স্রোতধারা পর্ব-০৫

0
308

স্রোতধারা
পঞ্চম_পর্ব
~মিহি

বাড়িতে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তেও স্রোত বুঝে উঠতে পারেনি তার জন্য কোন ঝড় অপেক্ষা করে বসে আছে। হাতের ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত নিজের ঘরে যাওয়ার চেষ্টায় ছিল সে কিন্তু তা হলো না।শাহরীন চৌধুরী স্রোত এবং সৌহার্দ্য উভয়কেই নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। সৌহার্দ্য যদিও বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরেছে কিন্তু স্রোত অজ্ঞের মতো চুপচাপ মায়ের ঘরের দিকে এগোল। শাহরীন চৌধুরীর হাতে ফটো ফ্রেম। ছবিটা তার ভাই রাশেদের। স্রোত আর সৌহার্দ্যের জন্মের এক বছর আগেই রাশেদের মৃত্যু হয়। দুই ভাইয়ের কেউই নিজের মামাকে দেখেনি। শাহরীন চৌধুরীর সাথে রাশেদের বয়সের পার্থক্য ছিল দু বছরের তবুও দুজন সমবয়সীর মতো বড় হয়েছে। রাশেদ শাহরীনকে শ্রদ্ধা করতো খুব। অল্প বয়সে ভাইকে হারিয়ে শাহরীন একেবারে বদলে যায়। মুখের কাঠিন্য বেড়ে এখন সে এক অনুভূতিশূণ্য মানবের ন্যায় আচরণ করে।

স্রোত এসে মায়ের সামনে দাঁড়ালো। পাশে সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। শাহরীন ফটো ফ্রেমটা দুজনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে তার।

“প্রেম নিয়ে এত নিষেধাজ্ঞা কেন আরোপ করতাম তোমাদের উপর আজ শোনো। আমার কথার মাঝে কোনোরূপ প্রশ্ন করবে না। কোনরকম জাজমেন্টও আমি শুনবো না। আমার কথা শেষ করার পর যা ইচ্ছা হয় করবে। বুঝেছো?”

“জ্বী মা।”

“রাশেদকে তোমরা দুজন কেউই দেখোনি কেবল জেনেছো একটা এক্সিডেন্টে তার মৃত্যু হয়েছে। আসলে কোনো এক্সিডেন্টে নয়, আমার ভাইকে মেরে ফেলা হয়েছিল। তিলে তিলে ওকে শেষ করে ফেলা হয়েছে। তখন ১৯৯৭ সাল। এস.এস.সি দিয়ে কলেজে উঠেছে রাশেদ। বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা আলাদা জগত খুলেছে সবে। আমার বাবা ছিলেন খুবই কড়া স্বভাবের। তার এক সিদ্ধান্তই শেষ। রাশেদ আর আমি ছিলাম বাবার দুই নয়নের মণি। খুব যত্নে আগলে রেখেছিলেন বাবা আমাদের কিন্তু এত সুখের মাঝে দুঃখের ঘনঘটা ঠিকই এলো।রাশেদ প্রেমে পড়লো। যেমন তেমন প্রেম নয়, মেয়েটাকে ছাড়া মারা যাবে এমন অবস্থা। মেয়েটা ছিল আমার বান্ধবী। রাশেদের দুই বছরের বড় ছিল সে। রূপসা নাম। তখনকার সময়ে প্রেম ভালোবাসা এ যুগের মত পান্তাভাত ছিল না। প্রেম শব্দটা মুখে আনতেও কলিজা কেঁপে উঠতো। সেখানে রূপসাও খিল রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। রূপসার চোখ ব্যতীত শরীরের সবকিছু বোরকায় আবৃত থাকতো। এমনকি রাস্তায় বের হলে সর্বদাই ওর সাথে একজন মাহরাম থাকতোই। আমার জন্যই রূপসা আর রাশেদের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। রূপসাকে একদিন বাড়িতে এনে আমরা গল্প করছিলাম। ইয়ার্কি করেই বলেছিলাম, তুই ছোট হলে তোকে ভাইয়ের বউ বানাতাম। আমার সামান্য কথায় রূপসা কিছুটা অন্যরকম হয়ে যায়। রাশেদ তখনো এসবের মধ্যে ছিল না তবে রূপসা রাশেদের ছবি দেখেছিল আমার ঘরে। এরপর থেকেই আমার বাড়িতে রূপসার আসা-যাওয়া বেড়ে যায়। একসময় রাশেদও খেয়াল করে বিষয়টা। রাশেদ ছোট হলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিল। রূপসার মনে রাশেদের প্রতি ক্ষীণ হলেও অনুভূতি ছিল তা সে রূপসার চোখ দেখেই বুঝে গিয়েছিল। রাশেদ নিজেকে সামলে নিয়েছিল কিন্তু দীর্ঘসময়ের জন্য তা পারেনি। আমি বোকার মতো এসব দেখেও কিছু বুঝিনি। একদিন রূপসা রাশেদের সাথে কথা বলে। প্রথম অবাক হই সেদিন। যে মেয়ে নন-মাহরামের সামনেই আসে না, সে কিনা আমার ভাইয়ের সাথে কথা বললো? বিষয়টা আমলে নেইনি আর সেটাও ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভুল। ধীরে ধীরে ওদের বন্ধুত্ব বাড়ল। কথাবার্তা, হাসাহাসি চলতো। হঠাৎ একদিন রাশেদ এসে বললো সে রূপসাকে ভালোবাসে। আমার তখন পুরো পৃথিবী থমকে যাওয়ার মতো অবস্থা। অসম্ভব একটা কথা বলে ফেলেছে রাশেদ। ওকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম অনেকভাবে কিন্তু ও নাছোড়বান্দা। রূপসাকে আমার বাড়িতে আসতে নিষেধ করে দিলাম অনেকটা রূক্ষভাবেই। রাশেদ এতে আরো উন্মাদ হয়ে উঠলো। নিজেকে শেষ করে ফেলার হুমকি দিল। সবটাই চলছিল বাবার আড়ালে। মা থাকলে হয়তো সহজেই ধরে ফেলতেন কিন্তু মা হারা ছিলাম তো! ঐ সময়টাতে রাশেদের হাতের কাটা দাগগুলো দেখলে আমার বুক কাঁপত। একটা ছেলে একটা মেয়েকে কতটা ভালোবাসলে এমন পাগলামি করতে পারে তা বোঝার সাধ্য আমার তখন ছিল না। একদিন বাবার নজরে পড়লো বিষয়টা। ব্যস! রাশেদকে ঘরবন্দি করে ফেলা হলো। রূপসার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ যেন না করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হলো। ভাইটা আমার পাগলের মতো হয়ে গেল। নাওয়া-খাওয়া সব বন্ধ করে দিনরাত খাতায় কী সব আঁকিবুঁকি আর কবিতা লিখত।”

শাহরীনের গলা ধরে এসেছে। স্রোত পানির গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল। মায়ের চোখে প্রথম অশ্রু দেখছে দুজন। বরাবরই মাকে একজন কঠোর হৃদয়ের মহিলার মতো শক্ত হাতে সংসার সামলাতে দেখা দুই ভাইয়ের কাছে এ দৃশ্যটা বেশ নতুন। শাহরীন গ্লাসের পানিটুকু শেষ করে দুই ছেলের দিকে তাকালেন। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুকণাটুকু মুছলেন।

“একদিন রূপসা আমাদের বাড়ির ল্যান্ডফোনে কল করলো। রাশেদ তখন ঘরে বন্দি। কলটা বাবা রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে রূপসার কণ্ঠস্বর শুনেই তিনি রেগে গেলেন। রাশেদ ঘরের দরজায় সমানে ধাক্কা দিতে লাগল। বাবা দরজা খুললেন ঠিকই কিন্তু রূপসার জন্য রাশেদের মনের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দিতে। বাবা রূপসার বাড়িতে গিয়ে রূপসার নামে যা তা বলে আসলেন। রূপসা রাশেদকে বিরক্ত করছে এসব বলে এলেন। রাশেদ এসব জেনে একদম পাগলপ্রায়। ওদিকে রূপসার রক্ষণশীল পরিবার। তাদের বাড়ির মেয়ে যেখানে কিনা মুখ অবধি খোলে না, সেখানে একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক করে? অবস্থা হাতের বাইরে যাওয়ার আগে রূপসার বাবা রূপসার বিয়ে ঠিক করলেন। রাশেদকে সামলানো যাচ্ছিল না তখন। বাবার পায়ে ধরে কেঁদেছিল ছেলেটা যাতে বাবা বিয়েটা আটকায় কিন্তু নাহ! রূপসার বিয়ের খবর আসার বদলে আমাদের কাছে আরেকটা খবর এলো। রূপসা গলায় দড়ি দিয়েছে। এলাকায় ছিঃ ছিঃ পড়ে গেল। রূপসার নামে যা তা বলতে লাগল সবাই। রাশেদ একেবারে চুপ হয়ে গেল। বাবার সাথে তো কথা বলতোই না, আমার সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দিল।কলেজের এক্সাম দিল না। চুল, দাঁড়ি বড় হয়ে বয়স যেন কয়েক গুণ হয়ে গেল। আমরা রাশেদকে সবসময় চোখে চোখে রাখতাম যেন ও নিজের কোন ক্ষতি করতে না পারে। দেখতে দেখতে যখন এক বছর পেরোলো তখন আমরা ভাবলাম এই বুঝি রাশেদ স্বাভাবিক হয়েছে। আর এই ভাবনাটাই আমাদের কাল হয়ে দাঁড়ালো। রূপসার মৃত্যুবার্ষিকীর রাতে রাশেদ রূপসার বাড়িতে গেল আমাদের না জানিয়ে। সবার সামনে গিয়ে রূপসার বাবাকে থাপ্পড় মারলো। এমনকি এলাকাবাসীর সামনে বারবার বলে উঠল যে রূপসার বাবাই নাকি ওকে মেরে ফেলেছে। রূপসার বাবা রেগে রাশেদকে মারতে আসলেন। সবাই অনেক কষ্টে আটকালো। ততক্ষণে আমাদের বাড়িতেও খবর এসেছে। বাবা গেলেন রাশেদকে আনতে। রাশেদ ফিরলো না। বাবা যাওয়ার আগেই ব্রিজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলো। রাশেদের জানাজায় যেন অসুবিধা না হয় তাই সবাইকে বলা হলো রাশেদ এক্সিডেন্ট করেছে। সত্যিটা জানলাম কেবল আমি আর বাবা। রূপসা আর রাশেদের মৃত্যুর জন্য আমি আজও নিজেকে দায়ী করে যাচ্ছি। পঁচিশটা বছর ধরে ওদের মৃত্যুর অপরাধবোধে আমি নুইয়ে পড়ছি ধীরে ধীরে। একটা ভালোবাসার সম্পর্ক আমার কাছ থেকে আমার সবচেয়ে কাছের দুজন মানুষকে চিরতরে ছিনিয়ে নিয়েছে। তবুও তোরা ভাবিস আমি ভুল? এসব ভালোবাসাই সবকিছু? আমি চেয়েছি তোদের সম্পর্কটা পারিবারিক সূত্রে হোক যেন কোনরকম অঘটন না হয়। আমার এই ভয় কি জায়েজ না? তোরাই উত্তর দে। তোদের এত শাসনে আমি কেন রেখেছি বুঝছিস তোরা?” কথা শেষ করতেই স্রোতের হাতের ব্যান্ডেজের দিকে নজর গেল শাহরীন চৌধুরীর।

চলবে…