স্রোতধারা পর্ব-০৬

0
316

স্রোতধারা
ষষ্ঠ_পর্ব
~মিহি

“প্রেমে এতই দিওয়ানা হয়ে গেছো যে সেই মেয়ের জন্য হাত কাটতে হলো? ঠিক এই কারণেই তোদের দুজনকে আমি সবসময় এসব থেকে দূরে রেখেছি। কিভাবে তুই এত বড় ভুল করলি স্রোত?”

“মা, বিশ্বাস করো আমার কথা। আমার আর ধারার মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি। যা হবে কেবল এবং কেবলমাত্র বিয়ের পর। এ শর্তটা ধারাই দিয়েছে আমাকে আজ। আমি ধারাকে বিয়ে করে ওর সাথে একটা বৈধ সম্পর্কের সূচনা করতে চাই মাত্র।”

“ভাবলে কী করে আমি রাজি হবো?”

“সেরকমটা ভাবিনি তবে যদি রাজি না হও, আমার কিছুই বলার থাকবে না মা।”

স্রোত খানিকটা ম্লান মুখে ঘরত্যাগ করলো। বিক্রিয়ার দর্শক আয়নের মতো মা আর ভাইয়ের কথাগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল সৌহার্দ্য। নিজের অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পারছে না সে। সে মায়ের দিকেও যেতে পারছে না আবার পুরোপুরি স্রোতের দিকেও যেতে পারছে না। মোটামুটি একটা ঝুলন্ত অবস্থায় আছে বলা যায়। সৌহার্দ্যও রুমত্যাগ করলো।

শাহরীন চৌধুরীর এ মুহূর্তে নিজেকে প্রচণ্ড একা অনুভব হচ্ছে। হ্রোতের মাঝে আজ তিনি রাশেদকে দেখতে পেয়েছেন। মনটা একরাশ শুন্যতায় ছেঁয়ে আছে। ফোনটা তুলে সায়ান চৌধুরীর নম্বর ডায়াল করলো সে।

অফিসের কাজের চাপে বেশ বিরক্ত সায়ান চৌধুরী। সৌহার্দ্যটাও আজ আসেনি অফিসে। দুটো মিটিং শেষ করে মাত্র চেয়ারে হেলান দিতেই ফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্ত হয়ে স্ক্রিণে তাকাতেই লক্ষ করলেন ‘বউ’ লেখাটি। সযত্নে নম্বরটা সেভ করেছিলেন তিনি কিন্তু বউ তার দরকার ছাড়া কল দেয় না। এত বছরের সংসারে শাহরীন চৌধুরী যতবার কল দিয়েছেন মনে হয়েছে বসের ফোন এসেছে। হালকা হাসলেন সায়ান চৌধুরী। এ অনুভূতিগুলো এ বয়সে এসেও কেন যেন জীবন্ত, রক্তজবার মতো জীবন্ত। ফোন ধরে কানে ধরলেন তিনি।

“তুমি এক্ষুণি বাসায় এসো সায়ান।”

“এত জরুরি তলব? কিছু হয়েছে নাকি?”

“আমার ঠিক লাগছে না। তুমি আসো।”

“অসুস্থ নাকি তুমি? প্রেশার বেড়েছে? আমি আসতেছি। তুমি সৌহার্দ্যকে বলো ডাক্তার ডাকতে।”

“বেশি বোঝো সবকিছু। আসতে বলছি আসো।”

ঠাস করে কল কাটলেন শাহরীন চৌধুরী। অবাক হয়ে বসে রইলেন সায়ান। কল করে এভাবে কখনো কথা বলেনি শাহরীন। আজ হঠাৎ কি এমন হলো? অফিসের কাজ এসিস্ট্যান্টকে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন।

_____________________________

“সাহস তো কম না! আপনি আবার আমার বাবার নম্বরে কল দিয়েছেন?”

“মিস.হায়া আহমেদ, আপনার সাথে আমি দেখা করতে চাই।”

“আপনি কি সত্যিই চাচ্ছেন নিজের হাড়গোড়ের ট্যালকম পাউডার বানাইতে? আসেন খেলা হবে।”

“ফাজলামি রাখো মেয়ে। আমি ধ্রুব, গতকাল আমার মাথায় টব ছুঁড়েছো, এটার কমপ্লেইন করবো তোমার বাড়িতে?”

“আ…আরে ভাইয়া আপনি!”

“এইতো লাইনে আসছো বাবুই পাখি। বিকেল চারটায় ছাদে এসে দাঁড়াবা। বুঝতে পেরেছো?”

“আমার সাথে কিসের দরকার আপনার?”

“সেটা আসলেই বুঝবা। রাখি। টা টা।”

হায়া আর কিছু বলার আগেই ধ্রুব কল কেটে দিল। বিরক্ত হয়ে বাবার ফোনটা রেখে দিল সে। বাবা যে কেন আজ ফোনটা ফেলে গেলেন সে দুঃখে আফসোসও করল। অতঃপর ধ্রুবর পরিকল্পনা বোঝার ব্যর্থ চেষ্টায় মনোনিবেশ করলো।

ধারা বাড়িতে ঢুকেই নিজের ঘরে গেল। অন্যান্য দিন বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর বিছানায় বসে কিন্তু আজ সরাসরি ঘরে ঢুকেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল। চোখ জ্বালা করছে খুব। স্রোতের পাগলামিতে মাথাও ব্যথা করছে খানিকটা। ছেলেটা হুট করে এরকম পাগলামি করে বসবে ভাবেনি ধারা।

“আপা, একটু আসি?”

হায়ার ডাকে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো ধারা। চুলগুলো হাতখোঁপা করতে করতে হায়াকে আসতে বললো।

“আয়। একটু না পুরোটাই আয়।”

“আচ্ছা আপা, আমার নামে কোনো কমপ্লেইন আসলে মা আমাকে সত্যিই দাদীর কাছে পাঠিয়ে দিবে?”

“মাকে তো চিনিস। একবার যখন বলছে তখন পাঠাবেই পাঠাবে। তুই বরং ভদ্র মেয়ে হয়ে যা। পড়াশোনাতে মন দে। চতুর্থবারের মতো চিরঅভিজ্ঞ ম্যাট্রিকটা দে। পাশ-ফেল তো আল্লাহর হাতে।”

“তুমিও এভাবে বলছো আপু?

“আরে! পাগলী বোন আমার। বইটা তো খুলে দেখিস না। তোকে একটা প্রাইভেট দিব ভাবছি। দেখি আমি খোঁজ নিই।”

“না না দরকার নাই। ধূর! আমি কেন আসলাম তোমার কাছে!”

“আসছিস যখন, এক কাপ চা করে দে তো।”

“আচ্ছা তুমি বসো। আমি এক্ষুণি বানিয়ে আনছি।”

হায়া লাফাতে লাফাতে চা করতে গেল। মেয়েটাকে কোনো কিছু রান্না করতে বললে ওর আর খুশি ধরে না। পড়তে বললে মুখ যেমন কালো হয়, রাঁধতে বললে মুখের ঔজ্জ্বল্য কয়েকগুণ যেন বেড়ে যায়।

ধারার মাথাব্যথা কিছুতেই কমল না। হায়ার হাতের চা খেয়েও মাথা ধরে বিছানায় পড়ে রইল সে। স্রোতের উপর বড্ড বিরক্ত ধারা। এই ছেলেটা আসার আগ অবধি সব কী সুন্দর গোছালো ছিল। ছেলেটা আসার পরই সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেল। ধারার সাজানো জীবন নামক নদীটাতে স্রোতের আগমন কী যে তুলকালাম বাঁধাতে চলেছিল তাও জানে না ধারা।

সাড়ে তিনটা বাজার পর থেকেই হায়ার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে। ধ্রুবকে প্রথম দেখেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। মুগ্ধতায় হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিল। এখন কিনা সেই সুদর্শন পুরুষের সাথেই সাক্ষাতে হাত কাঁপছে তার? ধ্রুব কি তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ডাকছে? কোনো কঠিন শাস্তি দিবে না তো? ভাবতে ভাবতেই ঘড়ির কাঁটা চারের ঘরে গেল। হায়া ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিবে এমন সময় আয়নায় চোখ পড়ল। কী ভেবে যেন মুখটা ধুয়ে চোখে কাজল দিল হায়া। আয়নায় হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুখের ম্লানভাবটা ফুটে উঠল বেশ কঠোরভাবেই। অতঃপর কিছু না ভেবে দ্রুত পায়ে সিঁড়ির দিকে এগোলো।

ধ্রুব মাত্র সিগারেট ধরিয়েছে। হায়াকে আসতে দেখে সিগারেটটা দ্রুত ফেলে দিল। দুই বিল্ডিংয়ের ছাদ অনেকটা কাছাকাছি হওয়াতে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে কথাবার্তা বলা সহজ। হায়া এসে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো। ধ্রুবর দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে হায়ার। এ অনুভূতির সাথে সে পরিচিত নয়। কেন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে তার।

“তো মিস.হায়া আহমেদ, আপনি কোন আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্যাংয়ের সাথে জড়িত?”

“মানে?”

“সবসময় মাথা ফাটানোর হুমকি দেন যে।”

“আপনি যে আমার বাবার নামে যা তা বললেন, সেটা কিছু না?”

“আমি ভেবেছিলাম আমার বন্ধুর নম্বর। যাই হোক, আপনাকে না স্যরি তোমাকে…হাঁটুর বয়সী মেয়েকে আপনি বলবো কেন!”

“এই যে মিস্টার, এসব আজেবাজে কথা রেখে দরকারের কথা বলেন।”

“বেশ। স্যরি বলো আগে তারপর কান ধরে চোখ বন্ধ করে দশবার উঠ-বস করবা।”

“কী? আপনার সাহস তো কম না! হায়া আহমেদকে কান ধরে উঠবস করতে বলার আপনি কে?”

“তুমি তাহলে চাচ্ছো কমপ্লেইন যাক তোমার বাড়িতে?”

“কেন করছেন আপনি আমার সাথে এরকম? কী ক্ষতি করছি আমি? আমি তো সেদিন নিশীথকে মারার জন্য টবটা ছুঁড়েছিলাম। আপনিই তো তালগাছের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়লেন।”

“তুমি তাহলে স্যরি বলবে না?”

“আই অ্যাম স্যরি কিন্তু কান ধরে উঠসব করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

“বেশ তাহলে আমি যাচ্ছি তোমার বাড়িতে কমপ্লেইন করতে।”

“আরে নাহ..দাঁড়ান।”

হায়া আশেপাশে তাকিয়ে মনে মনে ধ্রুবকে গালি দিতে দিতে কান ধরলো। চোখ বন্ধ করে একটানা দশবার উঠবস করে থামলো। ধ্রুব মুচকি মুচকি হাসছে। প্ল্যানটা এত সহজে কাজ করবে ভুলেও ভাবেনি সে। এলাকার ত্রাশ, লেডি ডন এখন এই ধ্রুব রায়হানের হাতের মুঠোয়। এখন থেকে ধ্রুবর তালে নাচতে বাধ্য হায়া। কথাটা ভেবেই এলোমেলো চুলে হাত চালিয়ে নিল একবার। অতঃপর ফোনে রেকর্ড করা ভিডিওটা হায়ার সামনে ধরলো। নিজের এ হেন বোকামি দেখে হায়ার নিজেরও রাগ লাগছে। ধ্রুব শয়তানি হাসি দিতেই হায়ার মনে গান বেজে উঠলো, “আমি ফাঁইসা গেছি..ফাঁইসা গেছি..মাইনকার চিপায়।”

চলবে…