স্বপ্নছায়া ২ পর্ব-২০+২১

0
490

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#২০তম_পর্ব

চিকন মেয়েলি কন্ঠটি অতি পরিচিত। নারীটি সুমী, নীলাদ্রির পূর্বকর্মরত অফিসের এক কলিগ। নীলাদ্রি দাঁড়িয়ে গেলো। পেছনে তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটি একটা সাদা ফ্লাট বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার কাছে এগিয়ে এলো। উৎফুল্ল কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
— “আপনি এখানে কি করছেন নীল ভাই?”
— “ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম”

ঈষৎ বিব্রত কন্ঠে উত্তর দিলো নীলাদ্রি। সুমী কোমলভাবে হাসলো। তারপর বললো,
— “আপনি কি বদলাবেন না নীল ভাই? কি হয় একটু অন্য কারোর থেকে সাহায্য নিলে? আমি তো বলেছি, আপনাকে সকল ভাবে সাহায্য করতে আমি প্রস্তুত। তবুও হন্যে হয়ে আপনি চাকরি খুজছেন?”

সুমীর কথায় উত্তর দেয় না নীলাদ্রি। শুধু এদিক ওদিক চাওয়া চাওয়ি করে। রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না সুমীর সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে। নীল টপিক বদলাতে প্রশ্ন করে,
— “তুমি এখানে? অফিস যাও নি?”
— “আমি জব ছেড়ে দিয়েছি ভাই, যার জন্য ছিলাম সেই মানুষটি তো নেই। তাই অহেতুক, কষ্ট করে কি হবে? আর বসের ইনএপ্রোপ্রিয়েট কাজ সহ্য হচ্ছিলো না।”

সুমী মেয়েটির কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো নীলাদ্রি। মেয়েটি তাকে পছন্দ করে। সেটা নতুন কোনো ভূত নয়, বরং যবে থেকে সে এই কোম্পানীতে জয়েন করেছে তখন থেকে। এবং সে এই ভালোলাগা অনুভূতিটা নীলাদ্রিকে বোঝাবার প্রচেষ্টা করেছে বহুবার। কিন্তু নীলাদ্রি ই এড়িয়ে গেছে। তার মন সর্বদাই পিউ এর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তাই সুমীর ভালোলাগাগুলোকে নিপুনহস্তে এড়িয়ে যেতো সে। আজ ও তাই করবে। স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্ন করে,
— “এখানেই থাকো?”
— “জ্বী, এই বাড়ির চারতালায় থাকি। চলুন চা খাবেন”
— “না, না আজ থাক। তোমার ভাবি অপেক্ষা করছে। যেতে হবে। মিরপুর যেতে অনেক সময় লাগবে, একবার জ্যামে বাধলে তো বুঝতেই পারছো!”
— “হুম, জানি। ভাবীর ডিউ ডেট দিয়েছে?”
— “হ্যা, আগষ্টে। দোয়া করিও”
— “জ্বী, করবো।”

নীলাদ্রি যেতে ধরলেই সুমী বলে উঠে,
— “আপনার একটা সিভি আমাকে দিবেন?”
— “কেনো?”
— “আমার বাবার কোম্পানীতে অপারেটিং সিস্টেম ম্যানেজারের পোস্ট টা খালি আছে, স্যালারীও বেশ ভালো। আপনি চাইলে আমি কথা বলবো”
— “দয়া করছো?”

মৃদু হেসে কথাটা জিজ্ঞেস করলো নীলাদ্রি। সুমী কিছুসময় চুপ করে থাকলো তারপর বললো,
— “আপনাকে দয়া করার ক্ষমতা আমার নেই নীলাদ্রি ভাই, সামান্য সাহায্য করতে চাই। আপনাকে এভাবে দেখতে একেবারেই ভালো লাগছে না”
— “আমার জন্য ভাবার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি যে এই সাহায্য নিতে পারবো না সুমী। তোমার কাছে ঋণী হতে পারবো না। আসছি, ভালো থেকো”

নীলাদ্রি দাঁড়ালো না। সুমীও তাকে আটকালো না। শুধু ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলো নীলাদ্রির যাবার পানে। কিছু স্বপ্নছায়ায় পূর্ণতা আসে না। সুমীর ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। কিন্তু আফসোস করে কি হবে, এটাই যে পাপ্য_______

ক্লাসের মধ্যিখানের একটি বেঞ্চের কর্ণারে বসে আছে দিশা। তার মূখের উপর তীর্যক সূর্যের রশ্নি পড়ছে। সোনালী হলদেটে রশ্নি। দিশা চোখ বন্ধ করে আছে। খুব ঘুম পাচ্ছে তার। গতকাল চারটে অবধি জেগে ছিলো সে, আজকের ক্লাসটেস্ট পরীক্ষার জন্য রাত অবধি পড়তে হয়েছে তার। যার জন্য ঘুমের অবস্থা নাজেহাল। এই ব্রেকের সময়টাতে একটু ঘুমিয়ে নিতে চায় সে। একটু পর ওই আহাশ নামক ব্যক্তিটি ঝড়ের গতিতে ঢুকবে, বুলেট গতিতে পরীক্ষার খাতা দিবে। তারপর বোর্ডে মার্কার দিয়ে প্রশ্ন লিখবে। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তাদের। গতদিনের মতো অপমানিত হতে চায় না দিশা। তাই আজ এই সময়টা ক্লাসেই থাকবে সে। সামিহা হালকা ধাক্কা দিলো,
— “দোস্ত, স্যার এসেছে”

কথাটা কানে যেতেই তড়িৎগতিতে উঠে পড়লো দিশা। সত্যি এসেছে আহাশ। তড়িৎ গতিতে ঢুকে খাতা বিলি করে দিলো। মার্কার দিয়ে প্রশ্ন লিখে জোড়ালো কন্ঠে বললো,
— “সময় পঁচিশ মিনিট, আমি পঁচিশ মিনিটের এক সেকেন্ড ও বেশি সময় দিবো না। যদি আমি খাতা নেবার সময় খাতা না পাই আমি সেই খাতা নিবো না। এখন বাজে ১১.৩০, ঠিক ১১.৫৫ এ পরীক্ষা শেষ হবে”

সবাই বুলেটের গতিতে লেখা শুরু করলো। দিশার কাছে প্রশ্নটি অতি সহজ কারণ অংকটি তার করা। সে সুন্দর করে পুরো গণিতের সমাধান করতে শুধু করলো৷ সময় কাটছে। ঠিক ১১.৫৫ তে আহাশ জোড়ালো কন্ঠে বলে উঠলো,
— “টাইমস আপ”

দিশা তখন ও লিখছে। তার লেখাটা শেষ করতে করতে তার বেঞ্চের সবার খাতা নিয়ে নিয়েছে আহাশ। যখন দিশা লেখা শেষ করে তার দিকে এগিয়ে দিলো সে খাতাটি না নিয়েই সামনে এগিয়ে গেলো। ক্লাসের সকলের খাতা কালেক্ট করে সে যখন সামনে এগিয়ে গেলো তখন দিশা পরীক্ষার খাতাটি নিয়ে তার কাছে গেলো। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
— “স্যার, আমার খাতাটা”
— “তোমার কাছেই রাখো। আমি নিবো না”
— “কিন্তু স্যার”
— “দিশা, আমি বলেই দিয়েছি। যখন খাতা নিবো তখন খাতা দিয়ে দিবেন। কোনো প্রকার টানাটানি আমি করবো না”
— “সরি স্যার, কিন্তু প্লিজ খাতাটা নিন”
— “নেক্সট টাইম কথাটা মনে রাখলেই হবে, এখন যান জায়গায় বসেন”
— “স্যার খাতাটা”
— “আমি নিবো না, বলেই দিয়েছি।”

দিশার মুখটা মিয়ে গেলো। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। এতো কষ্ট করে পড়েছিলো পরোক্ষার জন্য। এই পরীক্ষায় ১৫ নম্বর। দিশা অনুরোধের স্বরে বললো,
— “স্যার, প্লিজ”
— “আমি দিবো না তোমার খাতা, বারবার কেনো বলতে হয়। সেদিন তোমাকে বলেছিলাম। ফার্স্ট গার্ল হলেই হয় না, টাইম ম্যানেজমেন্ট করাটাও একটা গুন। এখন যাও আমি পড়াবো”

বেশ চেঁচিয়েই কথাটা বলে আহাশ। উপায়ন্তর না পেয়ে মাথা নামিয়ে ফেললো দিশা। আহাশ খাতাগুলো নিয়ে সাজালো, তারপর ক্লাস শুরু করলো। আজ একটুও নোট তুললো না দিশা। শুরু সরু দৃষ্টিতে আহাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো৷ তার খুব রাগ হচ্ছে। রীতিমতো ঘৃণা হচ্ছে আহাশের উপর। সে সিদ্ধান্ত নিলো, ক্লাস সে জেরা করবে আহাশকে। শুধু তার প্রেম নিবেদন না মানার জন্য যদি সে শাস্তি দিয়ে থাকে, কখনোই ক্ষমা করবে না তাকে দিশা তাকে।

ক্লাস শেষ হতেই আহাশের পেছনে ছুটলো দিশা। বারংবার মিনতি করলো যেনো সে খাতাটি নেয়। কিন্তু আহাশের যেনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। তাই সে নির্বিকার। একটা সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না দিশা। প্রশ্ন ছুড়ে দিলো সে,
— “আপনি কি আমার উপর শোধ তুলছেন?”

দিশার কথায় চোখ কুচকে পেছনে তাকালো আহাশ। তার চোখে মুখে বিস্ময়। অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— “কি?”
— “শুধু আপনাকে মানা করার জন্যই কি আমার উপর শোধ তুলছেন আপনি? এতোটা নিচ আপনি। প্রথমে একটি মেয়েকে ভালোবাসার দাবি করেন তারপর যদি সে আপনার প্রেম নিবেদন এক্সসেপ্ট না করে তখন এতো ঘৃণ্য ভাবে শোধ উঠাবেন। এই আপনার সততা?”
— “মুখ সামলে কথা বলো দিশা”

কড়া কন্ঠে প্রতিবাদ করে উঠলো আহাশ। আহাশের মুখের বর্ণ বদলে গেলো। প্রচন্ড রেগে আছে সে। কপালে বা পাশের শিরা উঁকি দিয়ে তার রাগের জানান দিচ্ছে। চোখ মুখে হিংস্রতা ফুটে উঠলো। দিশা এবার দমলো। আহাশ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে উঠলো,
— “আমি আমার জবের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্ববান। আমি যে দেরি হলে খাতা নেই না তা তো তোমার অজানা নয়। আজ তোমার ক্ষেত্রে আজ হয়েছে বলে তুমি আমাকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করবে তা তো আমি মানবো না। হ্যা আমি তোমাকে ভালোবাসতাম, কিন্তু তার জন্য কখনোই তোমাকে আলগা পিরিত দেখাই নি। তুমিও সবার মতোই আমার ছাত্রী। যদি আমার প্রেমিকা ও হতে তাহলেও একই থাকতে। তাই মুখ সামলে কথা বলবে”

দিশার উত্তরের অপেক্ষা করলো না আহাশ। কথাটা শেষ করেই হনহন করে হাটতে লাগলো। দিশা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। হয়তো আজ একটু বেশি ই বলে ফেলেছে। কিন্তু খুব রাগ হচ্ছে তার। ঠিক কার উপরে জানা নেই। তবে হচ্ছে। হাতে থাকা খাতাটা মুচড়ে ফেলে দিলো সে। তাতেও রাগ কমলো না। এক অদ্ভুত যন্ত্রণা, কাউকে বুঝানোর উপায় নেই।

পরদিন,
আজ কেসের দিন। কোর্টে উপস্থিত হলো ঐন্দ্রি এবং অভ্র। একটু পর আদালতে বিচারকার্য শুরু হবে। তাদের উকিল নিজের বক্তব্য তৈরি করছে। এমন সময় জ্যানেটের আগমণ ঘটলো। সে নিজের উকিলের সাথে কথা বলেই এগিয়ে আসলো অভ্র এবং ঐন্দ্রিলার দিকে। হাসি মুখে বললো,
— “গুড মর্নিং, কেমন আছেন মিস্টার চৌধুরী….

চলবে

#স্বপ্নছায়া (কপি করা নিষিদ্ধ)
#দ্বিতীয়_খন্ড
#২১তম_পর্ব

আজ কেসের দিন। কোর্টে উপস্থিত হলো ঐন্দ্রি এবং অভ্র। একটু পর আদালতে বিচারকার্য শুরু হবে। তাদের উকিল নিজের বক্তব্য তৈরি করছে। এমন সময় জ্যানেটের আগমণ ঘটলো। সে নিজের উকিলের সাথে কথা বলেই এগিয়ে আসলো অভ্র এবং ঐন্দ্রিলার দিকে। হাসি মুখে বললো,
— “গুড মর্নিং, কেমন আছেন মিস্টার চৌধুরী?”

জ্যানেটের এরুপ আচারণ ঐন্দ্রিলাকে বেশ অবাক করলো। মেয়েটির সাহসের প্রশংসা না করে পারছে না ঐন্দ্রিলা। সেদিনের শিক্ষার পর ও আজ নির্লজ্জের ন্যায় অভ্রের সামনে অহেতুক রঙ্গঢং করছে। ঐন্দ্রিলা কড়া দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। কিন্তু এতে জ্যানেটের ভ্রুক্ষেপ হল না। উলটো হাসির প্রলেপ ঘন করলো। অভ্রের মহিলাকে বিরক্ত লাগলেও প্রকাশ করলো না। উলটো মৃদু হেসে বলল,
— “জ্বী ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন তো?”
— “I’m always good, will get better after the trial of this case” (আমি সর্বদা ভালোই থাকি, এই কেসের বিচারের পর আরোও ভালো হয়ে যাবো)

অভ্র মৃদু হাসলো তারপর ইংরেজিতে উত্তর দিলো,
— “Let’s see” (দেখা যাক)

জ্যানেট উত্তর দিলো না বরং তার হাসি অক্ষত রেখে অপরপাশের বেঞ্চে গিয়ে বসলো। এদিকে ঐন্দ্রিলা দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে আছে জ্যানেটের দিকে। অভ্র ধীর স্বরে বললো,
— “কন্ট্রোল করো। জ্যানেট যেনো কিছু আন্দাজ না করতে পাবে”

বাসার সবাই জানে ঐন্দ্রিলা এবং অভ্রের মাঝে সম্পর্কটা ভালো চলছে না, শুধু তাই নয় তারা সারাদিনে কোনো কথাই তাদের মাঝে হয় না। দিশানের কোনো দায়িত্ব ও অভ্র ঐন্দ্রিলাকে দেয় না। কোল্ড ওয়ার যাকে বলে সেটাই তাদের মধ্যে চলছে। উষ্ণ সম্পর্ক শীতল হয়ে গিয়েছে। যদিও সবটা কেবল মাহফুজাকে দেখাবার জন্য। মাহফুজাও সে্টাই করছে। জ্যানেটকে এখানের সকল খবর পাঁচার করেছে। হয়তো সেকারণেই জ্যানেটের এতো আত্মবিশ্বাস। সে আজ কেসে প্রমাণ করবে অভ্র ঐন্দ্রিলা মা-বাবা হিসেবে একেবারেই অপারগ। দিশানের মেন্টাল কন্ডিশনের পক্ষে এমন একটি পরিবারে থাকাটা মোটেই ভালো নয়। অভ্র এই সকল কিছুর জন্য প্রস্তুত। এবং সেও চায় জ্যানে্ট যেনো তার পরিকল্পনায় সফল হয়। কারণ তার সময় লাগবে। সময় লাগবে জ্যানেটকে সম্পূর্ণভাবে নিষ্কাশন করতে। তাই ক্যাসটা যত টানা যায় ততই ভালো।

আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। একে একে দু পক্ষের উকিল ই তাদের মক্কেলের পক্ষের যুক্তি দেখায়। যখন জ্যানেটের পক্ষের উকিলকে কথা বলার কথা বলা হয় তখন তিনি তার যুক্তি শুরু করে,
— “ইউর অনার, এখানে আমরা সবাই জড় হয়েছি একটি বাচ্চার কাস্টেডির জন্য। আমার মক্কেল মিস জ্যানে্ট মার্টিনের ভগিনী পুত্র দিশান চৌধুরীর কাস্টেডির জন্য। দিশান চৌধুরী আমার মক্কেলের জমজ বোনের পুত্র। যখন বাচ্চাটি একবছর তখন তার মারা যায়। তখন মিস্টার অভ্র চৌধুরী তাকে এডাপ্ট করেন, বাংলাদেশে নিয়ে আসে। সেখান থেকেই অভ্র চৌধুরীর কাছেই দিশান মানুষ। প্রথমে জ্যানেট জানতেন না তার উপস্থিতি। যখন জানতে পারেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। নিজের রক্ত দিশানকে অন্য দেশে সে রাখতে চায় না বলেই তিনি অভ্র চৌধুরীর কাছে তাকে চান। কিন্তু তিনি তাকে সরাসরি নিষেধ করে দেন। সেকারণেই আমরা এখানে জড় হয়েছি। যেহেতু আমার মক্কেল ই দিশানের রক্ত তাই আমার অনুরোধ মাননীয় আদালতের যেনো দিশানের কাস্টেডি আমার মক্কেলকে দেয়া হয়”
— “অবজেকশন ইউর অনার, দিশান আমার মক্কেলের নিজস্ব সন্তান। এখানে তার এবং আমার মক্কেলের ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট ও আছে। আমার মক্কেলের সাথে জ্যানেফারের সম্পর্ক ছিলো। ক্যাথেলিক হওয়ায় তারা বিয়ে করতে পারে নি। তার মাঝেই জ্যানেট দিশানকে কনসিভ করে। যখন আমার মক্কেল সেটা জানে তখন দিশান অলরেডি পৃথিবীতে চলে এসেছিলো। একজন সজ্জন প্রেমিক এবং পুরুষ হওয়ার জন্য তিনি এবং জ্যানেফার বিয়ে করে কানাডার ম্যারেজ অফিসে। এই যে সার্টিফিকেট। জ্যানেফারের যখন ক্যান্সার ধরা পরে তখন আমার মক্কেল সেখানেই ছিলো। যখন জ্যানেফার মারা যায় তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন তারা দেশে ফিরবে। যেহেতু বিয়েটা কানাডায় হয়েছিলো এবং জ্যানেফার ক্যাথেলিক ধর্মাবলম্বী ছিলো তাই এই বিয়ের কথাটা গোপন করা হয়। যেনো কেউ দিশানকে অবৈধ না বলে তাই আমার মক্কেল তাকে এডাপ্ট করে। তাই দিশান শুধু তার এডোপ্টেড সন্তান নয় ইউর অনার। তাই জ্যানেট কিছুতেই তার কাস্টেডি পাবেন না। কারণ ল অনুযায়ী সন্তান তার পিতামাতার কাছেই থাকবে। দিশান ও সেটাই আছে। আর জ্যানেট মার্টিন একজন অবিবাহিত মহিলা। উনি কখনোই দিশানকে প্রোপার ফ্যামিলি দিতে পারবে না। তাই আমার বন্ধু উকিলের অনুরোধ না গ্রহন করার অনুরোধ আমি জানাচ্ছি। ধন্যবাদ”

অভ্রের পক্ষের উকিল শাফায়াত তার উক্তি শেষ করলো। জ্যানেটের মুখ মিয়ে গেলো। সে ভেবেছিলো অভ্র হয়তো নিজের সম্মান বাঁচাতে এই বিয়ের কথাটা উল্লেখ করবে না। কিন্তু অভ্র যখন প্রমাণ নিয়ে তৈরি। তবে সে ঘাবড়াচ্ছে না কারণ এখনো তুরুপের এক্কা তার হাতে। জ্যানেটের উকিল এবার উঠে দাঁড়ালো। অনুনয়ের স্বরে বললো,
— “শুধু রক্তের সম্পর্কই যে আসল তা একেবারে ভুল ইউর অনার। আমি তা প্রমাণ করতে পারি। আমি কাঠগড়ায় অভ্র চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী মিসেস ঐন্দ্রিলা চৌধুরীকে ডাকার অনুমতি চাচ্ছি।“
— “অনুমতি দেওয়া হলো”

ঐন্দ্রিলা কাঠগড়ায় দাঁড়ালো। এরপর জ্যানেটের উকিল ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে অহেতুক প্রশ্ন করতে লাগলো,
— “মিসেস ঐন্দ্রিলা চৌধুরী, আপনার যখন অভ্র সাহেবের সাথে বিয়ে হয়েছিলো আপনি কি জানতেন তার একটি ছেলে আছে? সত্যি বলবেন”
— “দেখুন আমাদের বিয়ে পাঁচটা বিয়ের মত হয় নি। বিয়ের আগে আমি অভ্র চৌধুরীর সম্পর্কে নূন্যতম জ্ঞান রাখতাম না। তাই আর সন্তান আছে কি না তা আমার জানা ছিলো না”
— “কখন জানলেন সেটা?”
— “বিয়ের দিন”
— “উনার যে আগে বিয়ে ছিলো সেটা কি আপনি জানতেন?”
— “আমার মনে হয় আপনার মাথা নষ্ট, বা ব্রেইন শার্প নয়। মাত্র বললাম আমাদের বিয়ে হুট করে হয়েছে”
— “চিল, চিল। আচ্ছা আমার পরবর্তী প্রশ্ন, অভ্র চৌধুরী যে বিবাহিত এই কথাটা আপনি কখন জানতে পারলেন?”
— “বিয়ের দিন রাতে”
— “আপনার এই সন্তান নিয়ে আপত্তি ছিলো?”
— “না ছিলো না, থাকলে আমি বিগত পাঁচ বছর ধরে তাকে মানুষ করতাম না। আমার কাছে দিশান ততটাই ইম্পোরর্টেন্ট যতটা অভ্রের কাছে।“
— “তাহলে সেদিন আপনার চোখের সামনে থেকে ছেলেটা যখন হারিয়ে গিয়েছিলো তখন কেনো খেয়াল রাখেন নি আপনি, সাড়ে সাত বছরের বাচ্চাটাকে একা কেনো রেখেছিলেন? দিশানের মানসিক রোগের কথাও আপনার অজান ছিলো না”

ঐন্দ্রিলাকে রীতিমতো জেরা করতে লাগলো উকিল। শাফায়াত তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলো,
— “অবেজেকশন ইউর অনার”
— “অবজেকশন ওভাররুলড”

অবজেকশন বাতিল করার পর, জ্যনেটের উকিলের মাত্রা বাড়লো। সে আদালতের উদ্দেশ্যে বললো,
— “মাননীয় আদালত, সেদিন কেবল মাত্র মিসেস ঐন্দ্রিলার গাফেলতির জন্য দিশানের বড় অঘটন ঘটতে চলেছিলো। ছোটবেলা থেকে দিশানের xenophobia রয়েছে। ফলে সে অপরিচিত ঘটনায় নিজেকে মানাতে পারে না। ছোট বাচ্চাটি পথ হারিয়ে নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলো। তখন আমার মক্কেল তাকে খুঁজে পায় এবং নিজ বাসায় নিয়ে যায়। ঐন্দ্রিলা এবং অভ্র সাহেবের একটি ছোট মেয়েও আছে। ঐন্দ্রিলা ম্যাডাম নিজের মেয়ের যত্নে ত্রুটি রাখেন না কিন্তু দিশানের বেলায় সে ড্যামকেয়ার। এমন একটা পরিবারে দিশানকে রাখা কি উচিত? মানছি আমার মক্কেল অবিবাহিত কিন্তু সে দিশানকে প্রোপার কেয়ার নেবার যোগ্য। দ্যাটস অল”

আদালত থমথমে। বিচারক তার চশমাখানা ঠিক করে বললেন,
— “শাফায়াত সাহেবের কি কিছু বলার আছে?”

শাফায়াত কিছু বলতেই যাবে ঠিক তখন…………………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি