স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০৪

0
402

#স্মৃতির_আড়ালে
#Tahmina_Akther

৪.

-কেন আমি কি তোকে কখনো বলেছি যে,আমি যেখানে থাকব তুই সেখানে থাকতে পারবি না?

তুলির হাত ছেড়ে দিয়ে ছাঁদের রেলিংয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো শিমুল।

তুলি মেকি হাসি দিয়ে শিমুলকে বলে,

-এই কথাটা আমিও ভাবছি কিন্তু আজ দুপুরের ঘটনার পরও কি তোমার মনে হয় শিমুল ভাইয়া আমাদের মাঝে সেই আগের মতো স্বাভাবিক সম্পর্কটা আছে?

-দুপুরের কথা যেহেতু টানছিস তাহলে একটি কথা না বলে থাকতে পারছি না। তোকে আমি কেন যেন সহ্য করতে পারি না। কিন্তু, তোকে যে এইটুকু থেকে অনেক বড়ো হতে দেখেছি তাই তোকে চোখের সামনে দেখলে সহ্য করে নিতে হয়। আমার মস্তিষ্ক তোকে ঘৃনা করতে চায় কিন্তু আমার মন বলে তুলিকে শুধু শুধু ঘৃনা করে কি লাভ?

শিমুলের মুখ থেকে ঘৃনা শব্দটা শোনার পর তুলি যেন কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে যথেষ্ট পরিমাণে স্বাভাবিক রেখে তুলি হেটে গিয়ে শিমুলের পাশে দাঁড়িয়ে সামনের বহুতল ভবনের দিকে তাকিয়ে বলে,

-তুমি আমাকে ঘৃনা কেন করতে চাইছো?বিষয়টা কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে?আরে ঘৃনা তো তোমাকে আমার করার কথা।

তুলির অস্তিত্ব নিজের খুব কাছে উপস্থিতি টের পেয়ে শিমুল নড়েচড়ে দাঁড়ায়। এরপর, খুব মনোযোগ সহকারে তুলির কথা শুনে উত্তর দেয়ার জন্য তৈরি হয়।

-তুলি ঘৃনা শব্দটা যতটা সহজে উচ্চারণ করা যায় ঠিক ততটা কি এই ঘৃনাকে বাস্তবায়ন করা যায়?যায় না রে ঘৃনা করা যায় না। তুই আমাকে ঘৃণা করিস এটা আমি জানি এবং পরিবারের সকলেই জানে। কিন্তু, সেদিন আমার অপরাধে ইশফাকের মৃত্যু হয়নি, ট্রাস্ট মি। ইশফাক আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল। ওকে আমি কিভাবে মৃত্যুর মুখে ফেলে আসবো?

-তুমি ইশফাকের মৃত্যুর কারণ। তোমার কারণে ইশফাক ওর পরিবার, আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। কি এমন হতো যদি তুমি তোমার শরীরের একটুখানি রক্ত আমার ইশফাককে ভিক্ষা স্বরুপ দান করতে। সেদিন আমি দেখেছিলাম ইশফাকের চোখে বেঁচে থাকার আকুলতা।শুধুমাত্র, তোমার কারণে আজ আমি ইশফাকের বিধবা নামে পরিচিত। যে তুমি আমার শরীরে সামান্য ধুলো লাগতে দাওনি সেই তুমি আমার শরীরে বিধবা ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছো।এখন তোমার মুখ থেকে ঘৃনা নামক শব্দটা শোনার পর আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি,আমি তোমাকে ঘৃনা করি। কারণ, তুমি একজন খুনি।

কথাগুলো বলে একদৌঁড়ে ছাঁদ থেকে চলে যায় তুলি।

তুলির মুখ থেকে এত তিক্তবাক্য শোনার পরও শিমুলের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়নি।আকাশের চাঁদের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলছে,

-দেখলে তো চাঁদমামা তুলি আমাকে ভুল বুঝেছে।আমার দেহের একফোঁটা রক্ত অবশিষ্ট থাকলে আমি ইশফাককে দিয়ে দিতাম কিন্তু….

পুরো কথা সম্পূর্ণ না করে শিমুল ছাঁদ থেকে নেমে ওর ঘরের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

ঘরের দরজা খুলে লাইট অন করলো।এরপর কাছে গিয়ে আলমারি খুলে ড্রয়ার খুলে পেনড্রাইভ বের করে আলমারির দরজা বন্ধ করে খাটের উপরে গিয়ে বসলো।

পেইনড্রাইভ ল্যাপটপের সাথে কানেক্ট করলো।পুরোনো ফাইলে কপি করে রাখা একটি ভিডিও প্লে করে চোখ বুঁজে শুয়ে পড়লো শিমুল।

ভাবতে লাগলো সোনালী পাড়ের সাদা শাড়ি, খোঁপায় ফুল গুঁজে দেয়া কোনো এক ষোড়শী কন্যার কথা।যার গান প্রকাশ্যে শুনতে লজ্জা পাবে ভেবে দূরে দাঁড়িয়ে ভিডিও করে রেখেছিল, একাকী গান শোনার লোভে।

সোনারও পালঙ্কের ঘরে
লিখে রেখে ছিলেম দ্বারে
যাও পাখি বলো তারে
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেক, ভালো থেক
মনে রেখ এ আমারে

বুকের ভেতর নোনা ব্যাথা
চোখে আমার ঝরে কথা
এপার ওপার তোলপার একা
বুকের ভেতর নোনা ব্যাথা
চোখে আমার ঝরে কথা
এপার ওপার তোলপার একা

যাও পাখি বলো তারে
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেক, ভালো থেক
মনে রেখ এ আমারে

মেঘের ওপর আকাশ ওড়ে
নদীর ওপার পাখির বাসা
মনে বন্ধু বড়ো আশা

মেঘের ওপর আকাশ ওড়ে
নদীর ওপার পাখির বাসা
মনে বন্ধু বড়ো আশা

যাও পাখি যারে উড়ে
তারে কইয়ো আমার হয়ে
চোখ জ্বলে যায় দেখব তারে
মন চলে যায় অদূর দূরে
যাও পাখি বলো তারে
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেক, ভালো থেক
মনে রেখ এ আমারে

সোনারও পালঙ্কের ঘরে
লিখে রেখে ছিলেম দ্বারে
যাও পাখি বলো তারে
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেক, ভালো থেক
মনে রেখ এ আমারে

সকাল থেকে বাড়ির প্রত্যেকটি মানুষ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। তুলির মা এবং ফুপি রান্না করছে। নাতাশা এবং তুলি দরজা,জানালা,টেবিল,সোফার কভার পরিবর্তন করে নতুন কভার লাগিয়ে দিচ্ছে। বাকি রইলো ঘর মোছা এই সব কাজ করার জন্য টুনির মা আছে।

নাতাশার মোবাইলে কল আসার পর নাতাশা ওর ঘরে চলে যায়। তুলি একা বসে কি যেন ভাবছিল এমন সময় বাড়ির সদর দরজা দিয়ে পাঁচজন মানুষকে প্রবেশ করলো।

-কি রে বাড়ির মানুষ নাই না-কি? শিউলি? নাতাশা?

তুলি ওর দাদির কন্ঠ পেয়ে অবাক হয়ে মাথা উঁচু করে তাকাতেই দেখতে পেলো,ওর ছোট চাচা-চাচী, চাচাতো দুই ভাই এবং দাদিকে।

তুলি দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর দাদির সামনে গিয়ে বললো,

-কেমন আছো, দাদি?

তুলির দাদি হালিমা বেগম তুলিকে চোখের সামনে দেখে মুহূর্তের মাঝে চোখমুখ অন্ধকার করে বললেন,

-সকাল সকাল যাত্রা করে তোর মুখটা দেখিয়ে তো আমার সারাদিন আজ খারাপ করে দিলি,পোড়াকপালি। সর সামনে থেকে তোর মা আর ফুপি কই?

তুলি ওর দাদিকে দেখে যতটা হাসিমুখে ছিল এখন ওর দাদির মুখ থেকে এমন বাক্য শুনে হৃদয়ে যেন সহস্র আঘাতে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। চোখের পানি আড়াল করে ওর দাদির সামনে থেকে চলে গেলো ওর মায়ের কাছে।

তুলি ওর মা এবং ফুপিকে মেহমানের আসার খবর জানিয়ে দিয়ে নাতাশার ঘরে চলে যায়।তুলি দেখলে নাতাশা ওর ঘরে নেই হয়তো ছাঁদে চলে গিয়েছে সায়মনের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে। এই সুযোগে ড্রয়ার থেকে বোরকা নিকাব নিয়ে তৈরি হয়ে পার্স নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হবার পর শিমুলের মুখোমুখি হলো তুলি।

তুলি ভেবেছিল হয়তো শিমুল কিছু জিজ্ঞেস করবে কিন্তু না শিমুল কিছু জিজ্ঞেস করেনি বরং পাশ কাটিয়ে ওর রুমের দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। তুলি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দেখলো ড্রইংরুমে কেউ আছে না-কি? না কেউ নেই। এই সুযোগে তুলি সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে মেইন রোডে গিয়ে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে।খালি রিকশা পাবার পর উঠে বসলো তুলি।

-নাতাশা, তুলিকে দেখছি না যে?

শিউলি নিজের মেয়ের প্লেটে রুটি দিয়ে কথাটি জিজ্ঞেস করলেন।

-তুলি আর আমি একসাথেই তো সকাল থেকে কাজ করলাম,ছাঁদে গিয়েছে হয়তো।

-না, আমি তো একটু আগে ছাঁদ থেকে এলাম তুলি ছাঁদে নেই।তুলির মা চিন্তিত ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন।

-এত বড়ো মাইয়ার লাইগ্যা কিয়ের এতো টেনশন করো বড়ো বৌমা? তোমার মাইয়া কি দুধের শিশু?

তুলির দাদি কথাটি শেষ করা মাত্র শিমুল ডাইনিং টেবিলের কাছে উপস্থিত হলো।শিমুল ওর নানীর পাশের চেয়ারটি টেনে বসলো।

শিমুলকে দেখে উপস্থিত সবাই কথা বন্ধ করে যার যার মতো করে খাবার খাচ্ছে।শিমুল তুলির মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর মামির মুখ মেয়ের চিন্তায় এইটুকুন হয়ে আছে।

-মা আজ আমার সকালের যাত্রাটা নষ্ট হয়ে গেলো। এখন কি করা যায় বলো তো?

নাতির মুখ থেকে এহেন কথা শুনে হালিমা বেগম শিমুলের কথায় সায় দিয়ে বললেন,

-হ ভাই। আমিও সকালে তোগো বাইত পা রাহনের পর ওই পোড়াকপালির মুখটা দেখচি। তোর আর আমার আজকের যাত্রা একেবারে শেষ। বড়ো বৌমা যতদিন এই বাইত থাকবা তোমার ওই বিধবা মাইয়ারে কইবা সকাল সকাল ওর মুখ কাউরে না দেহাইতে। আর শিউলি তোরে এই জীবনেও বুঝাইতে পারুম না। তোর মাইয়ার বিয়ার শুভ কামে একটা বিধবা মাইয়ার হাত লাগাইবি?

নিজের শ্বাশুড়ির কাছ থেকে নিজের মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা শুনে অঝোর ধারায় কাঁদছেন।

-দাদি,আমি কিন্তু একবারও তুলির নাম বলিনি। আমি বলেছি তোমার কথা। কারণ, সাত সকালে ঘুম থেকে ঘুম থেকে জেগে তোমার পাশে বসে আমাকে নাশতা খেতে হচ্ছে। তুমি তো আবার তুলির মতো বিধবা। তুলি বিধবা হলো আজ দু’বছর আর তুমি পঁচিশ বছর ধরে।মা, তোমার মা’কে আর তোমার ভাইঝিকে একই ঘরে থাকতে দিবে যতদিন পর্যন্ত নাতাশার বিয়ে না হচ্ছে। নাতাশার বিয়ের কোনো জিনিসে তোমার হাত যেন না লাগে নানী।

-এই সব তুই কি কইতাছোস? অবাক হয়ে নিজের নাতির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন হালিমা বেগম।

-আমি তো এই ব্যাপারে জানতাম না কিন্তু আজ সকালে দেখলাম তুমি তুলিকে যাত্রার ব্যাপারে কথা বলছো।এখন ভেবে দেখলাম তুলি এই সমাজের যেই ক্যাটাগরির মানুষ তুমিও সেই একই ক্যাটাগরির মানুষ, নানী। বিধবা বিধবাই হয় হোক সে যুবতী হোক সে বৃদ্ধা।

কথাগুলো বলে চেয়ার ছেড়ে চলে যেতে গিয়েও থেমে গেলো শিমুল।ঘাড় ঘুরিয়ে তুলির মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

-মামি,তুলি বোরকা পড়ে একটু আগে কোথায় যেন চলে গিয়েছে?আপনি কল করে জিজ্ঞেস করে আমাকে জানান আমি গিয়ে ওকে নিয়ে আসব।

শিমুল ওর ড্রইংরুমে সোফায় বসে টেলিভিশন দেখতে বসে পড়লো।

ডাইনিং টেবিলের বসা প্রত্যকটি সদস্য হালিমা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে। হালিমা বেগম মাথা উচু করতেই সবাই ঘাড় নিচু করে খাবার খেতে লাগলো।

#চলবে