স্বামী পর্ব-০২

0
192

#স্বামী
পর্ব : ০২
#মেঘা_মেহেরাব

রাইবাদ শ্বাস আটকে রাখার কিছুক্ষণ পর মাথা ঝিম ধরে আসে নাক দিয়ে মুখ দিয়ে পানি প্রবেশ করে শরীরের ভিতরে। তবুও বোন আর বাবার কথা মনে হতেই সেই কষ্ট যন্ত্রণা নিজের মধ্যে সহ্য করার চেষ্টা করে, ‌ এক সময় হাত দিয়ে ধরে রাখা ডাল টা আগলা হয়ে যায়। নিস্তেজ হয়ে পড়ে রাইবাদের পুরো শরীর পানির ভেতরে..

সকাল বেলা মাতব্বরের বাগানবাড়ি পুকুরে রাইবাদের লা’শ ভেসে ওঠায় গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ এসে জড়ো হয়েছে বাগানবাড়ির পুকুর পাড়ে।রাইবাদের বাবা হাটের থেকে উরো খবর পেয়ে ছুটে আসে বাড়িতে বেগম কে জানাই খবর টা, তিনি বলেন সে ও এমন খবর শুনেছে। ছেলে ঘুম থেকে ওঠে ৯-১০ টায়। উঠে যদি খাবার না পায় আর সারাদিন তাকে খুঁজেও কিছু খাওয়ানো সম্ভব না।আর নুরাইসা সেই সকালে কিছু না খেয়ে পড়তে গেছে সেখান থেকে আবার স্কুলে যাবে, টিফিনে ফিরে এসে খেয়ে আবার স্কুলে যাবে ফিরতে বিকাল হয়ে যাবে। তাছাড়া তিনি ছেলেকে হুঁশিয়ার করে দেখাতে নিয়ে যাবেন মাতব্বদের বাগানবাড়িতে।

বেগম খুপির মতো ছোট বেড়া দিয়ে ঘেরা নুরাইসার ঘরের বারান্দায় থাকা ঘরে যেয়ে যখন রাইবাদ কে দেখতে না পায় তখন তার বুক টা ছ্যাত করে ওঠে। এক চিৎকার দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে নুরাইসার বাবা কে ধরে বলে

– ও গো রাইবাদ তো নেই..

দুজন দৌড়ে যায় মাতব্বারের বাগান বাড়ি। ভীর ঢেলে যেতেই রাইবাত কে দেখতে পাই হাফ প্যান্ট আর হাফ হাতা ভেজা শার্ট পরে টান টান করে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে তাকে। গগন ফাটানো এক চিৎকার দিয়ে হুমরি খেয়ে পরে রাইবাদের বুকের উপর বেগম। নুরাইসার বাবা ধপ করে লুঙ্গি পরা অবস্থায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। গামছা দিয়ে মুখ চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব?

নুরাইসা রাইবাদের খাটিয়া দুই হাত দিয়ে ধরে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে রাইবাদের মুখের পানে। বেগম কয়েক হাত দূরে হাত পা ছড়িয়ে বসে কাঁদছে , পাশেই এক গ্রাম্য মহিলা বেগম কে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে বেগম বুকে হাত দিয়ে থা’বরিয়ে থা’বরিয়ে কান্না করছে । নুরাইসার বাবা তার থেকে একটু দূরে বারান্দায় বাশের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। এমন সময় গ্রামের মাতব্বর সাহেব এবং তার তিন ছেলে আসে রাইবাদের কাফন দাফনের ব্যবস্থা ঠিক করে করা হয়েছে কি না দেখতে।স্কুল ড্রেস পড়া এক কিশোরী লাশটির খাটিয়া ধরে বসে থাকতে দেখে মাতব্বর সাহেবের ছোট ছেলে রাসেল হাওলাদারের মনে ছনাৎ করে উঠে। মাতব্বর সাহেব গ্রামের মহিলাদের কে উদ্দেশ্য করে বলে

– মেয়ে টাকে এখান থেকে নিয়ে যাও

মাতব্বরের কথা বলা শেষ হতে না হতেই দুইজন মহিলা এসে নুরাইসাকে দুই পাশ থেকে ধরে উঠাতে যায়। তখনই নুরাইসার গগন ফাটানো চিৎকার শোনা যায়।

– ভাইরে এ ভাই, তুই আমাকে একা রেখে চলে গেলি? আমি এখন কার সাথে গল্প করবো ভাই..? এভাবে হাড়াই গেলি কেন ভাই বল না ,বল না ভাই, আমি একা কি করে থাকবো তোকে ছাড়া..

রাসেল হাওলাদার নুরাইসার কান্না দেখে নিজের বুকে ব্যথা অনুভব করলো। গ্ৰাম্য মহিলা দুই জন নুরাইসা কে নিয়ে যেতে পারছে না রাইবাতের খাটিয়ার কাছ থেকে। বার বার নুরাইসা কান্না করছে আর পাগলের প্রলাপ ভাইকে ডেকে ই যাচ্ছে‌।রাসেল হাওলাদার আরো দুই মহিলা কে ডেকে বলল নুরাইসাকে নিয়ে যেতে ,রাসেলের কথা মতো দুই মহিলা গেল , তিন জন মহিলা নুরাইসাকে সরিয়ে নিয়ে আসে জোর করে।

তিন দিন পর রাইবাদের জন্য একটা দোয়ার আয়োজন করে মাতব্বর সাহেব। সেখানে উপস্থিত গ্ৰামের সবাই ছিল। মাতব্বর বাড়ি থেকে দুপুরে নুরাইসার বাবা মা আর তার জন্য খাবার পাঠায় রাসেল হাওলাদার এর নেতৃত্বে। খাবার এর বাটি খুলতেই মুরগির মাংসর ঝোল ছিটা রুটি, ইলিশ মাছ ভাজা, ডিমের কোরমা আর ছোট মাছ চচ্চরি বের করে বেগম ‌। রাসেল হাওলাদারকে একটা টুল পেতে বসতে দেওয়া হয়। যদিও বসার ইচ্ছা নেই রাসেলের তবু ও কেন যেন সে বসে পরলো। রান্নার কড়া ঘ্রাণ নুরাইসার নাকে আসতেই নুরাইসা দ্রুত ঘর থেকে এসে মাংসর বাটি ধরে চোখ বড় বড় করে বললো

-ভাইয়ের প্রিয় খাবার আম্মা এটা, ছিটা রুটি আর মুরগির মাংসর ঝোল..

রাসেল এই প্রথম নুরাইসার পুরো মুখ টা দেখতে পেলো। কেমন বাচ্চা বাচ্চা টাইপ একটা মেয়ে। চিকন ছিপ ছিপে গঠনের শরীরে ডান ভ্রুর ঠিক মাঝখানে উপরে একটা গাঢ় কালো তিল ,পাতলা ঠোঁট, মাঝারি সাইজের নাক , গায়ের রং ফর্সা না হলেও শ্যামলার মধ্যে যেন নজর কড়া। নতুন যৌবনে পা দিয়েছে হয়তো তাই এতো অমায়িক সুন্দরযো ভর করেছে বুঝতে পারে রাসেল ‌।

নুরাইসা বাটি দুই টা দুই হাতে নিয়ে ছুট দেয় রাইবাদের কবরের কাছে। বেগম হতম্বিত হয়ে তাকিয়ে দেখে মেয়ের যাওয়ার দিকে। রাসেল নুরাইসার মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দেখে তিনি মুখে শাড়ির আঁচল গুজে কান্না করছে।আজ তিন দিন ধরে নুরাইসার এমন পাগলামী সে দেখছে‌, খাবার নিয়ে ভাইয়ের কবরের কাছে যেয়ে ভাইকে ডেকে তোলার চেষ্টা করে, কিন্তু হায়! তা কি কখনো সম্ভব? রাসেলের মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে। রাসেল হাওলাদার দ্রুত উঠে নুরাইসার পেছনে যায়। রাইবাদের কবরের পাশে এসে নুরাইসা হাউমাউ করে কান্না করে বলে

– ভাইরে উঠ না! দেখ আমি তোর প্রিয় খাবার এনেছি, খাবি না ভাই? উঠে বস ভাই ,তোকে ছাড়া আমি এগুলো খেতে পারবো না ভাই ,উঠ না ভাই( জোরে চিল্লিয়ে বলল) উঠ বলছি , উঠ নয়তো..

রাসেল হাওলাদার নুরাইসার পেছনে পেছনে এসে দেখে নুরাইসা পাশে খাবারের বাটি রেখে দুই হাত দিয়ে কবর খুঁড়তে যাচ্ছে। রাসেল হাওলাদার দ্রুত এসে নুরাইসার দুই হাত ধরে বাধা দেয়। নুরাইসার কি মনে হলো নুরাইসা এক ধাক্কা দিলো রাসেলের বুকে। আলতো হেলে পরলো রাসেল। নুরাইসা ভয়ে নাকি কি কারণে উঠে আবার দৌড় দেয়‌, নুরাইসার ওড়না পরে যায় রাসেলের সামনে। রাসেল ওড়না নিয়ে নুরাইসার পেছনে পেছনে আবার যায় কিন্তু নুরাইসা তার বাড়িতে না যেয়ে যাচ্ছে রাসেল দের বাগান বাড়ির দিকে। নুরাইসা দৌড়াতে দৌড়াতে বাগানবাড়ির সেই পুকুর পাড়ে আসে যেখানে রাইবাদ ডুবে মারা যায় । এসে ভাই বলে এক চিৎকার দিয়ে ঝাঁপ দেয় পুকুরে।

জলিল মিয়া লুঙ্গি কাছা মেরে পুকুরে ঝাপ দিতে যাবে তার আগেই রাসেল জলিল মিয়ার পাশ কাটিয়ে ঝাঁপ দেয় পুকুরে। প্রায় এক মিনিট পর নুরাইসা কে ধরে টেনে তোলে পানি থেকে । নুরাইসা রাসেলের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য বার বার সরে যেতে চেষ্টা করলে রাসেল নুরাইসা কে টেনে এনে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।

নুরাইসা কে দৌড়ে বাগান বাড়ি আসতে দেখে আবার তার পেছনে মাতব্বরের ছোট ছেলেকে দৌড়াতে দেখে কয়েক জন মহিলা পুরুষ পিছনে পিছনে আসে , দুপুরে বাগান বাড়ির গেট খোলাই ছিল। কিছু মানুষ দৌড়ে বাগান বাড়ি আসতে দেখে তার সাথে সাথে আরো কতগুলো মানুষ দৌড়ে আসে সেখানে। জলিল মিয়া চিৎকার সহ গ্রাম্য পুরুষ মহিলার কথা হট্টগোল শোনা যায় ‌। হুশ ফেরে রাসেলের যে সে নুরাইসা কে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে। কানাঘুষা শুরু হয়ে যায় মহিলা পুরুষ দের মাঝে ‌। নুরাইসার উপর ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করে তারা। রাসেল নুরাইসাকে ছেড়ে দিতেই বুঝতে পারে নুরাইসা ঙ্গান হাড়িয়েছে , হয়তো অতিরিক্ত দূর্বলতার কারণে। একে তো চিকন ছিপ ছাপ শরির তার উপর এই তিন দিনের মধ্যে কিছু খাবার খেয়েছে বলে তো মুখ দেখে মনে হয় না। রাসেল নুরাইসাকে পাজো কোলে তুলে নিয়ে আসে ঘাটে। আলতো শুয়িয়ে দিয়ে পেটে হালকা চাপ দিতে মুখ থেকে একটু পানি বের হলো নুরাইসার। খবর পেয়ে মাতব্বর সাহেব এসে দাঁড়ান সেখানে ‌। ছেলের এমন কাজে একটু নিজেকে ছোট মনে হয় মাতব্বর সাহেব এর। যদিও সে গ্ৰামে সবার সেবা করে আসছে তবে তা লোক দেখানো মাত্র । তার কথার ভাশ্য মতে ,এসব গরিব ছোট মানুষের শরীরে হাওলাদার বংশের কোন পুরুষ স্পর্শ করা মানে নিজের বংশের মানসম্মান সব ধুলোয় মেশানো সেখানে মাতব্বর সাহেব এর ছেলে হয়ে এক তুচ্ছ গরিব ঘরের মেয়ে কে বুকের সাথে লেপ্টে রেখেছিল।

নুরাইসার বাবা, মা দৌড়ে এসে মেয়ের এহেম অবস্থা দেখে খানিকটা ভরকে যায়। মাতব্বর সাহেব বাগান বাড়ির গেট থেকে বেরোনোর সময় তাদের দেখা , চোখ রাঙিয়ে যা বোঝানোর বুঝিয়ে দেয় মাতব্বর সাহেব। ভেতরে এসে মেয়ে কে ঘাটের শানে টান টান হয়ে আধো শোয়া অবস্থায় মানে রাসেল হাওলাদার এর বুকের সাথে মিশে শুয়ে থাকতে দেখে চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নেয়। বেগম হুমরি খেয়ে পরে নুরাইসার পাশে।

বেগম : আআআআ আমার নুরাইসার কককি হয়েছে? কি হয়েছে আমার মেয়ের? মা রে ওঠ ( নুরাইসা কে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলে) এএএই নুরা মা আমার কি হয়েছে তোর উঠ না মা..

রাসেল : আপনি চিন্তা করবেন না ঠিক আছে ও এখন। প্রচন্ড দূর্বল ওর শরীর।তাই …

বেগম : আজ তিন দিন কিছু খাই নাই একটু পানি ছাড়া ( কাঁদতে কাঁদতে বলল) ভাইকে ছাড়া খাবে না কয় খালিইই ..। কি করবো আমি এরে নিয়ে…

রাসেল : বোঝান ওকে , যে চলে যাওয়ার সে যাবে সে যেভাবেই হোক। এভাবে না খেয়ে থাকলে তো নিজের শরীর খারাপ হবে। ভাই নেই মা বাবার শক্তি হতে হবে ওকে।

নুরাইসা চোখ পিটপিট করে তাকায়, রাসেল হাওলাদার কে সামনে বসে থাকতে দেখে ভয়ে মায়ের বুকের সাথে আরো শক্ত করে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। আশে পাশের মানুষ সবাই ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করে দেয়,যত সব বাজে মন্তব্য করতে শুরু করে দেয়।

– শেষ মেষ মাতব্বরের ছেলের বুকে তাও গ্ৰাম বাসির সামনে? এই মেয়ে র কপাল পু’ড়ল বলে।

– মাতব্বর সাহেব নিজের চোখে দেখে গেল।এই গ্ৰাম থেকে তিনি ছলে বলে কৌশলে এই মেয়ে কে বের করেই ছাড়বে …। মনে নাই রোকেয়ার সাথে কি হয়েছিল?

– ইশশ, মেয়ের বাপটাকে মেয়ের একটা ভুলের অপরাধে মাথা ন্যাড়া করে সাড়া গ্ৰাম ঘুড়িয়ে ছিল। শেষ রাতে লজ্জায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করছে বট গাছের ঢালের সাথে। যদিও মেয়েটার অপরাধ ছিল মাতব্বর সাহেবের মেঝ ছেলে তার কাছে বলেছিল একটা বকুল ফুলের মালা গেঁথে দিতে।

– চিন্তা করো তোমরা সামান্য একটা মালা গেঁথে নিজ হাতে দিতে গিয়ে হাত হাত ধরেছিল মেজো ছেলে তা শুধু কানে শুনেই মাতব্বর সাহেব সে কি অবস্থা…

– সেখানে মাতব্বর সাহেব নিজের চোখে দেখে গেল এই মেয়ে কে তার ছেলে বুকে ছিঃ ছিঃ এবার কি হবে এই মেয়ের?

ক্রোধে ফেটে পরে রাসেল মানুষের মুখে এমন কানাঘুষা কথা শুনে। বেগম মাথা নিচু করে মেয়ের কপালে চুমু খায়, চোখ থেকে গলগলিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি পরে তার। নুরাইসার বাবা লুঙ্গি হালকা হাঁটু থেকে উঠিয়ে বসে পরে কপালে দুই বার হাত দিয়ে আঘাত করে বলে

– আল্লাহ গো তুমি সব দেখতাছো , আমার এই বিপদের সময়ে তুমি আমারে আর বিপদ দিও না গো আল্লাহ..

জলিল মিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। তার অনেক দিনের শখ এবার পূর্ণ করা যেতে পারে ভেবে মনে মনে এক তৃপ্তিকর হাসি দিল।

#চলবে….