স্রোতধারা
চতুর্থ_পর্ব
~মিহি
রঙ নম্বর কেসটা নিয়ে ধ্রুব রীতিমতো লজ্জিত। রাহাত বাড়ি আসতেই সে সবটা খুলে বলল। সব ঠিকই ছিল কিন্তু হায়া আহমেদ নামটা শোনামাত্র রাহাত বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ধ্রুব চমকে উঠলো।
“কীরে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? এ নামের কাউকে চিনিস নাকি তুই?”
“চিনবো না আবার? এলাকাবাসী ডেকে ডেকে ওর নাম চিনিয়ে দিয়েছে।”
“মানে?”
“যে তোর মাথা ফাটিয়েছে, সে-ই হায়া আহমেদ। এই এলাঈআর একমাত্র নারী ত্রাশ! ওর থেকে দূরে থাকাই মঙ্গল।”
“এটাই সেই মেয়ে? তাহলে তো ওকে এত সহজে ছাড়ছি না।”
“দেখ ভাই, ছাড়ার কথা তো বাদ দে, ওরে ধরার কথাও ভাবিস না। যে মেয়ে, দেখা যাবে সত্যি সত্যি তোর হাত কেটে কী না কী করবে।”
“আরে চুপ কর। ভীতুর ডিম।”
ধ্রুবর মাথায় শয়তানি বুদ্ধির দারুণ একটা খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। হায়াকে শায়েস্তা করার মাস্টারপ্ল্যান সাজাচ্ছে সে। সহজ একটা প্ল্যান। নম্বরটাতে কল দিলে যদি আরেকবার হায়াকে পাওয়া যায় তবেই প্ল্যানটা কার্যকর হবে। হায়ার কি ফোন আছে? ফোন থাকলে ওর নম্বরটাই ধ্রুবর দরকার।
সকালের পর থেকে স্রোতকে আর দেখেনি ধারা। ক্লাসও করেনি ছেলেটা। হঠাৎ যেন অদৃশ্য হয়ে গেল! এতদিন চোখের সামনে ছিল তবুও দেখেনি অথচ এখন নেই বলে দেখার এত আগ্রহ। এত অদ্ভুত কেন মানব বৈশিষ্ট্য? আনমনে লাইব্রেরির বইটাতে মন দিতেই ধারার পাশে একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো।
“তুমি ধারা না?”
“জ্বী।”
“তুমিই সেই মেয়ে যার জন্য স্রোত হাত কেটে মেডিকেলে ভর্তি?”
“কী যা তা বলছেন? ঘণ্টাখানেক আগেও আমি ওর সাথে বসে কফি খেয়েছি।”
“যা হওয়ার তার পরেই হয়েছে। তুমি কি একটু মেডিকেলে গিয়ে ওর সাথে দেখা করে আসতে পারবে?”
“অবশ্যই, চলুন।”
ধারা বিভ্রান্তির মাঝে পড়লো। ছেলেটা কি তাকে ভুল বুঝে এমন একটা ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ফেলল? দ্রুত বইটা রেখে মেয়েটার সাথে সাথে এগোলো সে।
আজকে প্রকৃতিটা বড্ড উদাসী। সকাল এগারোটা বেজেছে অথচ রোদের ছিটেফোঁটাও নেই দূর আকাশে। পেঁজাতুলোর মতো মেঘও ভেসে বেড়াচ্ছে না উদাসী গগণে। অদ্ভুত একটা থমথমে মুখে আকাশ তাকিয়ে আছে ভূমির দিকে। রক্তিম সূর্যটাও যেন আজ তেজশূণ্য। স্রোতের কপালে বিরক্তির ভাঁজ। হাতের ব্যান্ডেজটা ভিজে উঠেছে। এই পাগলামিটা না করলেও পারতো সে। কিন্তু ধারাকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে কিভাবে যেন এই দুঃসাহসী কাজটা হয়ে গেল। অল্প সময়েই হাতের উপর ছুরিটা বেশ প্রশস্ত দাগ কেটে ফেলল। রক্তক্ষরণটা যথাসময়ে বন্ধ করতে পেরেছিল ভাগ্যিস! ধারা কি খবর পেয়েছে? এখনো আসছেনা যে? অবশ্য স্রোতের জন্য দুশ্চিন্তায় ধারার ছুটে আসার মতো সিনেম্যাটিক দৃশ্য তো তার জীবনে আসবে না। কথাটা ভাবতে ভাবতেই দরজার দিকে তাকালো স্রোত। ধারা মাত্রই এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। নিঃশ্বাস ক্রমাগত ওঠা-নামা করছে। ধারা কি সত্যিই ছুটে এসেছে? খোঁপার কাঠি খসে পড়ে এলো চুলে সারা পিঠ ছেঁয়ে আছে। মুখে ঘামের উপস্থিতি দিব্যি স্রোতের জন্য ধারার চিন্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। স্রোত চোখ বুঁজে কল্পনা করল, এই বুঝি ধারা এসে তার গালে আলতো করে হাত রাখবে। নরম স্পর্শে স্রোতের অনুভবের রাজ্যে তোলপাড় তুলে ছাড়বে। হলো ঠিক তার বিপরীত। সজোরে থাপ্পড়ের শব্দে হতবিহ্বল স্রোত আর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা তার মেয়ে বন্ধুও। ধারার চোখে রাজ্যের রাগ!
“তুমি কি টুয়ে পড়া বাচ্চা? এরকম ইম্যাচিউর আচরণ আশা করিনি তোমার থেকে।”
“ভালোবাসলে কেউ ম্যাচিউরিটির ধার ধারেনা।”
“এসব ফলস মোটিভেশন দেয় কে? ফ্রেন্ড সার্কেলের পাগল-ছাগলে? লাইফ সিনেমা পাইছো? তুমি সুইসাইড করবা, প্রেমিকা দৌড়ে এসে ভালোবাসি বলে জড়িয়ে ধরবে?”
“তুমি এসেছো এ অবধি মিল পেলাম। জড়িয়ে ধরলে একশো ভাগ মিলে যেত।”
“তোমার পাগলামির জন্য আমি কিন্তু কমপ্লেইন করতে বাধ্য হবো।”
“অভিযোগ পত্রটা আমার মনের পোস্ট অফিসে জমা দিও প্রিয়তমা।”
“আমি খুব ক্যালকুটেড লাইফ লিড করি স্রোত। অনিশ্চিত একটা সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের জীবনটা শেষ করতে চাই না।”
“বেশ। বিয়ের প্রপোজাল দিলে তো রাজি হবে নাকি সেখানেও আপত্তি?”
“ভেবে দেখবো।”
“আচ্ছা ভাবো। তোমার সাথে আমি একমাত্র বৈবাহিক সম্পর্কেই জড়াবো। এর আগে কোনরকম অনিশ্চিত সম্পর্কের দাবি নিয়ে তোমার সামনে আসবো না।”
“ওষুধ কি নিয়েছো নাকি কাব্যিক হাওয়া খেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে?”
“যে দখিনা বাতাস লেগেছে মনে, ওষুধে আর ভালো হওয়ার উপায় নেই।”
ধারার ঠোঁটজোড়া সামান্য প্রসারিত হলো। অন্য কেউ এ ধরনের লাইন ব্যবহার করলে ধারা অকপটে ‘ফ্লার্ট’ খেতাব দিয়ে দিত কিন্তু স্রোতের বেলায় সবটা কেন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা আগে এক কাপ কফি খেয়েছিল কেবল তারা। পরিচিতিও খুব অল্প সময়ের অথচ তাকে হারানোর বিরহে ছেলেটা এরকম একটা কাণ্ড করে বসলো। স্রোতের দুর্বলতাটা একটু হলেও বুঝতে পেরেছে ধারা কিন্তু চাইলেই সে স্রোতকে হ্যাঁ বলে দিতে পারে না। পারিপার্শ্বিকতা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে।
“এই যে মহাশয়া, আপনি বরং আমার উপর একটু দয়া করুন। আমার বাড়িতে ম্যানেজ করা অবধি আমার প্রতি কৃপা দৃষ্টিটা বজায় রাখবেন।”
“তা তো রাখতেই হবে। রোগী যখন হয়েছেন আমার প্রেমে, চিকিৎসা না করে উপায় আছে?”
স্রোত সামান্য হাসলো এবার। দরজায় দাঁড়িয়ে দুজনের এ হাসাহাসি পর্ব বেশ উপভোগ করছে নিশি। স্রোত ছেলেটা ধারার জন্য কী পরিমাণ পাগল তার সবটুকুই সে জানে। আবার স্রোতের ফ্যামিলিতে প্রেমের বিয়ে এলাও না এসবও জানে। এখন স্রোত যে কিভাবে বাড়িতে ম্যানেজ করবে এটা ভাবার বিষয়।
__________________
“সৌহার্দ্য, ভাবছি হায়ার সাথেই তোর বিয়ে দিব।”
“হঠাৎ এই কথা? তুমি তো না করে দিয়েছো তাহলে এখন এসব কেন?”
“তোর যা মতলব দেখছি হয়তো বিয়েই করবি না। তার চেয়ে যখন হায়াকে পছন্দ করেছিস, ওর সাথেই বিয়ের ব্যবস্থা করি।”
“আমার একটা শর্ত আছে মা।”
“কিসের শর্ত?”
“ধারার বিয়েটা স্রোতের সাথে দিতে হবে মা।”
“জানতাম! এসব কিছু স্রোতের জন্যই করেছিস! এমনি এমনি তো আর চুল পাকেনি। বুঝেশুনেই ফাঁদ পেতেছিলাম আমি। তুই ধরা দিয়েই দিলি। এখন বল ধারার সাথে স্রোতের সম্পর্ক কী? কত বছর ধরে চলছে এ সম্পর্ক? এত বড় সাহস ওর ..”
“মা থামো, ধারার সাথে স্রোতের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি ও এখনো নিজের মনের কথা ধারাকে জানাতেই পারেনি। তার উপর তুমি মেনে নিবে না সেই ভয়ে তো আরো বলেনি।”
“ও ধারাকে ভালোবাসে?”
“দুই বছর ধরে পাগলের মতো ভালোবাসে।”
“আমার ছেলে হয়ে এ কাজটা কী করে করতে পারলো স্রোত? জবাবদিহি করতেই হবে ওকে। আর তুই যদি ভেবে থাকিস তোর ওছিলায় ওকে আমি ছেড়ে দেব তাহলে ধরে নে তোদের দুজনেরই এ বাড়িতে থাকা বন্ধ।”
সৌহার্দ্য বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। তার মা একটু বেশি রিয়েক্ট করছেন না? কেন যেন বাংলা সিনেমার শাশুড়িদের মতো কথার টোন শোনাচ্ছে। সৌহার্দ্য অবশ্য নিজের বোকামিতে কিছুটা বিব্রত হলো। তার মা এমন একটা মাইন্ড গেম খেলবেন তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। চটজলদি স্রোতের নম্বর ডায়াল করলো সে। রিং হচ্ছে কিন্তু স্রোত ফোনটা ধরছে না।
“দরকারের সময় ফোন ধরার রেকর্ড বোধহয় আমাদের বাঙালি জাতির মধ্যে নাই। এরা অদরকারে ফোন দিলে ঠিকই ধরবে, এমনকি মাঝরাতে ‘ঘুমোচ্ছেন কিনা’ জানার জন্য ফোন দিলেও ধরবে অথচ এখন দরকার, এখন ফোন ধরতে গেলে ডিহাইড্রেশন হবে? আজব পাবলিক!” রাগের মাথায় ফোনটা বিছানায় ঢিল দিয়ে ছুঁড়ল সৌহার্দ্য। আজ যে স্রোতের কপালে শনি তা তা থৈ থৈ করছে তা বুঝতে আর বাকি নেই তার।
চলবে…