কান জুড়িয়ে আসছিলো। এ যেনো অন্য এক অনুভূতি। মা হবার অনুভূতি এতোদিন কেবল শুনেছিলো, আজ তার সাথে সাক্ষাত হচ্ছে পিউ এর। এক দিন এই মানুষটি তার কোল আলো করে আসবে। আধো স্বরে বলবে “মা”। পিউ অপেক্ষা করছে সেই দিনের। নয়নজোড়া ভিজে আসছে তার। নীলাদ্রি আলতো করে হাতটা চেপে ধরলো। ধীর স্বরে বললো,
— “কাঁদছিস কেনো?”

পিউ অমলিন হাসি হেসে বললো,
— “স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে এক এক করে, সুখগুলো হাতের মুঠোয় পাচ্ছি। বিশ্বাস হচ্ছে না, এগুলো কি সত্যি?”
— “হ্যা, সব সত্যি। এখনো তো অনেক স্বপ্ন পূরণ বাকি”

নীলাদ্রির কথায় পিউ এর ঠোঁটের কোনায় মনের ব্যালকনির এক চিলতে রোদ্দুর হাসি এসে ঠায় নিলো। পিউ এর হাসিমাখা মুখটা দেখে বুকে ক্ষীণ ব্যাথা অনুভব হলো নীলাদ্রি। স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবে তো!!!

সকাল ১২.২০,
পরীক্ষা চলছে দিশার। “নিউমেরিক্যাল এনালাইসিস” এর পরীক্ষা চলছে। দিশার এই বিষয়টি তুলনামূলক কঠিন লাগে। সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করেছে যেনো রেজাল্ট কোনোভাবেই খারাপ না হয়। কিন্তু হয়তো ভাগ্যটাই খারাপ। কারণ প্রশ্ন অত্যধিক কঠিন এসেছে। এবং গার্ড এও আহাশ নামক বিরক্তিকর মানুষটি পড়েছে। সে ঘুরেফিরে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কারোর থেকে কিছু শোনার জো নেই। একটু পর পর তার বেঞ্চের পাশ থেকে আহাশের হেটে যাওয়া লাগছে। দিশার মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই। হুট করে লোকটা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রশ্নটা হাতে নিলো। তারপর উল্টেপাল্টে দেখলো। আহাশের এরুপ কাজে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো দিশা। দিশার চাহনী দেখে সে স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি দেখছো? লিখো?”

দিশা মাথা নামিয়ে নিলো। তার মুখ-চোখ কুচকে আছে। অরি বিরক্ত সে। ফলে ম্যাথটা মিলছে না কিছুতে। বারংবার কাটতে হচ্ছে। আহাশ তখন ধীর স্বরে বললো,
— “প্রশ্ন কি বেশি কঠিন হয়েছে?”

দিশা উত্তর দিলো না্‌, শুধু কটমট করে তার দিকে চাইলো। যার অর্থ “প্রশ্ন কঠিন না সহস সেটা কি আপনাকে বলতে হবে”। আহাশ তার চাহনীর উত্তরে গাল ভরে হাসলো। এই কোর্সটা আহাশ ই নিয়েছিলো। আর এই প্রশ্নটিও সেই করেছে। হয়তো একারণেই দিশার মেজাজ আরো খারাপ হচ্ছে। দিশা আবার কাটলো পৃষ্ঠাটা। তখন আহাশ ধীর স্বরে বললো,
— “মাথা ঠান্ডা করো, আমি জানি তুমি এগুলো পারো”

তারপর সামনে হেটে চলে গেলো। লোকটির কথায় কি যেনো একটা ছিলো। দিশার মনে হলো মনের কোনে লুকানো ভয়ের কালো মেঘগুলো আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগলো। আকাশ যেনো পরিষ্কার হয়ে গেলো। অজানা কারণে লোকটির কথাটা অত্যন্ত ভালো লাগলো দিশা। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। আবার লেখা শুরু করলো।

পরীক্ষা শেষ হলো ২টায়। দিশা খাতা জমা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো ক্লাস থেকে। তখন তার বান্ধবী সারা তাকে ঈষৎ ধাক্কা দিয়ে বললো,
— “কি রে, এক্সাম কেমন হলো?”
— “খারাপ না”
— “তোর তো খারাপ হবে না, ফার্স্ট বলে কথা। বেয়াদব লোকটা কি বাজে প্রশ্ন ই না করলো। আমি পাশ করবো কি না সন্দেহ

এর মাঝেই রিত্ত নামের ছেলেটি টিটকারী দিয়ে বলে উঠল,
— “দিশা তো ভালো করবেই, স্যার দাঁড়িয়ে থেকে তাকে উত্তর যে বলে দিচ্ছিলো”

রিত্তের ঠেস দেওয়া অতি বিরক্তিকর কথাটি শুনে মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না দিশা। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
— “একদম আজেবাজে কথা বলবি না রিত্ত, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি”
— “আমি নিজ চোখে দেখেছি, স্যার তোর সাথে গুজুর গুজুর করছিলো। এটায় যদি সর্বোচ্চ না পাশ, নাম বদলে দিস আমার। যেখানে সবার এক্সাম খারাপ হয়েছে শুধু তোরটা ভালো হবে এটা অস্বাভাবিক নয়?”

রিত্ত বিদ্রুপের স্বরে কথা বললো, রিত্ত ছেলেটি দিশাকে প্রচন্ড হিংসা করে। করার কারণ একটি সেটা হলো রিত্ত সেকেন্ড হয়। দিশা সব স্যারদের কাছেই বেশ স্নেহ পায়, যা রিত্তের একেবারেই সহ্য হয় না। তার ধারণা দিশা এই ভালো রেজাল্টের যোগ্য নয়। হিংসা জিনিসটি ছাই চাঁপা আগুনের ন্যায়। যা দেখতে তুচ্ছ মনে হলেও তার ললহমান শিখা প্রকৃতি ছারখার করে দিতে পারে। দিশার ইচ্ছে করছিলো কিছু একটা উত্তর দিতে। কিন্তু এই ছেলেটার সাথে কথা বাড়ানোর মানেই নেই। শুধু শুধু সময় নষ্ট। হঠাৎ একটা পুরুষালী কন্ঠ কানে এলো দিশার। পেছনে ফিরতেই দেখে আহাশ দাঁড়িয়ে আছে খাতাগুলো হাতে। আহাশ এগিয়ে এসে রিত্তের সামনে দাঁড়ালো। শীতল কন্ঠে বললো,
— “আমি দিশাকে উত্তর বলে দিয়েছি সেটার প্রমাণ কি তোমার কাছে আছে রিত্ত?”

আহাশের আকস্মিক প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রিত্ত। মুহুর্তেই তার মুখশ্রী বিবর্ণ হয়ে গেলো। আহাশ সরু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে কানাঘোষা শুরু হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদের জটলায় গুঞ্জন হচ্ছে। সকলের চোখে দিশা এবং আহাশের দিকে। সকলের দৃষ্টির আকর্ষণ হয়ে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে দিশার। লোকটার কান্ডজ্ঞান কি সত্যি ই নেই। কেনো রিত্তকে জেরা করছে সে? রিত্তের উত্তরের প্রতীক্ষায় রয়েছে আহাশ, রিত্ত খানিকটা এলোমেলো কন্ঠে বললো,
— “আপনি ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন”
— “একজন শিক্ষক নিশ্চয়ই বসে গার্ড দিবে না? হ্যা আমি ওর সাথে কথা বলেছি। কিন্তু শুধু ওর তো আমি তোমার সাথেও কিন্তু কথা বলেছি রিত্ত। তোমাকে জিজ্ঞেস করে নি প্রশ্ন কেমন হয়েছে?”
— “জ্বী”

আমতা আমতা করে উত্তর দিলো রিত্ত। এবার দৃঢ়তা বাড়লো আহাশের কন্ঠে,
— “শোনো, প্রতিদ্বন্দিতা ভালো। কিন্তু প্রতিহিংসা কিন্তু ভয়ানক। তাই নিজেকে শুধরাও। কারোর নামে ক্লেইম দেবার আগে তার বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণ নিয়ে কথা বলবে। আজ কিছু বলছি না। তবে আগামীতে ফল ভালো হবে না”

বলেই হন হন করে হেটে চলে গেলো আহাশ। রিত্ত রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো দিশার দিকে। কিন্তু দিশা তা সম্পূর্ণ রুপে উপেক্ষা করলো। কারণ তার আহাশের সাথে কথা বলাটা বেশি জরুরি।

খাতার সকল কাজ শেষ করে বেড়িয়ে পড়লো আহাশ। তখন ই আকস্মিক দিশা এসে দাঁড়ালো তার সামনে। দিশাকে এভাবে দেখে কিঞ্চিত চমকে উঠলো সে। তারপর নিজেকে সামলে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
— “কিছু বলবে?”
— “ওখানে আপনার সমস্যাটা কি?………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি।