স্বামী পর্ব-০৬

0
156

#স্বামী
পর্ব : ০৬
#মেঘা_মেহেরাব

বাবার কথার উপর তিনি ও কথা বলতেন না তাই বাবা মারা যাবার পর তিনি যখন প্রথম গ্ৰামের পঞ্চায়েত হিসেবে নিয়োজিত হন তখন থেকে তার ও কোন আপত্তি থাকে না নুরাইসার বাবা এখানে থাকাতে। কিন্তু এখন যখন তিনি চাইছেন না তারা এখানে থাকুক নুরাইসার বাবার ও আর জোর নেই এখানে থাকার। রাসেলের দাদা বেঁচে থাকলে বিষয় টা আলাদা ছিল।

পুরো একটা দিন পার হয়ে যায়। রাসেল হাওলাদার এর বড় ভাই রাজন হাওলাদার নুরাইসাদের বাড়ি খালি হয়েছে কিনা দেখার জন্য আসলে দেখে , রাসেল হাওলাদার সেখানে উপস্থিত শুধু তাই নয় কোদাল দিয়ে মাটি কেটে ঘর উঁচু করে করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং নুরাইসার বাবা বারবার রাসেল কে নিষেধ করছে তবুও সে শুনছে না। রাজন হাওলাদার বরাবরই তার বাবার মতন টাকার অহংকার আর বংশের গৌরবে মানুষকে মানুষ বলে মনে করে না। সম্পত্তির লোভ বরাবর তার একটু বেশি তার উপর মাতব্বরের সাহেব যখন বলেছে রাসেল হাওলাদার কে সম্পত্তির এক কানা করিও দিবেনা এবং লিখিত স্টাম্প তৈরি করেছেন রাসেল হাওলাদার কে সে ত্যাজ্যপুত্র করেছেন । সেখানে ছোট ভাইয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতন লোক সে নয় । রাজন হাওলাদার রাসেলের হাত ধরে থামিয়ে দেয় মাটি কাটতে । দুই ভাইয়ের রেষারেষি শুরু হয়ে যায়। রাসেল হাওলাদার রাজন হাওলাদারের প্রতিটি কথার পাল্টা জবাব কাটতে কাটতে একপর্যায়ে রাজন হাওলাদার রেগে রাসেলের গালে চড় বসিয়ে দেয়। যাবার সময় বলে যাই সে এর বিহিত করেই ছাড়বে। পরোয়া করেনি তাতে রাসেল হাওলাদার। সে তার মতো নিজের কাজ করে গেছে।

কেটে যায় আরো একটা দিন। গ্রামের দুই মাতব্বর সহ রাসেলের বাবা উপস্থিত হয় নুরাইসাদের বাড়িতে সাথে গ্রামের অনেকেই ছিল । রাসেলের সাথে কোন কথা না বলে নুরাইসার বাবাকে উদ্দেশ্য করে গ্ৰামে সবাইকে ডেকে এনে বললেন, এই গ্রাম থেকে তাদেরকে বেরিয়ে যেতে, যদি সসম্মানে না বের হয় আজ থেকে তাদের এক ঘরে করে থাকতে হবে। যদি কোন ব্যক্তি তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে যায় তাহলে তাদের সাথে তাকেও একঘরে করে রাখতে বাধ্য হবেন তিনি। রাসেল তার বাবার সাথে কথা বলতে এগিয়ে আসতে গেলে কোন কথা ছাড়াই হাতের ইশারায় রাসেলকে এগিয়ে আসতে থামিয়ে দিলেন । এবং গ্ৰামবাসীর উদ্দেশ্য করে বললেন

– আমি আমার পরিবার সম্পর্কে কখনোই গ্রামবাসী কে কোনদিন কিছু বলিনি তবে আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেই হচ্ছে যেটা না বললে নয়। গত দুইদিন আগেও আমার তিনটি ছেলে সন্তান ছিল । দুদিন আগে আমি আমার ছোট ছেলের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সব স্মৃতি কে আগুনে পুড়িয়ে আমার পরিবার সহ আমি দাফন করেছি তাকে। এখন থেকে আমার দুটি ছেলে আর দুটি মেয়ে সন্তান আছে সেটাই জানব। গ্রামের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলছি যদি আমার এই চার সন্তান বাদে কেউ যদি আমার পরিচয় নিয়ে আপনাদের কাছে যায় তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবেন এটা আমার অনুরোধ গ্রামবাসীর কাছে।

তিন মাতব্বর আর রাজন হাওলাদার বাদে সবার মুখী রাসেলকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। এটা দেখে রাজন হাওলাদারের মুখে হাসি ফুটে উঠে। রাসেল হাওলাদার চোখ বন্ধ করে তার বাবার প্রতিটা কথা হজম করে নেই। কিছু সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করে থাকে সে। কিছু একটা মনে করে চোখ খুলে স্মিত হেসে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। বিচার শেষ হওয়ার পর যে যার মতন চলে যাই নিজের বাড়িতে। রাসেল হাওলাদার একটা কাঠের তৈরি চৌকির উপর বসে নুরাইসাকে নিজের কাছে ডাকে। নুরাইসা রাসেলের সামনে যেতে ভীষণ ভয় পায়। নুরাইসার বাবা নুরাইসাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে রাসেলের সামনে নিয়ে আসে।

– যদি কিছু মনে না করেন আমি নুরাইসার সাথে আলাদা একটু কথা বলতে পারি?

নুরাইসার বাবা হাসিমুখে নুরাইসাকে রেখে একটু দূরে যেয়ে দা দিয়ে বাঁশের চাটাই বানাতে বসে।নুরাইসা তার বাবাকে যেতে দেখে সেও হাত গুটিয়ে যেতে নিলে রাসেল থামিয়ে দেয় নুরাইসাকে।আর বলে_

– বস এখানে ( চোখ দিয়ে ইশারা করলো তার পাশে বসতে)

নুরাইসা মাথা দুইদিক নারিয়ে না বোঝায় সে বসবে না।

– আমি বাঘ ভাল্লুক কোনটাই নয় যে আমাকে এভাবে ভয় পেতে হবে। তুমি যতটা শান্ত মেয়ে আমি ঠিক ততটাই স্বাভাবিকভাবে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি। তুমি যদি অস্বাভাবিক ব্যবহার করো আমি কিন্তু অশান্ত হয়ে তোমার সাথে কথা বলতে বাধ্য হবো। চুপচাপ এখানে এসে বসো..

নুরাইসা বাধ্য মেয়ের মত রাসেলের থেকে দুই হাত দূরে ছোট একটি ফিড়া নিয়ে হাত কচলাতে কচলাতে বসে পড়ল।

-তোমার পুরো নাম কি?

– নননুরাইসা জান্নাত( আস্তে এবং ধীরে বলল)

– মাশাআল্লাহ, তুমি এখন কিসে পড়ো ? মানে স্কুলে না কলেজে পড়ো?

– ক্লাস টেন এ( মাথা নিচু করে বলল)

– তুমি জানো আমি পড়াশোনায় কতটুক এগিয়েছি?

নুরাইসা চোখ তুলে তাকায় রাসেলের দিকে , এই প্রথম নুরাইসা রাসেলের দিকে এতো কাছ থেকে তাকিয়েছে । রাসেল দেখতে কেমন তা এই কয়দিনের মধ্যে একদিন ও দেখেনি সে। তরতাজা যুবক রাসেল হাওলাদার। মুখে চাপ দাঁড়িতে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে মনে হল নুরাইসার।

– আমি অনার্স ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত পড়েছি বাকিটা পড়তে পারবো বলে মনে হয় না ।যাই হোক এই গ্রামে ক্লাস টেনে পড়া মানে তুমি অবুঝ নও । আচ্ছা তোমার মায়ের যখন বিয়ে হয়েছিল তোমার মায়ের বয়স টা কেমন ছিল? তোমার মত নাকি তোমার থেকে ছোট?

– আমার থথথেকে ছোট ছিল, পড়াশোনা করে নাই আম্মা ক্লাস থ্রী পর্যন্ত পড়ে আর পড়তে পারে নাই।

– কত অল্প বয়সে বিয়ে করে কত কষ্ট সহ্য করেছে তোমার বাবার সংসারে তাই না?

– হ অনেক কষ্ট করে আম্মা । কাঁথা সেলাই করতো রাত জাইগা। দিনের বেলায় ছুটা কাজ করতো। বাবাও অনেক কষ্ট করে। অনেক কষ্ট করে আমাদের সংসার চালায় তো আমার আম্মা আর বাবা।

– তুমি পারবেনা তোমার মায়ের মত কষ্ট করে সংসার করতে? তবে তোমার মায়ের মত ছুটা কাজ করতে হবে না। রাত জেগে ও কাঁথা সেলাই করতে হবে না। শুধু কষ্ট করে সংসার করতে হবে।

– মানে?

– আচ্ছা তুমি স্বপ্ন দেখো না? তোমার ও এক দিন ঘর হবে, সংসার হবে তোমার স্বামী থাকবে, সন্তান থাকবে তোমার নিজের একটা পরিবার হবে? সেখানে হাজার কষ্টের মাঝে সুখ খুঁজে নেবে। দেখো না এমন স্বপ্ন?

নুরাইসা মাথা নিচু করে নেয়। প্রতিটা মেয়ে ই স্বপ্ন দেখে তার একটা ঘর হবে সংসার হবে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাকবে। এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে ? আর তাকেই বা কেন জিজ্ঞেস করছে বুঝতে পারছে না নুরাইসা।

– তোমার সুখ দুঃখের সঙ্গী করে নেবে আমায়? তুমি কি তোমার #স্বামী হিসেবে আমাকে গ্রহণ করবে? কথা দিচ্ছি তোমাকে অসম্মান করব না কখনো ‌ সারা জীবন যত কষ্ট দুঃখ যত যাই আসুক সব সময় তোমার পাশে পাবে আমাকে।

-আল্লাহ গো ( নুরাইসার হাত অটোমেটিক তার মুখে চলে যায়) এ হতে পারে না বলেই এক ছুটে চলে যায় তার বাবার পাশে।

____
কয়েক দিনের মধ্যে নুরাইসাদের ঘরের কাজ সম্পন্ন করে রাসেল আর নুরাইসার বাবা মিলে। রাসেল কে নুরাইসার বাবা এ জমির বিষয় সব খুলে বলে , রাসেল এটা নিয়ে আর মাথা ঘামায় না। বেগমের এক জোড়া কানের দুল ছিল তা বিক্রি করে কিছু টাকা নিয়ে আসে তিন গ্ৰাম দূর থেকে নুরাইসার বাবা। নিজের গ্ৰামে কেউ তাদের সাহায্য তো দূর , কথাও বলে না। নুরাইসার বাবার ও কোন কাজ দেয় না কেউ। রাসেল দুই তিন গ্ৰাম দুরে নিজের জন্য কাজ খুঁজতে থাকে কিন্তু কোথাও কোন কাজ পায় না। এভাবে কিছু দিন চলতে থাকে। কোন কাজের সন্ধান না পেয়ে বহু দূর গ্ৰামে দালান বাড়ী তে বাড়ি নির্মাণ তৈরি কাজে তাদের সহায়তা করলে দিন শেষে কিছু টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরতো রাসেল। আশেপাশের লোকজন নুরাইসার নামে আরো বেশি কানাঘুষা শুরু করে দেয় একটা যুবতী ছেলে মেয়ে কি করে এক বাড়িতে থাকতে পারে এটা নিয়ে ও আলোচনার শেষ থাকে না। রাসেলের ও খুব খারাপ লাগে বিষয় টা নিয়ে ভাবতে, তবে নিজের জন্য নয় নুরাইসার জন্য খারাপ লাগে। রাসেল হাওলাদার সিদ্ধান্ত নেয় সে আর দেরী করবে না কাজের সন্ধান পায় বা না পায় বিয়ে টা আগে করা জরুরি। নুরাইসার বাবা কে রাসেল যখন বলে বিয়ের কথা সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।অভাব তো সারাজীবন লেগেই থাকবে তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে। রাসেল টুক টাক তিন জন মানুষের খাবার এবং একান্ত প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের ব্যাবস্তা করে নেয়। সাথে নুরাইসার বাবা ও সাহায্য করে। নুরাইসা টুক টাক রান্না শিখে নেয়। তবে রাসেলের সেদিনের বলা কথার পর থেকে আর ভুলেও রাসেলের সামনে আসে না। এই নিয়ে রাসেলের মনে কৌতুহল জন্মলেও পরক্ষণে বুঝতে পারে নুরাইসা রাসেল কে দেখলে লজ্জা পায়।

দুইদিন পর নুরাইসার বাবা সহ নুরাইসা আর রাসেল পাশের গ্রামে গঞ্জে যেয়ে ছোট কাজী অফিস থেকে বিয়ে করে নেয়‌।নুরাইসা এই বিয়েতে অমত থাকলেও বাবার কথায় রাজি হতে বাধ্য হয়ে যায় নুরাইসা।বেড়া দিয়ে ছোট করে আপাতত দুইটা ঘর তৈরি করা হয়েছিল। একটা তে নুরাইসা থাকে যা আজ থেকে রাসেল আর নুরাইসার হয়ে যায়। অন্য ঘরে নুরাইসার বাবা। এই কয়দিন তিনি বারান্দায় থাকলেও আজ থেকে তিনি অপর রুমে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় রাসেল।নুরাইসার বিয়েতে নতুন বৌ এর জন্য যা যা বরাদ্দ থাকে রাসেল তার কিছুই দিতে পারেনি তবে লাল টুকটুকে একটা সুন্দর দেখতে ওড়না আর একটা লিপিস্টিক সাথে লাল টিপ এনে দিয়েছিল।নুরাইসার বাবা সামান্য এই কয়টা জিনিস দেখেই বেজায় খুশি হন। তিনি যখন বেগম কে বিয়ে করেন তখন বেগম কে যে বেনারশি পরিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা ছিল বেগমের বড় ভাবীর । বিয়ের দিন সকালে বেগমের শরীর থেকে টান দিয়ে খুলে নিয়েছিল বেনারশি সেদিন নুরাইসার বড় মামী,নুরাইসার বাবা লজ্জায় সেদিনের পর থেকে আর শশুর বাড়ি তে যান নি। মূলত বেগমের বিয়ে টা হুট করেই হয়েছিল নুরাইসার বাবা তখন বিয়েতে রাজি ছিল না কিন্তু নুরাইসার দাদী বেগম কে দেখে তখন ই ছেলের বউ করে নিবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ছেলে কে কোনমতে বেগম দের বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল একবার যদি ছেলে এই বাড়ি থেকে বের হয় তাহলে আর এই বিয়ে করানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন নুরাইসার দাদী তাই তিনি নুরাইসার নানিকে বলেন আগে বিয়ে টা দিতে তার পর বিয়ের জন্য কেনাকাটা করবে। বিয়ে হয়ে যাবার পর হঠাৎ করে রাতে ঝড় বৃষ্টি শুরু হয় তার জন্য তারা সেদিন রাতে আর বিয়ের কেনাকাটা করতে পারে নি আর সকাল হতেই নুরাইসার মামী বেগম এর শরীর থেকে কাপড় টেনে নেয় তার এমন ব্যবহারে আর কোন দিন ও মুখো হয়নি নুরাইসার বাবা। বছরখানেক খুব ভালো কাটে নুরাইসার বাবার তবে নুরাইসা যখন পেটে একদিন নুরাইসার দাদী অসুস্থতায় ভুগে মারা গেলে অন্য ছেলেরা মিলে নুরাইসার বাবা আর মা কে সে বাড়ি থেকে বের করে দেয়।নুরাইসার বাবা অতিরিক্ত সরল মনের মানুষ ছিল যে তাকে যা বোঝায় সে তাই সত্যি ই ধরে নিতো।নুরাইসার চাচা নুরাইসার বাবা কে বলেন তার নামে কোন সম্পত্তি নেই যা ছিল তা মায়ের চিকিৎসার জন্য তা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সরল সোজা নুরাইসার বাবা হাসিমুখে তা মেনে নিয়ে বেরিয়ে আসে সেখান থেকে ‌। তার পর এই গ্ৰামে এসে কষ্ট করে তাদের সুখের সংসার গড়ে তোলে‌।

সেদিন নুরাইসার বাবা তার স্ত্রীকে পরের কাপড় পরিয়ে সেজে গুজে বিয়ে করার পরিণাম সে জানতে পারে পরের দিন সকালে,আজ জামাই তার সামান্য কিছু নিজ টাকাই মেয়ের জন্য যা এনেছে তাতেই খুশি। কেউ অন্তত মেয়ের শরীর থেকে কাপড় তো আর খুলতে পারবে না।নুরাইসা একরাশ ভয় জড়তা নিয়ে বসে থাকে ঘরের জমিনে। খেজুর পাতায় বোনা পাটি বিছিয়ে তার উপর একটা নতুন চাদর বেছানো মাথার কাছে রাখা একটি বালিশ। এই ঘরে নেই কোন ফুলের গন্ধ আর নেই কোন সজ্জা। তবে তাদের সামনে একটা ল্যাম্পো আছে যা নিভু নিভু করছে…

#চলবে…