স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০৩

0
429

#স্মৃতির_আড়ালে
#Tahmina_Akther

৩.

-ইশফাককে মনে পড়ার কারণ ওর মৃত্যু হয়েছে বলে সমাজ আমাকে বিধবা বলতে পারে। ইশফাকের মৃত্যুতে যেমন ইশফাকের হাত নেই ঠিক তেমনিভাবে আমার নিজের গায়ে বিধবা নামক যে তকমা লেগেছে সেটাতে আমার হাত নেই।

জানালার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে তুলি। নাতাশা সব কথা শুনার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

চোখের পানি মুছে জানালার কাছ থেকে সরে এসে নাতাশার পাশে এসে বসলো তুলি। নাতাশার হাতের উপর হাত রেখে তুলি বললো,

-সায়মনের কি খবর? আর তোদের রিলেশনশিপ?

সায়মনের নামটি শোনার পর নাতাশার মুখে লজ্জার আবির্ভাব হলো।মাথা নিচু করে নাতাশা উত্তরে বলে,

-আজ সায়মনের পরিবার আসবে। কিভাবে যেন সায়মন ওর পরিবারকে কনভিন্স করেছে আর আজ আমাদের বাসায় আসবে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করতে অথচ ভাইয়া আর মা জানে উনারা আমাকে দেখতে আসবে।

-সবই বুঝলাম কিন্তু শিমুল ভাইয়া বা ফুপি যদি রাজি না হয়? চিন্তিত মুখে কথাটি বললো তুলি।

-রাজি না হয়ে উপায় নেই কারণ সায়মন ছেলেটা এমন যাকে দেখলে রিজেক্ট করার কোনো কারণ নেই।

-দোয়া করি তুই সায়মনের সাথে সুখে থাক।তুই তো সেজেগুজে পার্লার থেকে এলি আর মা আমাকে এখানে কি বলে নিয়ে এসেছে জানিস? বলেছে তোর ফুপি তোকে বলেছে নাতাশাকে সাজিয়ে দিতে। এখন বল তো কেমন লাগে?

-মামি জানে তোকে কিভাবে রাজি করাতে হয়। আমাকে না হয় না সাজিয়ে দিবি কিন্তু তুই তো সাজতে পারিস?

নাতাশার কাছ থেকে এমন কথা তুলি হয়তো আশা করেনি। অবাক মিশ্রিত চাহনিতে তাকিয়ে তুলি নাতাশাকে বলে,

-আমার সাজ কার জন্য নাতাশা?যার জন্য আমার সাজ সেই তো নেই। এখন আমার রুপ কেউ দেখবে না বরং এই সাজে আমাকে কেউ দেখলে বাঁকা নজরে দেখবে৷ আমি যেভাবে আছি বেশ আছি।

-তুই ঠিক নেই তুলি। তোর বয়স কত হয়েছে?এইভাবে সাদা শাড়ি পড়ে তুই কাকে কি বোঝাতে চাইছিস? এই সমাজকে তুই বোঝাতে চাইছিস যে তুই বৈধব্য গ্রহণ করেছিস!

-আমি কাউকে কিছুই বোঝাতে চাই না। ইশফাকের নামের সাদা শাড়ি আমার কাছে আর্শীবাদ স্বরুপ। এই একটা মানুষকে যতটা সম্মান করা যায় ততটাই কম হবে। আমার শরীরের কমতি মেনে নিয়ে আমাকে তার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেই মানুষটার স্ত্রী হিসেবে আমি এক রাতের জন্য থাকতে পারিনি। সেই মানুষটার কি অপরাধ ছিল আর আমার কি অপরাধ ছিল? বলতে পারবি নাতাশা?

নাতাশা কি উত্তর দিবে জানে না তবুও তুলিকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য তুলির দু-হাত হাত ধরে বললো,

-জন্ম যেদিন হয় মৃত্যু সেদিন থেকে তাড়া দিতে থাকে। হয়তো আজ নয়তো কাল কিন্তু মৃত্যু একদিন আসবে।ইশফাক ভাইয়ার জন্য এখন দোয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারবি না। আর রইল তোর কথা তুই এতটা বড়ো হয়ে যাসনি বুঝলি। এই সাদা কাপড় পড়া বাদ দে সামনের দিকে অগ্রসর হ। এখন চল সুন্দর দেখে একটা থ্রী-পিস পড়ে নে। আমি জানি এখন তুই বলবি তাই বলছি সাজগোজের দরকার শুধু থ্রী-পিস পরে নে।

তুলি নাতাশার কথায় হার মেনে নিয়ে রাজি হলো।কারণ,আজ নাতাশার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। মেয়েটাকে বারণ করে দিলে মন খারাপ করে বসে থাকবে।

সন্ধ্যার কিছু সময় পর সায়মনের পরিবার চলে আসে।উনারা এসে তাগাদা দিচ্ছেন নাতাশাকে দেখার জন্য। তুলির ফুপি নাতাশার ঘরে গিয়ে তুলিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

-তুলি, নাতাশাকে নিয়ে আয় তো। নাতাশা মাথার ঘোমটাটা আরেকটু বড়ো করে দে।কথাটি বলে আবারও তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন।

নাতাশা ওর ঘোমটা বড়ো করে দিলো তুলি এসে নাতাশার হাত ধরে নিচের ড্রইংরুমে নিয়ে যাচ্ছে।

তুলি নাতাশাকে সায়মনের মায়ের পাশে বসিয়ে দিয়ে কিচেনে চলে গেলো। এদিকে নাতাশাকে দেখে সায়মনের বাবা-মা, ভাইয়ের বৌ পছন্দ করে। উনারা বিয়ের পাকা কথা বলতেই নাতাশার বাবা জানায়,

-মাশাআল্লাহ ছেলে আমাদের পছন্দ হয়েছে।কারণ,সায়মন ব্যক্তিগত ভাবে আমার পরিচিত। বিয়ের পাকা কথা যেহেতু আজই বলতে চাইছেন তাহলে আমি বলবো আগামী শুক্রবার বিয়ের দিন ধার্য করতে।কারণ, আমার একমাত্র ছেলে এবং নাতাশার বড়ো ভাই শিমুল পনেরোদিন পর আবারও ডিউটিতে যোগ দিতে বান্দরবান চলে যাবে।

-আলহামদুলিল্লাহ, তাহলে আগামী শুক্রবার বিয়ের দিন ধার্য করা হলো।

সায়মনের পরিবার চলে গেলো। নাতাশা ওর ঘরে গিয়ে বসে আছে। লজ্জায় নিজের বাবা-মায়ের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না। মেহমানরা চলে যাবার পর থেকে তুলি ওর মা আর ফুপির সাথে কাজে সাহায্য করছে।

কাজ শেষ হতেই সবাই একসাথে খেতে বসলো।তুলি আর নাতাশা পাশাপাশি চেয়ারে বসে খাবার খাচ্ছে।নাতাশার বাবা খাবার খেয়ে সেই কখন ঘরে চলে গিয়েছে। তুলির মা আর ফুপি আরও পরে খাবেন বলে জানিয়েছে।

নাতাশা আর তুলি রাতের খাবার শেষ করে ঘরে চলে গিয়েছে।সকালে বেশ কাজ আছে কারণ বিয়ের আর মাত্র পাঁচদিন বাকি।

রাত তখন বেশ গভীর। ব্যস্ততম শহরের মানুষেরা বুঝি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম নেই তুলির চোখে। দুচোখ বুঁজলে মনে পড়ে যায় কারো আকুতিভরা টলটলে কৃষ্ণাভ আঁখি,বেঁচে থাকার আকুলতা ছিল সেই দৃষ্টিতে। কিন্তু, উপর ওয়ালা তো অন্যকিছু ভেবে রেখেছিলেন তাই তো সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

তুলি ধীরপায়ে খাট থেকে নেমে দরজা খুলে বের হয়ে ছাঁদের উদ্দেশ্য যাওয়ার জন্য হাঁটতে লাগলো।ছাঁদে প্রবেশ করার পর চাঁদের একফালি কিরণ তুলির পুরো শরীরকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।

আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদের দেখা মিলেছে। সেই চাঁদের আলোয়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে পুরো চট্টগ্রাম শহর।তুলি হাঁটতে হাঁটতে ছাঁদের রেলিঙের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। এরপর, মাথা উঁচু করে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলছে,

-আচ্ছা,চাঁদমামা লোকে বলে তোমার গায়ে নাকি কলঙ্ক আছে। তুমি যদি আমাদের মামা হও তবে তো তুমি পুরুষ! তাহলে,কি এই পৃথিবীতে পুরুষেরও কলঙ্ক আছে? না-কি এই সমাজের মিথ্যা কল্প-কথাকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না? কি হলো উত্তর দাও?

-চাঁদমামা তোকে উত্তর দিবে কেন?সে কি তোর বেতনভুক্ত কর্মচারী?আর এত বড়ো মেয়ে হয়ে চাঁদমামার সাথে কথা বলিস লজ্জা করে না!

এতরাতে ছাঁদে পুরুষ কন্ঠ শুনে ভয়ে তুলির হাত-পা কাঁপছে। এই রাতে ছাঁদে তেনারা ছাড়া আর কে-বা কথা বলবে?

তুলি ভয়ে ভয়ে পিছনে ঘুরে তাকাতেই নিজের থেকে চার ইঞ্চি দুরত্বে একজন পুরুষের অবয়ব দেখতে পেয়ে ভয়ে যেই না তুলি চিৎকার দিতে যাবে ওমনি তুলির মুখ চেপে ধরলো শিমুল।

-আরে আমি তোর শিমুল ভাইয়া। এত রাতে তোর চিৎকার শুনলে লোকে কি ভাববে?

তুলি যখন বুঝতে পারলো ওর সামনে দাঁড়ানো পুরুষটি শিমুল তখন জোর করে নিজের মুখের উপর থেকে শিমুলের হাত সরিয়ে দিলো।শিমুলকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে ছাঁদ থেকে নেমে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় তুলি। শিমুলকে পাশ কাটিয়ে দু’কদম এগিয়ে যাবার পর তুলির হাতে টান পরে।

তুলি চোখ বন্ধ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছনে না তাকিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু পারছে না।

-আমার হাত ধরে রেখেছেন কেন?আমি যদি জানতাম আপনি ছাঁদে ছিলেন তবে আমি কখনোই ছাঁদে আসতাম না।

#চলবে