স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-১৮+১৯

0
279

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#১৮তম_পর্ব

অভ্রের মুখপানে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঐন্দ্রিলা। তার চোখে এক রাশ বিস্ময়, সন্দেহের তীক্ষ্ণ রেখা। অভ্র অনেকক্ষণ যাবৎ তার পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে বললো তাকে। তারপর আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
— “বুঝেছো?”

ঐন্দ্রিলা সন্দীহান কন্ঠে বললো,
— “এই প্লান কাজ করবে?”
— “সন্দেহ আছে?”
— “সন্দেহ নেই, কিন্তু জ্যানেট যদি ধরে ফেলে?”
— “সেই দায়িত্ব তোমার, একেবারে হাই ভোল্টেজ ড্রামা করতে হবে। যেখানে সাসপেন্স থাকবে ভরপুর”

ঐন্দ্রিলা হেসে দিলো। এখন নাকি ড্রামা করতে হবে! এই অভিনয়ের কথা শুনে ঐন্দ্রিলার মনে পড়লো কলেজের কথা, নাট্যমঞ্চে একবার অভিনয় করেছিলো সে। তার ভূমিকা ছিলো অতি ক্ষুদ্র, প্রহরীর দায়িত্বে ছিলো সে। অথচ আজ মূল জীবনে নাটক করতে হবে তার। আর এই নাটকে প্রধান চরিত্র ই সে। কি একটা অবস্থা! ঐন্দ্রিলা হাসি থামিয়ে বলল,
— “মা-বাবাকে কি বলবেন?”
— “বলবো পিউ জন্য ও বাড়িতে যাচ্ছো। দিন পনেরো থাকবে”
— “মা হয়তো আন্দাজ করেছেন, বেশ চিন্তিত ও ছিলেন”
— “আপাতত এসব নিয়ে চিন্তা করো না, এই জ্যানেট নামক বিপদ কাটলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। ও আমার ছেলের অসুস্থতাকে টার্গেট করছে। আমি কিছুতেই তা হতে দিবো না। এই জন্য এই অভিনয়টা জরুরি”

অভ্রের কন্ঠ কাঁপছে। জমায়িত ক্রোধের আভাস পাচ্ছে ঐন্দ্রি। একজন না্রী কিভাবে এতোটা ক্রুর হতে পারে সেটা জানা ছিলো না ঐন্দ্রির। নিজের বোনের সন্তানকে কেন্দ্র করে এতোটা জঘন্য ষড়যন্ত্র করবার পূর্বে একটি বার ও ভাবলো না জ্যানেট। শুধু অর্থ ই কি সব? লোভ তাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তাই তো একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে নিজের গুটি বানিয়েছে সে। এই কাস্টেডি যদি জ্যানেটের কাছে যায় সে কি করতে পারে তা ধারনাতীত। তাই এই খেলায় যেভাবেই হোক কিস্তিমাত করতেই হবে, by hook or crook___________

৯.
ঘড়ির কাটা এগারোটার ঘরে। দ্রুত পায়ে ফুটপাত দিয়ে হাটছে দিশা। ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। তপনের দোকানে চা খেতে খেতে কখন যে ক্লাসের সময় হয়ে গিয়েছে টের পায় নি সে। অর্ধ চায়ের কাপটা রেখেই ছুট দিয়েছে সে। টাকাটাও দেওয়া হয় নি। হাক দিয়ে বলেছে,
“দাদা, টাকা খাতায় লিখে রাখেন”

শীতের প্রকোটতা কিছুদিন ধরে নাই এর কাছাকাছি, রৌদ্রস্নাত সকালে হাটতে হাটতে গা ভিজে আসছে তার। তবে একটা শান্তি ক্লাসটা আহাশের, তাই বিলম্ব হলেও সে ক্লাসটা করতে পারবে। হাঁপাতে হাঁপাতে যেয়ে পৌছালো সে ক্লাসে। দরজা ঠেলে আকুতির স্বরে বললো,
— “স্যার আসবো?”

আহাশ তখন সাদা বোর্ডে মার্কার দিয়ে গণিতের ইকুয়েশন লিখছিলো। দিশার প্রশ্নে তার ভ্রুক্ষেপ হলো না। সে তার কার্য অবিরত করতে লাগলো। লেখার পর সে ক্লাসের সকলকে বুঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। দিশা বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো আহাশের দিকে। লোকটা এরুপ বিরুপ আচারণ করবে সে কল্পনা করে নি। অন্য সময় হলে বলতো, “আসো”। অথচ আজ তার আচারণে মনে হচ্ছে দিশার উপস্থিতি সে অনুধাবণ করতে পারছে না। দিশা বিব্রত কন্ঠে বললো,
— “স্যার আসবো?”

এবার ঘাড় ফিরিয়ে দিশার পানে তাকালো আহাশ। নির্বিকার চাহনী প্রয়োগ করলো সে। তারপর হাতের ঘড়িটা দেখলো। নির্লিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “কটা বাজে?”
— “এগারোটা দশ”
— “ক্লাস কটায়?”

বেশ শক্ত কন্ঠে প্রশ্নটি করলো আহাশ। এভাবে সাধারণত অন্য স্যারেরা কথা বলে, কিন্তু এই প্রথম আহাশ এভাবে প্রশ্ন করছে। সারা ক্লাসে কানাগোসা হচ্ছে। যেনো তারা গসিপের একটা মুখ্যম টপিক পেয়েছে। এই টপিকে কথা না বললেই নয়। আহাশ ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠলো,
— “সাইলেন্স”

সবাই চুপ হয়ে গেলো। তাদের বুঝতে বাকি নেই আহাশের আজ মেজাজ অত্যধিক খারাপ। আহাশের কন্ঠস্বর শুনতেই দিশা খানিকটা কেঁপে উঠলো। আহাশ পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলো,\
— “ক্লাস কয়টায়?”
— “স্যার, এগারোটায়”
— “শুধু সিজিপিএ বেশি হলেই হয় না পাঞ্চুয়ালিটিও একটা বড় গুন, যা তোমার মধ্যে নেই। সেটা যখন ঠিক হবে তখন না হয় ক্লাস করো। তুমি যেতে পারো, আজ ক্লাস করা লাগবে না।“
— “কিন্তু স্যার……”
— “অহেতুক সময় নষ্ট করা আমার পছন্দ নয়, ইউ ক্যান গো”

তারপর আবার পড়াতে শুরু করে সে। দিশা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুসময় দাঁড়িয়ে থেকে উপান্তর না পেয়ে লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। এতোটা অপমানিত হতে হবে দশ মিনিটের জন্য কল্পনাও করে নি সে। এই নাকি ভালোবাসা। ক্ষোভে, দুঃখে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে আসে দিশার। এমন ভাবে বদলাটা না নিলেই পারতো আহাশ। দিশাকে চলে যেতে দেখে এক বান্ধবী রিত্তকে গুতো দিয়ে বলে,
— “খুব তো বলেছিলি, স্যার দিশাকে এডভান্টেজ দেয়। কোথায়? অপমান করে ক্লাস থেকে তাড়িয়ে দিলো। শুধু শুধু কেনো কথা রটাস?”
— “বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথায়?”
— “না হচ্ছে না। এখন থেকে দিশার নামে কিছু বললেই দেখিস কি করি?”

রিত্ত চুপ করে গেলো, ক্লাসের সামনে অহেতুক সে মিথ্যাবাদী বনে গেলো। যেখানে সে নিশ্চিত দিশা এবং আহাশের মাঝে কিছু না কিছু গন্ডগোল আছে।

ক্লাস শেষে আহাশ বেড়িয়ে গেলো। ক্লাস থেকে বের হতেই দিশার মুখোমুখি হলো সে। দিশা তাকে একবার দেখে পাশ কাটিয়ে ক্লাসে ঢুকে পড়লো। আহাশ দাঁড়ালো না। আক্ষেপের নিঃশ্বাসটি গোপন করেই পা বাড়ালো নিজের কেবিনের দিকে। সকল ক্লাস শেষ হলো দেড়টা নাগাদ। দিশা সামিহার কাছ থেকে ক্লাসনোটের খাতাটা নিয়ে নিলো। তারপর দাঁড়ালো ভবনের সামনে। অপেক্ষা একটা রিক্সার। অন্য সময় হলে আহাশ তার জন্য রিক্সা পাঠিয়ে দিতো। আজ এমন কিছুই হলো না। দিশার বুঝতে বাকি নেই সেরাতের কথাগুলো আহাশের মস্তিষ্কে বেশ ভালো করেই ছেপে গেছে। অবাপককর ব্যাপার দিশা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে না। সে ভেবেছিলো আহাশ তার প্রতি ভালোবাসার বর্ষণ না করলে হয়তো সে স্বস্তিতে থাকবে। কিন্তু উলটো, হৃদয়টা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা মধ্যিখানে করছে। এক অদ্ভুত অশান্তি। এই অশান্তি তো চায় নি সে। তাহলে এমনটা কেনো হলো? মাথা ঝাকিয়ে চিন্তা ঝাড়লো সে। ঠিক সেই মূহুর্তেই তার নজর গেলো আহাশের সিড়ির কোনে দাঁড়িয়ে থাকা আহাশের দিকে। আহাশ একা নয়, তার সাথে একজন নারী ও আছে। মহিলাটি আহাশের কনুই চেপে ধরে আছে। মুখশ্রীতে উচ্ছ্বাসিত হাসির ঢল। একটা কথা বলছে আর হেসে গড়াগড়ি। বেশ সুন্দর দেখতে সেই নারী। লম্বাটে মুখশ্রী, শুভ্র বর্ণ, কালো ঘন চুল। নারীটিকে খুব চমৎকার লাগছে। সামিহা তখন পাশ থেকে বললো,
— “আমাদের নতুন টিচার, ইভা ম্যাডাম। গত সপ্তাহে জয়েন করেছেন। এই টার্মে কোনো ক্লাস নেই তার। সুন্দর না অনেক?”

দিশা শুধু ছোট করে “হুম” বললো। আহাশ তাদের দিকে এগিয়ে এলে দিশা সরে দাঁড়ালো। একটা রিক্সায় ইভা এবং সে উঠে চলে গেলো। আহাশের এভাবে চলে যাওয়া কেনো যেনো ভালো লাগলো না দিশার। চাপা যন্ত্রণা হচ্ছে, কিন্তু কেনো হচ্ছে জানা নেই তার_______________

বিকেল চারটা,
রৌদ্রস্নাত বিকেল, তেজী রশ্নি কাঁচের গ্লাস ভেদ করে ঐন্দ্রিলার মুখে পড়ছে। তবে এই তীর্যক আলো যতটা বিরক্ত করছে তার চেয়ে অধিক বিরক্ত লাগছে সম্মুখের শ্বেত মুখখানা। কফি শপে মুখোমুখি বসে আছে ঐন্দ্রিলা এবং জ্যানেট। এমেরিকানো কফি অর্ডার করেছে জ্যানেট। দিতে অনেক দেরি হচ্ছে। তাই তার কপাল কুচকে আছে। অবশ্য জ্যানেটের বিরক্ত মুখখানা দেখে আত্মতৃপ্তি হচ্ছে ঐন্দ্রিলার। হালকা কেঁশে সে বলল,
— “আপনি যে আমার সাথে দেখা করতে রাজী হবেন আশা করি নি?”
— “দেখুন মিসেস চৌধুরী, আমার সময়ের মূল্য আছে। তাই কেনো দেখা করতে চেয়েছেন বলে ফেলুন”

এবার মোবাইলটা এগিয়ে দিলো ঐন্দ্রিলা। তারপর বললো,
— “এসব ছবি আমাকে পাঠিয়ে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন আপনি? আমার আর অভ্রের মাঝে বিবাদের সূচনা করে কি লাভ? এসব করে কি পাবেন?”

ঐন্দ্রিলার কথা শুনলো জ্যানেট। তারপর বিচিত্র হাসি হাসলো সে। এক অদ্ভুত্ রহস্য লুকিয়ে আছে সেই হাসিতে। নড়েচড়ে বসলো সে। তারপর বলল,
— “চাওয়া পাওয়া আপেক্ষিক ব্যাপার, আমি যা চাই তা কি দিতে পারবেন?”
— “কি চাই আপনার?”
— “ইউর হাসবেন্ড…………

চলবে

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#১৯তম_পর্ব

জ্যানেটের ঠোটে বিচিত্র হাসি। হাসিটা স্বাভাবিক মানুষের নয়, প্রচন্ড বিকৃত। ঐন্দ্রিলা তীব্র স্বরে ঝাঝালো গলায় বললো,
— “মশকরা করছেন?”
— “প্রশ্নটা আপনি করেছিলেন মিসেস চৌধুরী? আমি তো শুধু উত্তর দিলাম। ইটস নট মাই ফল্ট।”

জ্যানেট শান্ত গলায় বিদ্রুপের স্বরে কথাটা বললো। কিন্তু শীতল বাক্যটি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে ঝংকার তুললো ঐন্দ্রিলার। বুঝতে সময় ব্যয় হলেও সে বুঝতে পারলো জ্যানেট মজা করছে না। কপাল কুঞ্চিত হয়ে গেলো তার। শীতল কিন্তু রুঢ় কন্ঠে বললো,
— “আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি!”
— “বাহ রে আমার কি দোষ?”
— “একজন বিবাহিত পুরুষের প্রতি প্রলোভন কি দোষের নয়?”
— “আমার কিন্তু দোষের মনে হচ্ছে না। হোয়াটএভার, আমি যা চাই আপনি আমাকে দিতে পারবেন না। সো, সেটাকে আমার নিজের ই নিতে হবে, এখন সেটার জন্য যদি টুকটাক মিথ্যে সত্যি নিয়ে খেলতে হয় ক্ষতি কি?”

এবার উঠে দাঁড়ালো ঐন্দ্রিলা। হাতের কাছে গ্লাস ভর্তি পানিটা ছুড়ে দিলো জ্যানেটের মুখোপানে। ঘটনার আকস্মিকতায় জ্যানেটের মুখের বর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেলো। উচ্ছ্বাসিত হাসি কোথাও যেনো মিলিয়ে গেলো। ক্যাফের সকলের দৃষ্টি তাদের দিকে। বেশ কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে এই দুই রমনীর দিকে। যেনো খুব মজার কোনো ঘটনা হচ্ছে। ঐন্দ্রিলার অবশ্য মানুষের এরুপ দৃষ্টিতে কিছুই যায় আসে না। সে উল্টো শান্ত কন্ঠে বললো,
— “আপনার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটতে চলছে, আমার মনে হয় এই শীতল পানি তাকে ঠান্ডা করতে সক্ষম। বাংলাদেশে যখন কারোর মাথা খারাপের উপক্রম হয় তখন তাকে ঠান্ডা পানি চিকিৎসা করা হয়। টোটকা বলা হয়, এতে মাথা নষ্ট ব্যক্তি আরাম পায়। আশা করি এবার একটু সুস্থ মানুষের মতো চিন্তা করবেন। এবার তো ঠান্ডা পানি চিকিৎসা করলাম আগামীতে উত্তম মধ্যম চিকিৎসা করতেও আমি পিছ পা হবো না। কথাগুলো মাথায় ঢুকিয়ে নেন”

কথাটা বেশ শান্ত গলায় বললো ঐন্দ্রিলা। কিন্তু কথাটির প্রভাব পড়লো বিস্তাররুপে। জ্যানেটের শ্বেত মুখখানা আষাঢ়ের মেঘ মেদুর আকাশের ন্যায় হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ঐন্দ্রিলার কঠিন মুখের দিকে তারপর ব্যাগ থেকে রুমালটি বের করে মুখ মুছতে মুছতে নির্লজ্জের ন্যায় বলতে লাগলো,
— “এতো আত্মবিশ্বাস? ভুলে যাচ্ছেন এই মুখখানা যে তার গভীরতম ভালোবাসা”
— “আপনার মতো নির্বোধ মানুষের কাছেই চেহারাটা জরুরী। কিন্তু আমার স্বামী আমার শ্যাম মনটাকেই ভালোবাসে। আপনি বুঝবেন না। বললাম যে, আপনি নির্বোধ, স্টুপিড এন্ড ননসেন্স।”

ঐন্দ্রিলা দাঁড়ালো না। কফির বিলটা টেবিলে রেখেই হনহন করে বেড়িয়ে এলো কফিশপ থেকে। জ্যানেটের মুখখানা চড়িয়ে লাল করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তার। কিন্তু সেটা আইন ভঙ্গ করতো বিধায় করে নি ঐন্দ্রিলা। কফি শপের বাহিরে পাঁচ মিটারের ব্যাবধানে একটা কালো গাড়ি অপেক্ষা করছে। গাড়িটি অভ্রের। গাড়ির ভেতর অভ্র অপেক্ষারত। ঐন্দ্রিলার জ্যানেটের সাথে দেখা করাটা একটা পরিকল্পনা। ঐন্দ্রিলার দ্রুত পায়ে এগিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। বেশ শব্দ করেই দরজাটা আটকালো সে। জ্যানেটের রাগটা নির্জীব গাড়ির উপর জাহির করলো সে। অভ্র চোখ বন্ধ করে গান শুনছিলো। মান্না দে এর গান,
“কে প্রথম কাছে এসেছি
কে প্রথম চেয়ে দেখেছি,
কিছুতেই পাই না ভেবে
কে প্রথম ভালবেসেছি,
তুমি না অমি ?

ঐন্দ্রিলার সজোড়ে দরজা বন্ধের শব্দে সে চোখ মেলে তাকালো। অবাক নয়নে তাকালো নিজ স্ত্রীর মুখশ্রীর দিকে। রাগে শ্যাম মুখখানা লাল হয়ে আছে। চোখ গুলো অগ্নি ঝড়াচ্ছে। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে। তার মুখের কাঠিন্য দেখে অভ্র তাজ্জব বনে গেলো। অবাক কন্ঠে বলল,
— “ঐন্দ্রি, তুমি কি ঠিক আছো?”
— “আমি অভিনয় করতে পারবো না। আর আপনি ঐ জ্যানেটের সাথে কোনো রকম দেখা করবেন না”

ভনীতা ব্যাতীত কথাটা বললো ঐন্দ্রিলা। অভ্রের এবার ধোয়াশা ব্যাপারখানা স্বচ্ছ হলো। ঐন্দ্রিলা জ্যানেটের উপর রেগে আছে। মেয়েটা রেগে গেলে এরুপ আচারণ করে। অভ্রের বুঝতে বাকি রইলো না কিভাবে জ্যানেটকে কথা শুনিয়েছে ঐন্দ্রি, যাকে বলা হয় বাংলা ওয়াশ। অভ্র মুখ টিপে হাসলো। তারপর গম্ভীরের ভাব নিয়ে বললো,
— “এ ছাড়া তো উপায় নেই, তুমি তো জানো ও কি চায়”
— “কুনজর দিতে চায় আপনার উপর।”
— “হ্যা!!! জ্যানেট স্বীকার করেছে?”
— “আজ্ঞে হ্যা, অকপটে বলে দিলো, সে আপনাকে চায়। এবং এতে নাকি কোনো দোষ নেই। এই মহিলাকে থাপড়াতে মন চাচ্ছিলো। পাবলিক প্লেস বলে বেঁচে গেলো।”

অভ্র অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঐন্দ্রির দিকে। রাগলে তার বাঘিনীকে সত্যি অপরুপ সুন্দর লাগে। রাগী চাহনী, লাল নাক, ঠোঁটের উপর জমা ঘামের বিন্দু। অভ্র হাতটা স্টেয়ারিং হুইলের উপর হাতটা ঠেক দিয়ে বললো,
— “তোমাকে খুব চমৎকার লাগছে ঐন্দ্রিলা। বুকের ভেতরে কেমন জানে করছে! নিজেকে একুশ বছরের ছোকরা লাগছে”

অভ্রের অকপটে আবেগঘন কথা শুনে চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেলো ঐন্দ্রিলার। ঐন্দ্রিলার মনে আসছে না শেষ কবে এতোটা সুন্দর করে কথাটা বলেছিলো অভ্র। ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে আছে অভ্রের মুখোপানে। বুকের এক চাপা কোনে অদ্ভুত চিনচিনে ব্যাথা করছে। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদ গলে পড়ছে ঐন্দ্রিলার মুখে। মনে মনে আওড়ালো,
“তার আত্মবিশ্বাস ভুল নয়”

১০.
কালো পিচের রাস্তার পাশের সরু ফুটপাত দিয়ে হাটছে নীলাদ্রি। পরণে নীল চেক শার্ট এবং কালো প্যান্ট। টাইটা অগোছালো অবস্থায় গলায় ঝুলছে। হাতে এতোকালের সম্বলের ফাইল, চাকরির যোগ্যতার কাগজপত্র। ক্লান্ত পা গুলো এলোমেলো ভাবে হাটছে। ইন্টারভিউ দিয়ে বের হয়েছে। সব ই ভালো যাচ্ছিলো কিন্তু হুট করে যখন ইন্টারভিউয়ার প্রশ্ন করলো গত চাকরিটা ছাড়লেন কেনো সেখানেই ধরা খেলো নীলাদ্রি। সত্য মিথ্যা জড়িয়ে বলেছে। কিন্তু লোকটি হয়তো বিশ্বাস করে নি। অফিসটা উত্তরা সাত নম্বর সেক্টরে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী, স্যালারিটা একটু কম। কিন্তু বাকি সব মোটামোটি। তবে নীলাদ্রির ধারণা তার চাকরিটা হবে না। কারণ লোকটার মুখে এক অনীহা লক্ষ করেছে সে। বুক চিকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে তার। অমনোযোগের কারণে আবাসিকের ভেতর ঢুকে পড়ে সে। সাত নম্বর সেক্টরের বাড়িগুলো বেশ চমৎকার। বিশাল বিশাল অট্টলিকা, তার বাহিরে দামী দামী গাড়ি। নীলাদ্রি এক নজর বাড়িটির দিকে চাইলো। তারপর নিজের পকেটে। তিনটা পঞ্চাশ টাকার নোট আছে তাতে যার একটা ছেড়া। আসার সময় কন্টাকটরকে গসিয়ে দিয়ে চেয়েছিলো কিন্তু হয় নি। তখন নীলাদ্রির মনটা বিষাদে ছেয়ে আসলো, কেনো কিছু মানুষের এতো ধনী হতে হবে আর কিছু মানুষের পকেটে থাকবে তিনটা পঞ্চাশ টাকার নোট যার একটা ছেড়া। হঠাৎ একটা চিকন কন্ঠের ঢাক শুনলো নীলাদ্রি।
— “নীল ভাই……….

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷]

মুশফিকা রহমান মৈথি