স্বামী পর্ব-০১

0
360

#স্বামী
পর্ব : ০১
#মেঘা_মেহেরাব

নিজের স্বামীর জীবন বাঁচাতে নুরাইসা আঠারো মাসের ছেলে সন্তান,তার নাড়ী ছেঁড়া ধন কে বিক্রি করে দিলো। পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ হয়তো এটা, তবুও এই নির্দয় কাজটা তাকে করতে হলো বুকে পাথর চাপা দিয়ে। তার হাত অনবরত কাঁপছিল যখন সে তার ওই দুধের বাচ্চাকে অন্য এক নারীর হাতে তুলে দিয়েছিলো। শেষ বারের মত নিজের দুগ্ধ পান করাই সে বাচ্চাটিকে। ফ্রিডিং করানোর সময় চোখ থেকে ঝড়েছিল অঝর চোখের অশ্রু বিন্দুকণা। বাচ্চাটির চোখেমুখে অজস্র চুমু এঁকে দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কতসময় নুরাইসা কেঁদেছিলো জানে না। যখন বাচ্চাটি নিজের বুক থেকে আলগা করে ধরলো দেখে বাচ্চাটি ঘুমিয়ে পরেছে।আরো একবার বুকের সাথে লেপ্টে ধরল নুরাইসা। তার পর চোখের পানি মুছে সামনে বসে থাকা এক সুন্দর রমণীর হাতে তুলে দিল নিজের সন্তানটিকে। এই সন্তানের বিনিময়ে আটটি টাকার বান্ডিল তুলে নিল সে, যেখানে ছিল সারে চার লক্ষ টাকা।

বিক্রি করে দেওয়া সন্তানের উপর আর মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই তাই শেষবারের মতো সুন্দর রমণীর কোলে থাকা নিজের সন্তানের কপালে একটি চুমু এঁকে দিয়ে টাকা গুলো একটা কাপড়ের সাথে পেঁচিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। যেখানে নুরাইসার জীবনসঙ্গী , প্রাণপ্রিয় স্বামী রাসেল হাওলাদার প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। মাস পাঁচ আগে রাসেলের শরীরে ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে , ডক্টর বলেছিল যথা সময়ে চিকিৎসা না করলে তাতে ক্যান্সার ধরা পড়বে।চার বছরে ১৩ মাসের একটি ছেলে সন্তান নিয়ে অভাবের সংসারে অফুরন্ত ভালবাসায় বেশ ভালই কাটছিল তাদের সংসার জীবন। কিন্তু রাসেল যখন জানতে পারে তার মৃত্যু রোগ ধরা পড়েছে, সে যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল তখন। একেতে অভাবের সংসার তার ওপর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী আর ১৩ মাসের সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তায় নিজেকে কুড়ে খাচ্ছিল রাসেলের।পারছিলো না নুরাইসা কে নিজের ব্যাধির কথা বলতে।

রাসেল হাওলাদার গ্রামের মাতব্বরের পাঁচ টি সন্তানের মধ্যে সবার ছোট ছেলের ছিল তার উপরে এক বোন তার নিচে আর একটা বোন বাকি দুই ভাই বড় ছিল। গ্ৰামে রাসেলদের অবস্থা ধনীদের ভেতরে ১ম স্তরে তাদের পরিবার ছিল। অর্থ সম্পদ নাম ডাক বংশিয় পরম্পরা অহংকারে ভরপুর ছিল তাদের পরিবারে।আর নুরাইসার বাবা একদম সাদামাটা জীবন যাপন করতো গ্ৰামের হাটে হাটে কাঁচা সবজির দোকানে চায়ের দোকানে পানি বয়ে বয়ে দিতেন এর থেকে যা টাকা পেত তা দিয়েই তাদের সংসার চলতো। নুরাইসার মা গ্ৰামে মানুষের কাঁথা সেলাই করে ও কিছু টাকা রোজগার করতো। দুই টি সন্তান ছিল তাদের। নুরাইসা বড় ১৭বছরের কিশোরী আর নুরাইসার ভাই রাইবাদ ১২ বছরের দুষ্ট ছেলে ছিল। না জানিয়ে মানুষের গাছের আম আতা লিচু পেরে খেতে বেশ মজা পেত। কাঁচা আম পেরে এনে নুরাইসার হাতে দিলে তা কাঁচা মরিচ আর সরিষা দিয়ে মাখিয়ে দুই ভাই বোন মজা করে খেতো। একদিন রাইবাদ গ্ৰামে রাসেলদের বাগান থেকে কাঁচা আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে বাগানের চোকিদার জলিল মিয়ার হাতে, সেদিন পুরো এক বেলা বেঁধে রেখেছিল রাইবাদ কে । সাথে কটু কথা আর মা বোন বাবাকে নিয়ে আজেবাজে গালি দেয় জলিল মিয়া রাইবাদ কে। বোনের সম্পর্কে অত্যাধিক কটু কথায় হৃদয় ভেঙ্গে ছাড় খার হয়ে যায় রাইবাদ এর। ছোট মানুষ নিজের ও জেদ ধরে যে আর কোন দিন মরে গেলেও আসবে না এই বাগানে।

কিন্তু সেদিন নুরাইসা রাইবাদ কে বলে সেদিন যে গাছের আম এনেছিল কাঁচা মিঠে আম সেটা নুরাইসার খেতে মন চাইছে খুব। রাইবাদ বুঝতে পারে কোন বাগানের আমের কথা তার বোন বলছে। সে যে প্রতিঙ্গা করেছে আর ঐ বাগানে যাবে না আর সেই গাছের ঢাসা ঢাসা কাঁচামিঠে আম ও এনে দিতে পারবে না কারণ মা-বাবা কে নিয়ে বাজে কথা বললেও তারা বোনের বিষয়ে যে কথা গুলো বলেছে তা কতটা ব্রিশ্রী ছিল , তার গায়ে বেঁধে ছে কথা গুলো। কিন্তু তার বোন ভীষণ মন খারাপ করবে যখন জানতে পারবে যে সে তাকে ঐ আম এনে দিতে পারবে না, তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় রাতে সবাই ঘুমিয়ে পরলে যাবে সে গাছের আম আনতে নুরাইসার মন খারাপ সে দেখতে পারবে না কিছু তেই।

রাতে আঁধারে গাছে উঠে ব্যাগ ভর্তি আম নিতেই বাগানের ভেতরে থেকে টর্চ লাইট এর আলো ভেসে আসে বুঝতে পারে রাইবাদ। মনে পরে যায় জলিল মিয়ার কথা-

” এবারের মত ছেড়ে দিলাম, আর কোনদিন যদি এই বাগান মুখো হয়েছিস তো গ্ৰামে সবার সামনে বোনের সাথে তাকে ও চোর বলে প্রমাণ করবো, আর চোরের বাপ হওয়ার অপরাধে বাপের চুল ন্যাড়া করে সারা গ্ৰামে ঘোড়াবো”

কথা টা মনে পড়তেই রাইবাদের বুক ধক করে ওঠে। গাছের নিচে সেন’ডেল টাও রেখে গাছে উঠেছে নিচে নেমে পালানো সম্ভব নয় আবার সেন’ডেল সরানো সম্ভব না তাই ছোট মাথায় বুদ্ধি এলো গাছের ডাল ভেঙে সেন’ডেলের উপর ফেলবে যেন তা দেখা না যায়। করলো ও তাই।

হঠাৎ বাতাস ঝড় ছাড়া গাছের ডাল ভেঙে পরায় জলিল মিয়া এগিয়ে আসে সেই গাছের নিচে, চারিদিকে লাইট মেরে দেখতে থাকে কেউ আছে কিনা। হঠাৎ জলিল মিয়া খেয়াল করে বাগানের এক জায়গায় বেড়া টা ভাঙ্গা আর তা সরানো। রাইবাদ ভয়ে ভয়ে বার বার আল্লাহ কে সরণ করছিল তখন। যেন এবারের মতো তাকে আল্লাহ বাঁচিয়ে দেয়, তার জন্য যেন তার বোন বাবাকে গ্ৰামে সবার সামনে ছোট হতে না হয়।বেঁচে থাকলে সে আর কোনদিন এই বাগানের দিকে চোখ তুলেও তাঁকাবে না। বাবাকে বলে একটা কাচামিঠে আমের গাছ কিনে বাড়ির উপর লাগাবে যেন তার বোন যখন মন চাই নিজে পেরে খেতে পারে।

জলিল মিয়া বেড়া ভাঙ্গা সেদিকে যেয়ে কুল গাছের কাঁটাযুক্ত ডাল ভেঙ্গে সেই ভাঙা বেড়ার জায়গায় অনেকগুলো ডাল রেখে দেয়। ভয়ে বাসা বাঁধে রাইবাদের মনে। এই বাগানের চারিদিকে ইটের দেওয়াল তার উপর কাঁচের টুকরো গাঁথা। শুধুমাত্র ওইটুকু জায়গায় ছোট একটা বেড়া দিয়ে দরজা করা সেখান থেকেই এসেছিল সে। সেই পথটাও বন্ধ করে দিচ্ছে এই খচ্চর জলিল মিয়া । সে এখান থেকে বের হবে কি করে, তার উপর এডালে ও ডালে বেড়ালেও ভুতের ভয়ে হীম হয়ে যায় তার শরীর। জলিল মিয়া একটা চেয়ার পেতে বসে সেই কাটা দিয়ে ঘেরা জায়গার পাশে। রাইবাদ কান্না করে দিবে এমন অবস্থা হয়েছিল তার। জলিল মিয়া একটা বিড়ি ধরিয়ে তা টানতে থাকে কিছুক্ষণ পর ছোট আলো জ্বলতে দেখা যায় মেইন গেট এর থেকে। আর একটা মোটা সোটা লোক এগিয়ে আসে জলিল মিয়ার উদ্দেশ্যে । ছোট আলোটা ছিল মোবাইলের বুঝতে পারে রাইবাদ। মোটা লোকটা কোমর থেকে গামছা খুলে তা বিছিয়ে দুজন মিলে বসে । তার পর ছোট একটা খাম থেকে তাসের কাড বের করে দুজন মিলে খেলা শুরু করে। রাইবাদ গাছের ডালে বসে অপেক্ষা করে কখন তারা খেলা শেষ করে উঠে যাবে আর সে এখান থেকে নেমে পালাবে। বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে গাছের ডালের সাথে পেঁচিয়ে থাকায় একটু ঘুম ঘুম চলে আসে তার চোখে।

হঠাৎ ঝপাৎ করে ভারি কিছু পানিতে পরার আওয়াজ পেয়ে জলিল মিয়া সহ ঐ মোটা সোটা লোক টি লাইট জালি এগিয়ে আসে পুকুরপাড়ের দিকে। আর মোটা আওয়াজ এ জোরে জোরে বলে

” কে রে এখানে আজ ধরা পরলে তার কলি’জাটা বের করে খা’ব। রোজ রোজ বাগানে চুরি করার শখ ঘুচিয়ে দেবো। একবার হাতে পায়, জনমের শিক্ষা দিব”

রাইবাদ যে গাছের সাথে পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে ছিল সেই ডাল ভেঙ্গে নিচে পড়ে। নিচে ছিল পুকুর। রাইবাদ ধরা পড়ার ভয়ে পানির নিচে শ্বাস আটকে রাখে, সে এটা অনেক করেছে পুকুরে গোসল করার সময়। এক হাত দিয়ে ভেঙে যাওয়া ডালটা উঁচু করে ধরে যেন জলিল মিয়া বুঝে যে ডাল ভেঙ্গে পরেছে পানিতে। রাইবাদের মনে একটা ই কথা আওড়ায় তার জীবন গেলেও সে ধরা দিবে না এই খচ্চর জলিল মিয়ার হাতে। জলিল মিয়া যদি একবার জানতে পারে রাইবাদ আবারো এই বাগানে আম চুরি করতে এসেছে তাহলে সারা গ্রামের তুলকাম বাধিয়ে দিবে সাথে তার বোন বাবা কে ছোট করে দেবে।

জলিল মিয়া টর্চ এর আলো জ্বালিয়ে চারিদিকে দেখল কিন্তু কোন মানুষের আভাস পেল না। মোটাসোটা লোকটা আর জলিল মিয়া পুকুর পাড়ে বাঁধানো ঘাটের ওপর বসে দুইটা বিড়ি ধরিয়ে খেতে থাকলো। আর বিরক্ত নিয়ে বলল

‘শালা খেলার মনোযোগটা হারিয়ে গেল’ আজ আর খেলবো না। মনে হয় বাগানের ভেতরে কেউ আছে। আজ যদি ধরতে পারি…

রাইবাদ শ্বাস আটকে রাখার কিছুক্ষণ পর মাথা ঝিম ধরে আসে নাক দিয়ে মুখ দিয়ে পানি প্রবেশ করে শরীরের ভিতরে। তবুও বোন আর বাবার কথা মনে হতেই সেই কষ্ট যন্ত্রণা নিজের মধ্যে সহ্য করার চেষ্টা করে ‌ এক সময় হাত দিয়ে ধরে রাখা ডাল টা আগলা হয়ে যায়। নিস্তেজ হয়ে পড়ে রাইবাদের পুরো শরীর পানির ভেতরে..

#চলবে…