স্মৃতির আড়ালে পর্ব-০৫

0
422

#স্মৃতির_আড়ালে
#Tahmina_Akther

৫.

-আমার বাবা আব্দুল মান্নান প্রবাসে থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন।ছোট থেকে বাবার আদর না পেয়ে বড়ো হয়ে ওঠা আমি আর আমার বড়ো আপু তৃণা বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। কারন,আমাদের দুবোন এতটুকু বিশ্বাস করতাম আজ না হোক কোনো একদিন বাবা প্রবাস জীবন শেষ করে আমাদের কাছে ফিরে আসবে।
বাবার লাশ কিভাবে দেশে ফিরিয়ে আনবে এই নিয়ে আমার মা নিলুফা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে খালি হাতে বাড়িতে ফিরে আসেন।

-একমিনিট, আপনার মা কেন বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলেন? আপনার পরিবারের কেউ নেই?

-আমাদের পরিবার ছিল যতদিন আমার বাবার পরিশ্রমের টাকা উনাদের ব্যাংকে জমা হত।আমার বাবার মৃত্যুর খবর জানার পর আমার ছোট চাচার পরিবার আসেনি কারণ উনার দুই ছেলের পড়াশোনা আছে আমাদের কান্নাকাটি দেখলে ওদের মস্তিষ্কে চাপ পড়বে। এরকম কিছুর অজুহাত দেখিয়ে আমার চাচী আর উনার দুই ছেলে আসতে চায়নি। চাচা এসেছিলেন যখন উনাদের আমার প্রয়োজন ছিল না।

-আপনার বাবার লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন?

-হুম।আমার ফুপাতো ভাই পুলিশ অফিসার আলফাজ শেখ শিমুলের বন্ধু ইশফাক নওয়াজের সাহায্যে আমার বাবার লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।
বাবার মৃত্যুর দীর্ঘ একমাস পর বাবার লাশ যেদিন দেশে আসে তখন আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাই আমার বাবার লাশকে জানাযা দিতে এসেছিল।সবার সাথে আমার ছোট চাচা আসে জানাযা শেষে দাফন সম্পন্ন হবার আমার মা,বোন, আমাকে স্বান্তনার বাণী শুনিয়ে দাদীকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়।চারদিন পর আমার বড়ো আপু আর স্বামী চলে যায় বাড়িতে থেকে গেলাম আমি আর আমার মা।

-ইশফাকের সাথে লাভ ম্যারেজ নাকি এ্যারেন্জ ম্যারেজ ছিল?

-ইশফাকের সাথে আমার এ্যারেন্জ ম্যারেজ হয়। আমাদের পরিবারকে উনি সাহায্য করার কারণে আমার মা উনাকে বেশ স্নেহ করতো। বছরের অধিকাংশ সময়ে আমার ফুপাতো ভাইয়ের সাথে উনি আমাদের বাসায় আসতেন।
এইভাবে চলতে চলতে আমার এসএসসির পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার এক সপ্তাহ পর ইশফাকের পরিবার আমাদের বাড়িতে আসে আমার জন্য ইশফাকের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।সব দিক দিয়ে বিবেচনা করে আমার মা আমার কাছ থেকে সম্মতি নিয়ে ইশফাকের সাথে আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
ধুমধাম আয়োজনে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার পর বরযাত্রীবাহী গাড়ি রওনা হয় আমার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্য। কিন্তু, বরযাত্রীর গাড়ি আমার শ্বশুড়বাড়িতে পৌঁছায়নি।কারণ,রাস্তায় মালবাহী ট্রাক সামনের দিক থেকে এসে আমাদের গাড়িকে ধাক্কা দিলে, গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশের খাদে পড়ে যায়।এরপরের ঘটনা আমার জানা নেই। হুশ আসার পর নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করি। এক্সিডেন্টে আমার ডানহাত ভেঙে যায়।আমার মা আর বড়ো আপুকে আমার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে দেখেছি আমার জন্য। কিন্তু, সেদিন আমি নিজের থেকেও ইশফাকের জন্য বেশি চিন্তা হয়েছিল। ইশফাকের খবর জানতে চাইলে মা বলে, ইশফাকের মাথা ফেটে যাবার কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ হবার কারণে দুই ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু, এবি পজিটিভ ব্লাডের ডোনার কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হুট করে আমার মনে পড়ে গেলো, আমার ফুপাতো ভাই শিমুলের ব্লাড গ্রুপ এবি পজিটিভ। আমি মায়ের কাছে মোবাইল নিয়ে কল করলাম শিমুল ভাইয়ার কাছে কিন্তু উনি রিসিভ করেনি।একঘন্টা লাগাতার কল করার পরও যখন শিমুল কল রিসিভ করলো না তখন হাল ছেড়ে দিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এমন সময় আমার বড়ো আপুর স্বামী এসে আমাকে বললেন,
“তুলি, ইশফাক আমাদের সবাইকে ছেড়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় জানিয়ে চলে গিয়েছে”।
ইশফাকের বোন,ইশফাক গাড়ির ড্রাইভার কেউই বাঁচেনি, ভাগ্যের জোড়ে আমি বেঁচে আছি।
সেই ঘটনার একসপ্তাহ পর ইশফাকের বাবা মারা যায় হসপিটালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।

কথাগুলো শেষ করে সামনের টেবিলে রাখা এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে পান করলো তুলি।

-শিমুলের ব্যাপারটা কেমন খটকা লাগছে তুলি।ও তো এমন ছেলে নয় যে কারো বিপদ শুনেছে আর ও হাত গুটিয়ে বসে আছে। আজকের দিনে চাকরির বাজারে এসএসসি সার্টিফিকেটে চাকরি পাওয়া যায় না, তুলি। তবুও, আমি চেষ্টা করব। তুমি দুশ্চিন্তা করো না।

-ধন্যবাদ ম্যাম। আমি চলি।

-এসো।

তুলি বের হয়ে গেলো ওর বাংলা টিচার ফারজানা হকের ফ্লাট থেকে।রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতেই তুলির মোবাইল বেজে উঠলো। তুলি পার্স থেকে মোবাইল বের করে দেখলো ওর মা কল করেছে। তুলি রিসিভ করে ওর মা’কে বললো,

-মা, আমি একটু আমাদের বাড়িতে যাব।

-তুই এখন কোথায় আছিস?

-বিকেলে এসে বলছি।

কল কেটে দিয়ে রিকশা ডেকে উঠে বসলো তুলি।

***************

-তুলি আমাদের ফ্লাটে গিয়েছে। বিকেলে ফিরে আসবে।

শিমুল টেলিভিশনে নিউজ দেখছিল এমন সময় তুলির মায়ের কাছ থেকে কথাটি শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে রইলো।

আনুমানিক রাত ১১.০০ টা বাজে।শিমুল রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে শীতের মধ্যে। চারদিকে আজ সাজ সাজ রব।নতুন ইংরেজি বছরকে বরণ করে নেবার জন্য একেক জনের একেক পরিকল্পনা।

তুলি ঘরে বসে আছে মন খারাপ করে কারণ ওর মায়ের সাথে আজ অভিমান করে আছে। প্রত্যেক বছর ৩১শে ডিসেম্বরের রাতে ওর মা ওকে সন্ধ্যার পর ছাঁদে যেতে দেয় না।

এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলে তুলির মা উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতে শিমুল হাসিমুখে সালাম দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে বললো,

-মামি, তুলি কই?

-আর কোথায় ঘরে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এত বড়ো হয়ে গেছে তারপরও শখ মিটে না। এখন আর ছাঁদে গিয়ে ফানুস উড়ানোর বয়স আছে ওর? এটা বলেছি দেখে কান্নাকাটি করে রাতের খাবার না খেয়ে বসে আছে।

-মামী, আমি তুলিকে সাথে করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই। নাতাশা আর মা অপেক্ষা করছে তুলির জন্য।

-কিন্তু?

-মামী, নাতাশা তো কাঁদবে সাথে তুলিও কাঁদবে এটা কি দেখতে ভালো লাগবে আমাদের? তাছাড়া বছরের শুরুতে ওদের মন খারাপ করতে না দেয়াই ভালো হবে।

-আচ্ছা, নিয়ে যাও। আমি তুলিকে ডেকে নিয়ে আসছি।

তুলির মা গিয়ে তুলিকে শিমুলের কথা বলতেই তুলি খুশিতে লাফাতে লাগলো।গায়ে শাল জড়িয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে শিমুলের সামনে গিয়ে বললো,

-আমরা কি সত্যি আজ ফানুস উড়াবো?

তুলির প্রশ্নের উত্তরে শিমুল চোখের ইশারায় হ্যা জানাতেই তুলির চোখেমুখে খুশি রেখা দেখা যাচ্ছে।

-ভালোমতো নাক-মুখ ঢেকে বাইকে উঠিস।বাইরে যে ঠান্ডা পড়েছে।

-ঠিক আছে, মা।

তুলি ওর মায়ের গালে চুমু দিয়ে শিমুলের সাথে বের হয়ে যায়।

রাস্তায় দাড় করিয়ে রাখা বাইকে উঠে বসলো শিমুল, এরপর হেলমেটটা নিয়ে তুলির মাথায় পড়িয়ে দিয়ে বললো,

-নে এবার উঠে বসে পড়।

-তুমি পড়বে না?

-আমার লাগবে না।এখন বেশি কথা না বলে জলদি ওঠ। দেরি হয়ে যাচ্ছে বারোটা বাজতে আর বিশমিনিট বাকি।

শিমুল কথাটি বলে তুলির হাত ধরে বাইকের পিছনে বসিয়ে দিলো।তুলি শিমুলের কাঁধে হাত রেখে শক্ত হয়ে বসতেই শিমুল বাইক স্টার্ট করে বাড়ির পথে রওনা হলো ।

বাড়ির সামনে এসে বাইক দাড় করিয়ে তুলির হাত ধরে বাড়ির ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে চলে গেলো।তুলি আর শিমুল গিয়ে দেখলো নাতাশা আর শিমুলের বাবা-মা আগে থেকেই সবকিছু তৈরি করে রেখেছে।

নাতাশা তুলির হাত ধরে ছাঁদের এক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বারোটা বাজতে একে একে ফানুস উড়িয়ে দিলো নাতাশা আর তুলি। উড়ন্ত ফানুসের দিকে উচ্ছসিত নয়নে তাকিয়ে আছে তুলি আর নাতাশা।

ফানুস উড়ানোর শেষ করে সবাই ছাঁদ থেকে নেমে যাচ্ছে এমন সময় শিমুল তুলিকে ডাক দিয়ে বললো,

-এই তুলা শোন?

শিমুলের মুখে তুলা নাম শুনে তুলির মেজাজ বিগড়ে গেল। নাক ফুলিয়ে শিমুলের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

-আমার নাম তুলি,তুলা না শিমুল ভাই।

-তোকে তুলা নামে ডাকতে ভালো লাগে আমার।আমি যে তোর ফানুস উড়ানোর স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করলাম এর বিনিময়ে আমাকে কি দিবি?

-তোমাকে কি দিব আমি?

-তোর সাধ্যের মধ্যে চাইব, তুলা।

-বলো কি চাও?

-আজ থেকে পাঁচ বছর পর তুই আর আমি এই ছাঁদে ঠিক এইখানটায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ফানুস উড়াবো, প্রমিজ?

-ওকে,প্রমিজ। কিন্তু, শিমুল ভাইয়া তখন তোমার বিয়ে হয়ে যাবে। তোমার বৌ কি আমাকে তোমার সাথে দাঁড়িয়ে ফানুস উড়াতে দিবে?

তুলির এমন প্রশ্নে শুনে সেদিন শিমুল কিছুই বলেনি। যদি বলতো তবে আজ ওদের দিনগুলো অন্যরকম হতো।

মোবাইলের রিংটোনে কল্পনার জগত থেকে বের হয়ে এলো শিমুল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো ওর বন্ধু রুমেল কল করেছে। কল রিসিভ করে শিমুল বললো,

-অপেক্ষা কর আমি আসছি।

কল কেটে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো শিমুল।

#চলবে