স্রোতধারা পর্ব-০৭

0
320

স্রোতধারা
সপ্তম_পর্ব
~মিহি

হায়ার কিশোরী মনে ধ্রুবর আগমনটা হলো নাটকীয়ভাবে। হায়াকে এভাবে ফাঁসাবে ধ্রুব তা হায়া কল্পনাও করেনি। এখন আবার কী উল্টাপাল্টা কাজ করাবে হায়াকে দিয়ে আল্লাহ ভালো জানেন। হায়া ঘরে বসে নখ কামড়াচ্ছে। হায়াকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ধারা বেশ চমকাল। যে মেয়ে এক ক্ষণের জন্যও চুপ হয়ে বসে থাকে না, সে কিনা এমন চুপ হয়ে আছে!

“এত চুপচাপ কেন তুই হায়া? কিছু হয়েছে?”

“ন..না আপু। পরীক্ষার চিন্তা করছি।”

“শরীর-টরীর ঠিক আছে তোর? যে মেয়ে পরীক্ষার আগের রাতেও পরীক্ষার টেনশন করে না, সে কিনা পরীক্ষার চার মাস আগে থেকে পরীক্ষার চিন্তা করছে? চিমটি কাট তো আমাকে।”

“আহ আপা! যাও তো তুমি। ধূর, মেজাজটাই খারাপ করে দিলা।”

ধারাকে যেতে বলে হায়া নিজেই বই নিয়ে বেরিয়ে গেল। ধারা পেছন থেকে হালকা হাসলো। হায়া বই নিয়ে বারান্দায় এসে দরজা লাগিয়ে দিল ভেতর থেকে। হাতের দিকে লক্ষ করতেই দেখে মোটা একটা নীল রঙের বই। বইয়ের কভারে একটা ছেলে হুইল চেয়ারে বসে। হায়া নাক মুখ কুঁচকে বলল,”নির্ঘাত পড়তে পড়তে পঙ্গু হয়ে গেছে।” কিছুক্ষণ বই এপাশ ওপাশ করে ভাবলো, নিয়ে যখন এসেছিই, বরং পড়িই একটু। প্রথম অধ্যায়ের সাল আর বিজ্ঞানীর সংখ্যা দেখেই মাথা ঘুরে উঠলো তার। রাগে গজগজ করতে করতে থেলিস, আর্কিমিডিস আর আইনস্টাইনের বংশ উদ্ধারে লেগে পড়লো।

______________

শাহরীন কিছু বলছেন না। সায়ান কেবল তার মলিন মুখ দেখে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। নাহ! কিছুই বলা যাচ্ছে না। ঘটনা না বুঝে উল্টাপাল্টা বলে ফেললে আরো ঝামেলায় পড়তে হবে।

“শাহরীন, কী হয়েছে বলো তো। হুট করে ডাকলে এখন আবার চুপ হয়ে বসে আছো। আমাকে না বললে আমি বুঝবো কী করে?”

“তোমরা আমাকে খুব কঠিন হৃদয়ের ভাবো, তাই না?”

“তা তো তুমি কঠিন..না মানে একদমই না। কে বলেছে এসব? এসব আজগুবি কথায় তুমি এমন মন খারাপ করে বসে আছো?”

“স্রোত একটা মেয়েকে ভালোবাসে। মেয়েটার জন্য আজ ও নিজের হাত কেটেছে।”

“কী বলছো কী? স্রোত কোথায়? ঠিক আছে তো?”

“এরপরও তোমার মনে হয় প্রেমের বিয়ে মেনে নেওয়া যৌক্তিক?”

“রাশেদের কথা ভাবছো বুঝেছি কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখো, তোমার বাবা কিংবা রূপসার পরিবার যদি ওদের সম্পর্ক মেনে নিত তাহলে কি ওদের প্রাণ হারাতে হতো? তুমি ঐ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছো প্রেম থেকে নিজেকে এবং সন্তানদের দূরে রাখার কিন্তু ভুলবশত হলেও স্রোত একজনের প্রেমে পড়েছে। এখন যদি তুমিও নিজের বাবার মতো আচরণ করো তবে স্রোতের পরিণতিও রাশেদের মতো হতেই পারে।”

“সায়ান!”

“চেঁচিও না শাহরীন। বাস্তবতা যা তাই বলেছি। নিজেকে একবার স্রোত, রাশেদ কিংবা রূপসার জায়গায় বসিয়ে দেখো। স্রোত চাইলেই পারতো কথাগুলো তোমার থেকে লুকোতে কিন্তু ও তো বলেছে তোমায়। তাছাড়া তোমার উচিত স্রোত যখন মেয়েটাকে বিয়ে করতে চায় তখন বিয়েতে মত দেওয়া।”

“স্রোত ধারাকে ভালোবাসে। যাকে বড় ছেলের জন্য প্রত্যাখ্যান করেছি, সে কি আমার ছোট ছেলের বউ হতে আদৌ রাজি হবে?”

“সেটা নাহয় তুমি ধারার উপরেই ছেড়ে দাও। ধারা যদি সত্যিই তোমার ছেলেকে ভালোবেসে থাকে তবে নিশ্চয়ই রাজি হবে।”

“এই সমাধানটা আমার মাথায় কেন আসলো না?”

“কারণ তোমার সমস্যা সমাধানের জন্য তোমার স্বামী আছে।”

কথাটা শুনে শাহরীন মুচকি হাসলেন। সায়ান সেদিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলেন। ‘এ জীবন বোধহয় পূর্ণতা পেয়েছিল তাহার আগমনেই আর আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তার সেবাতেই আমি নিয়োজিত।’ কথাটা মনে মনে বললেন তিনি।

শাহরীন চৌধুরী ঠিক করেছেন তিনি আগেই স্রোতকে কিছু জানাবেন না। যদি সবটা ঠিকঠাক মতো এগোয় তবে স্রোতকে সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে। এ কাজে সৌহার্দ্যের সাহায্য নেওয়া যায়। সৌহার্দ্যের ঘরের দিকে এগোলেন তিনি।

____________

টি স্টলের সামনে এসে মাত্র দাঁড়িয়েছে ধ্রুব। অকস্মাৎ একটা রোগা লোককে ধরে সবাই মারতে লাগল। ধ্রুব বিষয়টা দেখার জন্য ভীড়ের দিকে এগোলো। শুকনো পাঠকাঠির মতো একটা লোককে সবাই যারপরনাই মেরে চলেছে। লোকটাকে সবার থেকে বাঁচিয়ে সাইডে আনলো ধ্রুব। আশেপাশের লোকগুলো ধ্রুবকে নিষেধ করতে লাগল।

“কী হয়েছে ভাই? এভাবে মারছেন কেন লোকটাকে?”

“আর বলেন না ভাই, বাচ্চার জন্য এক প্যাকেট পাউরুটি নিয়ে যাচ্ছিলাম। কোত্থেকে এসে প্যাকেট নিয়ে দৌড়! ভাবেন কী রকম চোর, খাবারের প্যাকেট নিয়ে দৌড় দেয়!”

“আসলেই তো। কী রকম মানুষ হলে আপনারা একজন ক্ষুধার্ত মানুষের অসহায়ত্বকে নিয়ে মজা ওড়াচ্ছেন? লোকটার দিকে তাকালেও তো মায়া হওয়ার কথা। আপনাদের মায়া-মমতা দেখি ঘুণে খেয়ে ফেলেছে।”

“বেশি হিরোগিরি দেখাইতে আসিও না। নিজের টাকায় পরকে খাওয়াতে কেন যাবো?”

“নিজের টাকায় আপনারা পরকে খাওয়াতে পারেন না কিন্তু নিজের সময় নষ্ট করে একজন মানুষকে রাস্তায় মারতে আপনাদের বিবেকে বাঁধে না।”

ধ্রুব পাউরুটির প্যাকেট লোকটার হাতে দিয়ে রোগা লোকটাকে নিয়ে স্টলে আসলো। স্টল থেকে বেশ কয়েকটা বিস্কিটের প্যাকেট কিনে লোকটার হাতে দিল। অসহায় দৃষ্টিতে লোকটা কেবল তাকিয়ে রইল।

“এভাবে তাকিয়ে আমায় লজ্জায় ফেলবেন না ভাই। ক্ষুধার যন্ত্রণা বোঝানোর জন্য আল্লাহ পাক সাওম ফরজ করেছেন অথচ মানুষ অবোধের মতো শুধু একটা মাসেই আল্লাহর ইবাদত করে। তা যাই হোক, আপনি থাকেন কোথায়?”

“রেললাইনের বস্তিতে থাকি ভাই।”

“আমার কাছে কিছু টাকা আছে। এটা রাখেন, একমাসের খাবার-দাবার কিনে নিবেন আর একমাস পর আমার সাথে দেখা করবেন। সামনের বিল্ডিংয়ের চারশো নয় নম্বর ফ্ল্যাটে আমি থাকি।”

“আচ্ছা ভাইজান।”

লোকটা চলে যেতেই সামনে চোখ পড়ল ধ্রুবর। এতক্ষণ একজন ভদ্রলোক তার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। লোকটা চলে যেতেই তিনি এগিয়ে এলেন ধ্রুবর দিকে। লোকটা হাত বাড়ালেন হ্যান্ডশেকের জন্য। ধ্রুব হ্যান্ডশেক করলো।

“তোমার কাজটা দেখলাম। ভালো লাগল। তোমার মতো মানুষ এখনকার সমাজে খুব দরকার। তুমি কী করো?”

“আঙ্কেল আমি পড়াশোনা করছি, একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছি।”

“এখানে তো আগে দেখিনি তোমায়।”

“আমি একমাসের জন্য এসেছি আঙ্কেল।”

“ওহ বেশ। তুমি তো কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছো, টিউশনি করাও?”

“না আঙ্কেল।”

“কথাটা বলা উচিত কিনা ভাবছি তবে আমার মেয়েকে একটু কেমিস্ট্রি পড়াতে পারবে? তোমার ব্যবহার আমার বেশ ভালো লেগেছে।”

“সমস্যা নেই আঙ্কেল তবে একমাসের বেশি বোধহয় সম্ভব না।”

“তুমি একমাসই পড়িও।”

“আচ্ছা আঙ্কেল।”

“আমি তোমার সামনের বিল্ডিংয়ের চারশো তিন নম্বর ফ্ল্যাটে থাকি। কাল তো শুক্রবার। তুমি সকালে এসো। আমি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।”

“আচ্ছা আঙ্কেল, আসসালামু আলাইকুম।”

সালামের জবাব দিয়ে ভদ্রলোক চলে গেলেন। টিউশনির ব্যাপারটা ধ্রুবর মাথায় আটকালো। এই বুদ্ধিটা এতদিন কেন আসেনি তার মাথায়? বাবার কারণে সে হয়তো জবের জন্য এপ্লাই করতে পারছে না কিন্তু টিউশনি? এখানে তো বাবার হাত নেই। টিউশনি করিয়ে তো ধ্রুব নিজের খরচটা চালাতে পারে। তখন আর বাবার পর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে না। লোকটাকে মনে মনে অসংখ্যবার ধন্যবাদ দিল ধ্রুব। অবশেষে সে নিজের বাবার মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো একটা অবস্থা তৈরি করার পথে পা বাড়িয়েছে। এখন আর বাড়ি ফেরা নয়, নতুন করে গন্তব্য খুঁজতে হবে। তার আগে ফ্ল্যাটে ফিরে রাহাতের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কাল যেহেতু ছাত্রীর বাসায় যেতে হবে, স্যালারির ব্যপারটাও ভেবে রাখতে হবে। তাছাড়া সবকিছুই মার্জিত ও পরিপাটি রাখতে হবে। টিউশনি হোক বা লাইফের যেকোন ইন্টারভিউ, ‘ফার্স্ট ইমপ্রেশ ইজ দ্য লাস্ট ইমপ্রেশন।’ ফ্ল্যাটে ঢুকতেই সামনের দৃশ্যে ভ্রু কুঁচকাল ধ্রুব। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটাকে মোটেও প্রত্যাশা করেনি সে।

চলবে…