স্রোতধারা পর্ব-০৩

0
362

স্রোতধারা
তৃতীয়_পর্ব
~মিহি

“তুমি তো ছেলে, তোমার উচিত ছিল আমি আসার কমপক্ষে আধঘন্টা আগে এসে বসে থাকা অথচ দেখো আমিই তোমার জন্য পঁচিশ মিনিট ধরে বসে আছি।”

ধারার কথায় মাথা চুলকাতে লাগল স্রোত। সময়মতোই বেরিয়েছিল সে কিন্তু জ্যামে পড়ে শেষে বাধ্য হয়ে হেঁটে আসতে হলো। কিয়ৎক্ষণ ভেবে একটা উত্তর প্রস্তুত করল সে।

“কী হলো? বসবে না?”

“না ভাবছিলাম, সমাজের একটা অদৃশ্য রীতি যে সবসময় ছেলেরাই মেয়েদের জন্য অপেক্ষা করে। কেন বলো তো? মেয়েরা অপেক্ষা করলে ক্ষতি কী?”

“ক্ষতি নেই। বসো। কফি অর্ডার করেছি। স্যরি তোমার পছন্দ না জেনেই অর্ডার করে ফেলেছি। এখন বলো কী বলবে, না হওয়া দেবরমশাই।”

‘না হওয়া দেবরমশাই’ কথাটা শোনামাত্র স্রোত যেন ফিউজড বাল্বের মতো নিভে গেল। এতটা রুক্ষ সম্বোধন? এত নিষ্ঠুর কেন ধারা? পৃথিবীতে যদি নিষ্ঠুর মহিলার তালিকা করা হয় তবে তার মায়ের পরের নামটা নিঃসন্দেহে ধারার হবে। চেয়ারে বসতে বসতে ধারার দিকে তাকালো সে। মেরুন রঙা সালোয়ার কামিজের উপর সাদা এপ্রোনটা কি মানিয়েছে? এপ্রোনের সাথে বাঁধা চুলগুলোর চেয়ে খোলা চুল বেশি ভালো লাগত না? স্রোতের এই আনমনা পর্যবেক্ষণ ধারার চোখেও ধরা পড়ল। ইতোঃমধ্যে কফি চলে এসেছে। একটা কাপ স্রোতের দিকে বাড়িয়ে দিল ধারা।

“সো ইউ আর ইন্টারেস্টেড ইন মি?”

ধারার কথায় বিষম খেল স্রোত। মাত্র কফি মুখে দিয়েছিল। এত সোজাসাপ্টা প্রশ্নে অনেকটা ভিমড়ি খেয়েছে সে। স্রোত জানত মেয়েরা ঢঙ করে, প্রচুর ন্যাকা হয়। এদের পেছনে বছর বছর ঘুরে কলিজা কেটে রান্না করে খাওয়ালেও স্বীকার করবে না যে এরা বুঝতে পেরেছে তুমি তাকে ভালোবাসো। বরং প্রপোজ করলে বাড়তি আহ্লাদ নিয়ে বলবে,”আল্লাহ সত্যি! আমি তো বুঝতেই পারি নাই কিন্তু আমি তো তোমাকে জাস্ট ফ্রেন্ড ভাবি।”

“চুপ করে না থেকে কফিটা শেষ করতে পারো। আইটেমের প্রশ্ন করিনি যে স্ট্যাচু হয়ে গেছো!”

ধারার কথায় ভাবনার জগত থেকে বের হয় স্রোত। নিজের এই অহেতূক ভাবনার জন্য নিজেকে মনে মনে গালি দিয়ে বসে। অতঃপর ধারার দিকে লক্ষ করে। বেশ শান্ত, ধৈর্যশীল একটা মেয়ে। কী অবলীলায় একটা জটিল প্রশ্ন করে দিব্যি উত্তেজনাহীন ভাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছে!

“ধারা, আসলে একটা কথা ব …বলতে চা..চা..”

“তোতলাচ্ছো কেন? আমি তো সরাসরি জিজ্ঞাসা করেছি তুমি আমার প্রতি ইন্টারেস্টেড কিনা।”

“মানে আসলে…”

“ইয়েস অর নো…”

“অ্যাহ! তুমি তো ভাইভার প্রফেসরের থেকেও কড়া।”

“আর তুমি নার্ভাস এজ ইউজ্যুয়াল।”

“নার্ভাস একদিন তুমিও ছিলে। মনে আছে ক্যাম্পাসে প্রথমদিন এসেই এক সিনিয়র ছেলে তোমায় বিরক্ত করছিল? তুমি নার্ভাস ছিলে, তখন অন্য একটা ছেলে তোমায় হেল্প করলো। তুমি এতটাই নার্ভাস ছিলে যে ছেলেটাকে থ্যাংক ইউ ভাইয়া বলতে গিয়ে আংকেল বলে ডেকেছিলে?”

“ওয়েট! তুমি এসব জানো কী করে?”

“কারণ ঐ আংকেলটা আমি।”

“তুমি? আমার চেহারা মনে নেই একদম। আসলেই আমি খুব নার্ভাস ছিলাম।”

“ওকে কুল। সেদিন থেকেই তোমায় পছন্দ করি। ধীরে ধীরে পছন্দ বাড়তে বাড়তে এখন ইনফিনিটি লেভেলে চলে গেছে।”

“তুমি কি জানো তোমার মা আমাকে ইতোঃমধ্যে তোমার ভাইয়ের জন্য রিজেক্ট করে ফেলেছেন?”

“ফরচুনেটলি ইয়েস।”

“ফরচুনেটলি?”

“তো? ভাবী বানাতে দিতাম তোমায়?”

“খুবই অদ্ভুত লাগছে তোমার কথাবার্তা। স্রোত, তোমায় আমি রিজেক্ট করবো না। রিজেক্ট করার কোনো কারণও নেই কিন্তু তোমার পরিবারে কি আমাকে মেনে নেওয়া সম্ভব হবে? তার চেয়ে বড় কথা আমি সেই পরিবারেই বিয়ে করবো যে পরিবারে আমি হায়াকেও রাখতে পারবো।”

“তোমার কি মনে হয়না হায়াকে নিয়ে তুমি একটু বেশি রিয়েক্ট করো? দেখো ধারা, হায়াকে তুমি নিজের কাছে রাখলেই ওকে সুখী রাখতে পারবে? হয়তো ও এমন কাউকে ভালোবেসে ফেললো যার কোনো ভাই নেই। তুমি কি বিয়ে করবে না তখন নাকি হায়াকে বিয়ে করাবে না?”

“এত কমপ্লিকেটেড ভাবিনা আমি।”

“লাইফ ইজ নট আ সিম্পল থিং! তোমায় আমি ভালোবাসি। দুই বছর আড়াল থেকে দেখেছি, ভালোবেসেছি। আরো দশ বছর এভাবেই ভালোবাসতে পারতাম কিন্তু প্রথমবারের মতো তোমায় হারিয়ে ফেলার ভয় স্পর্শ করেছে আমায়। বাধ্য হয়েই আড়াল থেকে সামনে আসা।”

“ভিত্তিহীন জীবনে এগোনোটা ঠিক?”

“সবকিছুই তো ভিত্তিহীন। তুমি আর পাঁচ মিনিট বেঁচে থাকবে এর কোন ভিত্তি আছে? ভিত্তি দাঁড় করাতে হয়। ভেবো না তোমায় ম্যানিউপুলেট করছি, তোমায় সত্যিটা চেনাচ্ছি। তোমায় ভালোবাসি। তুমি আমার জন্য ততটাই প্রয়োজনীয় যতটা হৃদপেশির সংকোচন-প্রসারণ প্রয়োজনীয়।”

“কফির বিলটা আমি দিলাম। ট্রিট ফ্রম মি।”

ধারা হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে গেল। স্রোতের বলার কিছু রইল না। ধারা কি তাকে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেল? নাকি ভাবার সময় নিল?

__________________

টিভির রিমোটটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না ধ্রুব। এ ঘর ও ঘর খুঁজেও পেল না। এদিকে রাহাতও বাড়ি নেই। ফোন বের করে রাহাতকে কল দিল ধ্রুব।

“রিমোট কই রে?”

“কে বলছেন?”

ধ্রুব কিছুটা অবাক হলো। অপর পাশের কথা সে স্পষ্ট শুনতে পায়নি তবে কণ্ঠটা যে মহিলার তা বুঝে নিয়েছে। ধ্রুব ধরেই নিল রাহাত বোধহয় তার প্রেমিকার কাছে ফোন রেখে কোথাও গেছে। দুজনের মধ্যে ঝগড়া লাগানোর সুবর্ণ সুযোগটা মিস করতে চাইল না সে।

“জ্বী, আপনি কে বলছেন? এইটা তো আমার দুলাভাইয়ের নম্বর।”

“কী যা তা বলছেন?”

“সত্যিই বলছি। আমার একমাত্র দুলাভাইয়ের নম্বর এটা।”

“ফাজলামি করছেন আমার সাথে?”

“ফাজলামি করবো কেন? আমার একমাত্র ভাগ্নি আফসানার কসম।”

“ভাগ্নি?”

“হ্যাঁ। দুলাভাই আর আপার একমাত্র কন্যা।”

“ফোন রাখ। বাঁদর পোলা, ফোন রাখেক। আর জীবনে কল দিবিনা আর তোর দুলাভাইয়ের ভাইগিরি আমি বের করতেছি।”

ধ্রুব কল কেটে জোরে জোরে হাসা শুরু করলো। আজকে রাহাত শেষ!

_____________

“ও আল্লাহ গো! আমার সর্বনাশ হলো! এই বুড়ো বয়সে এ দিন দেখার আগে তুমি আমারে তুলে নিলা না কেন গো?”

“ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছো কেন মা?”

“আমার সর্বনাশ হলো রে হায়া। তোর বাবার আরেক বউ আছে। সেই বউয়ের ভাই আবার তোর বাবার ফোনে ফোন দিয়ে তার দুলাভাইরে চায়। তাদের আবার মেয়েও আছে! ও আল্লাহ গো!”

“কী যা তা বলছো মা? রঙ নম্বরে ফোন দিছে হয়তো।”

“কিসের রঙ নম্বর? তোর বাবার সাত বছর পুরোনো নম্বর এটা। এত বছরে তো কেউ কল দেয়নি! নম্বরের সাথে সাথে আমিও পুরান হয়ে গেছি। এজন্যই তোর বাবা এগ্লা করতেছে।”

“ও মাদার বাংলাদেশ, থামো। এত ঢঙ কোত্থেকে যে পাও! এক রঙ নম্বরের জন্য এতকিছু। দাও তো ফোন দাও। আমি কথা বলতেছি আমার বাবার শালার সাথে।”

“নে।”

শায়লা আহমেদ হায়ার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন। হায়া পরপর দুবার ট্রাই করলো। দ্বিতীয়বারে কল রিসিভ হলো।

“হ্যালো, কে আপনি? আমার বাবার নামে যা তা বলার সাহস কী করে হলো আপনার?”

“কার বাবা? এটা তো আমার দুলা…”

“মিথ্যা বললে আপনার মাথায় একশটা টব ভাঙবো! বজ্জাত লোক। সাহস কতবড়! খবরদার যদি এরকম আজেবাজে কথা আর কোনদিন বলছেন! আর কখনো যদি এই নম্বরে কল দিয়ে কোনরকম উল্টাপাল্টা প্যাঁচ লাগানোর চেষ্টা করেন, আপনার হাতদুটো কেটে মাটিতে পুঁতে দেব নাহলে আমিও হায়া আহমেদ না।”

ঠাস করে কল কেটে দিল হায়া। ধ্রুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইল। কোন জাতের মেয়ের পাল্লায় পড়েছিল সে? ইয়া মাবুদ! এমন রাক্ষুসে মেয়েগুলোর সাথেই তার সংঘর্ষ কেন হচ্ছে ইদানিং? এক মেয়ে মাথা ফাটিয়ে গেল তো আরেকজন হাত কেটে ফেলার হুমকি দিয়ে গেল! ঢোক গিলে সোফার উপর সটান হয়ে শুয়ে পড়ল সে।

চলবে…