স্বামী পর্ব-০৯(শেষ পর্ব)

0
304

#স্বামী
পর্ব : ০৯( শেষ পর্ব)
#মেঘা_মেহেরাব

কারণ যাওয়ার আগে চাচার কাছে রাসেলের গুণগান শুনে খুব ভালো লেগেছিল তারপর যখন জানতে পারে তার একটি বাচ্চা আছে সে রাসেল কে আর যেতে দিতে চাই নি। কারণ অবসর সময়ে একটা বাচ্চা সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াতে দেখার খুব শখ তার, হোক না তা পরের। রাসেল ও আর অমত করে নি তাছাড়া এ গ্ৰামে ফিরে গেলে বাচ্চা টা যখন বড় হবে তখন যদি দেখে তাদের একঘরে রাখা হয়েছে তখন তার মস্তিষ্কে ব্যাঘাত ঘটবে যা রাসেল না।

কেটে যায় আরো তিন মাস বাড়ির মালিক উঠেছেন দ্বিতীয় তলায় নিচ তায়ালা ফাকা তৈরি করা জিনিস পত্র রাখা। তৃতীয় তয়ালায় কাজ চলছে । হঠাৎ করে কিছু দিন ধরে হটাৎ রাসেল নিজেকে দূর্বল মনে করে। মাথা টা মাঝে মাঝে খুব যন্ত্রণা করে একটু ঘুমোলে আবার ঠিক হয়ে যায়। তবে যন্ত্রণাটা খুব ঘনঘন হতে থাকে । গ্ৰাম্য ডক্টর দেখালে ৪-৫০০ টাকার ঔষধ দেয়। রাসেল তার কোন কোনো টা কিনে খেতো বাকি টা আর কিনতো না। ছেলেটা মায়ের বুকের দুধ কম পায় তাই রাসেল কৌটা দুধ কিনে খাওয়া তো। ছেলের খরচ দিন দিন বারতে থাকে। এর মধ্যে একদিন খবর পায় তার বাবা মাতব্বর সাহেব বুকের ব্যাথায় ছটফট করলে তাকে হসপিটালে নেওয়ার সময় ইন্তেকাল করেন। রাসেল খবর পেয়ে ছুটে যায় , কিন্তু খবর টা তার কানে আসতে দেরি হয়ে যায়। তিন দিনের দোয়ার পর পঞ্চম দিন রাসেল আসে নিজের গ্ৰামে নিজের বাড়িতে। তখন প্রথম বারের মত আবার ও রাজন রাসেল কে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আর চিল্লিয়ে বলে

আব্বা মরছে পাঁচ দিন হয়ে গেছে এখন লোক দেখাতে পারেন এসেছিস? গ্ৰামের মানুষ বুঝে সব এখন আইছে সম্পত্তির ভাগ নিতে।

রাসেল যেন সেখানেই গেথে যায়। গ্ৰামের মানুষ ও রাজনের কথায় সায় দেয়। পরিবারের সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয় রাসেলের থেকে। রাসেল ফিরে যায় আবার চার গ্ৰাম দূরে।আগের থেকে রাসেলের অসুস্থ তা আরো বেড়ে যায়। নুরাইসা বার বার বলে শহরে যেয়ে ডক্টর দেখাতে কিন্তু রাসেল অবহেলা করে তা‌, সে এক মুহূর্ত আর আপন মানুষের কাছ থেকে দূরে যেতে চাই না কেন যেন একটা ভয় কাজ করে তার ভেতরে। বাড়ির নতুন মালিকের বৌ সারাদিন নুরাইসার বাচ্চা কে নিজের কাছে রাখতেন ছেলে টা খুব মিষ্টি দেখতে। নুরাইসার ও খুব ভালো লাগে। এতো সুন্দর এক সুন্দরী মহিলা যার খুঁত ধরতে দূরবিক্ষ ও যেন হিম সিম খাবে । অথচ আল্লাহ তার ভেতর সব চেয়ে বড় খামতি টা ঠেসে দিয়েছেন। বন্ধা নারী তিনি, তার রূপের ঝলকানি দেখে ই তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর জানতে পারে সে কোন দিন মা হতে পারবে না।

বাচ্চার যখন বছর পুরে গেল তখন একদিন বাড়ির নতুন মালিক রাসেল কে কোন এক দরকারে শহরে নিয়ে যায়। আর সাথে রাসেল কে ভালো ডক্টর দেখাবে বলেন যদিও তাতে রাসেলের সম্মানে লাগে তবে লোক টা এখানে আসার পর থেকেই রাসেল কে খুব ভালোও বাসেন। ছোট ভাই বলে ডেকেছে রাসেল কে তাই রাসেল ও কিছু বলতে পারে না। এক সপ্তাহ পর রাসেলের রিপোর্ট আসে রাসেল সেদিন একাই সেই রিপোর্ট আনতে যায়, রিপোর্ট এ যা আসে তাতে রাসেলের পায়ের থেকে যেন মাটি সরে যায়। রাসেলের ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছে তার অপারেশন করতে হবে দ্রুত তবুও খুব রিক্স নিয়ে করতে হবে দেরি করলে তাতে ক্যান্সার হয়ে যাবে। এখন অপারেশন করলে লাক্ষ পাঁচের মধ্যে ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবেন বলে আশা করা যায়। ছেলের দুধ কিনে পুরো সংসার চালাতে যেখানে হিমসিম খেয়ে যায় সেখানে ৫ লাক্ষ টাকা দিয়ে অপারেশন করাতে হবে মানে এটা তার কাছে বামোন হয়ে আকাশের চাঁদ ধরতে চাওয়া মাত্র।বাসায় ফিরে রাসেল নুরাইসা কে কিছু বলতে পারে না শুধু নুরাইসা আর ছেলে কে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতো। ভেতরে ভেতরে নিজেই যেন শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তবে নিজের যাই হোক ছেলে আর নুরাইসার ভবিষ্যতের কথা তাকে ভাবতে হবে আগে। নুরাইসা কে শক্ত হতে হবে সত্য জানতে হবে নয়তো মেয়েটা আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে হয়তো নিজেকে ই শেষ করে দিবে।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরো কিছু দিন ছেলের বয়স এখন ১৭ মাস মত হবে । একদিন সকালে রাসেলের মুখ থেকে নাল বিজলে বের হয়ে ঙ্গান হারায় উঠানে। নতুন বাড়ির মালিক সাথে সাথে রাসেল কে শহরে হসপিটালে নিয়ে যায়। ভর্তি, পরীক্ষা সব করানো হয় আবার। জানতে বাকি থাকে না রাসেলের অসুস্থতার কারণ কি । নুরাইসা রাসেলের রিপোর্ট শুনে ঙ্গান হারায়, যখন ঙ্গান ফেরে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিস্কার করে ‌, আমার #স্বামী বলে এক চিৎকার দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে ,পরে জানতে পারে রাসেল কে ইমারজেন্সি অপারেশন না করালে মৃত্যু ৭০ভাগ নিশ্চিত আর বেঁচে থাকলে প্যারালাইজড হয়ে যাবে পরে কিছু দিন ভুগে মারা যাবে‌ । মোট কথা বেঁচে থাকার চান্স ২০ ভাগ তাও জিন্দা লাশ হয়ে। নুরাইসা তৎক্ষনাত ডক্টরকে অপারেশন করতে বলে কিন্তু ডক্টর জানাই অপারেশন করতে হলে আজকের মধ্যে সাড়ে চার লক্ষ টাকা জমা দিতে হবে। নুরাইসা সাড়ে চার লক্ষ টাকা র সংখ্যা শুনে দুই পা পিছিয়ে যায়। এতো টাকা সে কোথায় পাবে তাও আজকের মধ্যে?

নতুন বাড়ির মালিকের বৌ কুহেলিকারকে জরিয়ে ধরে কেঁদে দেয় নুরাইসা। নুরাইসার ছেলে নুরাইসার বাবার কাছে। রাসেল কে আইসি ইউ তে রাখা হয়েছে। কুহেলিকা নুরাইসা কে শান্ত হতে বলে। বাসায় এসে শান্ত হয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে টাকার ব্যবস্তা করতে হবে, তিনি যথাসম্ভব নুরাইসাকে শান্ত করার চেষ্টা করে ।কিন্তু নুরাইসার কান্না কি থামে তাতে? কুহেলিকা তার হাসবেন্ড আর নুরাইসার বাবা কে হসপিটালে রেখে নুরাইসা আর তার বাচ্চা কে নিয়ে বাসায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। আর নুরাইসা কে বলেন কান্না করলে চিকিৎসার টাকা আসবে না বরং বাসায় ফিরে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নুরাইসা হসপিটাল থেকে আসবে না তবুও কুহেলিকা বাচ্চাটার দোহাই দিয়ে এক প্রকার জোর করে বাসায় নিয়ে আসে। এটাও বলেন বাসায় ফিরে রাতের ভেতরে টাকার ব্যবস্তা করে হসপিটালে দিতে হবে এখানে থাকলে টাকা উরে আসবে না সেচ্ছায়। নুরাইসার মাথায় কথা টা খুব যত্ন করে ঢুকে যায় । কথা টা সত্যি তাকে টাকার ব্যবস্তা করতে হবে যা এখানে থেকে সম্ভব নয় জোগাড় করা। যদিও বাসায় গিয়ে ও এতো টাকা একদিন জোগাড় করা এমন অভাবের সংসারে কোন ভাবেই সম্ভব নয় নুরাইসার পক্ষে ।বাসায় ফিরে ও নুরাইসা টাকা জোগাড় করার কোন কূল কিনারা করতে পারে না। বুকের সন্তান টিকে বুকে নিয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে নুরাইসা।

কুহেলিকা নুরাইসার এমন কান্না দেখে নিজের মনে এক অদ্ভুত চাওয়া, পাওয়ার জন্য জানান দিলো। তিনি আদৌ যানে না তার এই চাওয়া টা এই মুহূর্তে বলা টা ঠিক হবে কি না তবে এই মুহূর্ত টা সঠিক মনে হলো তার। তিনি নুরাইসার কাঁধে হাত রেখে বলল

– জানিনা কথাটা বলা আমার এই মুহুর্তে ঠিক হচ্ছে কিনা। তুমি আমাকে ভুল বুঝনা বোন । আমি নিরুপায় তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি।

নুরাইসা কান্না থামিয়ে চোখের পানি মুছে কুহেলিকার দিকে তাকিয়ে থাকে তিনি কি বলবে তাই বোঝার চেষ্টা করছে যদিও তার এখন বোঝার শক্তি টুকু নেই।

– এতগুলো টাকা তোমার পক্ষে এই মুহূর্তে জোগাড় করা কিছুতেই সম্ভব নয় আমি জানি। আর কেউ শুধু শুধু এতো টাকা তোমাকে দিবেও না। তাই বলছি..

– বলেন আপা , বলেন কি করলে আমি এতো টাকা পাবো আমার #স্বামী কে বাঁচাতে?

– এবার তুমি আমাকে স্বার্থপর বলতে পারো। তবে এটা আমার স্বার্থপরতা নয় ,আমি বলব এইটা আমার দুর্বলতা। যদিও এটা আমার দূর্বলতা তবে তোমার কাছে এটা কিছু ই না। কিন্তু তোমার এখনকার পরিস্থিতি আমার দূর্বলতার কাছে আরো অসহায় ‌

– আপনি শুধু একবার বলেন আপা, আমি যে কোন ভাবে শুধু আমার #স্বামী র জীবন বাঁচাতে চাই। আমার আর কিছু চাই না আপা , আপনি আমাকে একটা উপায় খুঁজে দেন( কাঁদতে কাঁদতে বলল নুরাইসা)

– তুমি তোমার মূল্যবান একটা সম্পদ এর বিনিময়ে তোমার #স্বামী র জীবন বাঁচাতে পারো।

– মূল্যবান সম্পদ? কিন্তু আমার জীবনে মূল্য বান সম্পদ বলতে যে কিছু নেই আমার #স্বামী সন্তান আর বাবা ছাড়া?

– তুমি তোমার সন্তানের বিনিময় তোমার #স্বামী কে বাঁচাতে পারো।

– কি বলতে চান আপনি আপা , আমি কিছু বুঝতে পারছিনা আমাকে একটু বুঝায় বলেন আপা?

কুহেলিকা নুরাইসার এক হাত ধরে নিজের হাতে লুফে নিয়ে বলল

– তোমার #স্বামী র চিকিৎসা হতে যত টাকা লাগে আমি দেবো বিনিময় তোমার ছেলেটাকে সারাজীবনের জন্য আমাকে দিয়ে দাও । তুমিতো চাইলে রাসেল সুস্ত হলে আবার মা হতে পারবে কিন্তু আমি..

– কি বলতেছেন আপনি এইসব? আপনি পাগল হয়ে গেছেন আপা, আপনি পাগল হয়ে গেছেন। মা হয়ে আমি নিজের সন্তানকে বিক্রি করব টাকার জন্য? নিজের স্বামীকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে এখন কি আমাকে আমার সন্তানের বলিদান দিতে হবে? এত ই কি নিষ্ঠুর এই পৃথিবী আপা?

– তুমি আমাকে ভুল বুঝনা নুরাইসা, আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি। একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো রাসেলকে আজ রাতেই অপারেশন করতে বলছে ডক্টর , মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তুমি এত টাকা আকাশ-পাতাল খুড়লেও কেউ তোমাকে দিবেনা । কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি তোমার হাজবেন্ডের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ সব আমি দিবো‌ এমনকি সে পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর্যন্ত তার সব দায়িত্ব আমার থাকবে। তাতে যতদিন সময় লাগুক যত টাকা ব্যয় হোক না কেন। এমন সুযোগ তোমাকে কেউ দেবেনা নুরাইসা। একটি সন্তানের বিনিময় তুমি আবার তোমার স্বামীকে ফিরে পেতে পারো রাসেল সুস্থ হলে তুমি তো আবার মা হতে পারবে একবার ভেবে দেখো..

নুরাইসার মনে পরে সে যখন হসপিটালে ভর্তি ছিল এখন কার তুলনাই তখন পরিস্থিতি এতো করুণ ও ছিল না অথচ তখন রাসেল তাকে জড়িয়ে ধরে সবার সামনে বলেছিল

“আমার ঢ শরীরের এক ফোটা র’ক্ত বিন্দু থাকতে সে নুরাইসার কিছু হতে দিবে না।”

চোখ বন্ধ করে নেয় নুরাইসা বিয়ের দিন রাতে রাসেলের বলা সেই একটা কথা আজ কানে যেন বার বার ঝংকার দিয়ে বাজছে

“একদিন তোমার এই হাত দুটো ভয়ংকার কাজ করে বসবে আমার জন্য” সেদিন বুঝবে কতটা ভালো বাসো তুমি আমায়।

নুরাইসা হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলল

– আমার অতটুকু দুধের বাচ্চাকে আমি কি করে বিক্রি করে দিতে পারি আপা ? আল্লাহ পাপ দিবে আমাকে। রাহ..রাসেল সুস্থ হয়ে যখন জানতে পারবে আমি আমাদের সন্তান বিক্রি করে দিয়েছি আমাকে ও ক্ষমা করতে পারবে না আপা ও , আমাকে ক্ষমা করতে পারবে না।

– আমি তো তোমাদের সন্তান তোমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছি না। তোমারা এখানে থাকবে সবসময়। তোমাদের চোখের সামনেই ও বড় হবে তোমরা ওকে ধরতে পারবে, ছুঁতে পারবে , আদর করতে পারবে, তোমরা দেখাশোনা করবে ওর। শুধু ওর পরিচয় টা আমাদের সন্তান হবে। ও মা বাবা বলে আমাদের কে ডাকবে।

– নিজের গর্ভে ধরা সন্তান চোখের সামনে অন্য কাউকে মা বলে ডাকবে? এটা মা হয়ে আমি কি করে সহ্য করবো আপা? প্রতিটা মা বলে, সন্তানের শক্তি হয়, আমার বেলায় কেন উল্টো হবে আপা? তাহলে আমি কি সত্যি ই এতটাই অসহায় যে নিজের সন্তানকে কে বিক্রি করতে হবে নিজের স্বামীকে বাঁচাতে?

– তুমি বিষয়টা এভাবে দেখছো কেন নূরাইসা? ঠান্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখো তুমি তোমার সন্তানকে হারাবে না আমি কথা দিচ্ছি শুধু মা ডাক থেকে বঞ্চিত হবে শুধু ঐ বাচ্চাটার ক্ষেত্রে। তুমি তো আবার মা হতে পারবে ,মা ডাক শোনা তোমার জন্য কষ্টের নয়। রাসেল সুস্থ হলে তুমি আবার মা হতে পারবে। তুমি জানো অতটুকু বাচ্চাকে যখন আমি কোলে নি আধো আধো বুলিতে মা মা বলে ডাকতে শুনি আমার মাতৃত্ব জেগে উঠে। ও যখন আমার কাপড় ভিজিয়ে দেয় একটু বিরক্ত লাগে না খুব আনন্দ হয় আমার কেন হয় বলতে পারো? ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলে তুমি জানো না ও আমার বুকের সাথে এমন ভাবে লেপ্টে থাকে যেন ও আমার অংশ। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কতবার ফরিয়াদ করেছি, আল্লাহ তুমি আমার বুকে এক ফোঁটা দুগ্ধ দান করো যেন আমি ওকে তা পান করিয়ে আমার মা হওয়ার তৃপ্তি টা মেটাতে পারি।

– আপা..

– একবার তুমি ভাবো রাসেলের যদি কিছু হয়ে যায় তুমি একটা মেয়ে হয়ে ঐ টুকু বাচ্চাকে নিয়ে কিভাবে মানুষ করবে? ওর ভবিষ্যত টা কেমন হবে? তোমার বাবা তার শরীর টাও তো ভালো না যখন তখন কিছু হতে পারে। এই সমাজ তোমাকে একটা বাচ্চা নিয়ে কেমন ভাবে বাঁচতে দেবে , একবার ভাবো?

———–

প্রিয় মানুষের বিপদের সময় অচেনা শহর টা ও চেনা হয়ে যায়। নুরাইসা কাপড়ে পেচানো টাকাগুলো নিয়ে হসপিটালে জমা দিয়ে দেয়। হাত কাঁপছে তার। সাড়ে চার লক্ষ টাকার বিনিময়ে এই হাত দিয়ে সে ভয়ঙ্কর একটা কাজ করে এসেছে কিছুক্ষণ আগে নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দিয়েছে। রাত ১১ টার পর রাসেলের অপারেশন শুরু হয় , তিন ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর জানায় অপারেশন সাকসেসফুল তবে সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে। অপারেশন এ ওটির খরচ ছিল সারে চার লক্ষ টাকা তবে অপারেশনের পর ওষুধ বাবদ আরো অনেক টাকার প্রয়োজন হয় কুহেলিকা সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন রাসেলের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত। টানা ১৮ দিন পর রাসেলকে নিয়ে গ্ৰামের বাড়িতে ফিরে যায় নুরাইসা। রাসেল আগের থেকে সুস্থ। সারাদিন অনেক পাওয়ারের ঔষধ সেবনের ফলে ঘুমিয়ে থাকে বললে চলে। একটু সুস্থ হওয়ার পর যখন জানতে পারে তার সন্তানকে বিক্রি করা হয়েছে তার ই চিকিৎসার জন্য তখন পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে অসহায় ব্যাক্তির জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়েছিল। নুরাইসা কে শুধু একবার বলেছিল

-এমন অসহায় বাবা অসহায় স্বামী হয়ে তিলে তিলে প্রতিনিয়ত না শেষ হয়ে একবারে মরে গেলেই ভালো হতো নুরাইসা । এমন একটা ভয়ঙ্কর কাজ তুমি কেন করলে?এই ভাবে নিজের সন্তান বিক্রি করে আমার জীবন বাঁচাতে একবারও তোমার বুক কেঁপে উঠলো না?

অসহায় হয়ে রাসেলের বুকে মাথা রেখে রাসেল কে বলেছিল

– আমি আবার মা হতে পারবো তুমি আবার বাবা ডাক শুনতে পারবে কিন্তু তোমাকে হারিয়ে আমি কি করে বাঁচবো বলতে পারো? আমাকে এভাবে ভালো কে বাসবে বলতে পারো?

—-
তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া অনেক ঠান্ডা ঠান্ডা, গাছপালা দিয়ে শীতল বাতাস বইছে চারিদিকে। চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলা উঠেছে। উদ্দেশ্য এখন ঠান্ডা আইসক্রিম খাবে। কিন্তু তার মা এই ঠান্ডা আবহাওয়ায় কিছুতেই মেয়েকে আইসক্রিম দিবে না। এমনিতেই নাক সিড়সিড় করছে তার , কতবার যে হাঁকছুম দিয়েছে তা গোনার বাইরে। মা খেতে দেবে না তাই মায়ের ওপর রাগ করে দোতালার উপরে উঠেছে বড় মাকে বলবে আইসক্রিম খেতে দিতে। মেয়েটা খুব ভাল করেই জানে এমন সময় সে কিছু চাইলে তার মা তাকে কিছু না দিলেও বড়মা আদর করে কোলে বসিয়ে খুব যত্ন করে সেটা খেতে দিবে। কাপড় নোংরা থাকলেও দুই হাত বাড়িয়ে আগে কোলে তুলে নিয়ে ফটাফট কয়েক টা চুমু এঁকে দিবে । তারপর বলবে

আমার পিচ্চি মা টার কি চাই?

তখন মেয়েটি হেসে বড়মার নাকে একটা চুমু খেয়ে আগে তার মায়ের বিরুদ্ধে নালিশ করবে পরে বলবে তার কি চায়।

সাত বছরের দুষ্টু ছেলে আবির ফ্রিজ থেকে দুই টা আইসক্রিম এর কাপ বাটি বের করে হাতে নিয়ে সোফার উপর বসে আছে। চার বছরের ছোট মেয়ে কুহু দরজা টোকা দিতেই তা খুলে দেয় আবির, তার পর আবির হাঁটু গেড়ে বসে কুহু কে তার কাঁধে উঠতে ইশারা করে। কুহু হেসে ঝপাৎ করে আবিরের কাঁধে উঠে যায় আবির কুহুকে কাঁধে নিয়ে উঠতে গিয়ে ধপাস করে পরে যায় , আইসক্রিমের বাটি চেপ্টা হয়ে যায় কুহুর পিঠের তলে পড়ে। ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে দেয় কুহু। কুহেলিকা রান্নাঘর থেকে হাত মুছতে মুছতে এসে দেখে ছেলে মেয়ে দুইটার অবস্থা করুণ আবির রাগে ফুঁসছে কোমরে হাত দিয়ে আর কুহু পরে যাওয়া আইসক্রিম ফ্লোরে লেপ্টে দিয়ে কান্না শুরু করছে। কুহেলিকা এসে কুহু কে কোলে তুলতে গেলে আবির বলে

বাবাকে কত বলে ছয়টা আইসক্রিম আনিয়েছি ,কাকাই( রাসেল) কে বাবা কে তোমাকে নিজের হাতে খায়িয়েছি সকালে। তিন টা বাটি রেখেছিলাম একটা কাকীমা কুহু আর আমার জন্য। আমার টা সকালে চুরি করে কুহু কে দিয়ে দিছি এখন কাকীমার আর কুহুর টা নিয়ে নিচে যেতে ওকে কাধে উঠতে বলছি , বারবার করে বললাম শক্ত করে গলা ধর ও কাঁধে উঠে আইসক্রিম আমার হাত থেকে নিতে গিয়ে দিল তো পুরাই নষ্ট করে। এখন ওকে আজ আইসক্রিম দিবোই না এটা ওর শাস্তি।( গাল ফুলিয়ে বুকে আড়াআড়ি হাত বেধে বলল) কাকিমা কে কি বলবো আমি এখন?

কুহেলিকা বুঝতে পারে ছেলের এবার রাগ উঠেছে। কি করবে না করবে ভেবে বলল আমি আরো চারটা বাটি সরিয়ে রেখেছি , তুমি রাগ কমালে আমি বাটি চারটা নিয়ে নীচে যেয়ে একসাথে খেতে পারি। হাসি ফুটে উঠে আবিরের ঠোঁটে। কুহু ঝপাৎ ঝপাৎ করে কয়েকটা চুমু এঁকে দেয় কুহেলিকার চোখে নাকে-মুখে।

রাসেল গঞ্জে থেকে একটু আগে ফিরেছে। এখন সে গঞ্জে একটা দোকান কিনে সেখানে সারা বছরের চাউল গুদাম করে রাখে । দাম বাড়লেই তা বিক্রি করে বেশ ভালো টাকা রোজগার করে। কুহেলিকা দোকান ভারার ব্যবস্তা করে দেয় দোকান চালাতে চালাতে এখন দোকান টাই কিনে নিয়েছে রাসেল। হাতমুখ ধুয়ে খাবার খেতে বসতেই হাজির হয় সেখানে কুহেলিকা , তার কোলে কুহু আর এক হাত ধরা আবিরের । আবিরের হাতে ৪ টা আইসক্রিমের বাটি দেখে রাসেল হেসে বিছানা থেকে উঠে পরে। কুহেলিকা কুহু কে বেডের উপর ছেড়ে দিয়ে আবিরের থেকে একটা বাটি তার হাতে দিতেই খুশি হয়ে একা একা খুলে খেতে যায়। এটা কি হলো বাটি অতি আনন্দে খুলতে গিয়ে তার থেকে কিছু টা পরে গেছে ‌, কুহু এবার ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে দিবে তার আগেই আবির বলে ওঠে

– খবরদার কাকিমা ! তোমার বাটি যেন ওকে একটুও দিবেনা ।আম্মু( কুহেলিকা) তুমি ও দিবে না পচা মেয়ে সব সময় খালি নষ্ট করে।

– তুমি পচা, আম্মা ভাইয়া পচা শুধু আমাকে বকে। বড়মা ভাইয়া পচা না বলো?

– তুই পচা। কাকাই( রাসেল) চলো পুকুর পাড়ে বসে তুমি আর আমি এই বাটি খাবো। আগে আমি খাবো পরে তুমি ঠিক আছে?

– হেসে বলল ঠিক আছে কাকাই..

রাসেল আবির কে কোলে নিয়ে বের হলো, পুকুর পাড়ে বসে ছেলে আর সে একসাথে বসে আইসক্রিম ভাগ করে খাবে। আবিরের যেন রাসেলের প্রতি একটা আলাদা টান। হয়তো একেই বলে ” র’ক্ত কথা বলে”

কুহেলিকা কুহু কে তার বাটি টা দিয়ে বলল এই দুইটা ই তুমি খাও আমি খেয়েছি আর খাবো না। নুরাইসা হেসে দেয়। এই নারীটি যেমন সুন্দর তেমনি তার মন । তারা সবাই একটা পরিবার গ্ৰামের সবাই কে বলে।

রাতে কুহু ঘুমিয়ে যায় রাসেল নুরাইসা কে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয় কপালে একটা দীর্ঘ চুমু এঁকে দিয়ে বলে

– জানো নুরাইসা ? আমার মনেই হয় না জীবনে আমি কিছু হারিয়েছি । আমার দুটি সন্তান আমার বুকে খেলে তখন কি আনন্দ হয় তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। তখন মনেই হয় না ছেলে আর আমাদের নেই..

– সত্যি বিপদের সময় তারা আমাদের জন্য যা করেছেন তা কোনো দিন ভোলার নয়।তারা আসলেই খুব ভালো মানুষ। আমাকে ছোট বোনের মত দেখেন

– হিম ঠিক বলেছ । তার পর?

– কি..?

-মেয়ের বয়স চার , একটা ভাই তাও নাকি পচা, তার একটা ভালো ভাইয়া দরকার বুঝলে? এবার আবার একটা ছেলে হলে মন্দ হয় না, কি বলো?

– জি না..

– তুমি না বললে আমি কি শুনবো?

– একদম না , রেগে যাবো কিন্তু

– তাতে আমার সমস্যা নাই…
*
*
*
***সমাপ্ত****