স্বামী পর্ব-০৫

0
169

#স্বামী
পর্ব : ০৫
#মেঘা_মেহেরাব

রাসেল হাওলাদার এর জানা মতে এত মানুষের সুষ্ঠু বিচার করা বিচারক তার পিতা কেন একটা অসহায় মেয়ের প্রতি অবিচার করছে? কেন মেয়েটার কষ্ট বুঝতে চাইছে না? কেন মেয়েটাকে গ্রাম ছাড়তে বলছে? তার নিজেরও তো দুইটা মেয়ে আছে নিজের মেয়ের বেলায় যদি এমনটা হত তাহলে কি সে এই অবিচার মেনে নিতে পারতো? তবুও সে এই অবিচার করছে, গ্রামের মানুষের মনে এই অসহায় মেয়েটার বিরুদ্ধে বিষ ঢেলে দিচ্ছে কিন্তু কেন? কেন কেন কেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর চাই রাসেল হাওলাদার এর।

– আচ্ছা বাবা, আজ যদি আপা থাকতো ঐ অসহায় মেয়েটার জায়গায় ? তখন ও কি আপনি এমনই বিচার করতেন? যদি এই একই বিচারটা আপনার মেয়ের জন্য বরাদ্দ করে থাকেন তাহলে আমি এই বিচারটা হাসিমুখে মাথা পেতে নিব ।

– তুমি এই দুশ্চরিত্রা মেয়ের জন্য বড্ড বেশি ই কথা বলছো রাসেল? ভুলে যেও না তুমি কোথায় আর কার সামনে আর কাকে কি বলছো…

– না বাবা আমি ভুলে যাইনি, ভুলে যায়নি আমি কোন কিছু, আমি সুস্থ মস্তিষ্কে জেনেশুনে এক অসহায় মেয়ের বাড়িতে দাঁড়িয়ে গ্রামের সুষ্ঠু বিচারক যাকে সবাই মাতব্বর সাহেব হিসেবে সম্মান করে শ্রদ্ধা করে আমি তার সঙ্গে কথা বলছি , সম্পর্কে তিনি আমার বাবা হন।

– রাসেএএল..( জোরে শাসিয়ে বলল মাতব্বর সাহেব) নিজের বাবার সামনে দাঁড়িয়ে এই ভাবে বাবার বিরুদ্ধে কথা বলছো এই জন্যই কি তোমাকে পড়াশোনা করতে সেই শহরে পাঠিয়েছে আমি? এই শিক্ষা শিখেছো তুমি ?

– না বাবা আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।আমি আজ সুষ্ঠু শিক্ষা গ্ৰহন করেছি বলেই আপনার এমন অবিচার এর প্রতিবাদ করছি। যেই বাবা আমার আদর্শ ছিল যে বাবা আমার গর্ব ছিল গ্রামের সবাই যে বাবার নামে কানাঘুষা করলেও আমি বিশ্বাস করিনি সেই বাবাকে যদি আজ নিজের চোখের সামনে এমন অবিচার করতে দেখি কি করে তার প্রতিবাদ না করে পারি বলুন বাবা আপনি ? আর আমি বেঁচে থাকতে এমন অবিচার আমার চোখের সামনে হবে তাও আমার ই বাবা করবে এই অবিচার এটা আমি কিছুতেই মানতে পারব না। তাছাড়া শুধু আমি একা কেন আমরা কেউই এই বিচার মানি না মানবো না। কি বলেন আপনারা?

গ্রামের মানুষদের উদ্দেশ্যে বলে রাসেল। হায়! কি নিষ্ঠুর এই দুনিয়া কি নিঠুর এই দুনিয়ার নিয়ম। টাকা পয়সা ধন দৌলত এর যার অভাব নেই সে সঠিক বিচার না করে ও সুষ্ট বিচারক হয়ে যায়। আর এই অন্যায়বিচারের শিকার হয় নুরাইসার মতন অসহায় অবলা নারী আর তার বোকাসোকা সরল-সোজা বাবা আর তার পরিবার। গ্রামের সবাই রাসেল হাওলাদার কে সাপোর্ট করার বদলে সবাই মাথা নিচু করে নেই। বুঝে নেয় রাসেল হাওলাদার সে ছাড়া আর কেউ এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না।

– এই নোংরা মেয়ের নোংরামির কথা গ্রামের সবাই জানে তাই তো কেউ এই মেয়ের পক্ষ নিচ্ছে না জানিনা তোমার চোখে কি পট্টি পড়িয়েছে এই মেয়েটা, যে তুমি শুধু তার অসহায়ত্ব দেখছো।

– এই মেয়ের অসহায়ত্ব আমার চোখে পরেছে বাবা তা ছাড়া আর কিছুই নয়, বরং আপনি গ্রামের সবার চোখে পট্টি পরিয়ে রেখেছেন তাইতো আপনার ভয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। গ্রামের কেউ এই মেয়েটার পাশে না থাকলেও এই রাসেল হাওলাদার কথা দিচ্ছে এই গ্রামের সবার সামনে আমি সব সময় এই মেয়েটার পাশে থাকবো তার প্রতি অন্যায় বিচারের প্রতিবাদ করব। যদি অন্যায় টা আমার বাবা নিজে করে তবুও তার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও আমি তার প্রতিবাদ করব।

-আমার ই খেয়ে আমার ই পড়ে তুমি আমার বিরুদ্ধে কথা বলছো? তুমি আমার ছেলে ভাবতেও আমার মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে । যেই মেয়ের চরিত্র নিয়ে তার বাবা পর্যন্ত মুখ বুজে আছে তুমি তার জন্য নিজের জন্মদাতা পিতার সামনে এভাবে উঁচু গলায় কথা বলছ? ঠিক আছে, আজ থেকে ধরে নেব আমার তিনটি নয় আমার দুটি ছেলে ।

কথা টা বলেই মাতব্বর সাহেব সেই জায়গা ত্যাগ করলো। সাথে ছিল আরো দুজন তারা ও চলে যাওয়ার সময় গ্রামের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল যে যার বাড়িতে চলে যান। বেগম এর লাশ দাফন এর কাজ সম্পূর্ণ করার পর এই মেয়ে কে নিয়ে যেন তার বাবা গ্ৰাম ছেড়ে দেয়। রাসেল হাওলাদার সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল কিছু ক্ষণ। এতক্ষণ ধরে গ্রামের সবাই বাবা আর ছেলের কথা শুনছিল। মাতব্বর সাহেব চলে যাওয়ার সাথে সাথে সবাই নিজেদের ভেতর কথা শুরু হল। শোরগোল শুরু হয়ে গেল সবার মাঝে। সাথে আরো কিছু অপবাদ নতুন করে যুক্ত হলো নুরাইসার নামে যে, এই মেয়ের জন্য আজ বাপ ছেলের ভিতর ফাটল শুরু হয়েছে । এই মেয়ে এই গ্ৰামে থাকলে কেউ শান্তি তে থাকতে পারবে না। জলিল মিয়ার জন্য ই জানতে পেরেছে এই মেয়ের চরিত্র কেমন তা,নয়তো যার ভাই তিন দিন মরতে পারে না সেই মেয়ে রাতের অন্ধকারে কি করে ছিঃ ছিঃ ছিঃ ছিঃ..

নুরাইসার বাবার তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয় বুকের ভেতর তিনি আর ভাবতে পারছেন না। এখনো ছেলে মরার শোক কেটে উঠতে পারে নি চোখের সামনে সুখ দুঃখের সঙ্গী প্রাণপ্রিয় স্ত্রী পোড়া লাশ মাটিতে পড়ে রয়েছে। একমাত্র মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা উঠছে। তার মেয়ে তো এমন ছিল না তাহলে? না না গ্ৰামের সবাই মিথ্যা বলতে পারে না। কিন্তু মন যে মানতে নারাজ তার। সিদ্ধান্ত নেয় লাশ দাফন করে মেয়ে কে নিয়ে গ্ৰাম ছাড়বেন তিনি।যতই হোক মেয়েটা যে অবুঝ ভুল করেছে হয়তো।

রাসেল হাওলাদার নিজের বাসায় ফিরে আসে। তার প্রতি যতই রাগ দেখাক তার বাবা ,সে কোনভাবেই নুরাইসাকে গ্রামছাড়া হতে দিবে না।এমন অবিচার সে কিছু তেই করতে দিবে না তার বাবাকে। এতে যদি তার আর বাবার মাঝে সম্পর্কে ফাটল ধরে তবুও সে এমন অন্যায় কিছুতেই করতে দিবেনা। বাসায় ফিরতেই মাতব্বর সাহেব রাসেল হাওলাদার এর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে হুকুম করলো তার সহচর রাশেদ মিয়াকে। তার পর তিনি রাসেল কে উদ্দেশ্য করে বলল

– যে সন্তান গ্রামের সবার সামনে নিজের বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারে তেমন সন্তানকে আমি সন্তান হিসেবে মানি না। আমি ধরে নিবো আমার আরেকটি সন্তান ছিল সে মারা গেছে। এবার তুমি যেতে পারো এই বাড়ি থেকে এই বাড়িতে তোমার কোনো জায়গা নেই।

– কিন্তু বাবা আমার কথা শুনুন? আমাকে এই বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছেন বের করে দিন আমার থাকা-খাওয়ার অভাব হবে না । কিন্তু আপনি ওই অসহায় মেয়ের সাথে যে অন্যায় করছেন সেই অন্যায় আমি কিছুতেই করতে দিব না।

– বেড়িয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। মরে গেলেও তোমার ওই মুখ আমাকে আর দেখাবে না। আগামী কাল আমার সব সম্পত্তি আমার চার সন্তানের নামে করে দিব । আমি আমার সিদ্ধান্তে অটুট থাকবো। দেখি তুমি কি করে ওই অলক্ষী অপয়া দুশ্চরিত্রা মেয়ে কে এই গ্রামে রাখতে পারো..।

– ধিক্কার জানাই আমি আপনার ওই সম্পত্তির উপর যার অহংকারে আপনার চোখে কালো কাপড় পড়ে আছেন। হাত থাকলে ভাতের অভাব হয় না বাবা ।আমিও আপনার সন্তান বাবা আপনার শরীরের রক্ত আমার শরীরে বইছে ।আপনি যেমন আপনার সিদ্ধান্তে অটুট ঠিক তেমনি আমি ও আমার সিদ্ধান্তেই অটল থাকব। ওই অসহায় মেয়েকে ন্যায় বিচার দিতে গিয়ে যদি আমাকে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয় আমি সেটাই নিবো তবুও..

দুপুরের ভেতর বেগমের লাশ দাফন সম্পন্ন হয়েছে। নুরাইসা নির্বোধের মতো পুড়ে যাওয়া বাঁশের খুঁটি ধরে বসে আছে। মুখে কোন কথা নেই তার। মুখ টা শুকিয়ে একটু খানি হয়ে আছে।গ্ৰামের কোন মহিলাই আর আসেনি নুরাইসার পাশে। নুরাইসার বাবা বসে আছেন একটু পরে তিনি এই গ্ৰাম ছাড়বেন।এমন সময় রাসেল হাওলাদার আসে তার সামনে। নুরাইসার বাবার দুই হাত রাসেল হাওলাদার নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে তাকে বলে

– এই যে আমি হাওলাদার বাড়ির ছোট ছেলে, তার পরিচয় আজ শুধুই রাসেল। এই দুই হাত ছাড়া আমার বলতে আর কিছুই নেই ।এই যে আমার শরীরে যে কাপড় গুলো আছে তাও আমার টাকায় কেনা নয়।

– এসব কেন বলছো বাবা..( নুরাইসার বাবা কাদো কাদো চোখে চেয়ে রাসেল হাওলাদার কে বলল)

– এইসব বলছি এর জন্যই কারণ আমি, এই বেকার ছেলে যার আজ থেকে ঠিকানা হয়তো কোন গাছতলায় হবে। দুই হাতে পরিশ্রম করে নিজের পেটের ভাত জোগাড় করতে হবে । যার কোন পরিবার নেই। হয়তো ঠিক মতো কারোর মুখে তিন বার খাবার তুলে দিতে হিমশিম খেয়ে যাবো সেই আমি আপনার মেয়ে নুরাইসা কে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি কি আপনার ঐ অবুঝ মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিবেন?কথা দিচ্ছি পৃথিবীর সব কিছুর অভাব থাকলেও ভালোবাসার অভাব কোনদিনও বুঝতে দিব না আমি তাকে।

– কককি বলছো বাবা তুমি এসব? তোমার বাবা জানলে..

– আমার বাবা নেই , আজ থেকে আমি তার কাছে মৃত সন্তান। আমার বলতে শুধু আমি আছি , আপনি কি আপনার অবুঝ মেয়ের জন্য আমাকে তার জন্য যোগ্য পাত্র মনে করে তার হাত টা আমার হাতে তুলে দিবেন?

– আলহামদুলিল্লাহ এতো পরম সৌভাগ্য। আমার মত এক সামান্য ..

– আপনার থেকে ও আমি আরো অতি সামান্য একটা মানুষ যার কিছু নেই দুই হাত ছাড়া।

– আল্লাহ গো.. ও আল্লাহ ! তুমি আমার এত কষ্টের মাঝে এ কি সুখ দিলা? আল্লাহ গো আমার ঐ অবুঝ মেয়ের কপালে সত্যি ই কি এমন সোনার টুকরো ছেলে দিছো তুমি আল্লাহ? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না , সত্যি আমার বিশ্বাস হচ্ছে না গো আল্লাহ তুমি আমারে দিনে দুপরে স্বপ্ন দেখাইতেছো না তো আল্লাহ?

রাসেলের মুখে হাসি ফুটে ওঠে নুরাইসার বাবা দুই হাত তুলে এমন আল্লাহর কাছে আকুতি করছে তা দেখে। চোখ ঘুরিয়ে রাসেল একবার নুরাইসার দিকে তাকায়। এই অবুঝ নির্বোধ মেয়েটা আজ বাদে কাল তার বৌ হবে। মেয়েটা এখনো তাকে দেখলে ভয় পাই, ভাবা যায় যখন জানতে পারবে তার সাথে ই সারাটা জীবন কাটাতে হবে তার তখন তার মুখোভঙ্গি কেমন হবে?

নুরাইসা তখন ও বসে আছে সেই নিষ্পলক ভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে। তার সামনে যে রাসেল হাওলাদার আর তার বাবা মিলে এতো আলোচনা করলো কিছু ই তার বোধগম্য হলো না। রাসেল সিদ্ধান্ত নেয় সে এই পোড়া বাড়িটা বাঁশ দিয়ে আবার নতুন করে গোছাবে।নুরাইসার বাবা রাসেল কে নিষেধ করে নতুন ঘর আবার না বাধতে এখানে। মাতব্বর সাহেব যখন নিজে বলেছে এই গ্রাম তাদেরকে ছাড়তে হবে তাহলে গ্ৰাম বাসীরাও তাদের এখানে থাকতে দিবে না। কারণ টা সবার জানা তা হলো এই বাড়ির জমি টা তাদের নয় রাসেলের দাদা মানে মাতব্বর সাহেবের বাবার তিনি বেঁচে থাকতে তাদের এখানে থাকার অনুমতি দিয়েছিল সেখান থেকেই তারা এখানে থাকে। মাতব্বর সাহেব ও আর দিরুক্তি করে না । বাবার কথার উপর তিনি ও কথা বলতেন না তাই বাবা মারা যাবার পর তিনি যখন প্রথম গ্ৰামের পঞ্চায়েত হিসেবে নিয়োজিত হন তখন থেকে তার ও কোন আপত্তি থাকে না নুরাইসার বাবা এখানে থাকাতে। কিন্তু এখন যখন তিনি চাইছেন না তারা এখানে থাকুক নুরাইসার বাবার ও আর জোর নেই এখানে থাকার। রাসেলের দাদা বেঁচে থাকলে বিষয় টা আলাদা ছিল।

#চলবে ..