স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-১৬+১৭

0
306

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#১৬তম_পর্ব

অদ্রির গায়ে কম্বল টেনে দিচ্ছে ঐন্দ্রিলা। মেয়েটা বড্ড নড়াচড়া করে। ফলে বারংবার কম্বল সরে যায়। মেয়ের কপালে চুমু একে বসতেই লক্ষ্য করে অভ্র তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকেছে। একটা শার্ট এবং প্যান্ট বের করেই ছুটলো ওয়াশরুমে। মিনিট কয়েক বাদে বেড়িয়ে আসলো সে। সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে বের হতে যাবে তখন ই ঐন্দ্রিলা প্রশ্ন করে উঠে,
— “কোথায় যাচ্ছেন?”

ঐন্দ্রিলার তীর্যক প্রশ্নে থেমে যায় অভ্র। পেছন ফিরে বলে,
— “অফিসে একটা সমস্যা হয়েছে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। রাতে আমি ফিরছি না”
— “হঠাৎ কি এমন সমস্যা হলো?”
— “এতো কথা বলার সময় নেই, আমি আসছি। গেট আটকিয়ে দাও”

অভ্রের রুঢ় বক্তব্যে ঐন্দ্রিলা কথা বাড়ালো না। ছোট করে “হু” বলে তার পিছনে উঠে আসলো। অভ্র বেড়িয়ে গেলো। দরজা আটকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো ঐন্দ্রিলা। এক পুরোনো কুসংস্কার আছে, “নতুন বছরের প্রথম দিন যেমন কাটে; বাকি দিন গুলো নাকি সে অনুরূপ ই ঘটে”– ঐন্দ্রিলা এই কুসংস্কারটি বিশ্বাস করে না। তার মতো মানুষেরা সেটাই বিশ্বাস করে যা তারা অনুভব করে। কিন্তু এই প্রথম ঐন্দ্রিলার মনে হলো, তার বছরটা হয়তো ভালো যাবে না। বুকচিরে এক রুদ্ধশ্বাস বেড়িয়ে এলো সাথে গড়িয়ে পড়লো এক বিন্দু নোনাজল। ঐন্দ্রিলা আটকালো না সেই নোনাজলের বিন্দুটিকে। জমা বিষাদের কিছু অংশ যদি গড়িয়ে পড়ে ক্ষতি কি!

নতুন বছরের প্রথম রোদেলা সকালে পিউ এর ঘুম ভাঙ্গলো নীলাদ্রির উষ্ণ স্পর্শে। পিটপিট করে চোখ মেললো পিউ৷ ক্লান্ত চোখ জোড়ায় অস্পষ্ট নীলাদ্রির মুখশ্রী দেখে নিস্প্রভ হাসি হাসলো সে। নীলাদ্রি তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
— “নতুন বছরের প্রথম সুপ্রভাত”
— “কয়টা বাজে”
— “দশটা-টশটা বাজে হয়তো”
— “ডাকো নি কেনো?”
— “ডেকেছি, শুনতে পাস নি”

পিউ ক্লান্ত স্বরে “অহ” বললো। তারপর নীলাদ্রির বাহু খামচে উঠে বসলো। নীলাদ্রি আলতো হাতে গৌর মুখখানা আগলে ধরলো৷ কপালে কপাল ঘষে বললো,
— “কেমন লাগছে শরীরটা?”

পিউ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নীলাদ্রির শ্যাম মুখখানার দিকে। লোকটির জন্য বড্ড মায়া হয় তার। সারাটাক্ষণ তার চিন্তাগুলো এই নারীর চারপাশেই ঘুরে। এতো বেলা হয়ে গেছে অথচ প্রথম প্রশ্নটি তার শরীর সংক্রান্ত। মাঝে মাঝে নিজেকে সব থেকে ভাগ্যবতী মনে হয় পিউ এর। এমন স্বামী ভাগ্য ক জনের হয়। ম্লান হাসি অক্ষত রেখে বলে,
— “ভালো, নাস্তা করেছো?”
— “হু, জানিস তো ক্ষুধা আমার সহ্য হয় না। আমাদের সকলের খাওয়া শেষ, তুই বাদে। এখন উঠে পর তাড়াতাড়ি। খাবার গুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে। বাদাম ভিজিয়ে রেখেছি। নাস্তা খাবার পর বাদাম গুলো খাবি।”

পিউ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীলাদ্রির দিকে। নীলাদ্রির কোমল কন্ঠের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছে সে। অতি মনোমুগ্ধকর ঠেকছে তার কাছে। পিউ এর ঘোর গাঢ হলো। এগিয়ে এলো নিলাদ্রীর কাছে। নিবিড় আক্রমণ করলো সে। উষ্ণ ঠোঁট ছোয়ালো নীলাদ্রির গালে। পিউ এর অতর্কিত আক্রমণে বেকুব বনে যায় নীলাদ্রি। হতবাক কন্ঠে বলে,
— “এই হামলার কারণ?”
— “ইচ্ছে হলো, দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বর”
— “পিউরাণীর তো মুখে খই ফুটেছে। বোঝা যাচ্ছে সৈন্যের সামন্ত আসছে।”
— “সেই জানান বিগত এই বিশ দিনে বেশ ভালো করেই দিচ্ছে।”

ক্ষীন কন্ঠে পিউ কথাটা বলে৷ নীলাদ্রি ঈষৎ হেসে বললো,
— “বুঝতে হবে সে তার অংশ।”

তারপর হাসি থামিয়ে কোমল কন্ঠে বলে, — “তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
— “সবার ই হয়, এ আবার নতুন কি!”
— “আমার ভালো লাগে না তোকে এভাবে দেখতে। ভয় হয়। হারাবার ভয়”

নীলাদ্রির কথায় এক অদ্ভুত ঘোর ছিলো, ছিলো আতঙ্কের সূক্ষ্ণতা। পিউ এক দৃষ্টিতে কিছুসময় তাকিয়ে দেখে কথা পাল্টাতে বললো,
— “বাবাকে চাকরির কথাটা বলেছিলে?”
— “বলি নি, ইচ্ছে হয় নি। অহেতুক চিন্তা দেওয়া”
— “তাও ঠিক। কিছু পথ বের হলো?”
— “হলো, কিন্তু স্যালারিটা কম। তবুও ইন্টারভিউ দিবো বুঝলে।”
— “আচ্ছা, অভ্র ভাই কে বললে হয় না? এতো ভালো ব্যাবসা তাদের৷ একটা ভালো ব্যাবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বললে আমি নাহয়”

পিউ এর কথাটা শেষ হলো না, এর পূর্বেই নীলাদ্রি বলে উঠলো,
— “আমার উপর একটু ভরসা রাখো। কারোর দয়ার প্রয়োজন নেই আমার।”
— “দয়ার প্রশ্ন কেনো আসছে। সে তো আত্মীয় আমাদের”
— “বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে কখনো অর্থনৈতিক সাহায্য নিতে হয় না। এতে সম্পর্ক নষ্ট ব্যাতীত কিছুই হয় না। ভরসাটা রাখ একটু। চেষ্টা করছি তো”

পিউ কথা বাড়ালো না। নীলাদ্রি থমথম মুখটা দেখে সব কথা ভেতরেই গিলে ফেললো। নীলাদ্রি আত্মমর্যাদা সর্বপ্রথমে, সে না খেয়ে থাকবে কিন্তু অভ্রের থেকে সহায়তা নিবে না। তাই অরন্যে রোদন করে লাভ নেই। পিউ উঠে পড়লে নীলাদ্রি বিছানা করে দিলো। মাথায় অজস্র চিন্তার মাঝে এই অর্থনৈতিক চিন্তাটা বেশি ভাবাচ্ছে নীলাদ্রিকে। ব্যাংকে যে টাকা আছে আদৌ তাতে সংসার চলবে তো চাকরি পাওয়া অবধি!!!!!

অভ্র ফিরলো সকাল বেলা। সকালে বাড়িতে ঢুকতে দেখে শারমিন বেগম প্রশ্ন করে উঠলেন,
— “এখন কোথা থেকে এলি রে?”
— “মিটিং ছিলো মা একটা, তাই অফিস গিয়েছিলাম”

ক্লান্ত কন্ঠে কথাটা বলে অভ্র। ঐন্দ্রিলা তখন দিশানকে খাইয়ে দিচ্ছিলো। অভ্রের দিকে আড়চোখে চাইলো সে। তারপর পুনরায় নিজের কার্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অভ্র ভেতরে যেতে যেতে বলে,
— “মা, আমি কিছুক্ষণ ঘুমাবো। প্লিজ কেউ ডিসটার্ব করো না।”

বলেই নিজ ঘরে চলে গেলো সে। শারমিন বেগম বুঝতে পারলেন না তার ছেলের কথাটা। ঘুমাবে ঘুমাক, এটা জাহির করার কি আছে। তিনি বেকুব নজরে তাকালেন ঐন্দ্রিলার দিকে৷ ঐন্দ্রিলা কিছুই বললো না। সে মনোযোগ দিয়ে দিশানকে খাইয়ে দিচ্ছে। দিশান ঐন্দ্রিলার মুখোপানে চেয়ে সরল মনে বললো,
— “মাম্মাম, আজ আমরা বাহিরে যাবো না! আজ তো নিউ ইয়ার। প্রতিবছর তো আমরা বাহিরে যাই। এবার যাবো না?”
— “আমার দিশান তো গুড বয়, আজ যদি বিকেলের মাঝে সব হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করে ফেলে তবে বিকালে আমরা ঘুরতে যাবো।”

ঐন্দ্রিলার কথায় উৎসাহী হয়ে উঠলো দিশান। তাড়াতাড়ি খেয়ে সে ছুটলো হোমওয়ার্ক করতে। দিশান যাওয়ার পর শারমিন বেগম আমতা আমতা করে বললেন,
— “সব ঠিক আছে তো?”
— “বুঝলাম না মা”
— “মানে তোমার আর অভ্রের মাঝে! সেদিনের ঘটনায় কি অভ্র কিছু বলেছিলো?”
— “কিছুই বলে নি মা, সেটাই সমস্যা। বাদ দেন মা, আজ বিরিয়ানি রাধবো। নতুন বছরের একটা দিন। ভালো কিছু রাধলে ক্ষতি কি!”

শারমিন বেগম কিছু বললেন না। কি বলবেন বুঝে পেলেন না। ঐন্দ্রিলা সব গুছিয়ে উঠেই যাচ্ছিলো। তখন ই ফোনের নোটিফিকেশন বেজে উঠলো৷ ঐন্দ্রিলার চোখ পড়লো ফোনের দিকে। একটি মেইল এসেছে। কৌতুহল মন উৎসুক হয়ে উঠলো মেইল দেখতে। মেইলটি খুলতেই স্তব্ধ হয়ে যায় ঐন্দ্রিলা। একটি ছবি, সেখানে অভ্র এবং জ্যানেট পাশাপাশি বসে রয়েছে……..

চলবে

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#১৭তম_পর্ব

ঐন্দ্রিলা এখনো মোবাইলের দিকেই তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গিয়েছে তার। চিন্তা শক্তি স্লথ হয়ে গিয়েছে। ছবিটি আড়াল থেকে তোলা হয়েছে। অভ্র এবং জ্যানেট কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত। অভ্র ঠিক সেই শার্ট ই পড়া যা সে গতকাল রাতে পড়েছিলো। অর্থাৎ সে গত রাতে জ্যানেটের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। ঐন্দ্রিলা অভ্রকে সন্দেহ করছে না। কিন্তু বুকে চাপা ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এটা ভেবে তার কাছে লুকোনোর কি ছিলো! যদি তারা পরস্পরের সাথে দেখাও করে নিশ্চয়ই কারণে করেছে, সেই কারণটা কি ঐন্দ্রিলাকে জানানো যেতো না! নাকি সেই দিনের ঘটনার পর দিশানের কোনো ব্যাপারেই ঐন্দ্রিলাকে রাখতে চাইছে না অভ্র। চিন্তা করতেই মুখখানা শক্ত হয়ে গেলো তার। ক্ষুদ্ধ চাহনী স্থির। শারমিন বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
— “কি হলো, থেমে গেলে যে!”
— “মা, আপনি মাহফুজাকে দেখিয়ে দিন। আমি একটু আসছি”

শারমিন বেগম স্থির নয়নে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে বললেন,
— “বেশ, যাও”

বয়স তার কম হয় নি শারমিন বেগমের। তিনি মুখ দেখলেই বুঝতে পারেন সম্মুখের মানুষের মনে কি চলছে! তাই কিছু একটা ঘটেছে সেটা আন্দাজ করাটা খুব একটা কঠিন কর্ম নয় তার কাছে। এই জ্যানেট মেয়েটি আসার পর থেকেই তার পরিবারে একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে। মাঝে মাঝে ভয় হয় তার। সাজানো সংসারটি না ভেঙ্গে গুড়িয়ে যায়।

অভ্র ড্রেস বদলে একটা ট্রাউজার আর হুডি গায়ে দিয়েছে। চোখ গুলো ভেঙ্গে আসছে ঘুমে। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে তার। গতরাতে যা ঘটেছে তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না সে। অনেক কষ্টে সব কিছু আগের মতো করেছে। নির্ঘুম রাত কেটেছে তার। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো বিছানায় অভ্র। এর মাঝেই ঝড়ের গতিতে ঘরে প্রবেশ করলো ঐন্দ্রি। মোবাইল টা অভ্রের দিকে ছুড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “এসব কি?”

ঐন্দ্রিলার প্রশ্নে চোখ মেললো না অভ্র। বরং চোখ বন্ধ অবস্থায় নির্বিকার চিত্তে বললো,
— “বড্ড ক্লান্ত আমি ঐন্দ্রিলা, ঘুমোতে দাও”
— “আমার প্রশ্নের উত্তর পেলেই আমি চলে যাবো। অহেতুক কথা কাটাকাটি আমার ও পছন্দ নয়, অভ্র। গতরাতে আপনি জ্যানেটের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন কেনো?”

ঐন্দ্রিলার প্রশ্নটি বোধগন্য হতে সময় লাগলো অভ্রের। এবার চোখ মেলে চাইলো সে। ক্লান্তিতে ছেয়ে আসা রক্তিম চোখ জোড়া নজরে পড়লো ঐন্দ্রিলার। উঠে বসলো অভ্র। অবহেলায় মোবাইলটা হাতে নিলো সে। ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখলো। তারপর ধীর স্বরে বললো,
— “ছবিটা তোমাকে কে পাঠিয়েছে?

ঐন্দ্রিলা তাকিয়ে রইলো অভ্রের দিকে। অভ্রের মুখশ্রী স্বাভাবিক। শান্ত চাহনী নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে সে ঐন্দ্রিলার পানে। ঐন্দ্রিলা পরমূহুর্তে শক্ত কন্ঠে বললো,
— “কে পাঠিয়েছে সেটা জানা কি খুব জরুরি? নাকি “আপনি গত রাতে জ্যানেটের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন কেন” — এই প্রশ্নটা বেশি জরুরি?”
— “কে পাঠিয়েছে সেটা এজন্য জরুরী কারণ ছবিটা ফটোশপ করা।”

ঐন্দ্রিলা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অভ্রের দিকে। ফটোশপ করা ছবি কেউ কেনো তাকে পাঠাবে! ঐন্দ্রিলা অনুভব করলো মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা করছে। অভ্র এবার উঠে দাঁড়ালো। ধীর কন্ঠে বললো,
— “গত রাতে আমাদের কোম্পানির সকল কম্পিউটার হ্যাক হয়। সেকারণে আমি ছুটে যাই। কে করেছে আমি জানি না। এই ছবিটা লুকিয়ে তোলা হয়েছে। যে মেয়েটির সাথে আমাকে দেখছো সে আমাদের সোফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার৷ তার মুখের উপরে জ্যানেটের মুখ এডিট করা, তাই জানতে চাচ্ছি ছবিটা কে পাঠিয়েছে”

ঐন্দ্রিলা এখনো চুপ করে আছে। এবার অভ্র তার মুখখানা আলতো হাতে তুলে বললো,
— “তুমি কি আমায় সন্দেহ করছো ঐন্দ্রি?”
— “সেটা কি স্বাভাবিক নয়?”
— “তুমি চাইলে ঈদ্রিশকে জিজ্ঞেস করতে পারো”
— “অন্যের কাছে জিজ্ঞেস করে কি আদৌও কোনো লাভ আছে অভ্র? আমি ক্লান্ত, আমি সত্যি ক্লান্ত। সব কিছু কেমন যেনো এলোমেলো লাগছে আমার।”

ঐন্দ্রিলার কন্ঠে আক্ষেপ স্পষ্ট। সুনিপুনভাবে ছোট একটি নিঃশ্বাস গোল্পন করলো অভ্র। সুবিন্যস্ত জীবনটা কেমন যেনো এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। ঐন্দ্রিলা কিছুক্ষণ থেমে কড়া স্বরে বললো,
— “মাঝে মাঝে আশেপাশের মানুষগুলোকে অপরিচিত লাগে, অভ্র। আমি জানি দিশানের প্রতি আমার সিনসিয়ারিটি নিয়ে আপনার মনে সন্দেহ জন্মেছে। কিন্তু আমার অগোচরে আপনি ওই মহিলার সাথে দেখা করবেন, আমি মানতে পারবো না”
— “আমি কখনোই সেদিনের ঘটনার জন্য তোমাকে দোষ দেই নি ঐন্দ্রি”
— “দেন নি ঠিক ই, কিন্তু সেই ঘটনার পর আমার সাথে একটি বার ও স্বাভাবিক ভাবে কথা ও বলেন নি! আমি বলদ নই অভ্র। পাঁচবছর সময়টা কিন্তু কম নয়, আমি আপনাকে বুঝি।”

অভ্র চুপ করে রইলো। কথাটা পুরোপুরি সত্য না হলে আংশিক সত্য। জ্যানেটের সুন্দর মুখের আড়ালে কালচে মনটা তার অজানা নয়। সে চায় নি, ঐন্দ্রিলা এবং দিশানকে কেন্দ্র করে আবার কোনো মারাত্মক খেলা খেলুক সে। কিন্তু এই মহিলা অভ্রকে এক দ্বন্দ শান্তির নিঃশ্বাস নেবার উপায় রাখতে নারাজ। এখন দিশানকে নিয়ে কিছু করতে না পারায় ঐন্দ্রিলা এবং তার সম্পর্কের মাঝে দেয়াল তৈরি করতে চাচ্ছে। অভ্র কিছু না বলেই জড়িয়ে ধরলো ঐন্দ্রিলাকে। বক্ষস্থলে তাকে আগলে ধরে বললো,
— “আমি তোমাকে সন্দেহ করি নি ঐন্দ্রিলা। শুধু চাই নি মা-ছেলের মাঝে কোনো দেয়াল তৈরি হোক। সত্যি বলতে তোমার উপর আমার অভিমান হয়েছিলো বটে। এতো বুদ্ধিমতি হবার পর ও তুমি ওই মহিলার ফাঁদে পা দিয়েছিলে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই অভিমান ও গলে গেছে।”
— “তাহলে আমার কাছে এতোটা রুঢ় আচারণ কেনো করেছিলেন?”

ঐন্দ্রিলা অকপটে প্রশ্নটি করে। অভ্র বিছানায় বসায় তারপর ভালো করে দরজা চেক করে আসে। তারপর তার পাশে বসতে বসতে বলে,
— “জ্যানেটকে যতটা বুদ্ধিমান ভেবেছিলাম ও এর চেয়েও বুদ্ধিমতো মেয়ে। আমি এই ক দিন একটা পরীক্ষা করছিলাম।”
— “কি পরীক্ষা?”
— “দিশান হারানোর দিন থেকেই আমার একটা সন্দেহ হয়, কেউ আমাদের ঘরের সকল ঘটনা জ্যানেটকে জানাচ্ছে। দিশান কখন কি করে, দিশানের সাথে কে থাকে, আমি তুমি কি করছি সব। ঘরের শত্রু বিভীষণ যাকে বলে, আমি সেই মানুষটিকে হাতে নাতে ধরতেই এই পরীক্ষা করেছি। এখন দেখছি ঘরে না, বাহিরেও মহিলা লোক ঠিক করেছে”
— “ঘরের কে তাকে খবর পাচার করবে? আমরা ক জন ই ত থাকি। বাবা-মা, আহাশ, আমি-আপনি। পরিবারের এই পাঁচজনের কেউ ই তাকে খবর পাঁচার করছে না”
— “তুমি একজনকে ভুলে যাচ্ছো?”
— “মাহফুজা?”
— “ঠিক ধরেছো”

মাহফুজা মেয়েটি বিগত ছ মাস যাবৎ এই বাড়িতে কাজ করছে। অদ্রি কে সামলে বাড়ির সকল কাজ করা ঐন্দ্রিলার পক্ষে দুষ্কর হয়ে উঠেছিলো। তাই এই মেয়েটাকে কাজে রেখেছে তারা। কিন্তু মেয়েটা এমন কিছু করবে কল্পনা করতে পারছে না ঐন্দ্রিলা। অভ্র এবার ধীর স্বরে বললো,
— “জ্যানেট, আমাদের মাঝে একটা বিবাদ বাধাতে চাচ্ছে। যেনো কোর্টে প্রমাণ হয় আমরা মা-বাবা হিসেবে অপারগ। বিশেষ করে তুমি, দিশানের মনে তোমার একটা নেগেটিভ ছবি সে বানাতে চাইছে। তাই আমি তোমাকে দিশানের সব কিছু থেকে দূরে রাখতে চেয়েছি।”

ঐন্দ্রিলা এবার শক্ত কন্ঠে বললো,
— “তাহলে আমার থেকে লুকানোর কি প্রয়োজন ছিলো?”
— “মাহফুজার চোখ আমাদের উপর। আমি চাচ্ছিলাম যেনো জ্যানেটের কন্সেন্ট্রেশন দিশান থেকে আমাদের উপর হোক, সেটাই হয়েছে”
— “তাতে লাভ কি হলো? তার মনোবাঞ্চা তো পূর্ণ হয়েছে”

অভ্র এবার গাল ভরে হাসলো। তার হাসিটি বড্ড রহস্যে ঘেরা। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,
— “জ্যানেট যদি চলে পাতায় পাতায়, আমি চলি শিরায় শিরায়। ও আমার পরিবারকে ভাঙ্গতে গেম খেলছে তো সেটা বাঁচাতে। তবে এখানে তোমার ভূমিকাও খুব জরুরী। একটা অভিনয় করতে হবে ঐন্দ্রিলা……….

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন৷]

মুশফিকা রহমান মৈথি